অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ #অবন্তিকা_তৃপ্তি #পর্ব_২৭

0
378

#অ্যারেঞ্জ_ম্যারেজ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#পর্ব_২৭

শুভ্র তুলির বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল আসর পর বিয়ে। তুলিদের বিল্ডিং পুরোটাই সাজানো হয়েছে বাতি, সদর গেইট ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। জামাই আসবে এ বাড়ি। একটা আলাদা সৌন্দর্য্য তো দেখানো লাগবে নিজেদের। সন্ধ্যার পর চা খেয়ে ইয়াজিদ তখন রুমে বসে আগামীকালের খরচের হিসাব করছেন। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল: ‘বাবা, আসবো?’

ইয়াজিদ চোখ তুলে তাকালেন। মেয়েকে দেখে বললেন: ‘আসো, ভেতরে আসো।’

তুলি হেঁটে ভেতরে ঢুকলো। বাবার পাশে বিছানায় বসে বাবার দিকে চেয়ে বললো: ‘ডেকেছিলে? মা বললো!’

ইয়াজিদ তুলিকে দেখেন। তুলির গা থেকে আজ হলুদ-পারফিউম সব মিলিয়ে সুন্দর একটা বউ বউ গন্ধ আসছে। মুখটা লাগছে যেন আস্ত এক চাঁদের টুকরো। বিয়ের ফুল ফুটলে সব মেয়েদেরই বোধহয় চেহারায় সৌন্দর্য্য বাড়ে। ইয়াজিদের আবারও মনে পড়ে যাচ্ছে- মেয়ে তার চলে যাবে কাল পরের বাড়ি। এতদিন মেয়েকে পরের বাড়ি দেননি,কাল দিতে হবে। তারপর- তারপর এই ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে, ঠিক ইয়াজিদের বুকটার মতো। ইয়াজিদের বুকে কিছু যেন একটা দলা পাকাতে চাইছে। কষ্ট নাকি মেয়ে বিয়ে দেওয়ার যন্ত্রণা? ইয়াজিদ একটু কাশলেন। তুলি উৎসুক চোখে বাবার দিকে চেয়ে আছে। ইয়াজিদ কথা তুললেন- ‘ভালো লাগছে তোমার? কাল তো বিয়ে। ব্যাগ গুছিয়েছো?’

তুলি বাবার এমন প্রশ্নে আহ্লাদ দেখল। তুলি জবাব দিল- ‘মা গুছিয়ে দিয়েছেন। এখান থেকে বেশি কিছু নিয়ে যেতে শুভ্র স্যার মানা করেছেন! জরুরি জিনিস নিয়েছি শুধু।’

ইয়াজিদ চশমাটা এবার চোখে তুললেন। বললেন- ‘শুভ্র? শুভ্র তোমার স্বামী ছিল এতদিন। কাল থেকে ও ঘরে যাবে, ও ঘরে সংসার হবে তোমার। তুমি খুশি? আমাদের সিদ্ধান্তে তুমি কখনো এত বছরে আফসোস করেছো? বলো আমাকে।’

তুলি বুঝতে পারলো মূলত ইয়াজিদ কেন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। শুভ্রদের সম্পকে জানতে। উৎকণ্ঠায় ভুগছেন ইয়াজিদ। তুলি হালকা হাসলো। বাবার দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বললো- ‘তোমাদের সিদ্ধান্তটা ভালো ছিলো বাবা। হয়তো আমি নিজে কাউকে পছন্দ করলে শুভ্র স্যারের মতো বর বা তার পরিবারের মতো পরিবার পেতাম না। আমার জীবনটাকে এভাবে সুন্দর করে গুছিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ বাবা।’

ইয়াজিদ মেয়েকে দেখলেন। তুলির চোখেমুখে খুশি ঝলমলাচ্ছে। ইয়াজিদ মনেমনে বাবা হিসেবে প্রচণ্ড খুশি অনুভব করলেন। খুশিটুকু লুকিয়ে তাড়া দেখিয়ে হিসাবের খাতাটা হাতে নিয়ে বললেন- ‘আচ্ছা যাও এখন। তোমার আম্মুকে পাঠিয়ে দিয়ো একবার। কথা আছে।’

তুলি বাবাকে দেখে। বাবাদের বোধহয় সন্তানদের পাশে কান্না করা মানায় না। হোক সেটা খুশির কান্না!
___________________
শুভ্র আজ শেরওয়ানি পড়েছে। সাদা রঙের শেরওয়ানি। গলার কাছটায় কারুকাজ করা, হাতের মধ্যে সিলভার রঙের কারুকাজ করা। শুভ্রর মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দিলেন আফরোজা। তারপর শুভ্রর ঘাড়ে নজর ফোঁটা দিয়ে বললেন- ‘হাজার বছর বেঁচে থাকুক আমার শুভ্র। কারো নজর না লাগুক।’

পাশ থেকে আরিফ টিপ্পনী কেটে বললো- ‘কাকিমা, নজর তো লেগে গেছে শুভ্রর। তার বউয়ের।’

আফরোজা বাচ্চাদের এসব পাগলামি কথায় হেসে চলে গেলেন। শুভ্র আরিফের হাতে থাপ্পড় বসিয়ে বললো- ‘আম্মুর সামনেও তোর মুখ কা/চির মতো চলে। মহুরে বলা লাগবে।’

ফারহান হাসল। আরিফ বললো- ‘আর মহু? একটা বাচ্চাই আমাকে মহুর থেকে আলাদা করে দিয়েছে। রাতেও পাইনা, দিনেও পাইনা। তার মধ্যে আরেকট আসছে। বাচ্চা নিলে মেয়েদের যে হারে মুড সুইং হয় ভাই. . যদি জানতি। দেখবি ছোট থেকে ছোট কথায় হয় কাঁদে, নয় মার বসায় নয়, বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তোর ভোলাভালা বউও এমনি করবে দেখিস।’

শুভ্র হাসল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাগড়ি ঠিক করতে করতে বললো- ‘বাচ্চা আসলে আমার বউর সাত খুন মাফ। একটা বেবী ক্যারি করার জন্যে তাকে হাজারবার কাঁদার, মারার অনুমতি দেওয়া হল। শুধু বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে না, আমার বাড়ি বসে বসে রাগ মেটাক. ., ভাঙ্গুক যা ইচ্ছা।’

ফারহান এবার হা হুতাশ করে বলল- ‘শুভ্র রে, আরিফ দুই বাচ্চার বাপ হতে যাচ্ছে। আমিও বাপ হয়ে গেলাম। পিছিয়ে গেলি তুই। বিয়ে করে জলদি জলদি আমাদের সঙ্গে কম্পিটিশনে লাগ, বুঝলি?’

শুভ্র হাসলো, কিছু বললো না। একটা বাচ্চা! একটা বাচ্চার আবদারই করবে সে আজ তুলির কাছে। একবার করবে, বারবার করবে। বত্রিশ বছর হয়ে গেলো, মামা. . কাকা, দুলাভাই সব ডাক শুনল। এবার একটা বাবা ডাক শোনা লাগবে। শুভ্র তুলিকে বলবে- তুলির কিছু করা লাগবে না। শুধু বেবি ক্যারি করবে, পৃথিবীতে আনবে, আর দুধটুকু খাওয়াবে। বাচ্চার বাকী দেখাশোনা শুভ্র একাই করবে। শুভ্রর দম আছে এখনো . .. বুঝিয়ে দিবে মিসেস প্রত্যাশা হোসেন তুলিকে।
_________________
তুলি শুভ্রর আর তার টেক্সট দেখছে। লাস্ট মেসেজ এসেছিল আধা ঘণ্টা আগে। শুভ্র পাঠিয়েছে-
‘রেডি হয়ে ছবি দিয়ো।’

তুলি উত্তর করেছে- ‘একবারে এসে দেখে নিন বউকে।’

তুলি রেডি তো হয়েছেই। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি, সোনালি রঙের গহনা, অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করছে শুভ্রর পরিয়ে দেওয়া স্বর্ণের আংটি, হাতে শুভ্রর দেওয়া বালার সঙ্গে ডজন চুরি পড়েছে। ইয়াসমিন বালা দুটো আজকের জন্যে খুলে রাখতে চেয়েছিলেন। তুলি দেয়নি। শুভ্রর দেওয়া দ্বিতীয় উপহার, যা তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। এটা দিয়েই শুভ্র প্রথম তুলিকে ভালোবাসি বলেছিল। তুলির স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বালা দুটোতে।

শুভ্রর পাল্টা মেসেজ- ‘আমিও তাহলে ছবি দিব না। একবারে কবুল পরে দেখা দিচ্ছি।’

তুলি হাসলো। পাগল এখনো! তুলি স্ক্রল করে তাদের পূরনো মেসেজ পড়তে থাকে। এরপর তো আর মেসেজে কথা খুব কম হবে। ও ঘরে সংসার পাতবে তুলি, যা কথা বলাই সামনাসামনিই হবে। তুলি মেসেজগুলো আবারও পড়ছে, লাজুক হাসছে বারবার।

‘বর এসেছে, বর এসেছে’
সাজসাজ রব পড়ে গেলো তুলিদের বাড়ি। তুলি উঠে দৌঁড়ে গিয়েও আটকে গেল। বর আসার দৃশ্য নাকি বউদের দেখতে নেই, নজর লাগে। তুলি হেসে আবারও বসে গেলো বিছানায়। বুকটা লাফাচ্ছে খুব। শুভ্র এসেছে. . তুলির বর এসেছে?

শুভ্রকে বরণ করা হলো। ওপাশ থেকে টাকা চাওয়া হলো পঞ্চাশ হাজার। বেচার শুভ্র পড়েছে ফ্যাসাদে। বউর কাছে যেতেও পঞ্চাশ হাজার, তারপর আবার কাজিনগুলো হুমকি দিয়েছে বাসর রাতে নাকি টাকা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। ওহ গড! শুভ্র কী করবে? দিল টাকাটা। টাকা পেয়ে হৈ হল্লোর চললো কিছুসময়। শুভ্রকে ঘরে ঢুকানো হলো। ঘরেই স্টেজ করা হয়েছে ছোটখাটো। শুভ্রকে প্রথমেই মিষ্টি খাওয়ানো হলো। শুভ্রর সুগার কম খায় ইদানীং। তবুও মিষ্টি খেল। আফরোজা বলেছেন এটা নাকি নিয়ম।
শুভ্র উসখুস করছে: তুলিকে এরা কখন এনে পাশে বসাবে। আধা ঘণ্টা তো কাটল!

আরো দশ মিনিট পর তুলি এলো। এক পাশে ইয়াসমিন, অপর কাঁধ ধরে আছে অন্য এক মেয়ে। হাঁটার তালে তুলির শাড়ির কুচি দুলছে। শাড়ির আঁচলটা সম্পূর্ণ কারুকাজ কড়া, ঝুলে আছে একপাশে। শুভ্রর জানামতে তুলি ওই হেঁটে আসা তার দেখা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য! এই দৃশ্যে শুভ্রর যেকোনো সময় মিনি হার্ট অ্যাটাক হলেও হতে পারে। তুলি ধীর পায়ে এগিয়ে এলো, শুভ্রর পাশে বসানো হলো তাকে। শুভ্র তুলিকে একবার দেখেই চোখ সরিয়ে নিলো, বড়রা পাশে। তুলির ক্লাসমেটরা এগিয়ে এসে তুলি শুভ্রকে মিষ্টি খাওয়াল। তারা শুভ্রর সঙ্গে তেমন কিছু মজা করলো না। তবে তুলির কানেকানে বলে গেলো- ‘একরোখা স্যারের সঙ্গে প্রথম বাসরটা কেমন কাটে জানাইস।’

তুলি মাথা নিচু করে হাসে। এদের কে বলবে; তাদের এই একরোখা , রাগী, মেজাজি স্যার একাকী রুমে বড্ড রসিক আর- আর রোমান্টিক! ভেবে তুলি হাসলো।

প্রিন্সিপাল এলেন এবার। শুভ্র তুলিকে মিষ্টি খাইয়ে দোয়া দিলেন। তুলির দিকে চেয়ে বললেন- ‘শুভ্র কিন্তু দু বছর আমাদের থেকে বিয়ের কথা লুকিয়েছে। বুঝিনা. . বিয়ে আল্লাহর মর্জি। যার সঙ্গে যার জোর তার সঙ্গে তার বিয়ে। আমি খুশি হয়েছি তোমাদের বিয়েতে। খুব ভালো থাকো।’

তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করলো। প্রিন্সিপাল শুভ্রর দিকে চেয়ে বললেন- ‘বিয়ের কথা আমাদের থেকে লুকিয়ে ঠিক করো নি শুভ্র। তোমার আগামী সাত দিনের ছুটি ক্যানসেল করা হলো। সামনের মাসের পনেরো দিনের ছুটিও ক্যানসেল।’

শুভ্র হাসলো। লজ্জিত গলায় তারপর বলল- ‘সরি স্যার।’

প্রিন্সিপাল হু হা করে হাসলেন। শুভ্রর কাঁধে হাত রেখে বললেন- ‘আই ওয়াজ কিডিং ইয়াং ম্যান। ছুটি পাবে তুমি, জমিয়ে নিজের বিবাহিত লাইফ এনজয় কর। গুড লাক।’

তুলি স্যার যেতেই জিজ্ঞেস করলো- ‘সামনের মাসে আবার পনেরো দিনের ছুটি কেন?’
শুভ্র তুলির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল-‘ফর হানিমুন!’

তুলি কিছুক্ষণ শুভ্রকে হা হয়ে দেখে পরপরই লজ্জায় মাথা নিচু করলো। এই শিশু ডক্টর একদম লাগাম ছুট হয়েছে। যাতা বলে শুধু!

এবার কবুল বলার পালা। কবুল বলা হবে শুধু বিয়েতে ছবি তোলার জন্য। আকদনামা তো আগেই হয়ে আছে। কবুল বলার মুহূর্তে তুলির ঘোমটায় আড়াল করা মুখের দিকে শুভ্র তাকাল। তুলির আড়চোখে শুভ্রর দিকেই চেয়ে ছিলো। শুভ্র তুলির দিকে চেয়ে ভুবন ভোলানো এক হাসি দিল, তুলির বুক বরাবরের মতো ধ্বক্ উঠল। চোখ সরিয়ে নিল তুলি।

কাজী তুলিকে বললেন-
‘বলো মা কবুল।’

তুলি একনজর শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র ভীষন উৎসুক চোখে তুলিকে দেখছে। তুলি শুভ্রর ওই মুখটার দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বললো- ‘কবুল, কবুল, কবুল।’

শুভ্র মুগ্ধ চোখে তুলিকে দেখলো। প্রথমবার কবুল বলার সময় তুলির কণ্ঠে জড়তা ছিলো। এ আজ- আজ তুলির কণ্ঠে আছে আত্মবিশ্বাস। আছে শুভ্রর প্রতি অগাধ ভালোবাসা!

শুভ্রকে কবুল বলতে বলা হল। শুভ্র তুলির দিকে চেয়ে হালকা আওয়াজে বলে দিলো- ‘কবুল, কবুল, কবুল।’

‘আলহামদুলিল্লাহ’ পুরো ঘরময় হৈ-হল্লোর লেগে গেলো একপ্রকার। তুলিকে শুভ্রর পাশে বসানো হল। আয়না আনা হলো। আয়নায় তুলির মুখ দেখিয়ে শুভ্রকে জিজ্ঞেস করা হল- ‘বলো তো কাকে দেখা যাচ্ছে?’

শুভ্র হালকা হেসে জবাব দিল- ‘আমার অর্ধাঙ্গিকে।’

সবাই ‘হো, হো’ বলে উঠল। তুলিকে শুভ্রর মুখ আয়নায় দেখানো হলো,’কাকে দেখা যাচ্ছে’ জিজ্ঞেস করা হল। তুলি লাজুক গলায় শুভ্রর মুখটা এবার দেখে মাথা নিচু করে বললো- ‘আমার ভয়ংকর শিশু ডক্টরকে।’

শুভ্র লজ্জা পেয়ে তুলির দিকে তাকালো।তুলি লজ্জায় ফিরে তাকালো না শুভ্রর দিকে।

অতঃপর মহা সমারোহে হাসিখুশি ভাবে সম্পন্ন হল পেডিয়াট্রিক ডাক্তার উমায়ের হোসেন শুভ্র এবং সদ্য ডাক্তার প্রত্যাশা হোসেন তুলির।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here