অলিখিত_অধ্যায় #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬৯।

0
371

#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৯।

রাতের ফ্লাইটের টিকিট কেটে এনেছে ফারজাদ। আর এই খবর পাওয়ার পর থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে প্রিয়তা। লুৎফা বেগম কাজ করছেন, মন ভার তাঁরও। দিলরুবা বেগম প্রিয়তার রুমে এসে বললেন,

‘প্রিয়তা, তোমার যা যা নেওয়ার এখনই একেবারে গুছিয়ে ফেলো। নয়তো পরে তাড়াহুড়োতে আর মনে থাকবে না।’

প্রিয়তা মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা, মা।’

দিলরুবা বেগম এগিয়ে এলেন। প্রিয়তার পাশে বসলেন তিনি। মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘এক মা ছেড়ে আরেক মায়ের কাছে যাচ্ছো তুমি, মন খারাপ করছো কেন? এই বাড়িটা যেমন তোমার ঐ বাড়িটাও তো তোমার’ই।’

প্রিয়তা কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘মা, আমার সৌভাগ্য যে আমি আপনাদের আমার জীবনে পেয়েছি। পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টের পাশাপাশি আপনাদের মতো চমৎকার কিছু মানুষকে পাওয়ার সুখও হচ্ছে।’

‘এই সুখ তোমার আজীবন থাকুক, আমি দোয়া করি।’

লুৎফা বেগম সেই রুমে এলেন তখন। প্রিয়তা আর দিলরুবা বেগমের সুন্দর সম্পর্ক দেখে বড্ড প্রশান্তি বোধ করলেন। দিলরুবা বেগম বান্ধবীকে দেখে বললেন,

‘এই যে ম্যাডাম, অনেক কাজ করেছেন। এখন আমার ছেলের বউকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন তো।’

লুৎফা বেগম হাসলেন। বললেন,

‘নিয়ে যান বেয়ান সাহেবা, আমি নিশ্চিন্ত চিত্তে আমার মেয়েকে আপনার হস্তে অর্পণ করলাম।’

প্রিয়তা সরু চোখে চেয়ে বলল,

‘আর আসব না কিন্তু।’

‘আসিস না, আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারব।’

প্রিয়তা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,

‘কত বড়ো কথা! সত্যিই আর আসব না, যাও।’

লুৎফা বেগম আড়ালে হাসলেন। ব্যাগ এনে গুছিয়ে দিতে লাগলেন প্রিয়তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো। দিলরুবা বেগমকে বললেন,

‘তোকে আর নতুন করে কিছু বলার নেই, রুবা। পাকিস্তানে আমার মেয়েটার পাশে যেভাবে ছিলি, আজীবন সেভাবেই থাকিস। ভালোবাসবি যেমন, ভুল করলে শাসনও করবি। একদম ছাড় দিবি না।’

‘হয়েছে মা, তোমার শাসন পেতে পেতে শেষ আমি, এখন আবার আমার শাশুড়ি মাকেও শিখিয়ে দিচ্ছ?’

‘হু, শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি তো কম পাঁজি না, একটু শাসন না করলে আদরে পরে বাঁদর হয়ে যাবে।’

‘তুই বেশি বেশিই বলিস, লুৎফা। আমার মেয়েটা মোটেও এমন না।’

দিলরুবা বেগমের সমর্থন পেয়ে প্রিয়তা হেসে বলল,

‘দেখেছ, মা আমাকে ঠিকই বোঝেন, খালি তুমি বোঝো না।’

লুৎফা বেগম কিছু বলার আগেই মৌমি হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে আসে। বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলছে সে। প্রিয়তা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, মৌমি?’

‘ভাবিজান, তোমার ভাইটা কিন্তু এবার অতিরিক্ত করছে।’

‘কেন? কী করেছে?’

‘আমাকে কি বলেছে জানো? বলেছে, আমাকে নাকি পাবনায় রেখে আসা উচিত। ওখানে নাকি একটা পাগলাগারদ আছে যেখানে আমার মতো আরো পাগলেরা থাকে। আমাকে কি উনার পাগল মনে হয়?’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘নীহাল নিশ্চয়ই এমনি এমনি বলেনি, তুই এর আগে অবশ্যই কিছু বলেছিস।’

‘না, আমি কিছু বলেনি।’

‘তুমি এত ভালো মানুষ নও, মৌমি। তোমাকে আমি ভালো করেই চিনি।’

মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন তো নিজের মেয়ে তোমার কাছে পর হয়ে গিয়েছে। আন্টি(লুৎফা বেগমের দিকে চেয়ে) আপনার ছেলের কান মলে দিবেন, উনি সবসময় আমার সাথে ঝগড়া করেন।’

লুৎফা বেগম হেসে বললেন,

‘ঠিক আছে মা, দিব। এবার একদম কান ছিড়ে তারপর ছাড়ব।’

‘না না, ছিড়তে হবে না। খালি একটু মলে দিলেই হবে।’

‘হ্যাঁ মা, খালি একটু মলে দিও। কান ছিড়ে ফেললে তো আবার সবাই পরে মৌমিকেই বলবে যে মৌমির হাজবেন্ডের কান ছিড়া।’

প্রিয়তার কথা শুনে হেসে ফেলল সবাই। মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘তোমাদের সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে।’

বলেই সে অন্য রুমে চলে গেল। তার মেকি রাগ দেখে আরেক চোট হাসল সবাই।

_________

সবাই বের হবার জন্য প্রস্তুত। লুৎফা বেগম আঁচলে চোখ মুছছেন ক্ষণে ক্ষণে। প্রিয়তার নাক মুখ লাল, কেঁদেছে তা আর বোঝার বাকি নেই। অলিউল সাহেব আর নীহালেরও বিষন্ন মন। আর কিছুক্ষণ পরেই ফ্লাইট তাদের। এবার এয়ারপোর্টে যেতে হবে। দরজার কাছটাই গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তা। নিজেকে আর সংযত রাখতে না পেরে কেঁদে ফেলল সে। বলল,

‘আমাকে ক্ষমা করে দিও, বাবা। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।’

অলিউল সাহেবের বড্ড মন পুড়লেও কাঁদলেন না তিনি। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘সন্তানের উপর মা বাবার কোনো অভিযোগ থাকে না। অতীত ভুলে সুন্দর একটা বর্তমান কাটাও, বাবার অনেক অনেক দোয়া রইল।’

প্রিয়তা দাঁড়াল সোজা হয়ে। মায়ের দিকে চাইল। ডাকল,

‘মা।’

লুৎফা বেগম আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিয়তা বলল,

‘চলে যাচ্ছি মা, আমার জন্য দোয়া করো।’

লুৎফা বেগমের চোখের পানি বাধা মানছে না। তিনি খুব কষ্টে নিজেকে ধাতস্ত করে বললেন,

‘আমাদের দোয়া সবসময় তোমার পাশে আছে, মা। তুমি সুখী হও।’

প্রিয়তা শান্ত রাখল নিজেকে। নীহাল পাশেই তার। বোনের হাতটা ধরে বলল,

‘কাঁদবি না। আর সবসময় এই মানুষগুলোকে ভালো রাখার চেষ্টা করবি, নিজে ভালো থাকবি। আমরা সবাই তোর পাশে আছি।’

প্রিয়তা মাথা ঝাঁকাল, জোরে শ্বাস টেনে কান্না আটকাল তার।
গাড়িতে গিয়ে বসল সবাই। বাইরে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার মা, বাবা আর ভাই। প্রিয়তা ছলছল চোখে দেখছে তাদের। গাড়িটা চলতে শুরু করল। হাত বাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে প্রিয়তা। লুৎফা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে প্রিয়তা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মৌমি তার পাশেই বসা। এসব দেখে তারও মায়া হচ্ছে খুব। প্রিয়তার হাতের উপর হাত রেখে সে বলল,

‘কেঁদো না, ভাবিজান। আমরা আছি তো।’

প্রিয়তা সিটে হেলান দিয়ে বসল। মা, বাবা, ভাইকে আর দেখা যাচ্ছে না। সামনে থেকে একটা পানির বোতল প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিল ফারজাদ। বলল,

‘একটু পানি খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।’

প্রিয়তা পানি পান করল। তারপর চাইল মৌমির দিকে। বলল,

‘তোমারা আছো বলেই আমি এত নিশ্চিন্ত।’

দিলরুবা বেগম বললেন,

‘আর কেঁদো না তবে, বেশি কাঁদলে অসুস্থ হয়ে পড়বে যে।’

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

এয়ারপোর্টে প্রাসঙ্গিক সব কাজ শেষ করে ফ্লাইটে উঠল সবাই। জানলার পাশটাতে বসল প্রিয়তা। মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা, যেদিন সে প্রথম এই ফ্লাইটে করে এই দেশ ছেড়েছিল। কী বিদঘুটে ভয় ছিল বুকের ভেতর, তাও দুঃসাহসীক এক কাজ করে বসেছিল সে। আজ আবারও দেশ ছাড়ছে। তবে এক নতুন পরিচয়ে, নতুন স্বত্তায়। ভাবনার মাঝেই টের পেল স্বীয় হাতের উপর অন্য এক উষ্ণ ছোঁয়া। সে তাকাল পাশে। ফারজাদ বলল,

‘মন খারাপ করো না, তুমি যখন চাইবে আমরা তখনই বাংলাদেশে আসব।’

প্রিয়তা মৃদু হাসল। ফারজাদের কাঁধের উপর মাথার ভারটা দিয়ে চোখ বুজল সে।

চোখ খুলল যখন তখন তারা পাকিস্তানে। পরিচিত রাস্তার অলি গলি পেরিয়ে ছুটে চলছে গাড়িটা। প্রিয়তা একমনে চেয়ে আছে বাইরে। মনে করতে না চাইলেও অনেক কিছু মনে পড়ছে তার। এত এত অপেক্ষা, এত আক্ষেপ, এত হাহাকার কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? তাও সে ভুলে থাকবে, নিজের জন্য না হোক ফারজাদের জন্য হলেও ভুলে থাকবে।

চলবে….

(একটু অসুস্থ বলে গ্যাপ পড়েছে। দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here