#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৬।
খোলা ছাদের এক প্রান্তে তারা। অন্তরীক্ষের পূর্ণ চাঁদের পানে দৃষ্টি। বাইরে শুনশান নীরবতা। দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে কুকুরের হাহাকার। বাতাসও আছে খানিক। প্রিয়তার উড়ন্ত চুল যে তারই প্রমাণ দিচ্ছে। সে বলল,
‘এবার বলুন, ফারজাদ। আমি সব শুনতে চাই।’
ফারজাদ চাইল। চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আমি তোমার থেকে কিছু লুকাতে চাই না, প্রিয়তা। সত্যিটা আবার বলতেও চাই না। এই স্মৃতি আমাকে বড্ড পোড়ায় যে।’
‘জানেন, দুঃখের কথা অন্যজনের কাছে বললে দুঃখ কমে। আপনি বলুন, মনটা হালকা হবে।’
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল ফারজাদ। আকাশের দিকে চাইল। বলল,
‘ভালোবাসায় আমি বিশ্বাসী ছিলাম না। আম্মির এত এত কষ্ট দেখার পর এই জিনিসটার উপর থেকে আমার বিশ্বাস, ভরসা একেবারেই উঠে গিয়েছিল। তারপর আপনি এসে বদলে দিলেন সব, আমি এখন বিশ্বাস করি, ভরসা করি যে ভালোবাসা সুন্দর। তবে এই সুন্দর ভালোবাসাটাই আমার আম্মির জন্য ছিল বড্ড কুৎসিত, জঘন্য একেবারে। আম্মি আপনার মতো কোনো একজনকে ভালোবেসে সব ছেড়ে পাকিস্তানে এসেছিলেন। এখানে এসে বিয়েও করেছিলেন তাঁকে, তারপর আট বছরের সংসার। হুট করে মানুষটা বদলে গেলেন। কেমন অচেনা হয়ে উঠলেন নিমিষেই। পরে একদিন আম্মি খোঁজ নিয়ে দেখলেন, তিনি আঁড়ালে আরেকটা সংসার পেতেছেন। কী এক জঘন্য যন্ত্রণায় আমার আম্মি কাতরে ছিল আমি দেখেছিলাম সেদিন। এখনো চোখে ভাসে। তারপর শুরু হলো আমাদের বাঁচার লড়াই। আমার আম্মির গর্ভে তখন আমার ছয় মাসের বোন। বাবা বলতে যে মানুষটাকে জানতাম, তিনি আমার আম্মিকে ছেড়ে তখন অন্য নারীতে মত্ত। আমি দেখেছিলাম, আমার মায়ের দুর্বিষহ যন্ত্রণাগুলো। সেই নির্ঘুম রাতের কান্নার শব্দ এখনো কানে বাজে আমার। আমি সেগুলো ভুলতে পারি না। আমি জানি, আম্মিও পারেন না। আমাদের এই লড়াই সহজ ছিল না, প্রিয়তা। আমাকে আর মৌমিকে মানুষ করতে নিদারুণ কষ্টে দিন গড়িয়েছিলেন তিনি। কত কত বেলা নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন, এগুলো ভুলতে পারি না আমি। না ভুলতে পারি ঐ মানুষটাকে যার জন্য আমাদের এই অবস্থা হয়েছিল। ঐ মানুষটাকে আমি ক্ষমা করতে পারব না, কখনোই না।’
চোখে জল জমার আগেই দুই আঙ্গুল দিয়ে চোখ চেপে ধরে ফারজাদ। কাঁদবে না, একেবারেই না। প্রিয়তা তার বাহুতে হাত রেখে বলল,
‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন, ফারজাদ। আমি এটা বিশ্বাস করি। নিশ্চয় ঐ মানুষটাকে মা’র জীবন থেকে কোনো উদ্দেশ্যেই আল্লাহ সরিয়ে নিয়েছিলেন। হয়তো মা’র জন্য ঐ মানুষটা মঙ্গল বয়ে আনতেন না।’
ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘হ্যাঁ, আমিও তাই বিশ্বাস করি। আর আমার কাছে তাই মনে হয় যে, একজন প্রতারককে ভালোবাসার চেয়ে আজীবন ভালোবাসাহীন বেঁচে থাকাই শ্রেয়।’
‘আরেকটা কথা জানতে পারি?’
‘কী জানতে চাও? ঐ মানুষটার পরিচয়?’
প্রিয়তা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল। ফারজাদ অতশত ভাবল না আর। প্রিয়তার থেকে লুকাতে চায় না কিছু। তাই নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,
‘আহাম্মেদ তাজওয়ার।’
প্রিয়তা নির্বাক বনে চেয়ে রইল। তারমানে মনের সুপ্ত ভাবনাটাই সত্যি হলো অবশেষে। সে বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলল,
‘আহাম্মেদ তাজওয়ার? ওয়াদির বাবা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তারমানে কি ওয়াদিকে আপনারা আগে থেকেই চিনতেন?’
‘না না, একদমই তা না। আমার সেই আট বছর বয়সেই আমাদের ফেলে লোকটা চলে গিয়েছিলেন, তারপর আর কখনো আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি। আম্মি অনেকবার চেষ্টা করলেও সফল হোননি কখনো। এতগুলো বছর পর প্রথম আমি উনাকে দেখেছিলাম থানায়। প্রথম পরিচয়ও পেয়েছিলাম সেখানেই। তখনই জানতে পেরেছিলাম, ওয়াদি উনার ছেলে। আর আম্মি হয়তো এই কথা এখনো জানেন না।’
প্রিয়তার মুখটা থমথমে। মনে কী চলছে বোঝা যাচ্ছে না। ঘুরে ফিরে তো তাহলে ফারজাদ আর ওয়াদি ভাই হয়ে যায়। সে অসহায় সুরে বলল,
‘ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখুন, ওয়াদিকে আপনার ভাই বানিয়ে দিল।’
ফারজাদ দুহাতে প্রিয়তার বাহু ধরে বলল,
‘যেখানে আমার জন্মদাতাকে আমি ভুলে বেঁচে আছি, সেখানে উনার ছেলেকে মনে রাখার প্রশ্ন’ই আসে না। ওয়াদি আমার শত্রু বৈ আর কিছুই না। তুমি ওকে যতটা ঘৃণা করো, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি হলেও আমি ওকে ঘৃণা করি।’
প্রিয়তা জবাবে কিছু বলল না। ফারজাদ কাছে টেনে নিল তাকে। জিজ্ঞেস করল,
‘আমাদের ভুল বুঝছো?’
প্রিয়তার চোখ তুলে তাকাল। ফারজাদের চোখে ভয় দেখল সে। কীসের ভয় এটা? প্রিয়তাকে হারানোর ভয়? প্রিয়তা মাথা নাড়াল সঙ্গে সঙ্গে। বলল,
‘না। আপনাদের ভুল বোঝা অসম্ভব।’
ফারজাদ জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। বলল,
‘সত্যি মনটা আজ হালকা লাগছে ভীষণ। মনে হচ্ছে বিশাল এক পাথর নেমে গিয়েছে বুঝি।’
‘আমার থেকে কখনো কিছূ লুকাবেন না, ফারজাদ। পরে অন্য কারোর থেকে শুনলে আমি কষ্ট পাব।’
‘উঁহু, কখনোই না।’
‘চলুন, এবার নিচে যাওয়া যাক।’
‘হ্যাঁ, অনেক হয়েছে চন্দ্রবিলাস। এবার বউবিলাস করতে হবে।’
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কী?’
‘চলুন রুমে, কী এর উত্তর সেখানেই দিব।’
__________
রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন দিলরুবা বেগম। সবাই তখনও ঘুমে। কাল থেকেই মনটা ভালো নেই তাঁর। একে তো মেয়ে বিদায় দিবেন সেটার কষ্ট তার উপর আহাম্মেদ তাজওয়ারের সাথে তাঁর এই অনাকাঙ্খিত সাক্ষাৎ। সব মিলিয়ে মনে বিষন্নতা ভর করেছে বেশ প্রগাঢ় ভাবে। লুৎফা বেগম পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর। দিলরুবা বেগম তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিরে, এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি যে?’
লুৎফা বেগম বললেন,
‘তুই রুটি বেলে দে, আমি সেঁকে দিচ্ছি।’
‘না না, পারব আমি।’
‘পারবি তো জানি, তবে বান্ধবী হিসেবে এইটুকু কাজ আমি করতেই পারি। দে আমাকে।’
দিলরুবা বেগম তর্ক না করে দিলেন তাঁকে। লুৎফা বেগম রুটি সেঁকতে সেঁকতে বললেন,
‘কালকে যে লোকটা এসেছিলেন উনি কে ছিলেন, রুবা? তুই উনাকে চিনিস?’
দিলরুবা বেগম অবাক চোখে চাইলেন। সত্যিটা এখনই বলা উচিত কিনা ভাবছেন তিনি। লুৎফা বেগম ফের বললেন,
‘কিরে রুবা, বল। কে উনি? তোর সাথে কীসের সম্পর্ক?’
দিলরুবা বেগম চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ফেললেন। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা বোধ হয়। বললেন,
‘আহাম্মেদ তাজওয়ার, আমার স্বামী, ফারজাদের বাবা।’
আকাশ থেকে পড়লেন যেন লুৎফা বেগম। চোয়াল ঝুলল উনার। এটা শুনবেন আশা করেননি। তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন,
‘আহাম্মেদ তাজওয়ার তোর স্বামী? কই আগে বলিসনি তো তুই।’
‘লোকটার কথা মনে করতে চাই না আমি। তাই বলা হয়নি। কিন্তু কাল যে সে এভাবে এসে হাজির হবে ভাবতে পারিনি।’
লুৎফা বেগম চিন্তায় পড়লেন। বললেন,
‘তবে তো আমার মেয়ের বিপদ আরো বাড়ল। ফারজাদ প্রিয়তাকে বিয়ে করেছে জানলে তো তিনি প্রিয়তার ক্ষতি করতে চাইবেন।’
‘না, উনি প্রিয়তার ক্ষতি কেন করবেন?’
‘উনার ছেলের হয়ে তো করতেই পারেন।’
দিলরুবা বেগম বুঝলেন না ঠিক। জিজ্ঞেস করলেন,
‘মানে?’
লুৎফা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘তুই কি কিছু জানিস না, রুবা?’
‘না তো, কী জানব?’
‘আহাম্মেদ তাজওয়ার যে ওয়াদির বাবা, এটা তুই জানিস না?’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/