#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৮।
এক মেয়ে বিদায় দিয়ে আরেক মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যাবেন লুৎফা বেগম। সকাল থেকে তার’ই আয়োজন চলমান। ফ্লাইট বিকেলে। একটু পর’ই বেরুবে তারা। মৌমির মন খারাপ। দিলরুবা বেগমেরও। ফারজাদের’টা বোঝা যাচ্ছে না। ছেলে মানুষ, মুখ দেখে মন বোঝা দায়।
নীহাল খুশি, বউ নিয়ে নিজ দেশে ফিরছে যে। বারান্দায় মৌমির কাছে গিয়ে বলল,
‘আর কিছু নিতে হবে না?’
মাথা ঝাঁকাল সে। নীহাল ঘাড় কাত করে চেয়ে বলল,
‘মন খারাপ?’
উপর নিচ মাথা নাড়াল সে। বোঝাল, মন খারাপ। নীহাল বলল,
‘আমরা আসব তো আবার।’
‘আম্মি, ভাইয়া আর ভাবিজানকে অনেক মিস করব।’
‘এখানেই থেকে যেতে চাও?’
‘না, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি’ই মেয়েদের আপন।’
নীহাল হাসল। বলল,
‘বাহ, বেশ বুঝো দেখছি।’
‘হ্যাঁ তবে, কষ্ট হচ্ছে।’
‘আমি আছি না, সব কষ্ট উবে যাবে, দেখো।’
মৌমি তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আমাকে ভালোবাসেন?’
নীহাল এক পল সময় নিয়ে বলল,
‘উঁহু, একটুও না।’
‘তবে বিয়ে করলেন কেন?’
‘মা বলেছেন, তাই।’
মৌমি সামনে চাইল। বলল,
‘আপনি মোটেও মিথ্যে বলতে জানেন না।’
নীহাল রেলিং এ হেলান দিল। হাত ভাঁজ করল বুকের উপর। বলল,
‘তা কেন মনে হলো?’
মৌমি হাসল। বলল,
‘আমি সব বুঝি?’
‘কী বুঝো?’
‘বলব না আপনাকে।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
____________
ফারজাদ অফিস থেকে দ্রুত ফিরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যাবে সবাই। রুমে এসে দেখল প্রিয়তা বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, প্রিয়তা?’
প্রিয়তা বিষন্ন সুরে বলল,
‘মৌমি চলে গেলে আমার খুব একা লাগবে। ওকে মিস করব খুব।’
ফারজাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। সেও করবে। ছোট বেলা থেকে এত যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে যেই মেয়েটাকে বড়ো করেছে আজ তাকে বিদায় দিতে হবে। এই মুহুর্তটা মোটেও সুখকর নয় তার জন্য। কষ্ট পেলেও কিঞ্চিৎ হাসল সে। বলল,
‘তোমার বাড়িতেই যাচ্ছে। যখন খুশি দেখতে পারবে।’
প্রিয়তার ঠোঁটে হাসি ফুটল। বলল,
‘এটা ভেবেই খুশি আমি। জানেন, আমি প্রথম থেকেই চেয়েছিলাম, মৌমি যেন আমার ভাইয়ের বউ হয়। এমন মিষ্টি মেয়ে আর হয় না-কি।’
ফারজাদ হেসে বলল,
‘ওর মতো দুষ্টু মেয়েও আর হয় না।’
‘একটু দুষ্টুমি করলে কিছু হয় না। আপনি ওকে বেশি শাসন করেন, আপনাকে ও ভয় পায়।’
‘আম্মি ওকে তেমন শাসন করেন না। আমিও যদি ছাড় দিতাম তবে বিগড়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল। ও আমার কাছে আমার সন্তান, সন্তানদের ভালোবাসার সাথে শাসনও করতে হয়।’
‘হু, তা ঠিক। আচ্ছা আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। ওরা একটু পর’ই বেরিয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা।’
ফারজাদ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেল। আর প্রিয়তা গেল তার মা বাবার ঘরে।
‘আসব?’
‘প্রিয়তা, আয় মা।’
ঘরে প্রবেশ করল প্রিয়তা। ওর মা ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে পাশে রেখেছেন। মন খারাপ হলো প্রিয়তার। সেদিনও তো তাঁদের আসার খবরে কত খুশি হয়েছিল সে। আর আজ চলে যাচ্ছে। দিন কত তাড়াতাড়ি যায়। সে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। বলে,
‘তোমাদের খুব মিস করব, মা।’
লুৎফা বেগম তার গালে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আমরাও। ফারজাদ ছুটি পেলেই চলে যাবি।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শোন, রুবার মনে একটুও কষ্ট দিবি না। ও কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে। মনে রাখবি আমি তোর কাছে যা, রুবাও তাই। ও তোর শাশুড়ি না, তোর আরেক মা। মনে থাকবে?’
‘থাকবে।’
‘ফারজাদের সাথেও উঁচু গলায় কথা বলবি না কখনো। কোনো কারণে ভুল বোঝাবুঝি হলে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবি। মনে রাখিস, রেগে গেলেই শয়তান জিতে যাবে। আর শয়তান জিতে যাওয়া মানেই সম্পর্ক নষ্ট হওয়া। আমার মেয়েটার উপর আমার ভরসা আছে। আমি জানি, ও সব সামলে নিবে।’
‘আচ্ছা।’
লুৎফা বেগম প্রিয়তার দুই হাত জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
‘হার মানবি না কখনো। অন্যায়ের সামনে আপোষ করবি না। লড়াই করে যাবি প্রতিটা মুহুর্তে। আর আমি জানি, ফারজাদ আর রুবা যেখানে আছে সেখানে আমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেউ তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
‘আমিও তাই বিশ্বাস করি, মা। উনারা আমার ঢাল, আমার একমাত্র আশ্রয়। তুমি ভয় পেও না, তোমার মেয়ে ঠিক সামলে নিবে সবকিছু।’
লুৎফা বেগম খুশি হয়ে চুমু খেলেন মেয়ের কপালে। ওয়াশরুমে থেকে তখন বেরিয়ে এলেন অলিউল সাহেব। মেয়েকে দেখে তার পাশে বসলেন। বললেন,
‘আমরা চলে গেলে একদম মন খারাপ করবে না। তুমি তোমার মতো করে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবে। মা বাবার দোয়া আর ভালোবাসা সবসময় পাশে আছে তোমার।’
প্রিয়তা বাবার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা বাবা। তুমিও নিজের খেয়াল রাখবে। মায়ের কথা শুনবে সব, বুঝেছো?’
তিনি হাসলেন। বললেন,
‘আচ্ছা শুনব।’
__________
মৌমি কাঁদছে। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে বাইরে। ফারজাদ যাবে এয়ারপোর্ট অবধি। দিলরুবা বেগম সংযত করে রেখেছেন নিজেকে। তাঁকে কাঁদতে দেখলে মৌমি আরো বেশি কষ্ট পাবে। প্রিয়তা একহাতে মৌমিকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
‘কেঁদো না। একটা চমৎকার ভবিষ্যত তোমার অপেক্ষায়।’
মৌমি তার দিকে চেয়ে বলল,
‘কিন্তু আমার তো কান্না পাচ্ছে, কী করব?’
‘বেশি কান্না পাচ্ছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘একটু করে কেঁদে ফেল তবে, মন হালকা হবে।’
মৌমি ঠোঁট উল্টে বলল,
‘আমি তোমাদের মিস করব।’
‘আমরাও, অনেক বেশি।’
ফারজাদ তাড়া দিল গাড়িতে উঠতে। মৌমি ছুটে গেল মায়ের কাছে। বলল,
‘আম্মি, চলে যাচ্ছি।’
মনটা তীব্র ব্যথায় সংকুচিত হলো দিলরুবা বেগমের। তাও চোখে প্রকাশ পেল না সেই অভিব্যক্তি। কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,
‘যাও মা, একটা বিশাল দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত। আমি জানি, তুমি পারবে।’
‘যদি ভুল হয়ে যায় কোনো?’
‘ঐ যে আরেক মা, ক্ষমা করে শিখিয়ে দিবেন সব। ভয় পেও না, কাউকে কষ্ট দিও না। নিজেকে ভালো রেখো, সাথে সবাইকেও।’
‘আচ্ছা।’
‘চোখের পানি মুছে, গাড়িতে গিয়ে বসো।’
মৌমি তাই করল। সবাই বসল একে একে। চলতে শুরু করল গাড়ি। হাত বাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে মৌমি। দিলরুবা বেগমের ছলছল চোখ। যতই বলুক, কাঁদবেন না, মেয়ের বিদায়ে বুঝি কোনো মায়ের চোখ শুকনো থাকে?
প্রিয়তা দিলরুবা বেগমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল,
‘মা, চিন্তা করবেন না, মৌমির ঐ বাড়িতে কোনো কষ্ট হবে না।’
‘সেই চিন্তা আমি করছি না, প্রিয়তা। আমি লুৎফাকে চিনি। আমি জানি, আমার মেয়ের সুখের কমতি হবে না কোনো। তাও মায়ের মন, মেয়ের বিদায়ে ছটফট ঠিকই করে।’
প্রিয়তা মৃদু হেসে বলল,
‘এই যে, আরেক মেয়ে আছে না?’
দিলরুবা বেগম তার দিকে তাকালেন। হাসলেন। বললেন,
‘তাই তো, মেয়ে যে আরেকটা আমার কাছেই আছে।’
প্রিয়তা জড়িয়ে ধরল তাঁকে। বলল,
‘আপনার মতো শাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর আমার এই ভাগ্যে কারোর নজর না লাগুক।’
‘লাগবে না, ইনশাল্লাহ।’
বাসায় ফিরল ফারজাদ। মনটা ঠিকঠাক নেই। বসার ঘরে দিলরুবা বেগমের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উপরে এল সে। দিলরুবা বেগম তখন প্রিয়তাকেও উপরে যেতে বললেন। রুমে এল প্রিয়তা। ফারজাদ বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। প্রিয়তা তার পাশে বসল গিয়ে। বলল,
‘মন খারাপ?’
‘মৌমি যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল খুব।’
‘সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছে তো, তাই এত কষ্ট। আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ফারজাদ প্রিয়তার দিকে চাইল। উদ্বিগ্ন সুরে বলল,
‘নীহাল নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে। কিন্তু আমার বোনটাকে ভালোবাসবে তো?’
‘ভালোবাসবে না, ভালোবাসে। আমি ভাইয়ার চোখে মৌমির জন্য ভালোবাসা আরো আগেই দেখেছি। আপনি ভরসা রাখুন, মৌমিকে ভাইয়া ভালো রাখবে।’
ফারজাদ বলল,
‘অঢেল ভরসা আছে। আমি জানি, এই ভরসা সারাজীবন অটুট থাকবে।’
চলবে…..