#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৭।
কাজ ফেলে হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছেন দিলরুবা বেগম। এটা কী শুনলেন তিনি! নিজের কানকেই যে বিশ্বাস করা বড্ড দায় হয়ে উঠেছে এবার। তিনি নিশ্বাস ফেললেন জোরে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালালেন। বললেন,
‘তুই ঠিক বলছিস লুৎফা, আহাম্মেদ তাজওয়ার ওয়াদির বাবা?’
‘হ্যাঁ। এই কথাটা তুই আগে জানতি না?’
‘না। আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।’
লুৎফা বেগম হতাশ সুরে বললেন,
‘ফারজাদ জানত নিশ্চয়, হয়তো তোর কষ্টের কথা ভেবেই তোকে আর জানায়নি।’
দিলরুবা বেগম উপর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভাগ্যের খেলা বোঝা দুষ্কর। নয়তো এই লোকটাকেই ওয়াদির বাবা হতে হলো। তিনি অস্ফুট সুরে বললেন,
‘একটা জঘন্য ছেলে জন্ম দিয়েছেন তিনি, ছি!’
লুৎফা বেগম তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘শিক্ষার কি বিস্তর তফাত দেখেছিস, রুবা। একদিকে তৈরি হয়েছে একটা জানোয়ার আর অন্যদিকে তৈরি হয়েছে একটা খাটি সোনা।’
তিনি ঘুরে তাকালেন। চোখ ছলছল করছে তাঁর। বললেন,
‘একদিন থানা থেকে এসে ফারজাদ খুব রাগ দেখিয়েছিল, হয়তো এই জন্যই। বারবার বলছিল, কেন আমি তার নামের পদবীটা বদলালাম না। আজ বুঝতে পারছি, সেদিনের তার এত রাগ আর অভিমানের কারণ।’
‘থাক, ওসব ভাবিস না। সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এতগুলো বছর কাটিয়েছিস এত কষ্ট করে, এখন তোর সুখের দিন। ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে খুশির দিন কাটা, এটাই চাই। পুরোনো কথা ভেবে আর কষ্ট পাস না।’
দিলরুবা বেগম আঁচলে মুখ মুছে শক্ত গলায় বললেন,
‘উঁহু, কষ্ট পাব না। এখন আমার আনন্দের দিন। বাকি যে কয়দিন বাঁচব, আনন্দ করে বাঁচব।’
লুৎফা বেগম খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। দিলরুবা বেগম বললেন,
‘চিন্তা করিস না, আমাদের জীবন থাকতে আমরা প্রিয়তার কিছু হতে দিব না।’
‘না, করছি না। তোরা আছিস, এইটুকুতেই আমি নিশ্চিন্ত।’
____________
গোসল সেরে বেরিয়েছে মৌমি। বিছানার কাছটাই এসে ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার ঘুমন্ত স্বামীর মুখপানে। চোখ মুখের ভাব এমন যে সে তার প্রতি ভীষণ বিরক্ত। লোকটার এই আরামের ঘুম দেখে মারাত্মক গা জ্বালা হচ্ছে তার। সারারাত তার ঘুম নষ্ট করে সে এখন দিব্যি নাক ডেকে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। মৌমি কপট রাগ দেখিয়ে এগিয়ে গেল নীহালের দিকে। তার মুখের উপর নিজের ভেজা চুলগুলো ধরল। টপটপ করে পড়া পানিতে চোখ পিটপিট করে উঠল নীহাল। তাও চোখ খুলল না। মৌমি চুলগুলো আরো কাছে ধরল। চোখে মুখ ভিজছে তার চুলের পানিতে। নীহাল বিরক্ত। মুখ থেকে বিরক্ত সূচক শব্দ উচ্চারণ করল। মৌমি এতে মজা পেল বেশ। আরেকটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আমার ঘুম নষ্ট করার শাস্তি এটা। অসভ্য লোক, আর কত ঘুমাবেন?’
নীহাল চোখ মেলল। সরে এল মৌমি। নীহাল ঘুম ঘুম সুরে বলল,
‘তোমার জ্বালায় কাল সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। এখন একটু ঘুমিয়েছি, তাও আবার জ্বালাচ্ছো। এত পাষাণ হলে কী করে হবে?’
মৌমি বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলল,
‘এই মিথ্যুক, কে কাকে জ্বালিয়েছে? খবরদার মিথ্যে বলবেন না।’
উপুড় হয়ে শু’লো নীহাল। চোখের পাতা বুজে বলল,
‘মিথ্যে কোথায় বললাম? তুমিই তো জ্বালিয়েছ, তুমি যে এত দুষ্টু আগে বলোনি তো।’
মৌমি দু’হাতে মুখ চেপে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে। কী সাংঘাতিক কথাবার্তা। না, এখন আর কথা বাড়ানো যাবে না। পরে তাকেই উল্টো আরো লজ্জায় পড়তে হবে। সে উঠে দাঁড়াল তাই। বলল,
‘আজে বাজে কথা না বলে উঠুন এবার, আমি নিচে যাচ্ছি।’
‘তোমার দুষ্টুমির রেশ যে এখনো কাটছে না বউ, কীভাবে উঠব?’
মৌমির কান গরম হয়ে উঠে। সে দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে বলে,
‘আপনি মারাত্মক অসভ্য, নীহাল। আমি আপনাকে ভদ্র ছেলে ভেবেছিলাম।’
‘আশ্চর্য, বউয়ের সাথে অসভ্যতামো দেখাব না তো কার সাথে দেখাব।’
‘উফ, আপনি কথা কম বলে উঠুন তো। আমি নিচে গেলাম।’
মৌমি চলে গেল রুম থেকে। নীহাল প্রস্তুতি নিল আরেক চোট ঘুমিয়ে উঠার জন্য।
________________
রুমে ঢুকেই বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল ওয়াদি। কারাগারের চার দেয়ালের ভ্যাঁপসা গন্ধে এতদিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তার জীবন। নিজের রুমে ফিরে আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তাই। চোখ বুজল। ভেসে উঠল প্রিয়তার মুখ। চোয়াল শক্ত করল সে। আর একবার ঐ মেয়েটাকে পেলেই তার হয়। সাথে ঐ ফারজাদকেও, ওদের নিজের হাতে খু ন না করা অবধি ক্ষান্ত হবে না সে। কাকে একটা যেন কল লাগাল। কল রিসিভ হতেই জিজ্ঞেস করল,
‘খোঁজ পেয়েছিস কোনো?’
‘না ভাই, এখনো পাইনি।’
‘আর দুদিন সময় দিলাম, এর মাঝে কোনো খবর দিতে না পারলে আমি দুনিয়া থেকে তোর খবর মুছে দিব।’
ওপাশ থেকে ভীত সুরে জবাব এল,
‘জি জি ভাই, দুদিনের ভেতর’ই আমি খবর দিচ্ছি।’
ফোন কাটল ওয়াদি। মনে মনে পরিকল্পনা করল, ঠিক কীভাবে তার শত্রুদের দমন করবে। এর মাঝেই তার ঘরে আসেন আহাম্মেদ তাজওয়ার। বললেন,
‘তো এখন কী করার পরিকল্পনা করছো?’
ওয়াদি ডানে বামে ঘাড় কাত করে হাসল। হাসিটা আপাতত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও এর অর্থ মোটেও স্বাভাবিক নয়। সে বলল,
‘ভাবছি ব্যবসা করব।’
‘নারী ব্যবসা?’
শব্দ করে হাসল ওয়াদি। বলল,
‘করতেও পারি।’
‘খবরদার, একই ভুল যেন দ্বিতীয়বার না হয়।’
‘হবে না। তোমার অফিসেই জয়েন করব।’
‘বেশ, কাল থেকেই করো তবে।’
‘না না, কাল থেকে না। এক সপ্তাহ পর থেকে।’
‘কেন? এই এক সপ্তাহ কী করবে?’
‘রেস্ট নিব একটু। জেলে পড়ে থেকে শরীর হাত পা ম্যাচম্যাচ করছে সব। এগুলো একটু ঠিকঠাক হোক, তারপর জয়েন করব।’
‘ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝো। তবে সাবধান, ফারজাদ বা প্রিয়তার কথা আর মাথাতেও আনবে না। যা হয়েছে সব ভুলে গিয়ে সবকিছু নতুন ভাবে শুরু করো।’
আহাম্মেদ তাজওয়ার এই বলে চলে যাচ্ছিলেন। ওয়াদি প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ফারজাদ কি তোমার কেউ হয়, আব্বু?’
থমকে দাঁড়ালেন আহাম্মেদ তাজওয়ার। ছেলের দিকে চেয়ে ছোট্ট ঢোক গিললেন। ওয়াদি চেয়ে আছে তীক্ষ্ণ চোখে। আহাম্মেদ তাজওয়ার বললেন,
‘হঠাৎ এমন কেন মনে হলো তোমার?’
‘ওর প্রতি যেন কেমন একটা মায়া দেখাচ্ছ তুমি। ব্যাপারটা চিন্তার বেশ।’
‘এসব উদ্ভট চিন্তা বাদ দিয়ে কাজের কাজ করো কিছু।’
‘তারমানে তুমি বলতে চাইছো, ফারজাদ তোমার কেউ হয় না?’
‘না।’
স্পষ্ট বক্তব্য আহাম্মেদ তাজওয়ারের। ওয়াদি হেসে বলল,
‘যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।’
আহাম্মেদ তাজওয়ার বেরিয়ে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই ওয়াদি কাকে একটা যেন কল দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি বলেছিলে, আমার বাবার আগেও একটা বিয়ে করেছিলেন, তার আগের বউয়ের কোনো খোঁজ আছে তোমার কাছে?’
ওপাশের ব্যক্তির উত্তর শোনা গেল না। তবে ওয়াদি বলল,
‘আমার লাগবে, কাকা। অন্তত নাম, ঠিকানা কিছু একটা তো বলো।’
‘ ….’
‘নাম কী…দিলরুবা। উনার আগের স্ত্রীর নাম?’
‘…..’
‘আর ছেলে মেয়ে কারোর খবর জানো না?’
‘…..’
‘একটা ছেলে আছে, শুধু এইটুকুই জানো? আচ্ছা রাখো তবে।’
ফোন কাটল ওয়াদি। মনে মনে ভাবল, “বাপের আগের বউয়ের খোঁজটা এবার একটু নিতে হয়, অন্তত তাঁর ছেলেটাকে দেখার জন্য হলেও।”
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️