#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৪।
সবার সম্মুখে দাঁড়ান ফারজাদ আর প্রিয়তা। উৎসুক জনতা অধির আগ্রহে বসে আছে তাদের মুখের জবান খোলার অপেক্ষায়। মৌমি ছটফট করছে, কবে তার ভাই আর প্রিয়তা আপু তাদের বিয়ের ঘোষণা দিবে সেই আশায়। ফারজাদ প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তার চোখে মুখে এক বিস্তর লজ্জা দেখতে পেল সে। তাই নিজেই বলল,
‘আন্টি, আংকেল, আম্মি, আমরা দু’জন এই বিয়েতে রাজি।’
মনে হলো যেন সবার অন্তর থেকে এক বিশাল পাথর নেমে গিয়েছে। অন্তঃস্তলে বয়ে গেছে এক শান্তির স্রোত। মৌমি হাত তালি দিয়ে উঠল। বলল,
‘এই তোমরা আলহামদুলিল্লাহ বলো।’
সবাই এক সঙ্গে বলে উঠল, “আলহামদুলিল্লাহ”। অস্বস্তি আর লজ্জায় প্রিয়তার যবুথবু অবস্থা। সবার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন তার বেগ পোহাতে হচ্ছে বেশ। দিলরুবা বেগম উঠে এলেন। প্রিয়তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
‘আমি ভীষণ খুশি হয়েছি, মা। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’
প্রিয়তা উত্তরে প্রসন্ন হাসল। নীহাল ছিল না বাসায়। সে এতক্ষণে হাজির হলো, হাতে একগাদা মিষ্টি নিয়ে। এসেই বলল,
‘এই সবাই মিষ্টি মুখ করো। মিষ্টি ছাড়া সুখবর জমে না-কি?’
সবাই হৈ চৈ করে একে অন্যকে মিষ্টি খাইয়ে দিল। মৌমি এসে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। নিজের অফুরন্ত খুশি প্রকাশ করল। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘তাহলে শুভ কাজে আর দেরি করে লাভ কী? আমি আমার ছেলের বউকে আমার সাথেই দেশে নিয়ে যেতে চাই।’
প্রিয়তা অবাক হলো। লুৎফা বেগম বললেন,
‘তুই কি আমাদের একটু প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও দিবি না, রুবা?’
‘না, কীসের প্রস্তুতি? আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাব, এখানে আবার প্রস্তুতি কীসের?’
‘তাও আপা, এভাবে কি আর মেয়েকে দিয়ে দেওয়া যায়?’
অলিউল সাহেবের প্রত্যুত্তরে দিলরুবা বেগম বললেন,
‘ভাইজান, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি কেবল একটা ভালো দিন দেখুন, আর কাজী ডাকুন, বাকিটা আমি সামলে নিব। আমার পক্ষের কোনো আত্মীয় নেই। আর আমাদের কোনো আড়ম্বরতাও লাগবে না। আমরা শুধু আপনার মেয়ে প্রিয়তাকে চাই, এইটুকু দিয়ে দিন, তাহলেই হবে।’
অলিউল সাহেব হাসলেন। বললেন,
‘আপা, আপনার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এভাবেও যে কেউ আমাদের মেয়েকে ভালোবাসবে তা আমরা ভাবিনি। আমাদের মেয়েটা সারাজীবন ভালো থাকুক, শুধু এইটুকুই চাই। আপনার কথাই থাকবে তবে। আজ মঙ্গলবার, আগামী শুক্রবারে প্রিয়তা আর ফারজাদের বিয়ে। আমাদের পক্ষেরও কেউ নেই। মেয়েকে আমরা ঘরোয়া ভাবেই তুলে দিব।’
দিলরুবা বেগম বললেন,
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
ফারজাদ অনুচ্চ সুরে প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার কোনো আপত্তি নেই তো, প্রিয়তা?’
প্রিয়তা কী বলবে বুঝতে পারছে না। এত তাড়াহুড়োতে হচ্ছে সব। শেষটা ভালো হলেই হয়। সে মাথা হালকা নাড়িয়ে বলল,
‘না।’
ফারজাদ তৃপ্ত মুখে হাসল কিঞ্চিৎ।
কোনোপ্রকার সমারোহ না থাকলেও বাড়িতে যেন এক বিয়ে বিয়ে আমেজ। বিশেষ করে মৌমির ছোটাছুটিতে তা আরো বেশি প্রকট হচ্ছে যেন। রান্নাঘরে কাজ করছেন লুৎফা বেগম। রাতের রান্নার আয়োজন। দিলরুবা বেগম সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন তাঁর সাথে। মৌমি দৌড়ে এল সেখানে। অস্থির গলায় বলল,
‘আম্মি, আমরা শপিং এ যাব না?’
‘হ্যাঁ, যাব তো।’
‘কখন যাব?’
‘কালকে সকালে।’
‘আচ্ছা।’
মৌমি খুশি মনে ফিরে আসার জন্য ঘুরতেই লুৎফা বেগম আবার ডাকলেন তাকে। মৌমি ফিরে চেয়ে বলল,
‘জি আন্টি।’
‘এদিকে এসো।’
মৌমি ভেতরে গেল। লুৎফা বেগম কাছে টেনে নিলেন তাকে। বললেন,
‘খুব খুশি, তাই না?’
‘জি আন্টি, খুব।’
লুৎফা বেগম বললেন,
‘মা, প্রিয়তাকে ভালো লাগে তোমার?’
‘জি আন্টি, প্রিয়তা আপুকে শুধু আমার ভালো লাগে না, প্রিয়তা আপুকে আমি অনেক ভালোবাসি।’
‘আর আমাদের ভালোবাসো না?’
মৌমি হেসে বলল,
‘হ্যাঁ আন্টি, আপনাদেরও ভালোবাসি।’
‘আর আমাদের ছেলেকে?’
মৌমি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। সে বোকার মতো একবার তার মা’কে আরেকবার লুৎফা বেগমকে দেখে। দিলরুবা বেগমের মুখে চাপা হাসি। মৌমি চেয়ে আছে ফ্যালফ্যাল। লুৎফা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হলো, মা? বলো, আমাদের ছেলেকে তোমার পছন্দ না?’
মৌমি কোনোরকমে হেসে বলল,
‘না মানে, আপনার ছেলেটা এমনিতে ভালোই, খালি মাঝে মাঝে একটু আমার সাথে অযথা ঝগড়া লেগে যায়।’
‘ঐ মাঝে মাঝে একটু ঝগড়া লাগার স্বভাবটা তুমি মানিয়ে নিতে পারবে না, মা?’
মৌমি বুঝতেই পারছে না কিছু। সে জিজ্ঞেস করল,
‘মানিয়ে নিব মানে? আন্টি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘আমার ছেলেটাকে বিয়ে করবে, মা?’
মৌমি হকচকিয়ে উঠে। সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। মায়ের দিকে তাকাল সে। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘তোমার মতামতের উপরেই সব হবে, মৌমি। নীহাল ভীষণ ভালো একজন ছেলে; তুমি যদি বলো, তাহলেই আমি আগাব।’
মৌমি ঢোক গিলল। বলল,
‘আম্মি, আমি তো এমন কিছু ভাবিনি। আর নীহাল ভাইয়াও এসব ভাবেননি হয়তো।’
লুৎফা বেগম বললেন,
‘নীহালের সাথে আমি কথা বলব, মা। তুমি শুধু তোমার পছন্দের অপছন্দের কথাটা বলো।’
মৌমি মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকায়। কী বলবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। সে তো নীহালকে নিয়ে এত গভীর অবধি ভাবেনি কখনো। আবার ছেলেটাকে যে তার অপছন্দ তেমনও না। এবার কী উত্তর দিবে? দুটানায় পড়ল মৌমি। বলল,
‘আন্টি, আপনি আগে উনার সাথে কথা বলুন।’
লুৎফা বেগম বললেন,
‘এমনিতে তোমার পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই তো?’
মাথা নুয়াল মৌমি। বোধ হয় লজ্জার বহিঃপ্রকাশ। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না।’
বলেই এক দৌড়ে সে প্রিয়তার ঘরে চলে আসে। প্রিয়তা ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে কেবল। মৌমিকে ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, মৌমি?’
মৌমি বিছানায় বসল। শ্বাস ফেলল জোরে। মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘কিছু না।’
প্রিয়তা এই “কিছু না” মেনে নিতে পারল না ঠিক। সে এসে বসল মৌমির পাশে। বলল,
‘কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে, কী হয়েছে বলো তো?’
‘না আপু, কিছু হয়নি?’
‘শিওর, কিছু হয়নি?’
মৌমি আরক্ত মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ।’
ভ্রু কুঁচকাল প্রিয়তা। বলল,
‘কী ব্যাপার, এমন লজ্জা পাচ্ছো কেন?’
মৌমি চমকে তাকিয়ে বলে,
‘ক-কই না তো, আমি লজ্জা পাব কেন? তোমার বিয়ে তুমি লজ্জা পাবে, আমি কেন লজ্জা পাব?’
‘সেটা তো তুমিই ভালো জানো। আমি তো স্পষ্ট দেখছি, তোমার গাল দুটো লাল।’
মৌমি দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে খেয়াল করে দেখে ভালো মতো। আসলেই কি গাল লাল তার? কই, সে তো কিছু দেখছে না। সে প্রিয়তার দিকে চেয়ে বলে,
‘কই গাল লাল? মিথ্যে বলছো তুমি?’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘তার মানে আমার সন্দেহ ঠিক, কিছু একটা হয়েছে অবশ্যই। আর সেটা নিশ্চয় গাল লাল করে দেওয়ার মতোই কিছু। এবার আমাকে বলে ফেলো তো, কী হয়েছে?’
মৌমি প্রিয়তার পাশে বসে। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘তোমার থেকে লুকাতে পারব না কিছু।’
‘অবশ্যই না, জলদি বলো।’
মৌমি আবারও একরাশ ব্রীড়ায় আরক্ত হয়। হাত কঁচলাচ্ছে সে। মাথা নুইয়ে রেখেছে। প্রিয়তা চেয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে। তার এত এত লজ্জা পাওয়ার কারণ সে কোনোভাবেই ধরতে পারছে না। তাই অধৈর্য গলায় বলল,
‘বলো না, মৌমি।’
‘বলছি তো। একটু সময় দাও না।’
‘বাবা, এখন সময়ও লাগবে তোমার?’
‘হু, একটুখানি।’
‘আচ্ছা বেশ, একটুখানি সময় নিয়ে জলদি বলো।’
মৌমি আমতা আমতা করে বলল,
‘না মানে আসলে, আন্টি আর আম্মি…মানে উনারা দুজন বলেছেন আরকি।’
‘কী বলেছেন, সেটা তো বলো।’
‘বিয়ের কথা।’
‘কার বিয়ের কথা?’
মৌমি ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
‘আমার আর তোমার ভাইয়ের।’
চলবে…..