#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-৩২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
মে মাসের প্রথম সন্ধ্যা। চারিদিকে প্রকৃতির তান্ডবে অন্ধকার বিরাজ করছে। কারেন্ট নেই বলে জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে রুদ্রদের বাড়িতে। তটিনী পড়ার ফাঁকে একবার মোবাইল চেক করে নিলো। রুদ্র কোনো মেসেজ দিলো কি না সেটা সে পড়ার ফাকে বার-বার চেক করছে। কিন্তু সে জানে রুদ্র কল করবে না এখন। পাক্কা পড়া শেষ হওয়ার পরই করবে। তটিনীকে বলে কয়ে পড়তে বসানো হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও বেচারির শান্তি নেই। পড়তে হবে মানে পড়তে হবেই। নাহলে রুদ্র পাইভেটের পথ ধরবে। যেটা তটিনী একদমই চায় না। রুপান্তর পাবলিকে পড়ার সুবাদে পড়াশোনা নিয়েই আপাতত ব্যস্ত। এদিকে মিনহাজ মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। সেজন্য বেচারার তো আরও দম ফেলার সময় নেই। ছুটি পেলে তিনজন ট্যুর দিবে না-হয়। সেরকমই পরিকল্পনা তাদের।
তটিনী যখন পড়ার পাট চুকিয়ে ফোন হাতে বসলো তখন রাত নয়টা। তখনও কারেন্ট আসেনি। বৃষ্টি কমলেও হাওয়া দিচ্ছে তীব্র বেগে। মোবাইল হাতে নিয়ে সে নিচে নামলো। খাবার টেবিলে ঈশানী সব গুছিয়ে রাখছেন। একটু পরই হয়তো সবাইকে খেতে ডাকতেন। তটিনী চেয়ার টেনে বসলো। ঈশানী চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘তোকে তো খাওয়ার জন্য সবসময়ই ডেকে আনতে হয়। আজ হঠাৎ নিজ থেকে চলে এসেছিস যে?’
তটিনী গোমড়া মুখ বলল, ‘এখন কি চলে যাবো? তোমার ডাকার অপেক্ষা করবো?’
ঈশানী চোখ দিয়ে শাসালেন, ‘বড্ড বেশি কথা ফুটেছে। চুপচাপ খেয়ে উঠ।’
তটিনী প্লেটে খাবার নিয়ে সবার আগেই খেতে বসে গেলো। খেয়ে দেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো আবারও। তার খাওয়ার পরই সবাই খেতে বসলো। তটিনী যখন কলের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো তখনই তার মোবাইল ফেন বিকট শব্দে বেজে উঠলো। রিসিভ করে সে কানে ধরে রীতিমতো চিৎকার করলো।
‘আপনার এখন কল দেওয়ার সময় হলো, আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন।’ এতোক্ষণ কল দিলেন না যে-ই না ঘুমিয়ে পড়লাম ওমনি আপনার কল দেওয়ার জন্য হাত নিসপিস করলো না?’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তাহলে রেখে দেই?’
তটিনী ফুসফুস করল, ‘আপনার এতো বড় স্পর্ধা। আপনি কল রেখে৷ দিতে বলেন। নতুন কেউ জুটিয়ে নিয়েছেন নাকি আমি চলে আমার পরপরই?’
রুদ্র রেগে বলল, ‘নতুন কেউ জুটালে নিশ্চয়ই তোমাকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করতাম না?’
তটিনী দমে গেলো, ‘ঠিক আছে স্যরি, কি বলবেন বলুন।’
‘কি বলবো মানে?’ তোমার সাথে কি আমার বলাবলির সম্পর্ক?’
‘তাহলে কিসের সম্পর্ক?’
‘তুমি জানো না কিসের?’
‘না তো জানিনা, আপনি জানিয়ে দিন রুদ্র ভাই।’
‘একদম ভাই বলব না। আমি তোমার মায়ের পেটের ভাই হই না।’
তটিনী ভড়কে গেলো, ‘আমি তো স্বভাবতই ভাই ডেকে ফেলেছি।’
‘সেটাও বলবে না, স্বভাব চেঞ্জ করো।’
তটিনী চিন্তিত স্বরে বলল, ‘আপনার মুড এতো হট কেন?’ আমার উপর চেঁচাচ্ছেন কেন? কি করেছি আমি?’
রুদ্র জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো, ‘আমার তোমাকে চাই ঐশি।’ এখনই এই মুহুর্তে, দিতে পারবে তোমাকে এখন?’
তটিনী হতভম্ব হয়ে কিছু সেকেন্ড চুপ থাকলো। তারপর বলল, ‘তো নিয়ে যান আবার। আমি তো এক পায়ে রাজি।’
রুদ্র অসহায় কন্ঠে শুধালো, ‘আমি এইবার আসলে আর তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না ঐশি। যেখানেই যাবো তুমি সঙ্গে যাবে। তোমাকে ছাড়া প্রতিটা দিন মৃত্যসম যন্ত্রণা দেয়। তুমি আমার বুকে লেপ্টে না থাকলে আমার দিন শুভ হয়না।’
তটিনী আবেগি কন্ঠে বলল, ‘আপনি ও না, দিলেন তো মুড নষ্ট করে। এবার আমি ঘুমাবে কিভাবে?’
রুদ্র আবদার করলো, ‘আজ সারারাত কথা বলি প্লিজ?’
তটিনী হাসলো, ‘আমার সবকিছুই আপনার কাছে গিয়ে থামে। আপনি আবদার করেছেন তা পূরণ করা অবশ্যই কর্তব্য।
তটিনী ও রুদ্রের বকবকানি চলতে থাকলো। এদিকে রুপান্তর একের পর এক কল করছে মিনহাজকে। বেচারা মিনহাজ তখন ফোন সাইলেন্টে রেখে পড়াশোনা করছে। ডাক্তার হওয়া তো সহজ নয়। সবসময়ই পড়াশোনার উপর থাকতে হয়। রুপান্তর একসময় ক্লান্ত হয়ে কল করা বন্ধ করে দিলো। তীব্র অভিমানে ফুপিয়ে উঠতে লাগলো বার-বার। তার কেন যেনো মনে হচ্ছে মিনহাজ অন্য কারো প্রতি ঝুঁকে গেছে। সেজন্য তাকে আগের মতো পাত্তা দিচ্ছে না। এমন যদি হয় তো সে মিনহাজকে খু ন করতে দুবার ভাববে না। তার হাসবেন্ড হয়ে কি না অন্য মেয়ের সাথে টাংকি মা র বে। কতবড় সাহস!
রুপান্তর রেগেমেগে মেসেজে টাইপ করলো,
‘কি রে চৌধুরীর পোলা? তোর এতো ভাব কিসের? কোন মাইয়ার পিছনে ঘুরোস? আমারে খেলনা পাইছত?’
মিনহাজ মেসেজটা সিন করলো রাত এগারোটার পর। তখন রুপান্তর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এতোগুলা কল ও এই মেসেজ দেখে সে বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেলো। রুপান্তর এই প্রথম এমন করেছে। নাহলে এতোদিন ফর্মালিটির মতোই তাদের কথাবার্তা হতো। যেরকম একটা বন্ধুর সাথে হয়। আজ রুপান্তর কিসের একটা অদৃশ্য দেয়াল যেনো ভেঙে দিলো। মিনহাজের নিজেকে এবার সত্যিই কারো স্বামী মনে হলো। মনে হলো তার একজন মানুষ রয়েছে যার সাথে তীব্র ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে কথা বলা উচিত।
সে একটানা কল দিতে শুরু করলো। তারপর মেসেজ করলো,
‘স্যরি গো ভুল হবে না আর। আমি এখন থেকে তোমাকে সময় দিবো প্রমিজ। আজকের মতো ক্ষমা করে দাও রুপ।’
ফোনের শব্দে রুপান্তরের ঘুম ছুটে গেছে। সে কল রিসিভ করে রেগে বলল, ‘কেডা তুই? এতো কল দিচ্ছিস কেন? মাইয়া গো মোবাইলে রাত্রে কল দেওয়া কোন ধরনের মেনার্স?’
মিনহাজ শব্দ করে হাসলো, ‘আমি তো অন্য মেয়েকে কল দেইনি। নিজের বউকে দিয়েছি। যেটা প্রত্যেকটা স্বামীর কর্তব্য ও অধিকার।’
রুপান্তর স্কিনে চোখ ভুলিয়ে নিলো, ‘তুই এতো রাত্রে কল দিচ্ছিস কেন? তোর কি বউ অন্য বেডার লগে পালিয়ে গেছে নাকি?’
মিনহাজ এবারও হাসলো, ‘তুমি সিলেটি ভাষা শিখে যাচ্ছো ধীরে ধীরে রুপ।’
রুপান্তর দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার দিল, ‘ঐ চৌধুরী!
মিনহাজ থমকালো।
‘আবার ডাকো তো।’
রুপান্তর রেগেমেগে বলল, ‘ঐ চৌধুরী…!
মিনহাজ হেসে বলল, ‘এই ডাকটা এতো মনে ধরেছে। তুমি আমাকে এই নামেই ডেকো কেমন?’
রুপান্তর ফুসফুস করলো, ‘মজা হচ্ছে? আমি কি তোর লগে মজা করতাছি? আমি রেগে আছি বুঝতে পারছিস না?’
‘কি করলে রাগ কমবে?’
‘তুই এমন কেন? আমি তোর কেউ হই না? যেহেতু কেউ হই না তো তুই করে ডাকবি। বন্ধু ছাড়া আমি তোর কিছু হইনা।’
‘বউ হও তো। চৌধুরীর বউ তুমি।’
‘একদম আবেগ দেখাতে আসবি না। আমি যে কলের পর কল দিলাম তখন তোর আবেগ কই ছিল?’
‘স্যরি বউ ফোন সাইলেন্ট ছিলো।’ চৌধুরীর বউকে একশো একবার স্যরি।’
রুপান্তর একটু গললো, ‘এভাবে ডাকবি না খবরদার। আমি তোর কেউ হই না।’
‘তুমিই তো আমার সব রুপান্তর। আর ভুল হবে না তো। প্রথমবারের মতো ক্ষমা করে দাও।’
রুপান্তর আবেগি কন্ঠে বলল, ‘একদম ক্ষমা চাইবে না। আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবো না।’
‘কেন?’
‘তুমি বরং ক্ষমা না চেয়ে তার পরিবর্তে আমাকে ভালোবাসো, দায় মিটিয়ে নাও নিজ থেকে।’
‘ঠিক আছে তাই হবে বেগম।’
তারপর সব নিশ্চুপ। মিনহাজ ডাকলো, ‘রুপ?’
রুপান্তর ‘হু’ বলল।
‘তুমি কার বউ বলো তো?’
‘চৌধুরীর।’
‘তুমি এতো আবেগি কবে থেকে হলে রুপ? আমি অবাক হয়ে হজম করতে পারছি না তো। বদহজম হতে পারে।’
রুপান্তর এবার হাসলো, ‘এখন তো এমন বলবেই। পটে গেছি না।’
মিনহাজ হেসে বলল, ‘তুমি পটবে কেন? তুমি তো পটোনি। আমি তোমাকে পটানের কোনো চেষ্টাই করিনি। যেখানে তুমি আমার সেখানে তোমাকে পটতে হবে কেন? তুমি তো আমারই রুপান্তর। চৌধুরীর বেগম তুমি।’
রুপান্তর বিস্মিত হলো, ‘তুমি এতো রোমান্টিক কেমনে? আমি তো তোমাকে হাবাগোবা মজনু ভাবতাম।’সবই ডাক্তারি পড়ার সাইট ইফেক্ট তাই না?’
মিনহাজ হাসলো, ‘প্রতিটি পুরুষই তার একান্ত মানুষের কাছে অন্যরকম হয় আমার বেগম।’
#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-৩৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
মাস পেরিয়ে বছর ঘুরেছে। তটিনী অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। রুপান্তরও সেম। বাদ যায়নি মিনহাজও। সে এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে।
মার্চ মাস। রমজান শুরু হবে। চারিদিকে রমজানের পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেক মুসলমান অপেক্ষা করছেন রমজানের জন্য। তার মধ্যে একদিন তটিণী-দের বাড়ি থেকে বের হলো দুটো কালো টয়েটো কার। বাড়ির একটা মানুষও বাদ যায়নি। গাড়ি দুটো এসে থামলো এয়ারপোর্টের সামনে। জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক সবার। তারা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে বহু পরিচিত একটা মুখের। ঘন্টা পেরোতেই সেই মুখ দেখতে পেলো সবাই। তটিনী হাতের ফুল নিয়ে দৌড়ে গেলো। মুহুর্তেই শূন্যে ভাসলো তার পা। ব্যক্তিটি তাকে সর্বশক্তি দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে, আশেপাশে খেয়াল না করে পুরো মুখশ্রীতে ঠোঁট ভুলিয়ে নিচ্ছে তৃষ্ণার্থ পথিকের মতো। রাজ ও তুরফান একে অপরের দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসলো। বলল, ‘এবার আগের মতো ওদের জ্বালাতে পারবো ভাই। রুদ্র ভাই ইজ কাম ইন ব্রো।’
তটিনীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে ব্যাগপত্র ভর্তি চাকা ঘুরিয়ে সে এগিয়ে এলো সামনে। রোবা নাহার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কপালে আদর দিলেন। মাথায় হাত ভুলিয়ে আওড়ালেন, ‘আমার রুদু, বাবা আমার।’
রুদ্র বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তাহসিন ইরফানের চোখে জল এসে গেলো। চোখের পানি মুছে ছেলেকে আগলে নিলেন বুকে। বললেন, ‘বড় হও বাবা। তোমার এই সাফল্যে আমরা গর্বিত।’ বাবাকে ছাড়িয়ে যাবে এবার? তাই তো?’
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘তুমি তো তুমিই বাবা। তোমাকে ছাড়াতে পারবো না। কিন্তু নিজের মতো অবশ্যই ভালো কিছু করে দেখাবো।’
রুদ্র ঈশানীকে সালাম দিলো। ঈশানী মুখে হাত ভুলিয়ে দিলেন। তাহের ইফফাত বুকে জড়িয়ে নিলেন।
‘আরে আমার জামাইরাজা যে। বড় হও বাবা।’
রুদ্র হাসলো। রাজ ও তুরফানের কান টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো। দুটো বড় হয়েছে এখন। পাবলিক ভার্সিটিতে অনার্সে পড়ছে।
রুদ্রদের বাড়িটি আজ আত্নীয় স্বজনে ভরপুর। শিশির ও তার বোন চশমা ঠিক করতে করতে তটিনী ও রুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করছে। এতোদিনের গুজব যে সত্যি তা তারা টের পাচ্ছে। এই দুটো তলে তলে বিয়ে করে বাসরও যে সেরে ফেলেছে তাতে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। শিশির গম্ভীর হলো, ‘আমি ভেবেছিলাম একটু চান্স নিবো। কিন্তু রুদ্র ব্রো তো আমার থেকেও এগিয়ে বোন।’
শিশিরের বোন চশমা ঠিক করে বলল, ‘তোর গার্লফ্রেন্ডের কি হলো? সে থাকতে তটিনী কেন?’
শিশির মন খারাপ করে নিরীহ স্বরে বলল, ‘কোনো ইয়াং মেয়ের বিয়ে হলে আমার দুঃখ হয় বোন। ওরা কেন আমাকে রেখে বিয়ে করবে? রীতিমতো বুকে ব্যথা করছে দেখ?’
শিশিরের ন্যাকামোতে তার বোন পাত্তা দিলো না। বেচারি মনে মনে রুদ্রকে একটু আকটু পছন্দ করতো। কিন্তু তা প্রকাশ করলে এখন তার ভাই তাকে বাঁ*শসহ বাঁ*শঝা*ড় উপহার দিবে।
রাতে বিরাট আয়োজন হলো। ছাঁদে আড্ডা হলো অনেকক্ষণ। তারপর এলো ঘুমানোর পালা। রুদ্র যেনো এটারই অপেক্ষা করছিল। সবার অগোচরে তটিনীকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। বহু দিনের তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টায় মত্ত হলো দুজন।
রাত দুটোর দিকে যখন তটিনী রুদ্রের উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে ঘুমোচ্ছে রুদ্র তখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তার সর্বনাশিনীকে দেখছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁট ভুলিয়ে দিচ্ছে পুরো মুখশ্রীতে। এই দেখার শেষ হবে না কখনো। রুদ্রের মন ভরে না। তার শুধু দেখে যেতেই ইচ্ছে করে। এই মেয়েটা একসময় তাকে অনেক জ্বালিয়েছে। পুড়িয়েছে দিনরাত নিজের অজান্তে। রুদ্র কতশত রাত বুকে ব্যথায় ঘুমাতে পারেনি। তার মন শুধু এই একটি মেয়েকেই কাছে চাইতো। তারপর, বহু বহু প্রতীক্ষার পর সে মেয়েটিকে আচমকা নিজের সাথে জুড়ে নিলো। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিজের করে নিলো সেদিনই। এইযে তাকে রুদ্র এতো ভালোবাসে তাতে কি রমণীর ভাবান্তর হয়? সে তো দিনরাত এক প্রহর ভালোবাসার কথা বলে এগারো প্রহরই ঝগড়া করতে ব্যস্ত। কিন্তু তাতে রুদ্রের মন্দ লাগে না। তটিণী-র ঝগড়াতেও সে ভালোবাসা খুঁজে পায়। এইযে আজ সে এলো। মেয়েটা সারাক্ষণই তার আশেপাশে বসে ছিলো। যেন রুদ্র তাকে শর্ত দিয়েছে আমার কাছ থেকে একদম সরবে না। কিন্তু রুদ্র কিছুই বলেনি। নিজেও সুযোগ খুঁজেছে ভালোবাসার।
ভালোবাসাটা হঠাৎ করেই হয়ে যায়। কার কখন কবে কার সাথে ভালোবাসাবাসি হবে কেউ বলতে পারে না। রুদ্র ও বলতে পারেনি। কবে কিভাবে ভালোবেসেছে সে নিজেও জানে না। সে শুধু জানে সে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা যুগ যুগ ধরে চলুক। রুদ্র শুধু এই এক রমনীকেই ভালোবেসে যেতে চায় যুগের পর যুগ।
*
ভিডিও কলে কানেক্টেড রুপান্তর ও মিনহাজ। মিনহাজ বইপত্র গুছিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। গভীর চোখে রুপান্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঘুমাবে না?’
রুপান্তর মন খারাপ করে বলল, ‘রুদ্র ভাই আজ দেশে এসেছেন। তুই জানিস তটিনী আমাকে সেই যে সকালে এটা জানিয়ে উধাও হয়েছে তার আর কোনো খবর নেই। একবার ফোন পর্যন্ত করলো না।’
মিনহাজ হেসে বলল, ‘আজকের দিনটা ওর একজনের সাথেই কাটানো উচিত। সেজন্য ও তোকে কোনোরকম ফোনকল করছে না। যেদিন তোরও এমন দিন আসবে সেদিন তুই ও সেই মানুষটা ছাড়া আর কারো কথা ভাববি না। বুঝেছিস?’
‘তুই সবজান্তা নাকি?’
মিনহাজ হাসলো, ‘সবজান্তা কি না জানি না, তবে আমি যা বলেছি রিয়েলিটি -ই বলেছি।’
রুপান্তর গাল ফুলালো। মিনহাজ মুচকি হাসলো, আয় তোর গালটা টেনে দেই।’
‘চুপ কর বেয়াদব।’
‘আমি বেয়াদব? বেয়াদবির কি করেছি তোর সাথে?’
রুপান্তর অবাক হয়ে বলল, ‘করিস নি?’ মনে কর শয়তান।’
‘কি করেছি?’
‘তুই আমাকে চুমু খাসনি?’
‘কবে কখন?’
‘ওরে হারামি, তোদের বাড়িতে যে-ই কাহিনি করলি। আবার ভালো সাজোস। খবিশ কোথাকার।’
মিনহাজ হাসলো, ‘ওটা তো আমি করিনি, তোর বর করেছে।’
‘তুই কে তাহলে?’
‘আমি তো তোর বন্ধু তাই না?’
রুপান্তরের মাথা ঘুরে গেলো, ‘তাহলে আমার বরটা কে?’
‘যে তোকে সেদিন চুমু খেয়েছিল সে।’
রুপান্তর রেগে গেলো, ‘মজা নিবি না শয়তান। মাথা ঘুরাচ্ছে।’
‘আচ্ছা নিলাম না।’
মিনহাজ ও রুপান্তরের খুনসুটি চলতে থাকলো। রাত এভাবেই চলবে তাদের।
*
ভোর সাতটায় তটিণী-র ঘুম ভেঙে গেলো। রুদ্র তখন গভীর ঘুমে। তটিনীকে শক্ত করে আগলে রেখে ঘুমাচ্ছে সে। তটিনী উঠতে গিয়ে পারলো না। রুদ্রের শক্ত বাঁধনে আটকা পড়লো। রুদ্রের কপালের চুলগুলোতে হাত ভুলিয়ে সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কতোদিন পর মানুষটা তার পাশে। কতোদিন পর তাকে আবারও উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছে। তটিণী-র নিজেকে সর্ব সুখী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার কোনো দুঃখ নেই। কোনো মন খারাপ নেই।
প্রিয় মানুষকে পেয়ে গেলে মন খারাপ না-ই হয়ে যায়। মন খারাপের একমাত্র ঔষধ প্রিয় মানুষ।
তটিনী হাত বাড়িয়ে মোবাইল হাতে নিলো। রুপান্তরকে একটি মেসেজ পাঠিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে নিলো। ঘুম ধরা দিলো আবারও।
রাজ ও তুরফানের মস্তিষ্কে শয়তানি কিলবিল করছে। দুজন হাতে ফটকা নিয়ে ঘুরছে। উদ্দেশ্য যেকোনো সময় রুদ্রের দরজার সামনে ফা*টিয়ে দেওয়া। বাড়ির সবার অগোচরে কাজটা করতে হবে। নাহলে বাঁ*শ খেতে হবে। রুদ্র নিজে সেই বা*শ উপহার দিতে দ্বিধা করবে না। বহু সময় পর দুজন সুযোগ পেল। রুদ্রের দরজার সামনে ফু*টিয়ে দিলো বাজি। ঠাস করে শব্দ হলো। ঈশানী রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বের হলেন। কি হলো কি হলো বলে হৈহৈ পড়ে গেলো। রুদ্র নিচ থেকে কাপড় তুলে পড়ে নিলো। তটিনীকে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে বলে নিজে দরজা খুলে বের হলো। দরজার সামনে ফটকা দেখে তার বুঝতে বাকি নেই কাজটা কাদের। কিন্তু বাড়ির কারো সামনে তা সে প্রকাশ করলো না। বলল, ‘আমিই করেছি এটা।’
ঈশানী চলে গেলেন। রুদ্র ঘর ছেড়ে বের হলো। দুটো পাঁজিকে আজ সে দেখে নিবে।
(চলবে)