#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মু্গ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ২০
বসুন্ধরায় সূর্য ফিরে এসেছে।অন্ধকার দূর করে চারিদিকে আলো ছড়াচ্ছে।ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল আটটা।জানালার মাধ্যমে সূর্যের আলো ঘুমন্ত প্রতিজ্ঞার চোখে-মুখে আঁচড়ে পড়ছে।বিরক্তি নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে।মাথাটা ঘুরছে।চোখ খুলে রাখা দায়।মাথাটা ধরেছে প্রচন্ড।কিছুক্ষণ থম মেরে চোখ বুঝে বসে রইলো।রাতের কথা মনে পড়তেই নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ খুলে ভালোভাবে আশেপাশে নজর বুলাতেই তার মনে নিজের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন জেগে উঠে।সে কোথায়!মাথায় বজ্রপাত হয় নিজের পাশে উপুড় হয়ে ঘুমন্ত মানবকে দেখে।বুকটা ধ্বক করে উঠে তার।পিঠ উন্মুক্ত, মুখের একপাশ দেখা যাচ্ছে।সে নিজের দিকে একবার তো মানবের দিকে দশবার তাকাচ্ছে।হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ভালোভাবে চোখ কচলাতে শুরু করে।তারপর আবার চোখ মেলে। নাহ, সে যা দেখছে ঠিক দেখছে।ঘুমন্ত মানব সংকল্প ব্যাতীত অন্য কেউ নয়।
প্রতিজ্ঞা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন।চোখ মেললেই সব কর্পূড়ের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।তার মাথা বর্তমানে শূন্যস্থান ব্যাতীত কিছু নয়।মাথা কাজ করছে না।কিছু ভাবতে পারছে না সে।কি প্রতিক্রিয়া করা উচিত,বুঝতে পারছে না।শুধু ইচ্ছে করছে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে।কতদিন পর মানুষটাকে দেখলো সে।আর একদম নিজের পাশে।সারারাত এই মানুষটার সাথে ছিলো ভাবতেই তার গা শিউরে উঠে।অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায়।বুকটা কেমন জানি করছে।তার তো রাগ করা উচিত।কিন্তু রাগ হচ্ছে না।চোখের প্রান্তে অশ্রুরা দলে দলে জমা হচ্ছে।চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে।কতক্ষণ এক দৃষ্টিতে সংকল্পের দিকে তাকিয়ে ছিলো প্রতিজ্ঞার জানা নেই।
গতকাল রাতের কথা..
আকাশ অরেঞ্জ জুসে অতি মাত্রায় নে-শা দ্রবয় মেশানোয় অল্পতেই নে-শা হয়ে যায় প্রতিজ্ঞার।অস্পষ্ট স্বরে “সংকল্প” বলেই ঢলে পড়ে সে।আকাশ তাকে ধরে ফেলে।আকাশের মুখে ক্রুর হাসি।তৎক্ষনাৎ সংকল্প এসে আকাশকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আগলে নেয় প্রতিজ্ঞাকে।
আকাশ রাগান্বিত হয়ে বলে সংকল্পের কলারে ধরে বলে,
“এই কে তুই?জানিস ও কে?আমার গার্লফ্রেন্ডকে ধরার সাহস কোথা থেকে পেলি?”
সংকল্প রাগী চোখে তাকায়।চোখ দিয়ে যেনো অগ্নিবর্ষণ হবে।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“তুই জানিস ও কে?শী ইজ মাই ওয়াইফ।ওকে যেই হাত দিয়ে ধরেছিস,ওটা ভেঙ্গে দিতে আমার দু’মিনিট ও ভাবতে হবে না।সর!”
আকাশ রেগে গিজগিজ করতে করতে সংকল্পকে আঘাত করতে আসলে প্রতিজ্ঞার বাবার পাঠানো বডিগার্ডরা যারা সবসময় প্রতিজ্ঞার উপর নজর রাখে তারা এগিয়ে আসে।আটকে দেয় আকাশকে।আকাশ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।তার বাবা নামকরা শিল্পপতি।এখন কিছু হওয়া মানে বাবার কাছে সব তথ্য যাওয়া।সে এটা চায় না।সংকল্প বেরিয়ে আসে প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে।প্রতিজ্ঞা মা-তালের মতো আচরণ করছে।নিজের হুঁশে নেই।সংকল্প তাকে নিয়ে গাড়িতে বসায়।দেখতে পায় প্রতিজ্ঞা বিড়বিড় করছে।একটু ঝুঁকলে শুনতে পায় প্রতিজ্ঞার বিড়বিড় করা বাক্য,
“সংকল্প,আপনি অনেক খারাপ,অনেক খারাপ।আমাকে শুধু কষ্ট দিয়েছেন।এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। আপনি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন।আমার অনেক যন্ত্রণা হয়।আপনি আমার কষ্ট আগেও বুঝেন নি,এখনো বুঝেন না।আপনি অনেক খারাপ…”
সংকল্প প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে। প্রতিজ্ঞার কপালে আলতো চুমু খেয়ে আদুরে স্বরে বলে,
“আর যাবো না।এখন আমি এসে গেছি,সব যন্ত্রণা দূর করে দিবো।”
বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়।গাড়ি চলতে শুরু করে পিচঢালা ব্যস্ত শহুরে রাস্তার উপর দিয়ে।
অন্যদিকে,গার্ডদের আগে থেকেই সবধরনের তথ্যাদি দেওয়া থাকায় তারা সংকল্পকে চিনে।তাই তাকে আটকায় না।আনোয়ার সাহেবের ফোনে মেসেজ পাঠায়,
“ম্যামকে সংকল্প স্যার নিয়ে গেছেন।”
মেসেজটা সাথে সাথেই সিন্ হয়।আনোয়ার সাহেবের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।
সবাই বসার ঘরে প্রতিজ্ঞার জন্য অপেক্ষা করছিলো। অপেক্ষা নয় বরং চিন্তা করছিলো।এতো রাত হয়ে গেছে প্রতিজ্ঞার ফেরার নাম নেই।তাসলিমা বেগম রাগে গিজগিজ করছেন।আনোয়ার সাহেব হাই তুলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
“চিন্তা করতে হবে না।প্রতিজ্ঞা ঠিক জায়গাতেই আছে।”
তাসলিমা বেগম স্বামীর পানে তাকান।অবাক হয়ে বলেন,
“মানে?”
“প্রতিজ্ঞাকে সংকল্প নিয়ে গেছে।”
বলে আনোয়ার সাহেব আর দাঁড়ান নি।সোজা ঘরে চলে গেলেন।বসার ঘরে রেখে গেলেন দু’টো বিস্ফোরিত চেহারার মানুষ।
অন্ধকার ঘরটায় প্রতিজ্ঞাকে কোলে করে নিয়ে আসে সংকল্প।প্রতিজ্ঞার হুশ নেই,আবোলতাবোল বকছে।সংকল্প তাকে শুইয়ে দিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলো।
প্রতিজ্ঞা উঠে বসলো।টলছে সে।চোখ পিটপিট করে ঠোঁট উল্টিয়ে এক হাত উঁচু করে ডাকলো সংকল্পকে,
“এই প্রাণপুরুষ, এদিকে এসো!”
সংকল্প স্বাভাবিকভাবেই গেলো।পাশে বসলো।
প্রতিজ্ঞা চোখ পিটপিট করে নিজের পাশঘেষে বসার জন্য বললো,
“এখানে বসো,এখানে!”
সংকল্প আগের জায়গাতে বসেই বললো,
“কিছু লাগবে তোমার?বলো আমাকে! ”
সংকল্প ওর পাশঘেষে না বসায় প্রতিজ্ঞা রেগে যায়।
কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“তোমাকে এখানে আসতে বলেছি না?এসো!”
বলতে বলতে সংকল্পের কাছে যাওয়ার জন্য যেই উঠতে নিবে তখনই মাথা ঘুরে পড়ে যায়।সংকল্প ধরে ফেলে।প্রতিজ্ঞা সংকল্পের গলা জড়িয়ে ধরে।মাথা ঘুরছে তার।এক হাতে সংকল্পের গলা জড়িয়ে ধরে,অন্য হাত নেড়ে, চোখগুলো টেনে খুলে রাখার চেষ্টা করে বলে,
“প্রাণপুরুষ আপনি আমাকে নিয়ে ঘুরছেন কেনো?প্রাণপুরুষ দেখুন,দেখুন ঐ লাইটটা ঘুরছে,ঐ পর্দাটাও ঘুরছে,আরেহ ঐ আলমারিটাও ঘুরছে,সব ঘুরছে প্রাণপুরুষ, সব।
বলে বাচ্চাদের মতো খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করে প্রতিজ্ঞা।সংকল্প থতমত খায়।বুঝতে পারে সব অ্যালকোহলের প্রভাব।ভাবনার মাঝেই প্রতিজ্ঞা সংকল্পের গালে আঙ্গুল ঘুরিয়ে বলছে,
” প্রাণপুরুষ,তুমি এত্তোগুলা হয়ে গেলা কিভাবে?”
দ্বিতীয়বারের মতো আবার থতমত খায় সংকল্প।
প্রতিজ্ঞা খিলখিলিয়ে হাসছে আর বলেই চলেছে,
“ঐ যে একটা প্রাণপুরুষ, ঐ যে আরেকটা, ঐ তো আরেকটা।ওবাবা ঐখানেও একটা।একটা প্রাণপুরুষ,দুইটা প্রানপুরুষ,তিনটা প্রাণপুরুষ, চারটা প্রাণপুরুষ, পাঁচটা প্রাণপুরুষ।”
বলে আবার হাসতে শুরু করলো।সংকল্প চোয়াল ঝুলিয়ে বউয়ের কান্ড দেখছে।এরমধ্যেই প্রতিজ্ঞা আবার নজর দিলো সংকল্পের দিকে।চোখ পিটপিট করে বললো,
“প্রাণপুরুষ, তুমি আগের থেকে সুন্দর হয়ে গিয়েছো।কি মাখো?আমাকেও বলো!”
বলতে বলতে প্রতিজ্ঞা বমি করে দিলো।নিজের কাপড়সহ সংকল্পের কাপড়ও নষ্ট করে দিলো।সংকল্প অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললো,
“এটাই বাকি ছিলো!”
তারপর প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে ছুটে ওয়াশরুমে।পরিষ্কার করিয়ে দেয় প্রতিজ্ঞাকে।অন্ধকারে প্রতিজ্ঞার কাপড় পরিবর্তন করে দেয়।তার কাছে প্রতিজ্ঞার কাপড় আছে।দুপুরবেলা শপিংমল থেকে কিনেছে,কানাডা থেকে আসার সময়ও নিয়ে এসেছিলো।তারপর প্রতিজ্ঞাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে চলে যায় ফ্রেশ হতে।এসে দেখে প্রতিজ্ঞা ঘুমোচ্ছে।সংকল্প পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত চেহারাটায়।এই চেহারার দিকে তাকিয়ে সে সারাজীবন পার করে দিতে পারবে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“একটা দিন আগে যদি ভালোবাসা প্রকাশ করতে তাহলে না তোমাকে এতো কষ্ট পেতে হতো,না আমাকে অপরাধবোধে ভুগতে হতো,এতো দূরে থাকতে হতো।একটা দিনের ব্যবধানে একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিলো।নাহয় আমাদের একটা ভালোবাসা পূর্ণ সংসার হতো।তবে এতোদিন হয় নি,এখন হবে।আর ছাড়বো না তোমায়।একদম নিজের সাথে বেঁধে রেখে দিবো।নিজের খাঁচায় বন্দিনী করে রেখে দিবো।আমার ঘুড়ি আমার আকাশেই উড়বে,অন্যকোনো আকাশে উড়তে গেলেই ভোকাট্টা!যতই ঘুড়ি উড়ো,লাটাই তো আমার হাতেই!”
“ভালোবাসি বউ,অনেক বেশিই ভালোবাসি।একটা মানুষকে যতটা ভালোবাসা যায়,আমি তোমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসি।আমার ভালোবাসার গভীরতা খুঁজতে গেলে অতলে হারিয়ে যাবে,তবুও তলদেশ খুঁজে পাবে না।আমি তোমার প্রাণপুরুষ, তুমি আমার প্রাণভোমরা বউ।”
বলে আলতো করে উষ্ণ পরশ এঁকে দেয় প্রতিজ্ঞার কপালে।প্রতিজ্ঞা তার কোমড় জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।সংকল্প আর ঘুমাতে পারে না।সারারাত এভাবেই বিনিদ্র কাটিয়ে দেয়।ভোরের দিকে তার চোখ লেগে আসলে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
#চলবে…
#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ২১ (১৮+ এলার্ট)
সংকল্প নড়চড় করলে প্রতিজ্ঞা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।চেহারায় কাঠিন্যতা ধরে রাখে।নতমস্তকে আগের জায়গাতেই বসে থাকে।সংকল্প আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে।তার লাল টকটকে চোখগুলো বিনিদ্র রাত্রীযাপনের স্বাক্ষী।প্রতিজ্ঞাকে থম মে*রে বসে থাকতে দেখে বাঁকা হাসে।গা ঘেঁষে দুষ্টুমি করে বলে,
“গুড মর্ণিং,বউ!”
প্রতিজ্ঞা থতমত খায়।সরে যায় সে।প্রথম দেখায় সংকল্প থেকে এমন প্রতিক্রিয়া সে আশা করে নি।বড্ড বেশিই অবাক হয়েছে সে।তবে মুখে প্রকাশ করলো না।সোজা তাকালো সংকল্পের চোখের দিকে।সংকল্প চোখ ফেরালো না।অপলক চেয়ে রইলো।প্রতিজ্ঞা কাঠিন্যতা বজায় রেখে শক্ত গলায় শোধালো,
“আমি এখানে কেনো?”
সংকল্প ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“বউ স্বামীর পাশে থাকবে,এটাই তো নিয়ম।আমার বউ আমার পাশে থাকবে না তো কোথায় থাকবে?তুমি কি অন্য কাউকে আশা করেছিলে বউ?”
প্রতিজ্ঞা থতমত খায়।কাশতে থাকে।তার মনে হচ্ছে সে প্যারালাল ইউনিভার্সে আছে।সংকল্পের আচার-আচরণে এতো পরিবর্তন,তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।সে রাগ করবে কি!অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে।
সংকল্প চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠলো,
“বউ কি দেখছো?আমি কি আগের থেকে বেশি সুন্দর হয়ে গেছি?ক্রাশ খেয়েছো?প্রতিদিন অনেক মেয়েরাই খায়।”
প্রতিজ্ঞা কপট রাগ দেখিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“ফাইজলামি করছেন আমার সাথে?”
সংকল্প কপাল কুঁচকে বললো,
“তোমার সাথে ফাইজলামি করবো না তো কি পাশের বাসার ভাবীর সাথে করবো বউ?তুমি অনুমতি দিলে করতে পারি।পাশের বাসার সামিয়া ভাবী আমার উপর নজর রাখেন।একটু পরপর এসে খোঁজখবর নিয়ে যান,খাওয়ার সময় খেয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করেন,বিভিন্ন সময় খাবার দিয়ে যান।অনেক কেয়ার করেন আমার।তুমি অনুমতি দিলে তার সাথে ফাইজলামি করতেই পারি।দিবা?”
প্রতিজ্ঞার রাগ তরতর করে বাড়ছে।কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“যত্তসব পাবনাফেরত পা গল।”
“ভুল বললে বউ,আমি কানাডাফেরত!”
ঠোঁট উল্টিয়ে বলে সংকল্প।
প্রতিজ্ঞা এবার রাগ দমাতে পারে না।চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“অসহ্যকর।”
সংকল্প শান্ত দৃষ্টিতে প্রতিজ্ঞার দিকে তাকায়।ভরাট কন্ঠে বলে,
“আমি তোমাকে অসম্ভব,অসহ্যকর রকমের ভালোবাসি বউ।”
শব্দগুচ্ছ কর্ণপাত হতেই প্রতিজ্ঞার বুকটা ধ্বক করে উঠে।তড়িৎগতিতে দৃষ্টি ফেলে সংকল্পে।এই শব্দগুচ্ছ শোনার জন্য কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে। এখন এই লোক এমন করলে সে রাগ করবে কিভাবে!শাস্তি দিবে কিভাবে!নিজেকে সামলানো বড্ড দায়।নিজেকে সামলাতে হবে।এতো সহজে গলে গেলে হবে না।নিজেকে ধাতস্থ করে চোখে চোখ রেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“আই হেইট ইয়্যু।”
“আই লাভ ইয়্যু ইনফিনিটি।”
প্রতিজ্ঞা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সংকল্পের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে আছে।বউয়ের এমন অবস্থা দেখে সে মজা পাচ্ছে।সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
প্রতিজ্ঞা তাকায় তার দিকে।শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“আমি এখানে কিভাবে এলাম?”
“আমি নিয়ে এসেছি।”
স্বাভাবিক, স্পষ্ট জবাব সংকল্পের।
প্রতিজ্ঞা কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“কেনো?”
সংকল্প এবার তাকায় প্রতিজ্ঞার দিকে।বলে,
“তোমার তো আমার সাথেই থাকার কথা। তাই না?”
প্রতিজ্ঞা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে।অন্যদিকে ফিরে বলে,
“পরিস্থিতিটা আলাদা!”
“এখন থেকে সব ঠিক হবে।আমি ঠিক করে দিবো।”
সংকল্পের স্বাভাবিক স্বরের বিপরীতে প্রতিজ্ঞা রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমি থাকবো না আপনার সাথে।”
সংকল্প তাকায় প্রতিজ্ঞার দিকে।শক্ত গলায় বলে,
“থাকতে তুমি বাধ্য!”
“আপনার মনমতো সব হবে না।”
সংকল্প এগিয়ে আসে প্রতিজ্ঞার কাছে।দূরত্ব কয়েক আঙ্গুলের।সংকল্পের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে প্রতিজ্ঞার মুখের উপর।সংকল্প দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“যা হয়েছে সব ভুলে যাও।তোমার সব কষ্ট আমি শুষে নিবো।তুমি আমার আকাশে উড়ন্ত একমাত্র ঘুড়ি।যা খুশী তাই করো।কিন্তু অন্য আকাশে উড়তে গেলে ভোকাট্টা।ভুলে যেও না লাটাই আমার হাতে।ঘুড়ি কিভাবে সামলাতে হয় আমার জানা আছে।হয় ঘুড়ি আমার,নাহয় কারোর না।মাইন্ড ইট!”
বলে সংকল্প ওয়াশরুমে চলে যায়।প্রতিজ্ঞা অপলক তাকিয়ে থাকে সে দিকে।যেই ভালোবাসা সে এতোবছর চেয়ে এসেছে,সেই ভালোবাসা এখন তার কাছে ধরা দিচ্ছে।ভাবতে ভাবতেই নজর যায় নিজের পরিহিত কাপড়ের উপর।চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার উপর অবস্থিত নিজের প্রতিবিম্বের উপর।কাপড় পরিবর্তন করা!মাথায় কত কি চিন্তা আসছে।সে চিৎকার করে সংকল্পকে ডাকতে থাকে।একবার,দুইবার,তিনবারের মাথায় সংকল্প বেরিয়ে আসে।কিছুই হয় নি,এমন ভঙ্গিমা করে বলে,
“কি হয়েছে বউ?ডাকছো কেনো?বেশি মিস্ করছিলে আমায়?বললেই পারতে।তাহলে তুমি,আমি একসাথে শাউয়ার নিতাম।…”
কথা শেষ করতে পারলো না সংকল্প।প্রতিজ্ঞা রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে,
“আমার ড্রেস কে চেঞ্জ করছে?”
সংকল্প ফটাফট বলে উঠে,
“ঐতো পাশের বাসার ভাবীর হাসবেন্ড চেঞ্জ করেছে।”
প্রতিজ্ঞা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে।অবাক হয়ে বলে,
“হোয়াট?হ্যাভ ইয়্যু গোন ম্যাড?”
সংকল্প এবার প্রতিজ্ঞার পানে পূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করলো।স্বাভাবিকভাবে বললো,
“তুমি পা গল হয়ে গিয়েছো।আমি ছাড়া কে চেঞ্জ করবে?আর কেউ আছে?বোকার মতো প্রশ্ন করো কেনো!”
প্রতিজ্ঞা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।কত স্বাভাবিকভাবে লোকটা কথাটা বললো।যেনো তেমন কিছুই না। দাঁতে দাঁত ঠেকিয়ে বললো,
“আপনি কেনো চেঞ্জ করবেন?কে অধিকার দিয়েছে আপনাকে?”
সংকল্প স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“বমি করে তো নিজেকেসহ আমাকে ন ষ্ট করে দিয়েছিলে।ঐভাবে ফেলে রাখলে ভালো হতো?আর অধিকার?তুমি দিয়েছো।মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বিয়ে করেছো।ভুলে গেছো নাকি!”
কথার বিপরীতে প্রতিজ্ঞা আমতাআমতা করে বললো,
“সেটা অন্য ব্যাপার।”
সংকল্প বাঁকা হেঁসে বলে,
“এমন ভান করছো যেনো আমি পরপুরুষ।তোমাকে আমি দেখিনি আগে।তোমাকে আমার দেখা শেষ!”
কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই প্রতিজ্ঞার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে লাগলো।লজ্জায় তার চেহারায় লাল আভা দেখা দিয়েছে।সে ভাবছে,এই নির্লিপ্ত মানুষটার এতো পরিবর্তন!শুধু তার জন্য?তাহলে কি দূরত্বটা ভালোর জন্যই হয়েছিলো!দূরত্ব ভালো কিছু এনে দিয়েছে।
প্রতিজ্ঞা মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“ছিহ!অ সভ্য লোক!”
সংকল্প শব্দ করে হেঁসে ফেলে।সকালের খাবার তৈরী করার জন্যে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
প্রতিজ্ঞা ধপাশ করে বসে বিছানায়।লজ্জারা তাকে ঘিরে ধরেছে।তার মনে পরে যায় তাদের বিয়ের দিন রাতের কথা…
রাত এগারোটা।ঘরজুড়ে অন্ধকারের রাজত্ব।সংকল্প বিছানার এক পাশে চুপ করে শুয়ে আছে।তার দৃষ্টি সিলিং ফ্যানটার দিকে।আরেক পাশে প্রতিজ্ঞা হাটু ভেঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছে।একটু পরপর সংকল্পকে দেখছে সে।কিন্তু সংকল্পের তাতে মাথা ব্যাথা নেই।সে আজকের দিনটা নিয়ে ভাবনায় মত্ত।হুট করে ঝোঁকের বশে বিয়ে করে ফেললেও প্রতিজ্ঞার বড্ড মন খারাপ। তখন তো বলেছিলো সে সংকল্পকে আটকাবে না।কিন্তু এখন বড্ড কষ্ট হচ্ছে।বুক ফেঁটে কান্না আসছে।কথারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
সাহস সঞ্চয় করে নরম স্বরে সংকল্পকে ডাকলো,
“স্যার!”
“হুম!”
“না গেলে হয় না?”
“তোমার প্রতি অন্যায় হয়ে যাবে যে!”
“আমি সব সহ্য করে নিবো।শুধু আপনি থেকে যান।”
“তুমি একটা অমূল্য রত্ন প্রতিজ্ঞা।তোমাকে এতো সহজে পেয়ে গেলে যে তোমার প্রতি বড্ড অন্যায় করা হবে।আমি তোমার যোগ্য নই,তবুও তুমি আমার।যখন নিজেকে নিজের কাছে তোমার যোগ্য মনে হবে তখন ফিরবো।”
“কবে ফিরবেন?”
“যখন আমার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হবে!”
তারপর কেউ কোনো কথা বললো না।অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে।দু’জনেরই ভেতরে উথাল-পাতাল ঢেউ বইছে।ভালোবাসার মানুষ কাছাকাছি, তবুও আলাদা হয়ে যাবে।এখন যেনো প্রতিজ্ঞার আফসোস হচ্ছে।কে বলেছিলো এতো ভালোবাসতে?কেনো সে এতো ভালোবেসেছে? এর জন্যই তো সংকল্প এখন তার চোখে চোখ রাখতে পারছে না।নিজেকে ছোট মনে করছে।প্রতিজ্ঞা নিজেকে ধাতস্থ করলো।হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো।ঢোক গিলে শান্ত গলায় ডাকলো,
“সংকল্প!”
নিরব নিস্তব্ধ ঘরে এই শব্দটা যেনো বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।
সংকল্প ছোট্ট করে বললো,
“বলো!”
“আজকে সারাটা রাত আমাকে দিবেন,প্লিজ?”
সংকল্প এবার প্রতিজ্ঞার পাশ ফিরলো।চোখে-মুখে প্রশ্নের আভাস।অবাক হয়ে শোধালো,
“মানে?”
“আমাকে একটু আদর করবেন?”
সংকল্প আঁতকে উঠল। সে আবার সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো।সিলিং এর দিকে নজর দিয়ে থমথমে গলায় বললো,
“এটা হয় না।”
প্রতিজ্ঞা এবার উঠে বসে পড়লো।করুণ কন্ঠে একটু রাগ দেখিয়েই বললো,
“কেনো হয় না?আমি আপনার স্ত্রী।”
“আমি তোমার যোগ্য নই।”
থমথমে গলায় উত্তর।
প্রতিজ্ঞা রাগলো নাকি কষ্ট পেলো কে জানে!কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
“অনেক তো যন্ত্রণা সহ্য করেছি।ভালোবাসার অনলে দগ্ধ হয়েছি।ভেতরটা জ্বলছে অনেক ।একটু যন্ত্রণা কমিয়ে দিন না!কাল তো চলেই যাবেন।”
কি করুণ আকুতি!নির্লিপ্ত সংকল্প আর নির্লিপ্ত থাকতে পারলো না।বসে থাকা প্রতিজ্ঞার বা হাতটাকে নিজের ডান হাতের মাধ্যমে হেঁচকা টানে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো।আচকমা টানে প্রতিজ্ঞা মুখ থুবড়ে পড়লো সংকল্পের বুকের মধ্যিখানটায়।সংকল্পের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে প্রতিজ্ঞা।প্রতিজ্ঞা টের পেলো সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হারে সংকল্পের হৃদযন্ত্রটা স্পন্দিত হচ্ছে।তারপর নিজের হৃদস্পন্দন অনুভব করলো।তার হৃদযন্ত্রটাও একই গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে।তার কোমড় সমান চুলগুলো আছড়ে পড়লো সংকল্পের সারা বদনে।সংকল্প বা হাতে চুল গুলো সরালো।তারপর প্রতিজ্ঞার মুখের উপরে চুল গুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিলো।সংকল্পের প্রতিটা স্পর্শে প্রতিজ্ঞা শিউরে উঠলো।তার প্রাণপুরুষের স্পর্শ, অধিক প্রতিক্ষিত সেই স্পর্শ,সেই মুহুর্ত। চোখ বুঝে অনুভব করলো প্রতিজ্ঞা।
সংকল্প গাঢ় কন্ঠে বললো,
“অন্যায় করতে বাধ্য করছো কিন্তু!
“অন্যায় যদি যন্ত্রণা কমায়,খা খা বুকের তৃষ্ণা মেটায় তাহলে অন্যায়ই সই!”
তারপর নিঃশ্বাসের আওয়াজ ব্যতীত আর কোনো কথার শব্দ পাওয়া গেলো না।সংকল্প প্রতিজ্ঞার কোমড় আঁকড়ে ধরে পাশে শুইয়ে দিয়ে নিজে প্রতিজ্ঞার দিকে ঝুঁকে গেলো।প্রতিজ্ঞার কপালে কপাল ঠেকালো।প্রতিজ্ঞা এক হাত দিয়ে সংকল্পের এক হাত ধরে আছে,অন্য হাত দিয়ে সংকল্পের টি-শার্ট খামচে ধরেছে।যেনো ছেড়ে দিলেই সংকল্প পালিয়ে যাবে।
সংকল্প অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে প্রতিজ্ঞার কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখলো।তারপর অনেকসময় নিয়ে প্রতিজ্ঞার কপালে নিজের পুরু ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিলো।তারপর ধীরে ধীরে স্পর্শ প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছালো।অন্যায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলো।প্রতিজ্ঞার যন্ত্রণা খানিকটা কমলো হয়তো।প্রতিজ্ঞা টের পেলো কেউ একজন তাকে খুব যত্ন করে ভালোবাসছে,নিজের ভালোবাসার জানান দিচ্ছে।প্রতিজ্ঞার খা খা বুকে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এলো।প্রতিজ্ঞার হৃদয়ে থাকা সেই মানব এখন দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটাতে ব্যস্ত।প্রতিজ্ঞার মনে হলো তার ভালোবাসা সফল।তার হৃদয়জুড়ে অবস্থান করা সেই সখার হৃদয়ের সাথে তার হৃদয়ের মিলন ঘটেছে।মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।প্রতিজ্ঞার চোখ বেয়ে নেমে পড়লো সুখের,প্রাপ্তির অশ্রু।এই অশ্রুও সে মানব শুষে নিলো।সত্যি সত্যি সংকল্প সেই পুরোটা রাত প্রতিজ্ঞাকে দিয়েছে।
সারারাতে সংকল্প প্রতিজ্ঞাকে তিনটে বাক্য একের অধিকবার বলেছে।যার একটি শুনে প্রতিজ্ঞা থমকেছে।বহু প্রতীক্ষার পর সেই বাক্য,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি,প্রতিজ্ঞা।”
এই বাক্য কর্ণগোচর হওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা সংকল্পের চোখের জল টের পেয়েছিলো।ফিসফিস করে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলার সময় কয়েক ফোঁটা অশ্রু প্রতিজ্ঞার কাঁধে পড়ে ছিলো।জানান দিয়েছিলো মানুষটার ভালোবাসার সাথে অনুতপ্ততা।সংকল্পের বলা আরো দু’টি বাক্যও অনুতপ্ততা প্রকাশ করেছে।
“আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, প্রতিজ্ঞা ।আই অ্যাম স্যরি ফর এভ্রিথিং,এভ্রিথিং এন্ড এভ্রিথিং।”
#চলবে..
[আজকেও কিছু মানুষ আমাকে কথা শুনাবে]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/