#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-৩৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সকাল দশটা। বাহিরে তীব্র রোদ। রোদের তাপে ইরাবতীর শরীরে লাল লাল এলার্জি বের হচ্ছে। সে বেরিয়েছে ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ছাতা আনলে ভালো হতো। কিন্তু হায় তার ছাতা সাথে আনতে মনে নেই। সকাল আটটায় সে দুজন ফাইভের স্টুডেন্টকে পড়াতে যায়। সেখান থেকে সোয়া দশটা নাগাদ বের হয়। তারপর সেখান থেকে ভার্সিটি। ভার্সিটিতে গিয়ে ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে ক্লাসে জয়েন করা। তারপর হোস্টেলে ফিরার আগে আবারও দুটো টিউশনি। তারপর সন্ধ্যার আগে হোস্টেলে ফিরে এসে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করে পড়তে বসা। এটাই ইরাবতীর জীবন। হাত চুলকাতে চুলকাতে ইরাবতী তীব্র তাপের মধ্যে ভার্সিটিতে এসে পৌঁছালো। রাস্তাঘাট বেজায় গরম। পায়ের জুতোটা অনেক দিন হয়ে গেছে। হোস্টেলে একজোড়া হাইহিল ব্যতীত আর কোনো জুতা নেই তার। বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় বেশি কিছু সঙ্গে আনতে পারেনি সে।
ইরাবতী ভীষণ চুপচাপ মেয়ে। অবাক হলেও সত্যি তার কোনো বন্ধু নেই। এই এতো বড়ো ভার্সিটিতে সে আসে ক্লাস করে চলে যায় কিন্তু কাউকে বন্ধু বানানো হয়নি। সত্য কথা সে বন্ধুত্ব করেনি। তার কেন যেন একলাই ভালো লাগে। কিছু মানুষ একাই সুন্দর!
ক্লাস শেষ করে ইরাবতী ভার্সিটি থেকে বের হলো। সূর্যের তেজ বেড়ে গেছে আরও। ইরাবতীর পেট চুচু করছে। সে একটি সাধারণ রেস্টুরেন্টে গেলো। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটলো টিউশনি করাতে!’
গোধূলির আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে চিল। সেদিনের সেই জায়গাতে আজকেও দাড়িয়ে আছে মাহেন্দ্র। সে জানে ইরাবতী প্রত্যেকবারের মতো এদিক দিয়েই হোস্টেলে ফিরবে। আড়াল থেকে এক নজর দেখে চলে যাবে সেটাই তার উদ্দেশ্য! ইরাবতীর অজান্তে ইরাবতীকে প্রতিদিনি দেখতে আসে সে। ভালোবাসা কতো অদ্ভুত! যখন কেউ ভালোবাসে তখন অপরজন ভালোবাসে না। যখন দুজন দুজনকে ভালোবাসে তখন পরিবার মানতে চায় না। আর যখন দুজন দুজনকে ভালোবাসে কেউ কারো কাছেই প্রকাশ করতে পারে না! সেটা? মানবজাতির সবচেয়ে বড় হলো ধর্ম। আপনি আমি আমরা কেউই ধর্মের বিরুদ্ধে যেতে পারি না। আল্লাহ আমাদের সেই ক্ষমতা দেন নি। সেজন্য ভুল মানুষকে ভালোবাসার আগে আমাদের অবশ্যই ভাবা উচিত।
যদি ইসলামের দিক থেকে ভাবতে হয় তো। ইরাবতী ও মাহেন্দ্র পাপ করছে! ইরাবতীর উচিৎ হয়নি ভিন্নধর্মী কাউকে মন দিয়ে দেওয়া। ইসলামে বলা হয়েছে জন্মের আগে থেকে পার্টনার বানানো। কিন্তু আমরা দুনিয়ায় চাকচিক্যের মধ্যে ডুবে গিয়ে সেটা ভুলে যাই। যেখানে বিয়ের আগে রিলেশন করাই হারাম সেখানে ভিন্ন ধর্মী কাউকে ভালোবাসা ঠিক কতোটা যে ঘৃণ্য কাজ সেটা ভাবতেও পারবেন না। ইরাবতী আবেগি নয়! কিন্তু মাহেন্দ্র তার প্রথম প্রেম প্রথম ভালোবাসা। অ-আবেগি ইরাবতী এই একটা মানুষের বেলাতেই আবেগি হয়ে যায়! ধর্মের জন্য না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে! মাহেন্দ্র তাকে পছন্দ করলেও ইরাবতীর জন্য আগাচ্ছে না। ইরাবতী একবার এক পা আগালে দশবার ধর্মের জন্য আল্লাহর ভয়ে পিছিয়ে যায়! সমাজ জাতি ধর্ম ইরাবতীর এই আবেগ কখনোই মেনে নিবে না! কিন্তু তবুও! ইরাবতী সবকিছু থেকে বের হতে চাইলেও পারে না!সেজন্য সে বেছে নিয়েছে নিঃসঙ্গতা। মাহেন্দ্রকে নাই বা পেল, কিন্তু সারাজীবন হৃদয়ে মাহেন্দ্রকে জায়গা দিয়ে সে কাটিয়ে দিতে চায় পুরো এক জনম। এটা সে করতে পারবে। ধর্মের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না কিন্তু এটা করে ফেলতে পারবে অনায়াসেই! কিন্তু বোকা ইরাবতী জানেনা, জানলেও ভুলে গেছে আল্লাহ তাকে কারও পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি করেছেন!
ইরাবতী ক্লান্ত শরীর টেনেটুনে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে হাঁটছে। আড়াল থেকে মাহেন্দ্রের বড্ড মায়া হলো। নিজেকে মনে মনে গালাগাল করলো। তার জন্যই আজ ইরাবতীর এতো কষ্ট! সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে প্রার্থনা করলো ইরাবতীর জন্য।
*
অন্যান্য শহরে গরম হলেও সিলেট শান্ত। গরমের তাপমাত্রা কম সাথে প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়। এতে অবশ্য সিলেটবাসীর একটি ভোগান্তি পোহাতে হয়। বন্যার আতংকে থাকতে হয় তাদের৷ রুপান্তর মিনহাজের কাছে সিলেটের আবহাওয়ার কথাবার্তা শুনে সিলেট আসার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। মিনহাজের আপাতত কোনো৷ ছুটি নেই। সে এখনো স্টুডেন্ট। এই বছরটা শেষ হলে ইন্টার্নি শুরু হবে। প্রচুর পড়ার চাপ। বছর প্রায় শেষের পথে। সুতরাং সরকারি ছুটিতেও তাদের রেহাই নেই। ক্লাস না হোক হোস্টেলে থেকে পড়তেই হবে সাথে রোগী দেখাদেখি তো আছেই। সবমিলিয়ে সে রুপান্তরকে সময় দিতে পারবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত। তার মহারানী একবার যখন বলেছে আসবে তো আসবেই! দেখা গেলো মিনহাজ রাতে ক্লান্তিতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে তখন রুপান্তর ফোন করে বললো আমি এসে গেছি বের হয়ে এসো!
রুপান্তরকে সেজন্য মানা করলো না সে। বলল, ‘সোজা গ্রামে যাবে। ওখানে শহরের থেকে আরও বেশি শান্তি। আমি দেখি ছুটি পাই কি না। ষোলোই ডিসেম্বর আছে তো সামনে। আশা করি দু-একদিন পাবো হয়তো। তুমি সাবধানে এসো কেমন?’
রুপান্তরের হয়তো একটু মায়া হলো। বেচারি মন খারাপ করে বলল, ‘তাহলে বরং থাক। তোমার এই বছর টা শেষ হোক। ইন্টার্নি শুরু হওয়ার আগে নিশ্চয়ই ছুটি পাবে কয়েকদিন। তখন আমরা ট্যুর দিবো একসাথে।
মিনহাজ হাসলো, ‘পরের টা পরে। তুমি শশুরবাড়িতে চলে যাও। আমি শীগ্রই উপস্থিত হবো মিসেস।’
*
অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হতে গেছে রুদ্র। তটিনী পড়ার টেবিলে বসে কলম কামড়াচ্ছে। মূলত রুদ্রের আগমনী সংকেত পেয়েই সে পড়তে বসেছে। রুদ্রে শর্তানুযায়ী পড়তে না বসলে মাসের শেষের ট্যুরটা ক্যান্সেল করে দিবে বলেছে। তটিনী কোনো রকম রিস্ক নিতে চায়না। তারা দার্জিলিং যাবে ট্যুরে। তটিণী-র ড্রিম জায়গার একটি এটি। সুতরাং রুদ্রকে মত পাল্টানোর কোনোরকম সুযোগ দেওয়া যাবে না।
টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রুদ্র বের হলে। তটিনী বইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরবির করছে। রুদ্র ভাবলো হয়তো পড়ছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো তটিনী ‘দার্জিলিং যাবো’ বলে বিরবির করছে। ভাগ্যিস রুদ্রের কানে যাচ্ছে না। নাহলে বেচারি ধরা খেয়ে যেতো।
রুদ্র বউয়ের পড়াশোনা দেখে বেজায় খুশি হলো। যাক তার বউটার মতিগতি ঠিক হচ্ছে। তটিনী আড়চোখে রুদ্রের দিকে তাকালো। রুদ্র তখন ওয়ারড্রব থেকে শার্ট বের করে পড়ছে। তটিনী রুদ্রের উন্মুক্ত বুকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রুদ্রের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে বইয়ের দিকে তাকালো। রুদ্র ঠোঁট চেপে হাসলো। ধীর পায়ে হেটে এসে চেয়ার টেনে বসলো তটিণী-র পাশে। বই টেনে নিলো, ‘কি পড়ছো?’
তটিনী আমতা আমতা করতে লাগলো। মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার কিছুই মনে হলো না। রুদ্র রাগী স্বরে বলল, ‘এতোক্ষণ আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিলে তুমি?’
তটিনী নিরীহ চোখে তাকালো, ‘আমি তো পড়ছিলামই। কিন্তু ভুলে গেছি।’
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তটিনীকে পড়া বুঝিয়ে দিতে লাগলো মনোযোগ সহকারে। তটিনী রুদ্রের ভেজা চুলের ভাজে হাত রাখলো। উঠে গিয়ে টাওয়াল নিয়ে এসে ভালো করে মুছে দিলো। তারপর বসলো চেয়ারে। রুদ্র গভীর চোখে নিজের প্রিয়তমাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তটিনী হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ব্যস রুদ্রের আর পড়া বুঝিয়ে দেওয়া হলো না।
ঢাকা বাসীকে আশ্চর্য করে দিয়ে সেদিন বৃষ্টি নামলো। রাতের আঁধারে উষ্ণতা খুঁজে পেতে মরিয়া হলো রুদ্র।
সিলেটের ওসমানী মেডিকেল এর হোস্টেলের জানালার পাশে কানে ফোন গুঁজে দাড়িয়ে আছে এক যুবক। ওপাশ থেকে রুপান্তর ফিসফিস করে বলল, ‘আমি শীগ্রই আসছি এতো দূরত্ব আর ভালো লাগছে না মিস্টার চৌধুরী।’
পুরান ঢাকার ছাত্রী হোস্টেলে আবার অন্য দৃশ্য। এই মাঝরাত্রে বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত কেউ। জানালার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে অসম্ভব সুন্দরী সেই রমনীকে। হাটু সমান চুল ছড়িয়ে আছে পিঠময়। যে কেউ দেখলে বলে দিতে পারবে রমনীটির আজ মন খারাপ!
(চলবে)