#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৫।
ফের ঘুরে তাকালেন দিলরুবা বেগম। নিজেকে ধাতস্ত রাখার চেষ্টা চালালেন। কিন্তু এত বছর সামলে রাখা মনটাও যে আজ বেসামাল হয়ে উঠেছে। পুরোনো ক্ষত থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে অনবরত। কী যে এক যন্ত্রণা!
তিনি শান্ত করলেন নিজেকে। গম্ভীর সুরে বললেন,
‘কিন্তু আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই, আহাম্মেদ তাজওয়ার। আপনি এখান থেকে চলে যান।’
আহাম্মেদ তাজওয়ার অসহায় সুরে বললেন,
‘একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না, দিল?’
‘না, কোনো সুযোগ দেওয়া যায় না। নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকলে বেরিয়ে যান এখান থেকে।’
আহাম্মেদ তাজওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন কিছু হবে ভেবে নিয়েই এখানে এসেছিলেন তিনি। কথা বাড়ালেন না আর। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। দরজার কাছে গিয়েও ফিরে তাকালেন আরেকবার। ফারজাদের দিকে। ফারজাদ শক্ত চোয়ালে চেয়ে আছে তাঁর দিকে। অথচ আজ উনার দৃষ্টিতে মায়া, হাহাকার, আর কষ্ট। পুরো বাড়ির দিকে তাকালেন একবার। বাড়িতে মানুষ, সবাই বেশ সেজেগুজে আছে। কোনো অনুষ্ঠান বোধ হয়। একবার খুব করে তাঁর জানতে ইচ্ছে করল, তাঁর ছোট্ট মেয়েটা কোথায়? তাকে একবার কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে যে। কিন্তু আর সাহস করে উঠতে পারলেন না। চলে গেলেন।
প্রিয়তা ফারজাদের দিকে চাইল। তার চোখ মুখ এখনো শক্ত কঠিন। সে জিজ্ঞেস করল,
‘ঐ লোকটা মা’কে কীভাবে চিনেন?’
ফারজাদ প্রিয়তার দিকে তাকাল। প্রিয়তার চোখে মুখে খেলা করছে একগাদা প্রশ্নের রেশ। ফারজাদ বুঝতে পারছে না কী জবাব দিবে। তাকে চুপ দেখে প্রিয়তার দুশ্চিন্তা বাড়ল। মনে পড়ল তার আফসারের কথা। সে বলেছিল, ফারজাদ আর ওয়াদির নামের পদবী এক। তার উপর ওয়াদির বাবা আহাম্মেদ তাজওয়ার দিলরুবা বেগমকে যেভাবে সম্বোধন করলেন, মনে হলো খুব পরিচিত দুজন। তবে কী সম্পর্ক তাঁদের? ফারজাদ কি কিছু আঁড়াল করছে?
প্রিয়তা পুনরায় কিছু বলার আগেই ফারজাদ বলল,
‘আমি জানি না। ঐ লোকটা আমাদের কেউ হয় না। তাই উনার ব্যাপারে কোনো কিছুই আমরা জানি না।
‘
‘কিন্তু, মা’কে যেভাবে ডাকল মনে হলো যেন…’
‘কী মনে হয়েছে, খুব পরিচিত? খুব কাছের কেউ?’
প্রিয়তা মাথা ঝাঁকাল। তার মানে, এটাই মনে হয়েছে তার। ফারজাদ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘না, ঐ লোকটা আমাদের পরিচিত নন। উনার সাথে আমাদের কারোর কোনো সম্পর্ক নেই। উনাকে নিয়ে তোমারও আর ভাবার দরকার নেই।’
ফারজাদ উপরে উঠে গেল। দিলরুবা বেগমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,
‘স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে দেখার দরকার নেই, আম্মি। উনি আমাদের কেউ নন।’
দিলরুবা বেগমের গাল বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়া পানিটা ফারজাদ সযত্নে মুছে দিল। বলল,
‘মৌমির কাছে যান। ভেবে নিন, কিছু হয়নি।’
ফারজাদ নিজের রুমে চলে গেল। দিলরুবা বেগম গেলেন মৌমির ঘরে। নিচে এখনো একরাশ প্রশ্নের ভীড়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। অলিউল সাহেব বললেন,
‘লোকটা তাদের অপরিচিত? কথা শুনে তো মনে হলো না।’
প্রিয়তা বাবার দিকে চাইল। বলল,
‘ভেবো না, বাবা। ফারজাদ আমার থেকে কিছু লুকাবেন না, এমন কিছু হলে উনি অবশ্যই আমাকে জানাতেন।’
_______
‘রুবা, নিচে কী হয়েছিল?’
দিলরুবা বেগম কোনোপ্রকার হেসে বললেন,
‘না, তেমন কিছু না। একজন লোক এসেছিল, তার সাথেই ফারজাদ জোরে কথা বলছিল আরকি। তোরা চল নিচে, পুরুষরা সবাই বেরিয়ে যাবে এখনই। উনারা গেলেই তোরা খেতে বসে যাবি।’
খাবারের পর্ব শেষ করে মৌমি আর নীহালকে নিয়ে ছাদে গেল প্রিয়তা। ছবি তুলবে। সবাই সেখানেই। শুধু ফারজাদ নেই। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘প্রিয়তা, ফারজাদকে ডেকে নিয়ে এসো তো।’
‘জি মা, যাচ্ছি।’
প্রিয়তা নিজের ঘরে গেল। রুমে নেই, ফারজাদকে পেল বারান্দায়। সে পাশে গিয়ে দাঁড়াল তার। জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, ফারজাদ?’
ফারজাদ চমকে তাকাল। বলল,
‘ক-কই কিছু না তো।’
‘ছাদে সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, চলুন।’
‘হ্যাঁ, তুমি যাও। আমি আসছি।’
প্রিয়তা গেল না। একটু কাছে এগিয়ে দাঁড়াল। ফারজাদের এক হাত জড়িয়ে মাথা ঠেকাল বাহুতে। বলল,
‘আমি আপনার জীবনসঙ্গী হওয়ার আগে আপনার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হতে চাই, ফারজাদ। আমাকে কি সেই সুযোগটা দিবেন?’
ফারজাদ নিজের মাথাটা কাত করে প্রিয়তার মাথার সাথে ঠেকাল। বলল,
‘অবশ্যই।’
‘তবে বলুন না, কী লুকাচ্ছেন?’
ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘আমি পারছি না, প্রিয়তা। কথাগুলো সব গলায় এসে আটকে যায়। আমার দম বন্ধ লাগে, কষ্ট হয়।’
‘চেষ্টা করুন, অবশ্যই পারবেন। আমি আছি তো আপনার পাশে।’
ফারজাদ প্রিয়তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘সব জানার পর যদি আর না থাকো?’
‘থাকব, আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।’
ফারজাদ সাহস জুগাল মনে। স্মৃতিগুলো সব তাজা হয়ে উঠল। সেই বিচ্ছেদ, কষ্ট, যন্ত্রণা, বিষাদের দিনগুলো আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। কী নিদারুণ যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছিল তখন। সেগুলো ভোলার নয়। ফারজাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ফোন বেজে উঠে তার। প্রিয়তা গিয়ে ভেতর থেকে ফোনটা নিয়ে আসে। মৌমির কল। ফারজাদ রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মৌমি বলে উঠে,
‘কোথায় ভাইয়া তোমরা? ভাবিজানকে পাঠানো হয়েছে তোমাকে আনতে, এখন সেও উধাও। তোমরা কি ছবি তুলবে না, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে যে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আসছি।’
ফোন কেটে দিয়ে ফারজাদ বলল,
‘মেয়েটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, চলো।’
প্রিয়তা তার হাত টেনে বলল,
‘রাতে বলবেন তো?’
‘হ্যাঁ, বলব।’
তারা ছাদে গেল দুজন। অনেকগুলো ছবি তুলল।
এখন রাত। সবাই যার যার মতো ঘরে। অলিউল সাহেবের চিন্তিত মুখ। লুৎফা বেগম ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তাঁকে দেখে বললেন,
‘কী ব্যাপার, বিকেল থেকেই তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু হয়েছে?’
অলিউল সাহেব তাকালেন স্ত্রীর দিকে। গম্ভীর সুরে বললেন,
‘আজকে নিচে কে এসেছিল জানো?’
‘না তো, কে এসেছিল?’
‘দিলরুবা আপা তোমায় কিছু বলেননি?’
‘না, কেউ একজন এসেছিল বলেছে তবে সে কে সেটা বলেনি।’
‘ওয়াদির বাবা।’
লুৎফা বেগম হতভম্ব হোন। জিজ্ঞেস করেন,
‘ওয়াদির বাবা কেন এসেছিলেন? আমার মেয়েটার কোনো ক্ষতি করেনি তো?’
‘না, উনি প্রিয়তার জন্য না, দিলরুবা আপার সাথে কথা বলতে এসেছিলেন।’
‘বলো কী! রুবার সাথে উনার কী কথা?’
‘সেটাই তো আমি ভাবছি। তার উপর আপা আর ফারজাদের কথা শুনে মনে হলো উনারা পূর্বপরিচিত। প্রিয়তা ফারজাদকে জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু ফারজাদ পরিষ্কার ভাবে কিছু বলেনি।’
লুৎফা বেগমও এবার চিন্তায় পড়লেন। বললেন,
‘তাহলে তো ব্যাপারটা বেশ চিন্তার। কাল সকালেই আমি রুবার সাথে কথা বলব।’
‘হ্যাঁ, দেখো তো কথা বলে কী বলে।’
___________
লাল টুকটুকে মেয়েটাকে মন ভরে দেখছে নীহাল। চারদিক মৌ মৌ করছে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে। লজ্জায় আরক্ত নীহালের নববধূ মৌমি। চোখ তুলে তাকানোর মতো অবস্থাতেও নেই। নীহাল জিজ্ঞেস করল,
‘আর কত লজ্জা পাবে? এবার একটু তাকাও।’
মৌমি মাথা নাড়াল। মানে, তাকাবে না সে। নীহাল হাসল। বলল,
‘তাকাবে না?’
‘উঁহু।’
‘কেন?’
‘লজ্জা লাগছে।’
‘ভাঙিয়ে দেই?’
‘কী?’
‘তোমার লজ্জা।’
মৌমির গাল লাল হলো। নীহাল এগিয়ে এসে চুমু খেল সেই আরক্ত গালে। শ্বাস খিঁচে শক্ত করে বসল মৌমি। নীহাল তার দিকে চেয়ে হেসে বলল,
‘শ্বাস ছাড়ো, মেয়ে। মরতে চাও না-কি?’
শ্বাস ছাড়ল মৌমি। তাকাল নীহালের দিকে। বলল,
‘হ্যাঁ।’
নীহাল হাসল ফের। বলল,
‘চলো তবে, আমার ভালোবাসার বাণে আজ খু ন করি তোমায়।’
মৌমি লজ্জা, সংকোচ আর ভয়ে জবাব দিতে পারল না। তবে অনুভব করল, আজ আকাশ পূর্ণ। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। চমৎকার লাগছে সবকিছু। মনে হচ্ছে, এভাবে সে আরো হাজারবার খু ন হতে পারবে।
চলবে…..