#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৩।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই প্রিয়তা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মা’কে। লুৎফা বেগমও শক্ত বাঁধনে মেয়েকে বুকের সাথে মেশালেন। এগিয়ে এলেন দিলরুবা বেগম। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ভেতরে গেলেন সবাইকে নিয়ে।
ড্রয়িং রুমে বসেছে সবাই। দিলরুবা বেগম অনেক নাস্তা এনে রাখলেন। প্রিয়তা বেড়ে বেড়ে দিল সব। লুৎফা বেগম অপলক চোখে চেয়ে ভাবলেন, মেয়েটা তার পুরো-দস্তুর সংসারী হয়ে উঠেছে। খুশি হলেন তিনি খুব। আশেপাশে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘মৌমি কোথাও? ওকে দেখছি না যে?’
দিলরুবা বেগম প্রিয়তাকে বললেন,
‘প্রিয়তা, মৌমিকে নিয়ে এসো তো। মেয়েটার এত লজ্জা! কী আর বলব।’
নীহাল হাসল আঁড়ালে। লুৎফা বেগম বললেন,
‘বিয়ের কথা শুনলে সব মেয়েদের’ই এমন লজ্জা বাড়ে।’
__________
‘কী ব্যাপার, মৌমি? নিচে না গিয়ে রুমে কী করছো? সবাই এসে পড়েছে তো।’
মৌমি তাকাল। চোখ মুখ শুকনো। প্রিয়তা এগিয়ে গেল। উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
‘অসুস্থ তুমি? শরীর খারাপ লাগছে?’
মৌমি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘না।’
‘তবে তোমার চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?’
মাথা নোয়াল মৌমি। বলল,
‘আমি লজ্জা পাচ্ছি।’
প্রিয়তা মাথা চাপড়ে বলল,
‘হায় খোদা! এই মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাব। এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে, মেয়ে? বিয়ে তো সবারই হয়।’
‘কী জানি! আমি এত লজ্জা পাচ্ছি কেন?’
‘নিচে চলো, সব লজ্জা শেষ হয়ে যাবে। ভাইয়া তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তো।’
লজ্জা শেষ হলো না, বাড়ল বরং। মৌমির লাল লাল গাল টেনে দিয়ে প্রিয়তা বলল,
‘আহারে, লজ্জাবতী ননদী আমার। চলুন, আমার ভাইয়ের কষ্ট আর আমার সহ্য হচ্ছে না।’
‘উফ ভাবিজান, তুমিও বেশি বেশি করো।’
‘কয়দিন পর ননদ হব, তখন আরো বেশি বেশি করব। চলো এবার।’
মৌমিকে নিয়ে নিচে নামল প্রিয়তা। নতুন বউয়ের মতো নতজানু মৌমির। নিচে গিয়ে সালাম দিল সবাইকে। লুৎফা বেগম বললেন,
‘আমার পাশে বসো, মা।’
মৌমি লুৎফা বেগমের পাশে বসলেন। লুৎফা বেগম তাকালেন তার দিকে। বললেন,
‘উঁহু, এই মৌমিকে আমার পছন্দ না।’
সবাই চমকে তাকাল। মৌমি আঁতকে উঠল যেন। প্রিয়তা বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলল,
‘মা, কী বলছো এসব?’
‘আমার যে মৌমিকে পছন্দ হয়েছিল ঐ মেয়েটা তো খুব চঞ্চল, প্রাণবন্ত ছিল, ওর মতো চুপচাপ, শান্ত ছিল না। আমার ঐ মৌমিকেই পছন্দ, এই মৌমিকে না।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। দিলরুবা বেগম হাসলেন সেই কথা শুনে। মৌমিও হাসল ঠোঁট চেপে। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘ঐ মৌমি যদি পাস তবে তোর মাথা শেষ হয়ে যাবে, এখন যেমন আছে তেমন নিয়েই খুশি থাক।’
মৌমি মুখ কালো করে বলল,
‘মোটেও না, আম্মি। তুমি বাড়িয়ে বলছো কেন? আমি কি তোমাকে এতই জ্বালায়?’
‘সেই কথা কি আর বলে শেষ করা যাবে? উফফ!’
মৌমি নাক মুখ কুঁচকে প্রিয়তার দিকে চাইল। বলল,
‘ভাবিজান, তুমি বলো তো, আমি কি বেশি জ্বালাই?’
‘মোটেও না। তোমার মতো লক্ষী মেয়ে আর দুটো হয় নাকি।’
‘হ্যাঁ, আম্মি সেটা জীবনেও বুঝবে না। আন্টি (লুৎফা বেগমের দিকে চেয়ে) আপনি একদমই চিন্তা করবেন না, ধরে নিন পৃথিবীর সেরা মেয়েটা আপনার পুত্রবধূ হতে চলছে।’
লুৎফা বেগম হেসে বললেন,
‘ধরতে হবে না, আমি নিশ্চিত।’
সবাই হাসল। মৌমি বলল,
‘দেখেছ আম্মি, আন্টিও আমার মূল্য বোঝেন, খালি তুমি বুঝো না।’
‘হয়েছে হয়েছে, আমাকে আর বুঝতে হবে না। তোমার মূল্য যেমন উনারা বোঝেন, তেমনি তোমাকেও উনাদের সমপরিমাণ মূল্য দিতে হবে। কোনো অভিযোগ যেন আমি কোনোদিন না শুনি।’
লুৎফা বেগম আশ্বস্ত করে বললেন,
‘চিন্তা করিস না রুবা, মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমি, ছেলের বউ না।’
দিলরুবা বেগম খুশি হলেন। বললেন,
‘আমি জানি, তোর কাছে আমার মেয়ে থাকা মানে আমি নিশ্চিন্ত।’
____________
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যার যার মতো রুমে। মৌমির ঘুম আসছে না। উঠে বসল সে। ঘড়িতে দেখল, একটার কাছাকাছি সময়। জেগে থাকলে খিদে লাগে। তারও লাগল। নীহালরা আসার সময় মিষ্টি এনেছে কয়েক প্রকারের। মৌমির এখন মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে। তাই অতশত না ভেবে ঘর থেকে বের হলো সে। আস্তে ধীরে গেল ডাইনিং রুমে। ড্রয়িং রুমটাও লাগানো। পর্দা দিয়ে আলাদা করা শুধু। মৌমি আস্তে করে ফ্রিজ খুলে একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করল। বাহ, মিষ্টি দেখেই খিদা বাড়ল তার। একটা মিষ্টি তুলে মুখে পুরে নিল। অন্য একটা হাতে নিয়ে ঘুরতেই তব্দা খেল সে। খাওয়া রেখে বোকার মতো চেয়ে রইল কেবল। বুকের উপর হাত ভাঁজ করল নীহাল। বলল,
‘মুখেরটা শেষ করুন আগে, তারপর নাহয় আমাকে দেখবেন।’
মৌমি দ্রুত মুখের মিষ্টিটা গিলল। বলল,
‘আপনি? এইসময়, এখানে?’
‘ভাগ্যিস ছিলাম, নয়তো জানতেই পারতাম না এই বাড়িতে এত বড়ো একটা চোর আছে। স্যরি চুন্নী।’
মৌমি তেড়ে এসে বলল,
‘কে চোর? আর কে চুন্নী? এটা আমার বাড়ি, আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমি যখন যা খুশি খাব, আপনার কী? আর আপনি না ঘুমিয়ে এখানে কী করছেন?’
‘পাহারা দিচ্ছিলাম। আর দেখুন, চুন্নীকে পেয়েও গেলাম।’
‘আবার?’
মৌমি ক্ষেপল। নীহাল মজা পাচ্ছে বেশ। বলল,
‘হাতেরটা খান, পড়ে যাচ্ছে।’
মৌমি সেটা প্যাকেটে রেখে দিল। বলল,
‘খাবো না।’
নীহাল এগিয়ে এল। মিষ্টিটা তুলল প্যাকেট থেকে। মৌমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘নিন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
‘উঁহু, খাব না আমি।’
‘রাগ করেছেন বুঝি?’
‘না।’
নীহাল আরেকটু এগিয়ে এল। মৌমির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘মিষ্টি চুরি করেছেন বলে নাহয় চুন্নী বললাম না, কিন্তু মন যে চুরি করে বসে আছেন, সেটার বেলায় কী বলব? চুন্নী বললে এবার নিশ্চয় অন্যায় কিছু হবে না।’
শেষের লাইনটুকু নীহাল এত কাছে এসে বলল যে তার ঠোঁট মৌমির কান ছুঁয়েছে। লজ্জায় অস্বস্তিতে মৌমির মরে যাবার মতো অবস্থা। মৌমি বলল,
‘আমি রুমে যাচ্ছি।’
মৌমি যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নীহাল তার হাত টেনে ধরল। বলল,
‘আমি যেতে বলিনি।’
মৌমি আশেপাশে তাকাল একবার। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘বাড়ির কেউ দেখলে আবার খারাপ ভাববে।’
‘দুদিন পর আমার বউ হতে চলছেন, এখন এইটুকু খারাপে আমার কোনোকিছু যায় আসে না।’
সে মৌমিকে টেনে এনে মিষ্টিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা খেয়ে তারপর যাবেন।’
মৌমি আর বারণ না করে খেয়ে নিল। নীহাল কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘এখন যতটুকু মিষ্টি খাচ্ছেন, বিয়ের পর তার দ্বিগুণ আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।’
এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিষম খায় মৌমি। কাশতে আরম্ভ করে। নীহাল দ্রুত পানি আনে তার জন্য।
‘পানি খান। এইটুকুতে বিষম খায় কেউ।’
মৌমি ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে জোরে নিশ্বাস ফেলল। নীহালের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি ঘুমাতে যান তো। আমাকে খুব জ্বালাচ্ছেন।’
‘আর আপনি যে আমার সব ঘুম নিয়ে বসে আছেন, আমি একবারও অভিযোগ করেছি?’
মৌমি রা হারায়। কী বলবে আর বুঝতে পারে না। নীহাল নিজ থেকেই বলে,
‘থাক আর কষ্ট করতে হবে না, ঘুমান গিয়ে।’
মৌমি মাথা হেলাল। ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই নীহাল বলল,
‘এখন আমার ঘুমগুলো নষ্ট করার শোধ বিয়ের পর তুলব সব।’
মৌমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে হেসে বলল,
‘যান, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️