#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৪।
মৌমির কবুল বলার পালা। মেয়েটার শরীর কাঁপছে। প্রিয়তার হাতটা ধরে আছে শক্ত করে। চোখ টলমল জল। কিঞ্চিৎ খোলা ঠোঁটে মৃদু কম্পন। প্রিয়তা ধীর সুরে বলল,
‘মৌমি, কবুল বলো।’
মৌমি বলতে চাইছে, পারছে না। কী একটা যেন আটকে আছে গলায়। একটু তাকাল পাশে। মা’কে খোঁজার চেষ্টা। কিন্তু মা তো এখানে নেই। চাদরের ওপাশ থেকে কাজী সাহেব উর্দূতে বললেন,
‘কবলু বলো, মা।’
বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলছে মৌমি। এই যে কালকেও যে মেয়েটা লজ্জায় লাল হচ্ছিল আজকে সে ভয়ে কুপোকাত। তাও চেষ্টা চালাল। বলতে তো হবে। ঠোঁট নাড়িয়ে অতি ক্ষীণ সুরে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল।’
তারপর বলল আরো দুবার। ব্যস, বিয়ে সম্পন্ন। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল “আলহামদুলিল্লাহ”। প্রিয়তা খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরল মৌমিকে। মৌমি নিশ্বাস ফেলল জোরে। এই ছোট্ট একটা শব্দ বলতে গিয়ে দম যেন আটকে আসছিল তার। পুরুষ লোকরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই লুৎফা বেগম আর দিলরুবা বেগম সেই ঘরে এলেন। মা’কে দেখে জড়িয়ে ধরল মৌমি। কেঁদে ফেলল। দিলরুবা বেগম সংযত করলেন নিজেকে। কাঁদবেন না, একটুও না। আজ যে তাঁর খুশির দিন।
________
বেশ অনেকক্ষণ যাবত গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন লোকটা। তার ভাবমূর্তি দেখে বোঝার জো নেই তার ভেতরে কী চলছে। হাতের দিকে চেয়ে দেখলেন, হাতযুগল ঘামা। কপালেও ঘাম। পকেট থেকে রুমালটা বের করে মুছে নিলেন। এতগুলো বছর নিজেকে দমিয়ে রাখলেও আজ যেন পারছেন না। একবার ভেতরে যেতে বড্ড অস্থির হচ্ছে মন। জানেন, তিরস্কার ছাড়া আর কিছুই পাবেন না, তাও আজ একবার যাবেন’ই।
মনের সাথে বিশাল যুদ্ধ থামিয়ে পা রাখলেন গেইটের ভেতরে। এগিয়ে গেলেন ত্রস্ত পায়ে। বাড়ির ঠিক মেইন দরজার সামনে গিয়ে থামলেন। বাইরে জুতা বেশ। খানিকটা এগোতেই দেখলেন, বসার ঘরে বেশ কয়জন লোক। তিনি কাউকে চেনেন না। অস্বস্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল এবার। তাও ভেতরে প্রবেশ করলেন তিনি। একটু এগিয়ে এসে সোফার কাছটায় দাঁড়ালেন। কাউকে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই সিঁড়ির দিকে চোখ গেল তার। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা মেয়েটাকে তার চেনা লাগল খুব। তিনি চেয়ে রইলেন ভ্রু কুঁচকে। সিঁড়ির শেষ অংশে এসে থমকে দাঁড়াল প্রিয়তা। সোফার কাছটায় দাঁড়ান লোকটাকে তার চিনতে সময় নিল না এক সেকেন্ডও। চমকাল সে, ভীতও হলো। রাগে ফুঁসে উঠে বলল,
‘আপনি এখানে?’
এতক্ষণে মনে পড়ল তার। এই মেয়েটাই তো সেই মেয়েটা, যার জন্য এত কাহিনী। কিন্তু এই মেয়ে তো বাংলাদেশে চলে গিয়েছিল, তবে এখন এখানে কী করছে? এতসব প্রশ্নের ভীড়ে প্রিয়তার করার প্রশ্নের উত্তর দিতে বেমালুম ভুলে বসলেন তিনি। প্রিয়তা উত্তর না পেয়ে ক্ষিপ্ত হলো। সে বলল,
‘কী হলো, কথা বলছেন না কেন? এখানে কেন এসেছেন আপনি?’
ঐ রুমে প্রিয়তার বাবাও ছিলেন। তিনি উঠে এসে প্রিয়তার পাশে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘কে উনি প্রিয়তা?’
প্রিয়তা নিজের রাগকে সংযত করে বলল,
‘ওয়াদির বাবা।’
অলিউল সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন,
‘উনি এখানে কী করছেন?’
‘সেটাই তো জানতে চাইছি আমি। কিন্তু দেখো, উনার মুখে কোনো রা নেই।’
আহাম্মেদ তাজওয়ার জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এখানে এসে যে এই মেয়ের মুখোমুখি হবেন, তিনি সেটা ভাবেননি। এখন আর বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না তাই। প্রিয়তা বলল,
‘আশ্চর্য! আপনি কথা বলছেন না কেন?’
তাও লোকটার মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে সে এবার ফারজাদকে ডাকতে আরম্ভ করল।
‘ফারজাদ, ফারজাদ।’
ফারজাদ মৌমির রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ির কাছে আসতেই পা থেমে যায় তার। শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠে। কপালের রগ ফুলে উঠে সঙ্গে সঙ্গে। দ্রুত নেমে আসে সে। বাজখাঁই সুরে বলে উঠে,
‘এই লোকটা এখানে কী করছে?’
প্রিয়তা বলল,
‘আমিও তো তাই জানতে চাইছি, কিন্তু উত্তর দিচ্ছেন না।’
ফারজাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। লোকটাকে দেখলেই পুরোনো সব স্মৃতি তাজা হয়ে উঠে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে,
‘কী চাই আপনার এখানে?’
আহাম্মেদ তাজওয়ার কিছুটা সাহস করলেন। কম্পিত সুরে বললেন,
‘ন না মানে, একবার দেখা করতে এসেছিলাম।’
‘দেখা? আপনি এই বাড়িতে কার সাথে দেখা করতে এসেছেন আহাম্মেদ তাজওয়ার? এই বাড়িতে আপনার কে থাকে?’
আহাম্মেদ তাজওয়ারের কন্ঠস্বর কাঁপছে। তার ছেলে, তার প্রথম সন্তান, কী বজ্রকন্ঠে জবাব চাইছে তার কাছে। তাকে চুপ দেখে আরো ক্ষেপল ফারজাদ। বলল,
‘চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন, কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?’
আহাম্মেদ তাজওয়ার মাথা নোয়ালেন। বললেন,
‘তোমাদের সাথে।’
ফারজাদ রাগে দুহাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিল। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল তা শুনে। আহাম্মেদ তাজওয়ার ফারজাদদের সাথে কেন দেখা করতে আসবেন? তাদের কোনো ক্ষতি করতে? ফারজাদ বলল,
‘এক্ষুনি বেরিয়ে যান। দ্বিতীয়বার আর এই বাড়িতে পা রাখার সাহস দেখাবেন না।’
আহাম্মেদ তাজওয়ার অসহায় চোখে এদিক ওদিক দেখছেন। তার দুচোখ যে অন্য কাউকে খুঁজছে। কোথায় সে? কেন এসে তার সামনে দেখা দিচ্ছে না?
‘কী হলো? শুনতে পাননি আপনি? বেরিয়ে যেতে বললাম তো।’
ফারজাদের চেঁচানোর শব্দ মৌমির ঘর অব্দি গেল। সেই রুমেই ছিল সবাই। নীহাল বলে উঠল,
‘ফারজাদের গলা না? এত জোরে কার সাথে কথা বলছেন?’
দিলরুবা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, তাই তো। দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি।’
দিলরুবা বেগম সিঁড়ির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী ব্যাপার ফারজাদ, এত জোরে…’
বাকি কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না তিনি। মনে হলো যেন, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। চোখের পলক পড়ছে না। আদৌ ঠিক দেখছেন তো? ফারজাদ মায়ের দিকে তাকাল। ঢোক গিলল। সে কখনোই চাইনি, এই লোকটি আবার মায়ের চোখে পড়ুক। দিলরুবা বেগমের শরীর যেন জমে গিয়েছে। কথা বের হচ্ছে না কোনো। শুধু কম্পিত সুরে এইটুকু বললেন,
‘উনি এখানে কী করছেন, ফারজাদ?’
ফারজাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আম্মি, আপনি ভেতরে যান। আমি দেখছি।’
দিলরুবা বেগম ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আহাম্মেদ তাজওয়ার ডাকলেন তাঁকে।
‘দিল!’
মনে হলো কেউ যেন একটা ধারাল ছুড়ি দিয়ে বক্ষচ্ছেদ করেছে তাঁর। বুকের ভেতরটা তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। এই লোকটা তার শাশুড়িকে “দিল” বলে ডাকছেন কেন? তারা কি পূর্ব পরিচিত?
আহাম্মেদ তাজওয়ার আকুতির সুরে বলল,
‘দিলরুবা, আমার তোমার সাথে একটু কথা আছে।’
‘না, আম্মির সাথে আপনার কোনো কথা থাকতে পারে না। আপনি চলে যান এখান থেকে।’
‘আমাকে দুই মিনিট সময় দাও, বাবা।’
ফারজাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘একদমই না। দুই মিনিট কেন, আপনাকে আমি দুই সেকেন্ডও দিব না। বের হোন এক্ষুনি।’
‘ফারজাদ, আমি…’
‘খবরদার আহাম্মেদ তাজওয়ার, নিজের সীমা অতিক্রম করবেন না। আমার আচরণ খারাপ হবার আগে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।’
দিলরুবা বেগম পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছেন। এতদিন, এতগুলো বছর পর অপ্রিয় মানুষের সেই প্রিয় মুখটা দেখে তার বড্ভ যন্ত্রণা হচ্ছে যে। নিচ থেকে আহাম্মেদ তাজওয়ার ফের বললেন,
‘আমাকে দুটো মিনিট সময় দাও, দিল। কথা দিচ্ছি, আর কখনো তোমার সামনে আসব না।’
চলবে …..