#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭৯।
গ্রীষ্মের ভ্যাঁপসা গরম। চারদিক রোদে খা খা করছে যেন। সূর্যটা দুপুরের আগেই চড়াও হয়ে উঠে আজকাল। নিজের এসি কক্ষে বসে বেশ আরামে পা দুপাচ্ছে ওয়াদি। ঠোঁটের কোণে ক্রূর হাসি। চোখ তার হাতের ছবিটার দিকে। একহাতে ছবি ধরে অন্য হাতে ছবির মধ্যকার মানুষটার মুখে হাত বুলাল সে। মেকি অভিমানের সুরে বলল,
‘বিয়ে করে ফেললে? আর আমাকে একবার জানালেও না?’
ওয়াদি হাসল আবার। ছবিটা মুচড়ে ধরল হাতের মুঠোয়। চোয়াল শক্ত করল। কঠিন সুরে বলল,
‘ফারজাদকে বিয়ে করে খুব সুখে আছো, তাই না? আমিও দেখি, তোমার এই সুখ ঠিক কতদিন সয়।’
________________
অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছে ফারজাদ। প্রিয়তা শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা খান, ভালো লাগবে।’
ফারজাদ বসল বিছানায়। শার্টের প্রথম দুই বোতাম খুলে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল,
‘উঁহু, খাব না।’
‘কেন?’
‘সেই প্রথম রাতেই বলেছিলাম, আমাকে “তুমি” করে বলবে। অথচ তোমার মাঝে এখনো কোনো বদল নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, “তুমি” করে বলা না অবধি আমি তোমার কোনো কথা’ই শুনব না।’
প্রিয়তা হাসল ঠোঁট চেপে। বলল,
‘আচ্ছা বলব, এবার খেয়ে নিন।’
‘আবার?’
ফারজাদের বীতঃস্পৃহ সুর। প্রিয়তা হেসে বলল,
‘খেয়ে নাও।’
খুশি হলো ফারজাদ। শরবতটুকু খেয়ে আরামবোধ করল সে। বলল,
‘ভাবছি কাল ছুটির দিনে একটু ঘুরতে যাব, তোমাকে আর মা’কে নিয়ে।’
প্রিয়তা আগ্রহ দেখিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, চলুন না, অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না।’
‘না, যাব না। প্ল্যান ক্যান্সেল।’
প্রিয়তা কিছু বলতে গিয়ে থামল। পরে মুচকি হেসে বলল,
‘চলো, অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না।’
ফারজাদ মাথা নাড়াল। বলল,
‘বেশ, কাল সকাল সকাল’ই বের হব তবে। সারাদিন ঘুরে, দুপুরে খেয়ে দেয়ে একেবারে বাসায় ফিরব। আম্মিকে জানিয়ে দিও।’
‘আচ্ছা।’
_________________
ফোনের ওপাশে মৌমি হাসতে হাসতে কুপোকাত। নীহালের চেঁচানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রিয়তা বুঝতে পারছে না, হয়েছে’টা কী। সে অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল,
‘এবার কি হাসি থামিয়ে একটু বলবে, কী হয়েছে?’
মৌমি শ্বাস টানল জোরে। হাসি তার থামছে না। তাও থামাল। বলল,
‘জানো, আজ কী হয়েছে?’
‘তুমি না বললে কীভাবে জানব শুনি?’
‘আমি না আজ তোমার ভাইয়ের একেবারে ন্যাং টা একটা ছবি দেখেছি।’
নীহাল ধমক দিয়ে বলে উঠে,
‘তো দেখেছ বলে কি, এটা এখন মাইকিং করে জানাতে হবে সবাইকে?’
‘হ্যাঁ, জানাতে হবে। এত চমৎকার একটা ব্যাপার, না জানালে হয়?’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘কোথায় দেখেছ এই ছবি?’
‘একটা পুরোনো অ্যালবামে। আমাকে তো দেখতে দিচ্ছিল না, আমি জোর করে দেখেছি। এত বড়ো ছেলে এভাবে ন্যা…’
বাকি কথা শেষ করার আগেই নীহাল তার কাছ থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নেয়। কানে লাগিয়ে বলে উঠে,
‘তুই তো আরেকটা ফাজিল, এই অসভ্য মেয়েটার কথা শুনছিস।’
‘কোথায় শুনতে পারলাম, তুমি তো তার আগেই নিয়ে নিলে।’
‘ফোন রাখ।’
‘না না, আমার কথা আছে তো।’
মৌমি বলে উঠল। নীহাল চেতে বলল,
‘তুমি আর একটা কথাও বলবে না। মা বাবার আদরে বেশি বাঁদর হয়েছ।’
‘আমি কী করেছি?’
‘কী করোনি সেটা বলো, অসভ্য মেয়ে।’
‘ভাইয়া, মৌমিকে একদম বকবে না।’
‘না বকব না, আদর করব। ফোনটা রাখ।’
‘ছি অসভ্য, এটা আবার বোনকে বলছোও।’
প্রিয়তা হেসে ফেলল মৌমির কথায়। নীহাল মাথা চাপড়ে বলল,
‘আহ মাবুদ, এ আমি কাকে নিয়ে সংসার করছি।’
‘দশটা না পাঁচটা না, আমার একমাত্র কিউট ননদিনীকে নিয়ে।’
‘তুই ফোন রাখবি, প্রিয়?’
ভাইয়ের ধমক শুনে জলদি ফোন কাটল প্রিয়তা। নীহাল ফোনটা বিছানার উপর ফেলল। মৌমি চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। নীহালের ভাবমূর্তি বোঝার চেষ্টা করছে। নীহাল তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলল,
‘এই মেয়ে, এত বড়ো ছেলে দিয়ে কী বোঝাতে চাও তুমি? ঐটা আমার সাত বছরের ছবি, এত বড়ো ছেলে কোথায় পেয়েছ?’
মৌমি বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলে,
‘সাত বছরের ছেলে বড়ো না? আল্লাহ!’
নীহাল নিশ্বাস ফেলল জোরে। বলল,
‘বড়ো হোক ছোট হোক, তাই বলে কি সবাইকে বলে বেড়াতে হবে? আমার একটা প্রাইভেসি আছে না?’
‘বউয়ের কাছে আবার কীসের প্রাইভেসি?’
নীহাল হতাশ হয়ে বসল। এই মেয়েকে বোঝানো তার পক্ষে সম্ভব না। সে আশা ছেড়ে বলল,
‘হ্যাঁ, তোমার যা খুশি তুমি তাই করো, আমি আর কিছু বলব না।’
মৌমি উত্তেজিত সুরে বলল,
‘তাহলে ছবিটা আমার স্টোরিতে দিয়ে আপনাকে মেনশন দেই?’
‘হুয়াট!’
চেঁচিয়ে উঠল নীহাল। মৌমি হেসে ফেলল। বলল,
‘আরেহ ভয় পাবেন না, মজা করছিলাম।’
নীহাল অধৈর্য হয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল বিছানায়। মৌমিও হাসতে হাসতে তার পাশে শু’লো। মাথা রাখল তার বুকে। বলল,
‘আমি কোনোদিন হারিয়ে গেলে আমার এই বাঁদরামিগুলো’ই তো আপনার মনে পড়বে। তখন আমার কথা ভাববেন আর হাসবেন।’
নীহাল শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মৌমিকে। বলল,
‘কোথাও হারাতে দিচ্ছি না।’
মৌমি চোখ বুজে জোরে শ্বাস টেনে নীহাল গায়ের ঘ্রাণ নিল। বলল,
‘এভাবে বেঁধে রাখতে পারবেন তো।’
‘হ্যাঁ, নিজের সবটুকু দিয়ে আটকে রাখব তোমায়।’
‘আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি, নীহাল।’
‘আমিও।’
‘কী?’
‘ভালোবাসি?’
‘কাকে?’
‘আমার এই বাঁদর বউকে।’
মৌমি তার বুকে মুখ লুকিয়ে হাসল।
_______________
পরদিন বেশ সকাল সকাল’ই তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল সবাই। ফারজাদের পছন্দমতো একটা সুতি শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে প্রিয়তা। ফারজাদের পরিয়ে দেওয়া ছোট্ট কালো তিলটা তার কপালের মধ্যখানে জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটে কিঞ্চিৎ রঙের ছোঁয়া। চুলগুলো বেণী করা। ফারজাদ পরী দেখেনি। দেখলে হয়তো প্রিয়তাকে কেবল “পরী” বলে প্রশংসা করত না, আরো বেশি কিছু বলতো।
____________
‘কোথায়?’
‘একটা রিসোর্টে।’
‘রিসোর্টের ঠিকানা আমাকে এক্ষুনি টেক্সট কর।’
‘জ্বি, ভাই।’
______________
গাছ থেকে টকটকে লাল জবাটা পেরে এনে প্রিয়তার কানে গুঁজে দিল ফারজাদ। প্রিয়তার মুখে লাজুক হাসি। ফারজাদের বিস্তর প্রচেষ্টা প্রিয়তার এই এত এত লজ্জা ভাঙাতে পারিনি এখনো। ফারজাদ ফোন বের করে বলল,
‘দাঁড়াও এখানে, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।’
প্রিয়তা দাঁড়াল। তার ব্যক্তিগত আলোকচিত্ৰকর সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো ছবি তুলে দিল তার। দূর থেকে একটা জায়গায় বসে এসবই দেখছেন দিলরুবা বেগম। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি তাঁর। অবশেষে ছেলের সুখ দেখতে পাচ্ছেন তিনি। মনে মনে খুব করে দোয়া করলেন, ‘ছেলে মেয়ে দুটো এভাবেই ভালো থাকুক আজীবন।’
কোনো একটা জরুরি কলে ফারজাদ একটু দূরে গিয়ে কথা বলছে। দিলরুবা বেগম বসে আছেন আগের জায়গায়। প্রিয়তা এসেই দেখেছিল, এখানে একপাশে দোলনা আছে। দিলরুবা বেগমকে বলে তাই সেখানেই আসে সে। দোলনায় বসে। দোল খায় আপন মনে। মৃদুমন্দ বাতাস তখন। প্রিয়তা চোখ বুজে নেয়। হঠাৎই খেয়াল করে দোলনাটা থেমে গিয়েছে। সে চোখ মেলে তাকায়। সামনে কেউ নেই। আচমকা ঘাড়ের উপর টের পায় কারোর তপ্ত নিশ্বাস। সে ভেবে নেয়, হয়তো ফারজাদ। কিন্তু না। ভুল ভেঙে যায় অযাচিত এক কন্ঠস্বর শুনে।
‘কেমন আছো, প্রিয়তা?’
পিলে চমকে উঠে প্রিয়তার। চট করে উঠে দাঁড়ায়। পেছন ঘুরে উপস্থিত মানুষটাকে দেখে দু কদম পিছিয়ে যায় সে। কাঁপাকাঁপা সুরে বলে,
‘ত-তুমি? তুমি এখানে?’
চলবে……