রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ২৮

0
186

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

২৮
[ কপি করা নিষেদ্ধ ]
একটা সুন্দর সকালের সূচনা। সকাল ছয়টা কি সাড়ে ছয়টার ঘরে। ভোরের মিষ্টি রোদের সঙ্গে ফুরফুরে বাতাস এসে বইয়ে যাচ্ছে দক্ষিণা জানালা দিয়ে। কে যেন দক্ষিণা জানালাটা খোলে পর্দা সরিয়ে দিয়ে গেল। নাকি গভীর রাতের ফোন আলাপের শেষে জুই জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে, জানে না মায়া। জানালা দিয়ে ভেসে আসা সকালের মিষ্টি রোদ যেমন মায়ার আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, ঠিক তেমনই দক্ষিণা হওয়ায় ফুরফুরে বাতাসে শরীরে আরাম তুলছে। মায়া সকালের আরামদায়ক ঘুমের রেশ কাটাতে না পেরে চিৎ হওয়া থেকে মূহুর্তে উপুড় হয়ে শুলো, বালিশে মুখ গুঁজে। এবার রোদের আলো মায়াকে বিরক্তি করতে পারবে না ভেবেও আরামের ঘুমটা শান্তিমত দিতে পারছে না সে, বাড়ির ভিতরে থেকে ভেসে আসা তীব্র হৈচৈ আর কলরবে আওয়াজে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ আজ কেমন লাউডস্পিকার কথা বলছে মায়ার মনে হলো। থেকে থেকে রান্না ঘর থেকে জুইয়ের মা সাবিনা বেগমের চেঁচামেচি ডাক শুনতে পারছে মায়া। তিনি জুই আর মায়াকে ডাকছেন চেঁচিয়ে হয়তো কোনো কাজে। কিন্তু এতো সকাল সকাল কেন? বাড়িতে এতো মানুষ থাকতে হঠাৎ মায়া আর জুইকে কি কাজে পরলো চাচীর? জানে না মায়া। সাবিনা বেগমের চেঁচামেচি ডাকাডাকি শব্দ মায়ার কান অবধি পৌছালেও জুই বিন্দাস ঘুমাচ্ছে তখনো। ওর কোনো সাড়াশব্দ বা নড়াচড়া নেই। হয়তো সারারাত ফোনালাপ শেষে সকালে মটকা মেরে ঘুমাচ্ছে জুই। মায়া জানে না জুই কার সাথে বিগত তিনমাস ধরে এতো কথা বলে। কার সাথে প্রেম করে বেড়ায়? লোকটা কে? তবে মায়ার জানামতে যতটুকু বুঝতে পেরেছে জুই হয়তো খান বাড়ির কারও সাথে প্রেম জমিয়েছে। খুব সম্ভবত রিদ খানের ছোট ভাই রাদিফের সঙ্গে জুইয়ের প্রেম। ফোন নাম্বার অন্তত রাদিফ❤️ নামে সেইভ করা। মায়া সেই থেকেই একটু বুঝেছে। বাহির থেকে ভেসে আসা তীব্র ভসভস আওয়াজে মায়া নাক মুখ কুঁচকে বালিশের ভিতরে আরও মুখটা চেপে রাখল। আরামের ঘুমটা হারাম হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হতে গিয়েও হলো না কিছু একটা ভেবে। বরং চট করে মায়ার মাথায় আসল আজ ওর বড়বোন মুক্তা গায়ের হলুদ। সেজন্য বাসায় মেহমান থেকে শুরু করে ডেকোরেশনে মানুষের ভরপুর। এজন্য সকাল হতেই এতো হৈ হুল্লোড় চেচামেচি শব্দ ভেসে আসছে। মায়া ঘুমের রেশ কাটাতে চেয়ে বালিশ থেকে মুখ তুলে ঘুমন্ত চোখে তাকাল ঘরের দক্ষিণা জানালাটার দিকে। কি সুন্দর মিষ্টি রোদ আর হাওয়া বইছে বাহিরে। মায়া চোখ আওড়িয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় আম গাছটার দিকে তাকাল। বাতাসের তোপে ফুরফুর করে নড়ছে গাছে পাতা সেই সাথে ছোট ছোট আম ফলের ঝুল। মায়া আস্তে করে মাথাটা বালিশের উপর রেখে অসল ভঙ্গিতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল আম গাছের পাতায় বইতে থাকা সেই বাতাসের দিকে। আজকের দিনটা খুব সুন্দর লাগছে মায়ার কাছে। মনের মধ্যে অজানা এক খুশির ঝলক বয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। মায়া মনে হচ্ছে আজ মায়ার সাথে স্পেশাল কিছু ঘটবে। যা এর আগে কখনো ঘটেনি। হয়তো আজকের দিনটা মায়ার জন্য শুভ কিংবা অশুভে পরিণত হবে। হয় আজকে মায়ার জীবনে বেস্ট কিছু ঘটবে নয়তো একেবারে অনেক খারাপ কিছু ঘটবে। যায় ঘটুক না কেন? মায়া মনে হচ্ছে আজকে দিনটি মায়ার জীবনে বাকি দিনগুলোর মতোন হবে না। একদম ভিন্ন আর স্পেশাল কিছু হবে। আল্লাহ জানে এবার কি হয়! মায়া মনে মনে দোয়া করলো যাতে খারাপ কিছু না ঘটে মায়ার সাথে। আজকে মায়ার বোনের গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান আর আজ যদি মায়ার জন্য খারাপ কিছু হয় তাহলে বোনের স্পেশাল দিনটা নষ্ট হয়ে যাবে। মায়া চাইনা ওর জন্য মুক্তার স্পেশাল দিনটা নষ্ট হোক। তাই মায়ার নিজের জন্য ভালো কিছু হওয়ার দোয়া করল মনে মনে। তারপর অলস ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরে তাকাল পাশের বালিশে শয্যায়িত ঘুমন্ত জুইয়ের দিকে। সে মায়ার দিকে মুখ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। এই মূহুর্তে রুমে বোম মারলেও মনে হয় জুইয়ের ঘুম ভাঙবে না। সারারাতের অঘুমের ঘুম দিয়েছে জুই। আবারও সেই একই ভসভস আওয়াজটা তীব্র ভাবে কানে লাগতে মায়া অলসতা ঝেড়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। হামি তুলতে তুলতে জুইয়ের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলো। কথা বলতে বলতে জুই ফোনের চার্জ শেষ করে ফেলেছে। আর মাত্র দুই % আছে শেষে। মায়া ফোনের চার্জ নিয়ে মাথা ঘামাল না। বরং মায়ার নিখোঁজ স্বামী কল কিংবা মেসেজ করেছে কিনা তাই চেক করতে লাগল। অপর পাশ থেকে কোনো মেসেজ বা ফোনকল না পেয়ে হতাশায় ভুগল মায়া। মন খারাপ করে ফোনটা আবারও একই জায়গায় রাখল। লোকটা মায়াকে কখনো কল দেওনা আবার মায়ার কল রিসিভ করে না সে। এতো কিসের রাগ মায়ার উপর লোকটার সেটাই বুঝে না ওহ। এমন-তো না যে লোকটা মায়াকে অপছন্দ করে। বরং মায়া দুইদিনের ফোনালাপের খুব বুঝতে পেরেছে লোকটাও মায়াকে মনে রেখেছে এবং হয়তো মনে মনে মায়াকে সে পছন্দও করে। কথাবার্তায় তো মায়ার তাই মনে হলো। মায়া নিরাশ ভঙ্গিতে আবারও আড়মোড়া ভেঙে খাট থেকে পা নামিয়ে বসল বিছানার কিনারায়। হামি দিতে দিতে হাটু সমান এলোমেলো চুল গুলো দু’হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে খোঁপা করলো। বিছানা পাশ থেকে গায়ের সুতির ওড়নাটা কাঁধে দুপাশে ঝুলিয়ে ঘরে স্যান্ডেল গুলো পায়ে পরলো। তারপর ওয়াশরুমের কাজ সেরে হাতের ব্রাশটায় টুথপেস্ট লাগিয়ে অলস ভঙ্গিতে ঘর ছেড়ে, বসার ঘরে ঢুকতে চোখে পরলো এলাহিকান্ড। মায়া দুই ফুপি থেকে শুরু করে তাদের বড় বড় ছেলেরাও মায়ার বাবা-চাচার সাথে হাতে হাতে কাজ করছে। আরিফের সঙ্গে মায়ার ফুপাতো ভাই, রাকিব, সাকিব,তামিম,পলাশ সবাই ডেকোরেশন মালামালের কাজ দেখাচ্ছে দাঁড়িয়ে থেকে লোকদের। শফিকুল ইসলাম বাজারের লিস্ট বানাচ্ছে ছোট ভাই জামাল সাহেবকে নিয়ে। ঘরে-বাইরে সারা বাড়িতে ডেকোরেশনে কাজ করা হচ্ছে। মায়া উঁকি মেরে রান্নাঘরে দিকে তাকাল। দেখল রান্নাঘরে মা-চাচীর সাথে দুই ফুপিও হাতে হাতে কাজ করছে। তখনকার ভসভস আওয়াজটার উৎস খুঁজে পেতেই মায়া দেখল ওর বড় ফুপি সাজেদা বেগম আদা, রসুন ব্লেন্ডার করছে। আর ছোট ফুপি জাহানারা বেগম পেঁয়াজ কাটছে সঙ্গে আরও তিনজন কাজের মহিলা নিয়ে। মায়ার মাকে দেখা গেল নকশি পিঠা বাজতে। ছোট চাচী সেই পিঠা শিরায় ঢুবিয়ে বড় তালায় তুলছে। বাড়ির সবাইকে কাজ করতে দেখে মায়া হাতের ব্রাশটা মুখে ঢুকিয়ে ব্রাশ করতে করতে রান্না ঘরের দিকে যেতেই মায়ার ছোট চাচী সাবিনা বেগম মায়াকে দেখেই বলল…

‘ তুই উঠেছিস? সেই কখন থেকে ডাকছি তোদের। জুই কই?

মায়া ব্রাশ করতে করতে মিথ্যা বলে বলল…
‘ জুই সারারাত পড়েছে চাচী তাই এখন ঘুমাচ্ছে। দশটার আগে উঠবে না। সামনে আমাদের ফাস্ট সেমিস্টার পরীক্ষা এজন্য পড়াশোনার চাপ বেশি। ওকে এখন ডেকো না।

মায়ার কথায় সাবিনা বেগম বিশ্বাস করলো। মাঝ থেকে মায়া বড় ফুপি জাহানারা বেগম ব্লেন্ডার মেশিনটা বন্ধ করে মায়ার উদ্দেশ্য বলল…

‘ আচ্ছা জুই ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। ওকে ডাকার দরকার নেই। তুই বরং তাড়াতাড়ি গোসলটা সেরে একটা নতুন জামা পরে নে। অল্প সেজেও নিস চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজন আসবে একটু পর। ওদেরকেও বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তুই একটু সুন্দর মতো সেজেগুজে থাকিস কেমন।

ফুপির কথায় মায়ার হাত থামে দাঁত মাজা থেকে। কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় জাহানারা বেগমকে শুধিয়ে বলে…

‘ কেন ফুপি? চেয়ারম্যান বাড়ির মানুষ আসলে আমি সাজব কেন?

মায়ার কথায় জাহানারা বেগম কিছু বলার আগেই মায়ার মা রেহেনা বেগম ধমক দিল মায়াকে বলল।

‘ বেয়াদব হয়েছিস। মুখেমুখে প্রশ্ন করিস। তোকে যা বলেছে তাই কর। এতো কথা কিসের হ্যাঁ? বিয়ে বাড়িতে যুবতী মেয়েদের এমনই সেজেগুজে থাকতে হয় নয়তো মানুষ মন্দ বলে। যা এবার! গিয়ে গোসল করে ভালো একটা জামা পরে নে।

‘ আচ্ছা।

মায়া মন খারাপে গাল ফুলিয়ে যেদিকে থেকে এসেছিল সেইদিকে পুনরায় হাঁটে। মায়ার সুন্দর দিনটা মাটি হয়ে গেল সকাল সকাল মায়ের ঝাড়ি খেয়ে, আল্লাহ জানে সারাদিন কিভাবে যায় মায়ার। মায়ের কথা মতো মায়া গোসল সেড়ে গাঢ় সবুজ রঙের একটা থ্রি-পিস পরে নিল। সাজুগুজু করতে চেয়েও করলো না। কারণ মায়া এখন সাজবে আবার সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য আবারও সাজতে হবে বলে এখন আর সাজলো না। মায়াকে সাজতে না দেখে রেহেনা বেগম ধমক দিতে গিয়ে আবার দিল না। মায়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন তিনি। মায়া এমনই অনেক সুন্দর। সাজুগুজু ছাড়াই মায়াকে চোখে লাগার মতোন সুন্দর লাগছে বলে তিনি আর কথা বাড়াল না। বরং চুপ থাকলো। মায়া নাস্তা খেয়ে সারাবাড়ি ঘুরঘুর করতে লাগল আরিফের পিছন পিছন। জুই ঠিক দশ-টার দিকে ঘুম থেকে উঠলো। খেয়ে-দেয়ে মুক্তাকে নিয়ে বসল। ততক্ষণে বিয়ে বাড়িতে মেহমানদের সংখ্যা আরও বাড়ল। মায়ার নানু বাড়ি চট্টগ্রাম থেকে মানুষজন উপস্থিত হলো কিছুক্ষণ আগে। উনার রাতে ট্রে-তে সকালে এসে পৌঁছাল আশুগঞ্জ। হৈচৈ করে পুরো বিয়ে বাড়ি মেহমানে ভরপুর হলো। মায়ার চাচাতো, খালাতো, ফুফাতো এবং নিজের স্কুলের বান্ধবী সকল মেয়েদের জন্য আরিফ একই রঙ্গের শাড়ি কিনে এনেছে হলুদের অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য। আর ছেলেদের জন্য একই রঙ্গা পাঞ্জাবি।

মুক্তার বিয়ের স্টেজ করা হয়েছে মায়াদের বাড়ির বড় উঠানে। ভারি ফুলের ডেকোরেশনে উজ্জ্বল পরিবেশ। দেখতে চমৎকার সুন্দর দেখাচ্ছে সবকিছু। মায়া সারাবাড়িতে ঘুরঘুর করে বিয়ে বাড়ির ডেকোরেশন দেখল। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে মানুষজন এসেছিল প্রায় এগারোটা দিকে। তাও নাদিমকে নিয়ে দশ বারোজনের মতো! তাঁরা এসে মায়াদের বাড়িতে দুই ঘন্টার মতোন থেকে আবারও চলে গেল। মায়াকে দেখে কিছু অর্থ আর একটা শাড়ি উপহার দিয়ে গেল বোনের গায়ে হলুদে পরতে। উপহার গুলো নেওয়ার সময় মায়া শুধু বোকার মতো তাকিয়ে ছিল নিজের মায়ের দিকে। রেহেনা বেগম মায়াকে চোখ রাঙ্গিয়ে উপহার গুলো নিতে ইশারা করলে মায়া হাত বাড়িয়ে শাড়ি আর অর্থ গুলো হাতে তুলল। বোকার মতো শুধু চেয়ে রইল চেয়ারম্যান বাড়ির মানুষজনের কর্মকাণ্ডের দিকে। যে যা বলছিল মায়া শুধু করেই যাচ্ছিল পুতুল বনে। চেয়ারম্যান বাড়ির মানুষজনের আন্তরিকতার পঞ্চমুখ মায়ার আত্মীয়স্বজন। তার থেকে বেশি প্রশংসা করলো নাদিমের। ছেলেটি দেখতে বেশ সুন্দর, স্মার্ট আর লাম্বাটে গঠনের। নাদিমকে দেখে মায়ার আত্মীয় স্বজনদের বেশ ভালো লেগেছে সবার। মায়ার সাথে নাদিমকে মানাবে ভালো এই প্রশংসাও করলো। সারাদিন ভর হৈচৈ আর ব্যস্ততায় কাটলো সবার সময়। পার্লার থেকে মেয়েরা আসলে বিকাল থেকে সাজুগুজু ধুম পরলো মায়ার কাজিনদের মধ্যে। কারণ সন্ধ্যা নাগাদ কনে পক্ষ থেকে এক গাড়ি মেয়েছেলে মিলে যাবে ফাহাদের বাড়ি হলুদের ডালা নিয়ে। সেজন্য যাঁরা বরের বাড়ি যাবে সেই সকল ছেলেমেয়েরা আগে আগে সেজেগুজে নিচ্ছে। কারণ মায়াদের বাড়ির মানুষজন যাওয়ার পর ওদের সাথে আবার বরের বাড়ির মানুষজন আসবে মুক্তাকে হলুদ লাগাতে। আশুগঞ্জ টু ঢাকা যাতায়াতের সময় লাগবে করে সিদ্ধান্ত নিলো বউয়ের বাড়ি থেকে মায়ারা আগে যাবে ফাহাদের বাড়ি। তারপর মায়াদের সঙ্গে বরের বাড়ির মানুষজন আসবে গাড়ি নিয়ে। হৈচৈ করে বাড়ির সকল মেয়েরা এক রঙ্গা শাড়ীর আর অর্নামেন্ট গায়ে জড়ালেও মায়া আর জুই পরলো একদম ভিন্ন। দুবোন একই রকম দেখতে বাসন্তী কালার মসলিন জামদানী জড়াল গায়ে। শাড়ী দুটো বেশ দামী। আরিফ সেদিন ঢাকা থেকে কিনে দিয়েছে বোনদের। জুই শাড়ি সাথে অর্নামেন্ট পরেও খুলে রাখল। মায়ার মতো করে সেও সিম্পল সাজল একই ভাবে। মায়া নিজের বাসন্তী রঙ্গা শাড়ি সাথে একই রকম দেখতে গাঁদাফুলের মালা দুটো দু’হাতে পরলো। মুখে হাল্কা পাতলা মেকআপ করে, ঠোঁটে টকটকে সিধুর লাল লিপস্টিক দিয়ে চোখে মোটা করে কাজল টানল। মায়া বরাবরই মাথায় হিজাব পরে বেড়ায়। স্কুল, কলেজ এমনকি কোথাও গেলেও হিজাব পরে চলাচল করে। খান বাড়িতে যতবার গিয়েছে ঠিক ততবারই মায়া ড্রেসের সাথে হিজাব পরে গিয়েছে। তবে আজ হাতে বাসন্তী রঙ্গের হিজাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পড়বে কি পড়বে না সেই নিয়ে দ্বিধা কাজ করলো। তারপর এই নিয়ে জুইকে জিগ্যেসা করতেই জুই নিষেধ করল, আজ হিজাব না পড়তে। মায়া কেমন দ্বি-মনা করে হাতের হিজাবটা রেখে দিল। তবে চুলগুলো খোলা রাখল না। সুন্দর খোঁপা করে তাতে গাঁদাফুলের একটা মাথা পেঁচাল। কঁপাল থেকে গালের উপর দুই গাজি কাটা চুল ফেলে, কানে ছোট ঝুমকা পরে সাজটা কমপ্লিট করে জুই দিকে তাকাতে, জুই কানে ঝুমকা পড়তে পড়তে মায়াকে দেখে হাত থেমে গেল মূহুর্তে। মায়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে আচানক হেঁসে বলে উঠলো…

‘ বাপরে আগুন! মাশাল্লাহ!

জুইয়ের কথায় মায়া ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। জুই কানের দুল পড়তে পড়তে মায়ার শাড়ির কচি ঠিক করে দিল। দু’বোন একিই রকম সেজেগুজে রুম থেকে বের হতেই সবাই মাশাল্লাহ বলে বলে মুখরিত করলো। মায়ার ছোট ফুপি দুই ভাজতির নজর কাটলো থুপথুপিয়ে। মায়া-জুইকে সাবধানে যেতে বলে আরিফকে ডেকে পাঠাল মেয়েদের নিয়ে যেতে। মায়ার সকল কাজিনরা ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে পনেরোজনের মতোন হলো। একগাড়ীতে সকল মানুষ আঁটবে না বলে ঠিক করলো আরও একটি গাড়ি নিয়ে যাবে। নাদিম সবেমাত্র গাড়ি নিয়ে মায়াদের বাড়িতে ঢুকেছিল। তাঁকে বিশেষ ভাবে দাওয়াত করা হয়েছে হলুদের অনুষ্ঠানে থাকতে। গাড়ী থেকে নেমেই নাদিম আরিফের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে জানতে পারলো তাঁকে যেতে হবে ফাহাদের বাড়িতে। নাদিম না করলো না। বরং সম্মতি দিল। নাদিমের গাড়িতে ওঠার জন্য আরিফ মায়া, জুই, সঙ্গে মায়ার একজন বান্ধবী সুমিকেও ডাকল। বড় ভাইয়ের ডাকে বাধ্য মেয়ের মতোন তিনজনই নেমে আসল প্রথম গাড়ির থেকে। মায়াকে নামতে দেখে বিষন্নয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ি রইল নাদিম। অদ্ভুত ঘোর লাগা দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল মায়ার দিকে। মায়া নত মস্তিষ্কের হেঁটে গিয়ে বসল নাদিমের গাড়িতে। একটা বারের জন্য উপরে দিকে তাকাল না। কিন্তু জুই বেশ কয়েক বার কপাল কুঁচকে নাদিমের ঘোর লাগা দৃষ্টি পরখ করলো মায়ার প্রতি। জুই বিয়ের এতো হৈচৈর মধ্যেও কিছু একটা আচ করেছে নাদিমের পরিবারকে নিয়ে। কিন্তু সে এখনো শিওর না বিষয়টা আদৌও সত্যি কিনা। জুই গাড়িতে বসতে বসতে আবারও তাকাল নাদিমের দিকে। সে এখনো থমকে গিয়ে তাকিয়ে মায়ার দিকে। আর মায়া নিজের কাজে ব্যস্ত। ওর প্রতি কার কি দৃষ্টি সেটাও দেখতে চাইল না। মায়া গাড়ির পিছনে চেপে বসল জুইকে জায়গা দিয়ে, আর জুই মায়ার পাশে বসতে বসতে সুমিকে জায়গা দিল নিজের পাশে বসাল। নাদিম আসিফের ডাকে হুঁশে ফিরে ঘাড় চুলকে ঠোঁট কামড়িয়ে হাসলো। আরিফ পাশের সিটে বসতে নাদিম ঘুরে গিয়ে ডাইভিং সিটে বসল। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে মিরর দিয়ে আরও একবার মায়াকে দেখে নিল।
~~
সন্ধ্যা সাতটা। অবস্থানটা ফাহাদদের নিজস্ব বাড়িতে। এবার বিয়ের আয়োজন খান বাড়িতে নয় বরং ফাহাদদের নিজস্ব বাড়িতে করা হচ্ছে। মুক্তা ফাহাদের বিয়েটা যেহেতু আগেই হয়েছিল সেক্ষেত্রে পুনরায় বিয়ে হবে না শুধু নিয়ম মেনে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের আয়োজন হবে। আর এই বিয়ের অনুষ্ঠানটা খান বাড়িতে নয় বরং ফাহাদের নিজস্ব বাড়িতে হচ্ছে। সময়টা সন্ধ্যা ছয়টা পার হয়ে সাতটার ঘরে পৌঁছাল। ফাহাদদের বাড়িতে মায়ারা পৌঁছিয়েছে আরও ঘন্টা খানিক আগে। এর মাঝে মায়াদের মেহমানদারি প্রায় শেষ। ফাহাদের বাড়িতে এসে মায়া সকলের দেখা পেল এমনকি রিদের কাজিন হিসাবে শ্রেয়াকেও ফাহাদের বিয়েতে উপস্থিত পেল। বিশাল আয়োজনে মুখরিত ফাহাদদের শেখ বাড়ি। পুরো তিনতলা ভবনটি ফেইরী লাইট থেকে শুরু করে ভারি ডেকোরেশনে সাজানো হয়েছে সামনের গেইট পযন্ত। তিনতলা ভবনটি সম্পূর্ণ ফাহাদের বাবার। এই বাড়িতে মায়া আজ প্রথম আসল। আগেবার মুক্তা-ফাহাদের আকদ সময় খান বাড়িতে হয়েছিল। তাই মায়ার কখনো ফাহাদের নিজস্ব বাড়িতে আসা হয়নি। বিয়ে বাড়িতে মায়া অসংখ্য মেহমানদের আনাগোনা দেখতে পেল। শুধু বাদ রইল রিদ খান আর আসিফ। রিদ খান নেই তারমানে আসিফও আসবে না। মায়া বুঝে না রিদ খান এতো সমাজ ছাড়া কেন? নিজের ফুপাতো ভাইয়ের বিয়েতে অ্যাটেন্ড হবে তাতে এতো তালবাহানা করে কেন? এই লোককে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে, যেতে চাইনা কেন সে? পারিবারিক অনুষ্ঠানও কেউ মিস করে বুঝি? কি জানি! ফাহাদের হলুদের স্টেজ করা হয়েছে বাড়ির ছাঁদে। মায়া ছাদের এক কোণে স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে রইল হাতে হলুদের তত্ত্বের ডালা নিয়ে। ফাহাদকে সবাইকে নিচ থেকে নিয়ে আসবে ঢোল বাজিয়ে। তাই আপাতত ছাঁদে তেমন কেউ নেই। সবাই নিচে। হাতে গোনা দশবারো জনের মতো হবে ছাঁদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। মায়া হাতের ডালাটা নিয়ে আশেপাশে তাকাল। সন্ধ্যার ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে অদ্ভুত ভালো-লাগা সৃষ্টি করছে। আজ সারাদিন ঠান্ডা হওয়া বইছে। মায়া আবারও মনে হচ্ছে আজ ভালো কিছু নয়তো ভালো কিছু হবে ওর সাথে। মায়া ভারি নিশ্বাস ফেলে অনুসন্ধান চোখে জুইয়ের খুঁজ করল। ডালা হাতে আশেপাশে বেখেয়ালি চোখ বুলাল। তখন দেখা গেল ফর্মাল গেটআপে রিদকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে। হয়তো এখনো মায়াকে লক্ষ করেনি। কিন্তু মায়ার চোখে ঠিকই পরলো গুরুগম্ভীর আর মেজাজী রিদকে। রিদ ধুপধাপ পা ফেলে বিরুক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে কানে ফোন চেপে কথা বলতে বলতে উপরে উঠছে। মায়া খুব আস্তে করে ওর বেখেয়ালি দৃষ্টি রিদ থেকে সরিয়ে নিতে গিয়েও আবারও তাকাল কি মনে করে। পুরো কালো গেটআপে এসেছে রিদ। দু’হাতের শার্ট কুইন পযন্ত টেনে গুটানো। গায়ে কোটটা হাতের মুঠোয় ঝুলিয়ে। মায়া ভাবলো, এই লোক কি সোজা অফিস থেকে এসেছে এখানে? লোকটা কি ক্লান্ত? দেখেতো তাই মনে হচ্ছে মায়ার? মায়া কৌতুহল দমাতে ধীরেই রিদ থেকে নিজের দৃষ্টি ঘুরাতে মূহুর্তে কানে আসল কিছু পরার শব্দ। মায়া চমকে উঠল। মূহুর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে দেখতে পেল রিদের ফোনটি ততক্ষণে মাটিতে পরে আছে। আর রিদ থমকে যাওয়ার মতোন স্তব্ধ হয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে। মায়া থতমত খেয়ে গেল রিদের থমকে যাওয়ার সৃষ্টিতে চোখ পরে। জড়তার আর অস্বস্তি বোধে হাসফাস করে দৃষ্টি ঘুরাল। মায়ার এতো অস্বস্তিত বোধেও রিদ নিজের দৃষ্টি সরাল না। মূলত এই নিয়ে রিদের মাঝে পরিবর্তন ঘটল না। সেই একই ভাবে মায়ার দিকে থমকে যাওয়া ভঙ্গিতে তাকিয়ে। মায়া আঁড়চোখে রিদের দিকে তাকাল। সাথে সাথে চোখ মিলল রিদের দৃষ্টিতে। মায়ার অস্বস্তি বাড়লো। হাসফাস করে ডালা হাতে রিদের দিকে পিঠ বেঁকে দাঁড়াল। মায়া বুঝতে পারছে রিদ এখনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর দিকে। মায়া হাতের ডালাটা স্টেজের সামনে আস্তে করে রেখে রিদের চোখের সামনে থেকে পালাতে চাইল। মিনমিন করে আস্তে ধীরে ছাঁদে অপর কোণায় যেতে চাইল। কারণ সিঁড়ি বেয়ে নামার কোনো উপায় নেই, রিদ সিঁড়ি ঘরে দরজার দাঁড়িয়ে। আসিফ রিদের পিছন পিছন উঠে আসল ছাঁদে। রিদকে থমকে যাওয়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসল সেদিকে। রিদের ফোন নিচে পরে থাকতে দেখে দ্রুত পদে সেটা হাতে তুলে দেখল ঠিক আছে কিনা। যখন ঠিকঠাক দেখতে পেল তখন সুস্হির হলো। তবে বেশ সন্দেহ হলো রিদের থমকানো মনোভাব দেখে। রিদের ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে আস্ত করে ডেকে বলল আসিফ…

‘ ভাই আপনার ফোন।

আসিফ ডাক রিদের কান অবধি পোঁছাল কিনা সন্দেহ। আসিফ পুনরায় রিদের মনোযোগ পেতে ডাকল।

‘ ভাই?
‘হু?

রিদ বেখেয়ালি, অমনোযোগী লালাভ দৃষ্টি ঘুরাল আসিফের দিকে। এক সেকেন্ড ভিতর পুনরায় সেই নেশাক্ত দৃষ্টি ঘুরাল মায়ার উপর। আসিফ চট করে বুঝে গেল রিদের থমকে যাওয়া মনোভাব। রিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে মায়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে আস্তে করে পিছন সরে গেল রিদের ফোন নিয়ে। রিদকে আর বিরক্ত না করল না আসিফ। আসিফ চলে যেতেই রিদ মোহাচ্ছন্ন ঘোরে মায়ার দিকে এগোতে চাইল। কয়েক কদম এগোতে হৈচৈ করে ফাহাদকে নিয়ে সবাই উপস্থিত হলো ছাঁদে। দেখতে দেখতে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পুরো ছাঁদে নাচ-গানের ছেলেমেয়েদের হৈচৈ পরে গেল। মায়া এগিয়ে গিয়ে সেই ভিড়ে দাঁড়াল জুই, শ্রেয়া, সেঁজুতি পাশে। রিদ তখনো সেই ভিড়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে। তাঁর আজ এতো হৈচৈ রাগ লাগছে না। বরং বউয়ের নেশায় আসক্ত হয়ে এই মূহুর্তে সবকিছুতে মাতাল মনে হচ্ছে। মায়া ভিড়ের ভিতর থেকেও চুরি করে উঁকি মেরে তাকাল রিদের দিকে। সাথে সাথে আবারও চোখাচোখি হয়ে গেল রিদের সাথে। মায়া চমকে উঠে তক্ষুনি ঘাড় ঘুরাল। বিরবির করে বলতে লাগল, আর জীবনেও মায়া তাকাবে না সে রিদ খানের দিকে। কেমন বেহায়ার মতোন তাকিয়ে লোকটা। মায়ার অস্তিত্ব লাগাটাও বুঝতে চাইছে না আজব! ফাহাদকে স্টেজে বসিয়ে সেঁজুতি ওর কাজিনদের নিয়ে টেবিলে কাটা ফল গুছিয়ে রাখছে। মায়া স্টেজের এককোণায় দাঁড়াল জুইয়ের পিছনে। মায়া তাকাবে না, তাকাবে না, করেও জুইয়ের পিছন থেকে হাল্কা উঁকি মেরে আবারও তাকাল ছাঁদের অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিদের দিকে। তক্ষুনি চোখে পরলো অতি সুন্দরী শশীকে। যে কলমা রঙ্গা ফিনফিনে পাতলা মসলিন জামদানী শাড়িটি পড়ে রিদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। শশীর সোনালি চুল গুলো ছেড়ে পিঠে ছড়িয়ে। তবে গায়ের ব্রাউজটা মাজিত আর শালীনভাবেই পরেছে। কুইন পযন্ত ব্লাউজের হাতা দু’টো। পাতলা শাড়িতে ফর্সা পেট দেখা গেলেও পিঠ ডাকা চুলে। একটা আধুনিক স্মার্ট মেয়েরা যেমন ভাবে শাড়ি পড়ে ঠিক তেমন ভাবেই পড়েছে শশী। দেখতে শশীকে শালীন আর মাজিতই লাগছে। তবে এই মূহুর্তে মায়ার দৃষ্টি শশী সৌন্দর্য্যতা থেকে হাতের উপর বেশি। রিদকে একটা খালি গ্লাসে লেবুর শরবতের পানি তুলে দিচ্ছে সে। রিদ ক্লান্তিতা দূর করতে শশীর হাতের সেই গ্লাস তুলে নিয়ে চট করে পানিটুকু পান করে পুনরায় শশীর হাতে খালি গ্লাসটা তুলে দিল। শশী খালি গ্লাসটা হাতে নিলো ঠিক কিন্তু সেই সাথে রিদের হাত থেকে ওর কোটটাও নিজের কাছে টেনে নিলো। মায়া উদাস চোখে সেই সব দেখল। বিগত দুই দিনে মায়া শশীকে দেখে যতটুকু বুঝল মেয়েটি বেশ যত্নশীল রিদের প্রতি। হবেই না কেন? ভালোবাসার মানুষের যত্ন সবাই করতে চাই। মায়ার স্বামীকে খোঁজে পেলে মায়াও এমনভাবে বেশ যত্ন করবে। যত্ন করতে করতে দরকার পরলে স্বামী চোখে মুখে ঢুকে পরবে তারপরও লোকটার অযত্ন করবে না কখনো। মায়ার কতো সাধনার স্বামী হবে লোকটা। অযত্ন করা প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু কথা হলো লোকটাকে মায়া কখন খোঁজে পাবে আল্লাহ জানে। মায়ার হাতে থাকা ফোনটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আশেপাশে নজর ঘুরাল। উচ্চস্বরে গান-বাজনা সাথে সাথে মানুষজনের ভিড় বেশি। তাই এই মূহুর্তে মায়া ঐ লোকটাকে কল করবে না বরং একটু পর কল দিবে ভিড় কমে আসলে। আসিফ তাড়াহুড়ো নেয় রিদের দিকে এগিয়ে আসল। আস্তে করে রিদকে কিছু একটা বলতে রিদের গম্ভীর মুখটা চট করে রাগের আভাস পেল মায়া। এক মূহুর্ত দেরি না করে রিদ তৎক্ষনাৎ হাঁটল সিঁড়ি দিকে। আসিফ খানিকটা দ্রুত পদ মিলাল রিদের পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে। মায়া রিদের চলে যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখল। তারপর খুব স্বাভাবিক নেয় স্টেজে বসা ফাহাদের দিকে তাকাল। আয়ন ফাহাদদের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রিদের পিছু পিছু আসিফকে ছুটতে দেখে আয়ন সেদিকে এগিয়ে এসে আসিফকে খাক ছেড়ে ডেকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো।

‘ আফিস? এই অসময়ে আবার কোথায় যাচ্ছে তোমরা?

আয়নকে দেখে আসিফ তাড়াহুড়োয় সেদিকে এগিয়ে আসল। আসিফের হাতে থাকা রিদের ফোনটা আয়নের হাতে তুলে দিতে দিতে ব্যস্ত গলায় বলল।

‘ ভাই নিন! একটু রিদ ভাইয়ের ফোনটা রাখেন আপনার কাছে। আমরা এখন একটা জায়গা যাচ্ছি জরুরি ভাবে। রাদিফ ভাই নাকি কার সাথে ঝামেলায় জড়িয়েছে। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।

আসিফের কথায় আয়ন অস্থির চিত্তের বলল…
‘ সেকি? রাদিফ দেশে আসতে না আসতেই ঝামেলায় জড়িয়ে পরলো কার সাথে? ওহ তো ভালো ছেলে। ওহ আবার কার সাথে ঝামেলায় জড়াল? কি হয়েছে? চলো আমি যাব তোমাদের সাথে।

আসিফ বাঁধা দিয়ে বলল…
‘ না ভাই আপনি এখানেই থাকেন। যদি এদিকে কোনো ঝামেলা হয় তাহলে সামলে নিয়েন। তাছাড়া রিদ ভাই যাচ্ছেন, সবটা এখন এমনই ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পেয়েন না।

‘ ভয়তো রাদিফকে নিয়ে নয় রিদকে নিয়ে পাচ্ছি আসিফ। ওহ যা মাথা গরম মানুষ। ঝামেলা কমবে না আরও বাড়াবে।

‘ ভয় পেয়েন না ভাই। রিদ ভাই ঠিক সামলে নিবে।

‘ আচ্ছা! বেশি সমস্যা হলে আমাকে ফোন করে জানিও।
‘ আচ্ছা ভাই।

আসিফ তাড়াহুড়ো চলে যেতে চাইল আবারও পিছন ডাকল আয়ন বলল…

‘ আরে ফোন তো আমাকে দিয়ে যাচ্ছো আসিফ। কল দিবে কিভাবে?

আসিফ রিদের পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে খাক ছেড়ে বলল…

‘ ঐটা রিদ ভাইয়ের ফোন। এখন আপনার কাছে রাখেন ভাই। কোনো সমস্যা হলে, আমি আমার ফোন থেকে আপনাকে কল দিব।

আয়ন নিজের সাথে রিদের ফোন নিয়ে চলল ছাঁদে উদ্দেশ্য। অনেক সময় ধরে সে বাহিরে। জুই বারবার মেসেজ করছে তাঁকে দেখা করার জন্য। আয়ন ছাঁদে চলল জুইয়ের উদ্দেশ্য। কিন্তু হলরুমে দিকে এগোতে দেখা হলো ভয়ার্ত হেনা খানের সঙ্গে। তিনি মূলত আয়নের খোঁজে ছিল এতক্ষণ যাবত। আরাফ খানের হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হলো। কিসব হাবিজাবি খেয়েছে নাকি ঔষধ অনিয়মে এমন হয়েছে সঠিক জানে নেই হেনা খান। আরাফ খান যখন হুট করে বুকের ব্যথায় বসাঘরে সোফায় বসে বুক চেপে কাতরাচ্ছিল তখন সবাই ধরাধরি করে উনাকে নিয়ে শুয়াল রুমে। হেনা খান এতক্ষণ পর আয়নকে বসারঘরে ঢুকতে দেখে তিনি দ্রুত এগিয়ে আসল। আয়নকে আরাফ খানের কথা জানাতে সেও তৎক্ষনাৎ ছুটলো সেদিকে। উত্তেজিত আয়ন সেদিকে দ্রুত দৌড়াতে গিয়ে পাশে থাকা সেঁজুতি কাছে বেখেয়ালি ভাবে নিজের আর রিদের ফোনটা দিয়ে গেল। যেহেতু আয়ন একজন পেশায় হার্ট সার্জেন। তাই আরাফ খান আয়নেরই একজন রোগী। সেজন্য ডাক্তার হিসাবে আয়নের জানা আরাফ খানে বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে।
~~
স্টেজের সাজানো জন্য মিষ্টি আর সন্দেশের ঢালা হাতে নিয়ে কোনো রকমের ছাঁদে উঠলো সেঁজুতি। একহাতে মিষ্টি বড় ঢালা তো অপর হাতে আয়ন, রিদ, আর নিজের ফোন তিনটি চেপে ধরা। শাড়ি পড়ে একহাতে এতো বড় মিষ্টির ঢালা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিল সেঁজুতি। একহাতে তিনটা ফোন থাকায়, দু’হাতে মিষ্টির ঢালাটাও সামলে ধরতে পারছিল না সে। মায়া স্টেজের সামনে থেকে সেঁজুতি অবস্থান পরখ করে দ্রুত এগিয়ে আসল সেঁজুতিকে সাহায্য করতে। দেখায় যাচ্ছিল সেঁজুতি অতো গুলো জিনিস একত্রে সামলাতে পারছে না। মাা এগিয়ে আসতে আসতে সেঁজুতিকে বিনয়ে বলল..

‘ আপু হেল্প করবো তোমার?

সেঁজুতি মায়াকে দেখে আশ্বস্ত হলো। নিজের ফোনটা রেখে রিদ আর আয়নের ফোন দুটো মায়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ তুমি এসেছো ভালো হয়েছে। এই দু’টো ফোন তোমার কাছে রাখো। আমি যখন চাইবো তখন দিয়ো কেমন?

‘ আচ্ছা আপু।

মায়া ঘাড় কাত করে সম্মতি জানি ফোন দুটো হাতে নিলো। দুটো ফোন দেখতে একই রকম। আইফোন ফিফটিন প্রো-মেক্স। সাদা রঙ্গা ফোন দুটো দেখতে একদম নতুন। দেখে বুঝার উপায় নেই কার ফোন কোনটা। মায়া জানতেও চাইল না ফোন গুলো কার কার। বরং নিজের কমদামি ফোনটার সাথে দামি দুটো ফোন নিয়ে ঘুরলো এক ঘন্টার মতোন। সময় তখন সাতটা থেকে আটটার ঘরে। মায়া স্টেজের সামনে পাতা চেয়ার গুলোতে অলস ভঙ্গিতে বসে। এতক্ষণ মায়ার সাথে নাদিমও বসে ছিল তবে দুজনের মধ্যে কারও কথা হয়নি। নাদিম এমনই মায়ার পাশে বসে ছিল বলে মায়াও অস্তিত্ব বোধ করেনি। কিন্তু একটু আগেই আরিফের ডাকে চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় নাদিম। চারপাশে হাল্কা মিউজিকে গান ছাড়া। ফাহাদকে মায়াদের কাজিন গুলো একে একে হলুদ লাগাচ্ছে। শালী হিসাবে মায়া আর জুই সবার প্রথমে হলুদ লাগিয়ে ছিল বলে এখন মায়া অলস ভঙ্গিতে এখানে বসে। কোলের উপর সেঁজুতির দেওয়া দুটো ফোন অবহেলায় পরে আছে। মায়া কি মনে করে নিজের স্বামীকে কল দিতে মন চাইল। ব্যস্ততার জন্য মায়া আজ সারাদিন নিজের স্বামীর খোঁজ দিতে পারেনি। এমনকি একটা মেসেজ পযন্ত করেনি। মায়া জুইকে ডেকে ওদের দুজনের ব্যবহিত ফোনটা চেয়ে নিলো। মেসেজ অপশনে গিয়ে রিদের মুখস্থ করা নাম্বারটা তুলে ফটাফট মেসেজ লেখল’
এক, দুই, তিন আজ ভালোবাসার দিন!
চার, পাঁচ, ছয় আজ যদি বাসর হয়?
সাত, আট,নয় আমি হবো জয়, তুমি হবে পরাজয়!

স্বামীকে ডিস্টার্ব করতে মায়া মনগড়া ছন্দ লেখে পাঠাতেই টুং করে মায়ার কোলের উপর রিদের ফোনটা বেজে উঠল। মায়া নিজের ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে বেখেয়ালি ভাবে তাকাল কোলের উপর পরে থাকা দু’টো ফোনের দিকে। ফোন দুটোট স্ক্রীন একত্রে থাকায় মায়া দেখতে পেল না ফোনের মেসেজটি কিসের। মায়া ভাবল হয়তো ফোনের মালিকের কোনো মেসেজ-টেসেজ হবে। মায়া গুরুত্ব না দিয়ে পুনরায় একই ভাবে স্বামীকে মানে রিদকে মেসেজ করে লেখল…
‘ শুনুন স্বামী সাহেব! আজকে আপনি আমার ফোন রিসিভ না করলে আমি কিন্তু একটা প্রেম করবো। ছেলেও কিন্তু আমি ঠিক করে রেখেছি। অনেক হ্যান্ডসাম আর অনেক সুন্দর সে।

মায়া মেসেজ সেন্ট করতে করতে আবারও সেই একই ভাবে কোলের উপর ফোনটি টুং করে মেসেজের শব্দ করে উঠল। এবারও মায়া শুনলো কিন্তু তেমন গায়ে মাখলো না। বরং আবারও স্বামীকে হুমকি দিতে দিতে মেসেজ লেখল…

‘ সত্যি বলছি ছেলে কিন্তু অনেক সুন্দর। আমি কিন্তু প্রেমে পরে যাব, আপনি কল রিসিভ না করলে। আপনি আমার কলটা রিসিভ করলে প্রেমটা বাতিলও হতে পারে।

মায়া আবারও মেসেজ পাঠাল। আবারও সেই একই ভাবে কোলের উপরে রিদের ফোনটা টুং করে মেসেজের শব্দ করে উঠল। প্রতিবারে মায়ার মেসেজের সাথে সাথে ওর কোলের উপর ফোনটা শব্দ করে উঠছে সেটা মায়া খেয়াল করেনি তেমন। মূলত মায়ার ধারণাতে নেই যে, মায়ার স্বামীর ফোন ওর কোলে থাকতে পারে সেটা নিয়ে। তবে আজ বোধহয় ভাগ্য মায়া সাথে ছিল। অদেখা, অদৃশ্য সকল সুতো ছিড়ে আজ ভাগ্য মায়ার হতে চলল। নয়তো রিদের ফোন, প্রথমে আসিফ তারপর আয়ন, এরপর আয়ন থেকে সেঁজুতি, আর এখন সেঁজুতি থেকে সোজা মায়ার হাতে চলে আসল। এই সবটাই হলো মায়ার ভাগ্যের জোরে। আজ প্রকৃতিও চাইছে মায়া ওর স্বামীর বিরহ থেকে নিস্তার পাক। অনেক তো হলো লুকোচুরি এবার না-হয় মুখোমুখি হোক মায়া নিজের স্বামীর। মায়া যখন নিজের স্বামীকে হুমকি ধামকি দিয়ে মেসেজ পাঠাল কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো রিপ্লাই আসল না। তক্ষুনি মায়া উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরে কিছু একটা ভাবল। তারপর চট করে নিখোঁজ স্বামীকে কল মিলাতেই মায়ার কোলের উপর রিদের ফোনটা অবহেলায় বেজে উঠল তক্ষুনি। মায়া নিজের কানে ফোন চেপে ধরা অবস্থায় বেখেয়ালি ভাবে কোলের উপর বাজতে থাকা ফোনটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আশেপাশে অনুসন্ধান চোখে সেঁজুতিকে খোঁজল ফোন গুলো দিয়ে দিতে। কিন্তু ছাঁদের আশেপাশে কোথায় সেঁজুতিকে দেখতে না পেয়ে মায়া আর ঘাঁটাল না কোলের উপর বাজতে থাকা ফোনটাকে নিয়ে। ভাবলো হয়তো কল বাজতে বাজতে একটা সময় এমনই থেমে যাবে। হলো তাই! কোলের ফোনটা রিং হতে হতে একটা সময় বন্ধ হয়ে গেল। সেই সাথে সাথে মায়াও নিজের কান থেকে ফোনটা নামিয়ে হাতে নিলো। মনে মনে ভাবল! মায়ার স্বামী হয়তো মায়ার হুমকি গুলোকে সিরিয়াস নেয়নি। তাই মায়াও আজ সর্বোচ্চ বিরক্ত করবে এই লোককে। কিভাবে মায়ার কল আজ রিসিভ না করে থাকে সেটাও আজ দেখবে মায়া। মায়া অনেকটা রাগ নিয়েই দ্বিতীয়বারের মতোন কল করতেই সেই একই ভাবে কোলের উপর থাকা দুটো ফোনের একটা ফোন আবারও বেজে উঠল। মায়া এবার বেশ বিরক্ত হলো। তবে মায়া কোলের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল না কে কল দিয়েছে। পারমিশন ছাড়া অন্যের ফোন ধরা খারাপ বলে মায়া বিষয়টি এরিয়ে গেল। আবারও সেই একই কাজ হলো, কোলের ফোনটা রিং বাজতে বাজাতে বন্ধ হতেই মায়াও কান থেকে নিজের ফোনটা নামাল। মায়া এবার আরও বিরক্ত হলো। আশ্চর্য! মায়া যখন ফোন দেয় তখনই কেন এই বজ্জাত ফোনটাকে বাজতে হবে? মায়ার কল করার আগে বা পরে যেকোনো সময় বজ্জাত ফোনটা বাজলেও পারে আজব। মায়া বিরক্তি আর রাগ নিয়ে তৃতীয়বারের মতোন স্বামীকে উদ্দেশ্য কল লাগাতে, আবারও সেই একই ভাবে মায়ার কোলের উপর রিদের ফোনটা বেজে উঠতে মায়া এবার, বেশ বিরক্তি নিয়েই রিদের ফোনটা হাতে নিলো। ভাবল কলটা কেটে দিবে। বারবার কানে কাছে অযথা ফোনের রিংটোনের শব্দটা ভালো লাগছে না মায়ার। যেহেতু আশেপাশে ফোনের মালিক নেই, তাই কলটা রিসিভ করার মতোন মানুষও নেই। অনবরত রিং বাজতে থাকা ফোনটা মায়া হাতে নিলো কলটা কেটে দিবে বলে। কিন্তু কাঁটতে গিয়ে বেখেয়ালি চোখ পরলো ফোনের স্ক্রিনের উপর নামটার দিকে ‘ বেয়াদব বউ’ নামে নাম্বারটা সেইভ দেখে মায়া বুঝল ফোনের মালিকের বউ হয়তো তাঁর খোঁজে কল করেছে। কিন্তু ফোনের মালিক তো এই মূহুর্তে আশেপাশে নেই। তাই মায়া কলটা কাঁটার আগে আবারও অনুসন্ধানের চোখ ঘুরিয়ে সেঁজুতিকে আশেপাশে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ মায়ার কপাল কুঁচকে এলো কিছু একটা মনে হতেই। এক মিনিট! ফোনের স্ক্রিনে বেয়াদব বউ’ নামের নিচে মায়া নাম্বারটা কার দেখল? ওটা মায়ার ফোন নাম্বার ছিল না? মায়া চমকে উঠে তৎক্ষনাৎ ফোনের স্ক্রিনে দিকে তাকাল। গুটি গুটি সংখ্যা নিজের নাম্বারটা মিলাতে পেরে হাত কেঁপে উঠে মূহুর্তে ফোনটা পরে গেল কোলে। আর মায়ার ফোনটাও ততক্ষণে কান থেকে নিচে পরে আছে। মায়া অতি উত্তেজনায় অস্থির হয়ে তরতর করে কাঁপতে লাগল। বহু প্রত্যাশিত পর আজ মায়া নিজের স্বামীকে এভাবে হুট করে পেয়ে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি ওহ। মায়ার ফোনটা ফ্লোরে পরে থাকায় অবস্থায় বাজতে বাজতে একটা সময় বন্ধ হয়ে যেতেই কোলের উপর রিদের ফোনটাও রিং অফ হয়ে স্ক্রিনে লাইট জ্বলে উঠলো। মায়া কম্পিত হাতে ছলছল চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল, এতক্ষণ ধরে মায়ার সবগুলো মেসেজ ফোনের উপর ভাসছে ‘বেয়াদব বউ’ নামে। মায়া কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনের স্ক্রিনের লক খুলতে চাইল ফোনটি কার সেটা দেখার জন্য। কিন্তু ফোনে পাসওয়ার্ড দেওয়ায় খুলতে পারলো না। শুধু নিজের মেসেজ গুলো উপর দিয়ে দেখতে পেল মায়া। এতক্ষণ মায়া যা উল্টো পাল্টা মেসেজ করেছিল সবগুলো এখানে দৃশ্যমান। হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে যাওয়ায় মায়া মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল। আজ এই কান্না মায়ার কষ্টের নয় বরং অতি আনন্দের। দুটো বছর, অনেকটা দিন পর মায়া আজ নিজের স্বামীর মুখোমুখি চলেছে। এই খুশি, এই অস্থিরতা মায়া কোথায় রাখবে? মায়া নিজের কান্না আটকে স্বামীর ফোনটা বুকে আঁকড়ে মাথা ঝুকে বসল। এই সময়ে কান্নাকাটি করে মায়া সময় নষ্ট করবে না। আর কোনো কিছুর বিনিময়ে মায়া নিজের স্বামীকে হারাতে দিবে না। ফোনটা যখন মায়ার কোলে এসেছে তারমানে মায়ার স্বামী খান বাড়ির ছেলেদের মধ্যে কেউ হবে? কিন্তু কে? আচ্ছা এমনটা নয়তো যে লোকটা মায়াকে পূর্ব থেকে চিনে, ইচ্ছাকৃত ভাবে মায়ার কাছে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। মায়ার সামনে আসতে চাইছে না। কিন্তু কেন? কেন এতো লুকোচুরি? মায়া এই লোকটাকে এবার এতো সহজে যেতে দিবে না। এই লুকোচুরি খেলাটায় আজ মায়া যেকোনো হোক শেষ করবে। লোকটার মুখোমুখি হয়ে মায়া দাঁড়াবেই।

চোখের পানি মুছে মায়া দ্রুত নিচ থেকে ওর ফোনটা তুলে উঠে দাঁড়াল। রিদের ফোনটার পাশাপাশি কোল থেকে আয়নের ফোনটাও হাতে নিয়ে দেখলো দুটো একই রকম দেখতে, একই মডেলের ফোন। মায়া পার্থক্য করতে পারছে না কোনটা কার ফোন হতে পারে। মায়া নিজের স্বামীর ফোনটা বুকে চেপে অপর হাতে দ্বিতীয় ফোনটা আনলক করতে চাইল। দেখতে চাইল ফোনটা আসলে কার। কিন্তু মায়াকে নিরাশ করে দ্বিতীয় ফোনটাও একই ভাবে পাসওয়ার্ড দেওয়া। মায়া দ্রুত মোবাইল দু’টোর ওয়ালপেপার চেক করলো কারও ছবি দেওয়া আছে কিনা, যেটা দেখে মায়া মানুষ চিহ্নিত করতে পারবে। কিন্তু মায়াকে আবারও নিরাশ করে দু’টো ফোনের একটাতেও ওয়ালপেপারে কোনো ব্যক্তি ছবি দেওয়া নেই। মায়া অতি উত্তেজনায় ছটফটিয়ে উঠল। কিভাবে লোকটাকে চিহ্নিত করবে সেই চিন্তায় একই জায়গায় বারবার অস্থির নেয় পায়চারি করল। চট করে মায়ার মাথায় আসল, ফোন দু’টো সেঁজুতি দিয়েছি মায়াকে! তারমানে সেঁজুতি বলতে পারবে এই ফোন গুলোর মালিক কারা? মায়া তড়াক করে অস্থির নেয় আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে সেঁজুতিকে খুঁজলো। দেখতে পেল মায়ার ঠিক পিছনে ছাঁদের একপাশে দাঁড়িয়ে সেঁজুতি স্টেজে বসা ফাহাদের ছবি তুলছে। মায়া ছটফটিয়ে দ্রুত হাঁটল সেদিকে। সেঁজুতির পাশাপাশি দাঁড়াতে দাঁড়াতে অস্থির নেয় হাতের ফোন গুলো সেঁজুতিকে দেখাতে দেখাতে উত্তেজনায় প্রশ্ন করে বলল…

‘ আপু এই ফোন গুলো কার?

সেঁজুতি ফাহাদের ছবি তুলায় এতোটায় মনোযোগী যে মায়া অস্থির মুখটা চোখ আওড়িয়ে দেখল না ওহ। বরং সামনে তাকিয়ে মায়ার উত্তর দিয়ে বলল…

‘ আয়ন ভাইয়া হবে।

আয়ন! আয়ন! মায়া বেশ কয়েকবার নিজের মনে মনে আয়নের নামটা আওড়াল। মায়ার আগেই সন্দেহ হয়েছিল আয়নকে। এখন সেঁজুতির মুখে আয়নের নামটা শুনতে আরও দৃঢ় বিশ্বাস হলো, যে আয়ন সাথে মায়ার স্বামীর কোনো সম্পর্কিত থাকতে পারে। তবে মায়ার মনে একটা খচখচ সৃষ্টি হলো। সেই প্রথম দিন যখন মায়া নিজের স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলেছিল তখন লোকটা নিজের নাম ‘ আব্রাহাম ‘কেন বলেছিল? তাহলে আব্রাহাম কে? নাকি আয়নের অপর নাম আব্রাহাম? সেঁজুতি নিশ্চয়ই বলতে পারবে আব্রাহাম লোকটা আয়ন কিনা? মায়া দু’হাতে দুটো ফোন আঁকড়ে, ডানহাতে থাকা রিদের ফোনটা সেঁজুতির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কৌশলে জানতে চেয়ে বলল মায়া…

‘ আপু এটা মনেহয় আব্রাহাম ভাইয়া ফোন হবে। তুমি দেখো তো।

সেঁজুতি দু’হাতে নিজের ফোনটা উঁচু করে ধরে স্টেজে বসা ফাহাদের ছবি তুলতে তুলতে বলল…

‘ ওহ হবে হয়তো! আমি জানি না। মনে হয় আয়ন ভাইয়ার কাছে আব্রাহাম ভাইয়া ফোনটা রেখে গেছে। তুমি ফোন দুটো রাখো মায়া। ভাইয়ারা আসলে নিয়ে যাবে। তবে তুমি ভুলেও আব্রাহাম ভাইয়ার কোনো কল আসলে রিসিভ করো না। ভাইয়া যে রাগী মানুষ, তুমি উনার কল রিসিভ করেছো শুনলে রেগে যাবে।

মায়া থমকে দাঁড়াল। সর্বাঙ্গে জোরে কম্পন সৃষ্টি হলো মূহুর্তে। হাত-পা দূর্বলতায় ভেঙ্গে আসার জোগাড় হলো। মায়া মনে মনে আব্রাহাম! আব্রাহাম! নামটা বেশ কয়েকবার আওড়াল। সাথে এ ও ভাবল আব্রাহাম আর আয়ন দুটো আলাদা মানুষ। আয়ন ভাইয়া আব্রাহাম নামের লোকটা নয়। সে ভিন্ন কেউ। উত্তেজিত মায়া আরও উত্তেজিত হলো। সেঁজুতির মুখে স্বাভাবিক নেয় আব্রাহাম ভাইয়া নামটা সম্মোধন করার ধরনের বুঝল সেঁজুতি আপনজনদের মধ্যে কেউ মায়ার স্বামী। সেঁজুতি চিনে আব্রাহাম নামের মানুষটাকে। সেঁজুতির ভাই হয়। তাহলে সেদিন লোকটা মায়াকে নিজের নাম মিথ্যা বলেনি। সত্যিই বলেছিল। কিন্তু কে এই আব্রাহাম নামের লোকটা? মায়ার জানতে হবে। মায়া কলিজা কাঁপছে ভিতরকার অস্থিরতার ছটফটে। গলা শুকিয়ে কাটকাট। ভয়ানক পানি তৃষ্ণা পেল মায়ার। মায়া মনে হচ্ছে নিঃশক্তিতে তরতর করে কেঁপে যেকোনো সময় জ্ঞান হারিয়ে পরবে। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মায়ার কাঁপা কাঁপা হাতটা গুটিয়ে নিলো রিদের ফোনটা আবারও মুঠোয় চাপলো। এই ফোন মায়া ততক্ষণ ছাড়বে না যতক্ষণ না পযন্ত মায়া আব্রাহাম মানুষটাকে চিহ্নিত করতে পারছে। আজ যেকোনো মূল্যে হোক মায়া লোকটাকে খোঁজে বের করবেই। মায়া হা করে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সেঁজুতির দিকে তাকাল। ওর গলা কাঁপছে সেঁজুতিকে আব্রাহাম নামের মানুষটাকে নিয়ে প্রশ্ন করতে। তারপর মায়া মনে সাহস যুগিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে প্রশ্ন করল…

‘ আব্রাহাম তোমার কোন ভাইয়া আপু?

সেঁজুতি একই ভাবে সামনে ছবি তুলতে তুলতে খানিকটা হতবাক গলায় শুধালো…

‘ তুমি এতোদিনে আব্রাহাম ভাইকে চিনো না? কি বলো এসব? ভাইয়া এতো পপুলার একজন মানুষ। আর তাঁকে চিনে না তারই সুন্দরী বিয়াইন? ভেরি বেড।

অধৈর্য গলায় মায়া আওড়াল…
‘ আপু বলো না প্লিজ! আব্রাহাম তোমার কোন ভাইয়া নাম?

সেঁজুতি একই ভাবে বলল…

‘ তুমি রিদ খানকে চিনো না? রিদ ভাইয়ের পুরো নামই হলো ‘আব্রাহাম রিদ খান।

‘ কিহহহ?

মায়া হঠাৎ চেঁচানোতে চমকানো ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে পিছন ঘুরলো সেঁজুতি। মায়ার হঠাৎ চিৎকারে একটু জন্য হাত থেকে ফোনটা পরেনি ওর। রিদের সামান্য নামটা শুনাতে মায়া এই ভাবে কেন রিয়েক্ট করলো সেটা বুঝল না সেঁজুতি। এই নিয়ে মায়াকে সেঁজুতির প্রশ্ন করার আগেই স্টেজ থেকে ফাহাদ ডাকল ওকে সেদিকে যেতে। সেঁজুতি মায়াকে এক পলক দেখে সেদিকে হাঁটল। আর মায়া ঠাস করে চেয়ারে উপর বসে পরে মুখ ঢেকে আবারও ফুপিয়ে কেঁদে উঠল দুঃখে, কষ্টে। একদিকে স্বামীকে খোঁজ পাওয়ার খুশি হবে নাকি রিদ খান মায়ার স্বামী হয় সেটা নিয়ে দুঃখ পাবে। কান্না করতে করতে মায়া মস্তিষ্ক গেঁথে গেল একে রিদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা গুলো। মূলত মায়া এখন বুঝতে পারছে রিদ কেন এতোদিন মায়ার সাথে ঘেঁষাঘেষি করতে চাইতো। কেন মায়াকে অকারণে ছুঁয়ে দিত। কেন মায়াকে পরকীয়ার মতোন বাজে প্রস্তাব দিতো। নিজের বউ বলেই হয়তো মায়াকে নির্দ্বিধায় পরকীয়ার প্রস্তাব করতো। আর মায়া না বুঝেই রিয়েক্ট করতো। লোকটা শুধু থেকে জানতো মায়া রিদের বউ। আর এজন্য বউ ভেবেই মায়ার সাথে ওমন ব্যবহার করতো। আর মায়া না বুঝেই কতো খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। মুখে মুখে কতো তর্ক করে মায়া। কতো বেয়াদবি করেছে রিদের সাথে। এজন্য রিদ মায়া নাম্বারটাও বেয়াদব বউ’ দিয়ে সেইভ করে রেখেছে। মায়া আসলেই একটা বেয়াদব বউ নয়তো কেউ স্বামীর সাথে ওমন ব্যবহার করে? রিদ নিশ্চয়ই মায়াকে এখন অভদ্র, বেয়াদব, মেয়ে বলেই জানে আর এজন্য হয়তো মায়ার কল গুলোও রিসিভ করে না। রিদ খানকে সবাই কতো সম্মান দেয়। অথচ মায়া রিদের মুখে মুখে তর্ক করতে মুখিয়ে থাকে সবসময়। মায়া কতোটা বেয়াদবি করলে ওমন বেয়াদব বউ’ নাম দিয়ে ওর নাম্বারটা সেইভ করে রাখে? মায়ার জানা নেই সেটা। মায়া দীর্ঘ সময়ের ঘটে যাওয়া রিদের সঙ্গে একেকটা ঘটনার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। সবশেষে যা বুঝল রিদ মায়ার টানে মায়ার কাছে যেত এতোদিন, মায়াকে সময় দিতে চাইতো, কিন্তু মায়াই কখনো রিদকে চিনতে পারতো না। চোখে সামনে স্বামীকে রেখে অন্যথায় খুঁজে বেড়াত। অকারণে রিদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতো। এখন মায়া কি করবে? কিভাবে হবে রিদের মুখোমুখি? মায়াতো এখন মরে যেতে ইচ্ছা করছে। সত্যিটা জানার পর মায়া রিদের মুখোমুখি হওয়াটায় অসম্ভব হয়ে পরলো। মায়ার কি এখন রিদকে ছেড়ে দিবে? মায়ার এখন কি করা উচিত সেটা বুঝল না। শুধু মুখ ডেকে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল সে।

এই গ্রুপে গল্প সম্পর্কিত আপডেট দেওয়া হয়। চাইলে জয়েন হয়ে থাকতে পারেন। বা গল্প নিয়ে কোনো সমস্যা হলে মডারেটস আপুদের বললে সমাধান করে দিবে।
ধন্যবাদ সবাইকে।

গল্প সম্পর্কিত আলোচনা সমালোচনার গ্রুপ https://www.facebook.com/groups/565066277893177/?ref=shaমায়ার~গল্পবিলাস
.
#চলিত….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here