অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬৮।

0
340

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৮।

ফ্রেশ হয়ে এসে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ল দুজন। নামাজ পড়া শেষ হলে প্রিয়তা সব গুছিয়ে রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজ পূর্ণিমা নয়, তবে আকাশে পূর্ণ চাঁদ। ফারজাদও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দুজন। যেন নীরবতার প্রতিযোগিতা চলছে এখানে।
চারদিক নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো রা নেই, আওয়াজ নেই। পুরো অন্তরীক্ষ জুড়ে এক চাঁদ উঠেছে কেবল, তারাও নেই আজ। প্রিয়তা আকাশ দেখল অনেকক্ষণ। ফারজাদ চুপ থেকে থেকে ভাবছে, তার কি কিছু বলা উচিত? কী বলবে সে? কীভাবে বলবে?

তবে তার এত এত চিন্তা কমিয়ে দিয়ে প্রিয়তা নিজে থেকেই বলল,

‘কথায় আছে না, সৃষ্টিকর্তা কারোর কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিলে তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেন; আমি সেই কথার প্রমাণ পেয়েছি, ফারজাদ।’

প্রিয়তা ফারজাদের দিকে চাইল। ফারজাদও দেখছে তাকে। প্রিয়তা ফের নিজ থেকে বলল,

‘এত ভুল করার পরেও আল্লাহ আমার জীবনে আপনাকে এনে দিয়েছেন, আমি নিঃসন্দেহ সৌভাগ্যবতী।’

ফারজাদ বলল,

‘কিছু ভুল ভালোর জন্যই হয়। তুমি সেদিন ভুল না করলে আজ আমি তোমায় পেতাম না।’

প্রিয়তা মলিন হাসল। ফারজাদ বলল,

‘একটা অনুরোধ করব?’

‘কী?’

‘ওয়াদিকে আজকের পর থেকে তোমার দুঃস্বপ্নেও কখনো ঠাই দিও না। আমি আমার মা’র মতো কষ্ট পেতে চাই না, প্রিয়তা। আমার বিশ্বাস ভেঙো না কোনোদিন।’

‘ভাঙব না, ওয়াদা করলাম। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি আপনার হয়েই থাকব।’

ফারজাদ তৃপ্ত হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। প্রিয়তা তখন জিজ্ঞেস করল,

‘আন্টির সাথে কী হয়েছিল?’

ফারজাদ অন্যদিকে চাইল। বলল,

‘কুৎসিত স্বপ্ন ভেবে ঐদিনগুলো আমরা আমাদের স্মৃতির মলাট থেকে বাতিল করে দিয়েছি। সেগুলো আর মনে করতে চাই না, আমি দুঃখিত।’

‘না না, আমিও চাই না কোনো দুঃখজনক অতীত আপনাকে আবার কষ্ট দিক। আপনি ভালো থাকুন, আমি এটাই চাই।’

ফারজাদ এগিয়ে এসে প্রিয়তার দুগালে হাত রাখল। ফারজাদের স্পর্শে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল প্রিয়তা। ফারজাদ আরো খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,

‘ওয়াদা করো, আমার সুখের একমাত্র কারণ তুমি হবে।’

‘ওয়াদা করছি।’

ফারজাদ আলতো করে প্রিয়তাকে তার বুকে জড়িয়ে নিল। প্রিয়তার শরীর যেন এখন শক্তিহীন এক নিথর দেহ। ফারজাদের এতটা কাছে এসে শরীরের শিরা ধমনীগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আদৌ রক্তপ্রবাহ ঠিকঠাক হচ্ছে কি-না কে জানে। ফারজাদ আকাশের দিকে চাইল। এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখল প্রিয়তাকে। প্রিয়তা চুপচাপ ফারজাদের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ফারজাদ বলল,

‘মায়ের পর আমার কাছে সবথেকে মূল্যবান নারী তুমি। আমি আজীবন তোমাকেই আগলে ধরে বাঁচতে চাই, একটা চমৎকার সুন্দর ভবিষ্যত চাই, আর চাই এক অন্তরীক্ষ সমান ভালোবাসা। দিবে তো?’

প্রিয়তা লজ্জা আর জড়তায় জমে কাঠ। কেবল মাথা নাড়াল সে। ফারজাদ তার দিকে মাথা নুইয়ে চাইল। বলল,

‘তুমি যে মাঝে মাঝেই কথা বলা ভুলে যাও, সেটা আমাকে আগে জানাওনি কেন?’

প্রিয়তা আরেকটু মাথা নুয়ালো। ফারজাদের বুকের ভেতর ঢুকতে পারলে শান্তি পেত বোধ হয়। আপাতত সেটা পারছে না বলে অতি ক্ষীণ আওয়াজে জবাব দিল,

‘দিব। ঐ অন্তরীক্ষের গভীরতা যতটা আমি আপনাকে ততটাই ভালোবাসা দিব, এই পৃথিবী জুড়ে যত ভালোবাসা আছে, আমি একাই সেই সম্পূর্ণটা আপনাকে দিব। একটুও কৃপণতা দেখাব না, প্রমিজ।’

ফারজাদ এবার দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরশ প্রিয়তাকে। প্রিয়তাও তাকে জড়িয়ে ধরল। একে অন্যের উষ্ণ আলিঙ্গনে জীবনের সমস্ত অবসাদ, ক্লেশ, গ্লানি মুছে গেল তাদের। দুচোখে তাদের জ্বলজ্বল করে উঠল, আসন্ন এক অনবদ্য ভবিষ্যতের। দুজনেই সময়টাকে আঁকড়ে ধরল। স্মরণীয় করে তুলল প্রতিটি মুহুর্ত।

______________

একটি রৌদ্রদগ্ধ অনিন্দ্য সকাল। দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভাঙে প্রিয়তার। চোখ মেলতেই আবিষ্কার করে এক চমৎকার দৃশ্য। ফারজাদের দুই হাতের বাঁধনের মাঝে বেশ আরাম করে ঘুমিয়ে আছে সে। প্রিয়তা মাথাটা উঁচিয়ে তাকাল। দেখল, ফারজাদ ঘুমে বিভোর। আস্তে করে উঠে বসল সে। গায়ের জামা কাপড় ঠিকঠাক করে নেমে দাঁড়াল। তারপর গিয়ে খুলল দরজাটা। দরজার বাইরে মৌমি। দুই ঠোঁটের ফাঁকে তার বত্রিশ’টা দাঁত স্পষ্ট। সে লাজুক লাজুক ভঙিতে বলল,

‘গুড মর্নিং, ভাবিজান।’

প্রিয়তা হেসে বলল,

‘গুড মর্নিং।’

মৌমি খানিকটা এগিয়ে আসে। এদিক ওদিক চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘বাসর রাত কেমন কাটল?’

‘ইশ, অসভ্য মেয়ে। এত জানার শখ কেন তোমার?’

‘আরে বলো না, একটু এক্সপেরিয়েন্স হবে।’

প্রিয়তা রগড় সুরে বলল,

‘আমার ভাই এমনিতেই এক্সপার্ট, তোমার আর এক্সপেরিয়েন্সের প্রয়োজন নেই।’

মৌমির লজ্জায় কান নাক লাল হয়ে উঠল। বলল,

‘তোমার সাথে আমার কথা বলাই ভুল হয়েছে। যাচ্ছি, আর কথাই বলব না।’

মেকি রাগ দেখিয়ে মৌমি চলে গেল সেখান থেকে। প্রিয়তা হাসল এক চোট। তারপর দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

প্রিয়তা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ফারজাদ উঠে পড়েছে। বিছানায় বসে ফোন দেখছে সে। ফারজাদ চাইল তার দিকে। হেসে বলল,

‘শুভ সকাল।’

‘শুভ সকাল।’

প্রিয়তা তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফারজাদ উঠে গেল ওয়াশরুমে। আয়নায় নিজেকে দেখে অযথায় লজ্জা পাচ্ছে প্রিয়তা। সে হাসছে কারণ ছাড়াই। নতুন বউয়ের ন্যায় নাক গাল লাল তার। নিজেকে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মনে মনে অনেক শুকরিয়া জানাল আল্লাহর কাছে। পরক্ষণেই আবার হেসে বলল,

‘ধন্যবাদ ওয়াদি, তোমার জন্য পাকিস্তানে গিয়েছি বলেই না আজ ফারজাদকে পেয়েছি। এই একটা কারণে আমি অবশ্যই তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
__________

রান্নাঘরে গিয়ে দেখে মা তার হরেক আয়োজন করেছেন। প্রিয়তাকে দেখে লুৎফা বেগম বললেন,

‘উঠে পড়েছিস, যা জামাইকে নিয়ে টেবিলে বসে যা।’

‘আমি সাহায্য করব, মা?’

‘না না, তুই ফারজাদকে নিয়ে টেবিলে বস গিয়ে।’

‘বাকিরা কোথায়?’

‘তোর বাবা খেয়ে অফিসে গিয়েছে। নীহাল ওর কোচিং সেন্টারে। রুবাও আমার সাথে খেয়ে নিয়েছে। এখন শুধু তুই মৌমি আর ফারজাদ বাকি।’

প্রিয়তা বসার ঘরে গেল। মৌমি টিভি দেখছে বসে বসে। প্রিয়তা গিয়ে বলল,

‘খেতে এসো, মৌমি।’

মৌমি ফিরে তাকাল। প্রিয়তাকে দেখে হাসল সে। বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি খেতে হবে। জরুরি কাজ বাকি যে।’

‘কী কাজ?’

মৌমি এগিয়ে এসে বলল,

‘তোমার বাসর রাতের গল্প শোনা।’

বলেই সে দ্রুত ডাইনিং রুমে চলে গেল। প্রিয়তা হাসল মেয়েটার চঞ্চলতা দেখে।

প্রিয়তা, ফারজাদ আর মৌমি খাচ্ছে। লুৎফা বেগম আর দিলরুবা বেগম তাদের বেড়ে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। প্রিয়তার মাঝে জড়তা। সে বলল,

‘তোমরা দুজনও বসে যাও না, আরেকবার আমাদের সাথে খেলে কিছু হবে না।’

দিলরুবা বেগম হেসে বললেন,

‘তোমার মা এমনিতেই আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে কয়েক কেজি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর খেলে পরে আমি বেলুন হয়ে আকাশে উড়ে যাব।’

সবাই হাসল। প্রিয়তা বলল,

‘এইটুকু খেলে কিছু হয় না, আন্টি।’

‘আন্টি?’

দিলরুবা বেগম কপাল কুঁচকে বললেন। ফারজাদ প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলল,

‘ন না মানে আসলে, এতদিনের অভ্যাস তো, তাই বলে ফেলেছি।’

দিলরুবা বেগম নাক মুখ কুঁচকে বললেন,

‘তার শাস্তিস্বরূপ এখন দুটো পরোটা আরো বেশি খেতে হবে তোমাকে।’

এই বলে তিনি প্রিয়তার প্লেটে দুটো পরোটা তুলে দিলেন। প্রিয়তা আঁতকে উঠে বলল,

‘না না, এতগুলো আমি খেতে পারব না।’

‘এটা তোমার শাস্তি, মা’কে আর আন্টি ডাকবে?’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘জীবনেও না।’

আরেক চোট হাসল সবাই। লুৎফা বেগম তৃপ্তির স্বরে বললেন,

‘দোয়া করি, আমার মেয়ে আর তার শাশুড়ির সম্পর্ক আজীবন এমন থাকুক।’

মৌমি জোর গলায় বলে উঠল তখন,

‘আমিন।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here