#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৮
ইফাদ রিতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল অনেকটা সময়। রিতুর বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলেও নিজেকে শক্ত রাখল। বাচ্চামো করল না একদম। না চাইলেও ইফাদকে যেতে দিতে হবে। আটকে রাখার নিয়ম নেই। রিতু যখন অশ্রু লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ইফাদ তখন ম্লান গলায় বলল,
— আমি যে কেন হায়ার স্টাডিজের ডিসিশনটা নিয়েছিলাম! তুমি আমাকে কাছে টেনে আবারও দূরে সরিয়ে দিচ্ছো। খুব নিষ্ঠুরতা করছো আমার সাথে।
ইফাদের কথা শুনে রিতুর মন আরো খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে কৌতুক সুরে বলল,
— নিষ্ঠুরতা মনে হলে তা-ই! কয়েক বছরেরই তো ব্যাপার। আপনি এমন একটা ভাব করছেন যেন আর কখনো দেখা হবে না আমাদের।
— কিন্তু এ সময়গুলো তো আর ফিরে আসবে না।
রিতু ইফাদের খারাপ লাগাটা অনুভব করার চেষ্টা করল। বছর হতে চলল ইফাদ দেশ ছাড়া। এতগুলো দিন পরে মাত্র এক মাস সে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছে। যারমধ্যে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে ওদের মান-অভিমান চালাচালিতে। এখন আবারও বছর কয়েকের জন্য আলাদা হওয়া। সময় নিজ গতিতে চলছে। আসলেই এ সময়গুলো আর ফিরে আসবে না। চাইলেও না। এরজন্য
ওর ও কম কষ্ট হচ্ছে না! রিতু আবেগী হয়ে ওর
গালে হাত রেখে বলল,
— আমাকে আবার ভুলে যাবেন না তো ওখানকার সুন্দরীদের দেখে?
এটুকু বলতেই ইফাদ ত্বরিত রেগে গেল,
— মানে সিরিয়াসলি? আমাকে তোমার এমন মেন্টালিটির ছেলে মনে হয়?
রিতুর ঘোর কেটে গেল। থতমত খেল। প্রসঙ্গ বদলের প্রয়োজন অনুভব করল সে৷ শীতল গলায় বলল,
— মজা করছিলাম। অহেতুক রেগে যান।
— তুমি লজিকলেস কথাবার্তা বলছো, আমার তাতে রাগ হবে না? আশ্চর্য!
রিতু ভার গলায় বলল,
— আচ্ছা আর বলব না।
— অপেক্ষা করবে…
— করব।
— করবে?
— সন্দেহ আছে?
ইফাদ দ্বিধান্বিত হয়ে বলল,
— নেই বলব না!
রিতু ইফাদের বরাবর মুখ নামিয়ে আনল। এরপর
ভ্রু কুঁচকে বলল,
— আচ্ছা, এত সন্দেহ? কী নিয়ে?
— পুরো তুমিটাকেই নিয়ে। এখন আমাকে যেতে বলছো। হয়তো দেখা যাবে, একটু পরই মত বদলে ফেলবে!
রিতু গোমড়া মুখে বলল,
— আর বদলাবে না। এটা ফাইনাল ডিসিশন।
রিতু কথা শুনে ইফাদ ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
বুকের ভেতর শূন্য অনুভূতি। এই মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে ওর ভীষণ কষ্ট হবে। যতই অবহেলা করুক রিতু, কেন যেন ওর কাছে এলেই ইফাদ গলে পানি হয়ে যায়। ও শক্ত করে আগলে নিল রিতুকে। আর মাত্র দুটো দিন। এরপর চাইলেও ছুঁতে পারবে না মেয়েটাকে।
.
জানালার কাচ খোলা। সেখান দিয়েই কনকনে ঠান্ডা বাতাস এসে ঘরটাকে পুরো শীতল করে দিয়েছে। ইফাদের ঘুম ভেঙে গেল। উঠতে গিয়ে টের পেল রিতু ওর বুকের নিচে পিষ্ট হয়ে আছে। খোলা চুলগুলো মুখের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। দেখতে কমবয়েসী মেয়েদের মতো লাগছে। অবশ্য রিতুর বয়স বেশি নয়। ঊনিশ-বিশের আশেপাশে। ইফাদ আনমনে হেসে ফেলল। দু’জনের বয়সের তফাৎটা কি আসলেই বেশি? হলে হোক! ভাগ্যে লেখা ছিল বলেই তো হয়েছে। স্বস্তির বিষয় এটাই যে ও কোনো নাবালিকাকে বিয়ে করেনি। ইফাদ ঘুম থেকে ডেকে তুলতে গিয়েও ডাকলো না রিতুকে। ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে জানালাটা আটকে দিলো ইফাদ। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। বাকি রাতটা বেশ ঠান্ডা লাগবে ভেবেই আলমারি থেকে পাতলা কম্বল নিয়ে ফিরে এল সে। রিতুকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতেই ও অন্যপাশে ফিরে গুটিশুটি মেরে ঘুমে মজে গেল। ইফাদ মৃদু হাসল।
বাকি রাতটুকুতে আর ঘুম নামলো না চোখে। বৃষ্টির জোরালো শব্দে বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইল রিতুর মুখখানিতে। ভোরের দিকে ঘুম আলগা হয়ে যেতেই রিতু চোখ ঢলে দেখল ইফাদ ওর শিয়রে বসে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে। কোলের উপর বন্ধ ল্যাপটপ। পাশে একটা বই। রিতু হকচকিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
— আপনি এভাবে বসে আছেন কেন?
ইফাদ ফিরে তাকাল। উত্তরে বলল,
— উঠলে কেন? ঘুমাও।
— আপনি পুরো রাত ঘুমান নি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
রাত জাগতে নেই। শরীর খারাপ করবে।
— রাত জাগিনি…
রিতু হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ইফাদ হতভম্ব।
ঘাবড়ে গেল খানিকটা। কোলের উপর থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে রেখে বিচলিত স্বরে বলল,
— হঠাৎ কী হলো?
রিতু ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল,
— আপনি এমন অনিয়ম করেন ওখানে তাইনা? সেজন্যই আপনার এই দশা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে ফিরেছেন…
ইফাদ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। হ্যাঁ, মাঝখানে শরীর একটু ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেটা রিকভার করে নিয়েছে। দেশে ফিরেছে সম্পূর্ণ ফিট হয়েই। মোটেও শুকিয়ে কাঠ হয়ে নয়।
এই রিতুটাও মায়ের চরিত্র ধারণ করেছে। ‘ক’ কে ‘কলকাতা’ বুঝছে। ইফাদ মৃদু ধমক দিল,
— এরজন্য কাঁদার কী আছে?
— আমার কান্না পাচ্ছে। কী করব?
ইফাদ ওর কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগলো।
রিতু ভড়কে গেল। এভাবে হাসার মতো কিছু বলেছে নাকি? রাগ হচ্ছে ওর। রিতু গাল ফুলিয়ে শুয়ে পড়ল আবার। ইফাদ ওর ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল,
— আই মিস ইউ সো মাচ জান…
.
ইফাদের ফ্লাইট রাত নয়টায়। সেজন্য ও খুব ব্যস্ত। গোছগাছ করতে করতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। ইফাদ খেতে গেল। রিতুকে অনেক জোর করেও নিতে পারেনি। ওর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। তাই মাথাব্যথা আর ঘুমের বাহানা দিয়ে ঘরেই রইল। রিতু ঘরে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদছে। কান্নার দরুণ ওর শরীর কাঁপছে। রিতু প্রাণপণে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কান্না থামাতে পারছে না। কি করে পারবে? ইফাদকে তো ও খুব ভালোবাসে। ওকে তো যেতে দিতেই চায় না। তবুও যেতে দিতে হচ্ছে। মুখফুটে শুধু বলতে পারছে না। দু’জনের মধ্যে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে, গভীরভাবে মিশে গেছে। এখন কীভাবে থাকবে? কষ্টে রিতুর ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সে ম’রে যাবে।
ঘন্টাখানিক পর ইফাদ ঘরে ফিরে দেখল রিতু আগের মতোই শুয়ে আছে। রিতু ঘুমাচ্ছে ভেবে ওকে না ডেকে ফ্রেশ হতে গেল। এদিকে রিতু ইফাদের উপস্থিতি টের পেয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রইল। তড়িঘড়ি করে উঠে চোখমুখ মুছল। ওড়না গায়ে চাপিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইল। একটু পর ইফাদ বেরিয়ে এলো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। রিতুকে একপলক দেখে নিয়ে এরপর জিজ্ঞেস করল,
— মাথাব্যথা কমেছে? ঘুম ভালো হয়েছে?
রিতু মাথা নাড়লো। মুখে কিছু বলল না। গলা শুনলেই ইফাদ বুঝে যাবে ও এতক্ষণ কেঁদেছে। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। এদিকে ইফাদ জবাব না পেয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল। এরপর তোয়ালেটা রেখে রিতুর কাছে এসে বসল। ওর গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
— হয়েছে কান্না? নাকি আরও বাকি আছে?
রিতু চট করে ওর দিকে তাকাল। ইফাদ কি করে বুঝলো ও এতক্ষণ কেঁদেছে? রিতুর চোখ টলমল করছে। ওকে এভাবে দেখে ইফাদ নরম গলায় বলল,
— এভাবে কাঁদবে না। আমি কষ্ট পাব৷ নিজেই যেতে বলেছো।
রিতু জল মুছে নিল। ইফাদের বুকে মাথা রেখে বলল,
— আমাকে প্রতিদিন ফোন দেবেন। আর অন্য
মেয়েদের দিকে একদম তাকাবেন না।
ইফাদ ওর কথা শুনে হেসে ফেলল। রিতু ওকে হাসতে দেখে রেগে ওর বুকে কিল-ঘুষি দিতে থাকল। ইফাদের বেশ লাগল। ওর হাত দুটো ধরে আটকাল। ব্যথায় জর্জরিত মুখ নিয়ে বলল,
— এতক্ষণ যার জন্য এত কান্নাকাটি করছিলে তাকে এভাবে আঘা’ত করতে হাত কাঁপছে না?
— না।
— তাহলে আমিও ফোন দেব না।
— মে’রে ফেলব।
বলেই চুপ করে গেল। এরপর ইফাদের কপালে হাত দিয়ে চেক করে হতবাক হয়ে বলল,
— জ্বর বাঁধিয়ে ফেললেন?
এই ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। এরজন্য সবাই আড়ালে ওকে বউ পাগল তকমা দিয়ে বসে আছে। রিতুর কাছ থেকে দূরে চলে যাবে এমন কিছু হলেই ওর মন দুর্বল হয়ে যায়। মনের উপর চাপ পড়লে শরীরের আর কী দোষ! ইফাদ থতমত খেয়ে গেল। লুকিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
–কোথায় জ্বর! সামান্য গরম হয়ে আছে। রোদ থেকে এসেছি তো তাই।
রিতু বিছানা থেকে নেমে ঔষধ এনে ধরল ওর সামনে। পানির গ্লাস হাতে ধরিয়ে কর্কশ স্বরে বলল,
— মিথ্যেটা বেশ বলতে পারেন। নিন হা করুন…
ইফাদ মিনমিন করতে করতে ঔষধ মুখে দিল।
এরপর বলল,
— কাউকে বলো না। মা জানলে চিন্তা করবে।
রিতু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— বলব না। আপনি একটু রেস্ট নিন।
ইফাদ বিছনায় শুয়ে পড়ল রিতুকে নিয়ে। ওর বুকে মাথা রেখে রিতু চিন্তিত হয়ে বলল,
— এত জ্বর! আপনি কীভাবে যাবেন?
— চিন্তা করো না। ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
— হুম।
— আমাকে মিস করবে?
রিতু কান্নাভেজা গলায় বলল,
— খুব!
ইফাদ ভারাক্রান্ত মনে রিতুকে শক্ত করে আঁকড়ে
ধরল দু’হাতে! রিতু বলল,
— আপনি আমার সব!
.
রিতু ঠিক করেছিল ইফাদের বিদায়ের সময় সে
একটুও কাঁদবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। সবার সামনেই ইফাদের গলা জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। বাড়ির বড়রা নিজেদের দুঃখ ভুলে কেশে ওঠল। যে যার মতো সরে গিয়ে ওদেরকে স্পেস দিলো। ইফাদ রিতুর এমন কান্ডে কষ্টের সাথে সাথে লজ্জাও পেল। এমনিতে পেতো না, কিন্তু বাবা আর চাচা থাকায় ওর লজ্জার মাত্রাটা বেশিই লাগছিল। সবাই সটকে পড়ার পর নিজের লজ্জা ও বিস্ময় ভাব কেটে গেল ওর। তীব্র ব্যথার ছাপ দেখা দিলো ওর চেহারায়। বিষণ্ণ গলায় বলল,
— কান্না থামাও প্লিজ। অবুঝের মতন আচরণ করলে আমার একটুও ভালো লাগবে না। নিজেই বলেছো আমাকে যেতে, আমি তোমার জন্য যাচ্ছি। এখন তুমিই যদি এভাবে কাঁদো আমি যেতে পারব না!
রিতুকে অনেক কষ্টে শান্ত করল ইফাদ। কিছুক্ষণ সময় দিলো ওকে ধাতস্থ হতে। রিতুর কান্না পুরোপুরি থামানো গেল না। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইফাদ ওকে সান্ত্বনাসূচক বলল,
— মাঝেমাঝে আসব। সুযোগ পেলেই আসব।
— সত্যি তো?
— প্রমিজ। এবার বলো আর কাঁদবে না।
রিতু ‘কাঁদবে না’ বলতে গিয়ে আবারও কেঁদে ফেলল। ইফাদ অসহায় বোধ করল। এখন তো ওর যেতেই
ইচ্ছে করছে না। রিতুকে এ কথা বলতেই ও কান্নারত অবস্থায়ই বলল,
— ভালোবাসি আপনাকে। খুব খুব ভালোবাসি।
ইফাদ ওর বলার ধরণ দেখে এই কষ্টের মুহূর্তেও
হেসে ফেলল। নাবিলা, তৌফরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ওদের দেখছে আর হাসছে। ইফতি ওদের ধমক দিলো
এভাবে হাসার জন্য।
ইফাদ চলে গেল। রিতু সেই রাতটা কাঁদতে কাঁদতে কাটালো। সারারাত চিন্তায় ঘুম হলো না ওর। খুব মিস করতে শুরু করল ইফাদকে।
_______________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…