রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা #লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া ৩১_বর্তিতাংশ

0
192

রিদ-মায়ার প্রেমগাঁথা
#লেখিকাঃ_রিক্তা ইসলাম মায়া

৩১_বর্তিতাংশ

সময়টা একটার ঘরে। চাঁদ বিহীন আকাশটা অন্ধকারে তলিয়ে। তবে যান্ত্রিক শহর ঢাকা, রাত যাহ দিনও তাই। মানুষের চলাচলে কোনো কমতি নেই। রাস্তাঘাট বৈদ্যুতিক আলোয় উজ্জ্বল। মানুষজনের সমাগমের ভরপুর। আয়ন এই রাতে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। পাকিং এরিয়া থেকে গাড়িটা রাস্তায় নামিয়েও কি মনে করে থেমে যায়। মনটা আজ একটু বেশি খারাপ আয়নের। তার কারণটা অবশ্য জুঁই। আয়নের প্রতি জুইয়ের অপরিচিত আচরণ আয়নের মন ভাঙ্গনের কারণ। সে জুইকে ভালো না বাসলেও জুইয়ের মায়া জড়িয়ে পড়েছে বেশ করে। জুইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে জুই। এখন জুইকে ছাড়া তার চলা মুসকিল। বলতে গেলে অচল। আয়ন দম ধরে কিছুক্ষণ গাড়িতে বসে রইল। পর পর বুক ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে পাশের সিট থেকে নিজের ফোনটা হাতে তুলল। ডায়েল নাম্বারের জুইয়ের নাম্বারটা খোঁজে কল দিয়ে কানে ধরল। এই মূহুর্তে জুইয়ের সাথে কথা বলা প্রয়োজন আয়নের। আয়ন একটা জিনিস লক্ষ করেছে জুই আয়নকে ফোনে যতোটা আপন মনে করে কথা বলে, দুজনের সরাসরি দেখা হলে ততটাই অপরিচিত মতোন আচরণ করে জুই। সেটা কেন করে এই কথাটা জুইকে একান্ত জিজ্ঞেসা করতে চাই বলে আয়ন হসপিটালের যায়নি। বরং মন ছটফটের ভাবটা কমাতে চেয়ে জুইয়ের সাথে একান্ত কথা বলা প্রয়োজন বলে আয়ন জুইকে কল দিল। পরপর রিং হতেই ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কন্ঠে ফোন রিসিভ করলো জুই।

‘ আসসালামু আলাইকুম।

জুইয়ের ঘুম জড়ানো কন্ঠের সালাম পেয়েই আয়নের বুক শীতল হলো। মনে মনে সালামের উত্তর দিয়ে আয়ন গম্ভীর কন্ঠে বলল….

‘ নিচে আসুন জুই। আমি অপেক্ষা করছি।

আয়নের গম্ভীর কন্ঠে ধড়ফড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসল জুই। কান থেকে ফোন উঠিয়ে নাম্বারটা এক পলক দেখে নিতেই ভালো লাগা চেয়ে গেলো মনে, স্ক্রিনে রাদিফের নামটা দেখে। কিঞ্চিৎ লজ্জা পাওয়ার মতোন পাশে ঘুমিয়ে থাকা সেঁজুতির দিকে তাকাল। মায়াকে নিজেদের পাশে না দেখে ভাবল, মায়া হয়তো শ্রেয়ার কাছে গেছে। তখন মায়া বেড়িয়ে যাওয়ার সময় সেঁজুতির সাথে কথা গুলো ঘুমের মধ্যেই জুইয়ের কানে এসেছিল বলে মায়াকে নিয়ে জুই অতো টেনশন করল না। তবে আয়নকে রাদিফ ভেবে পুনরায় ফোনটা কানে তুলল। লজ্জা পাওয়ার মতোন করে ফিসফিস বলল…
‘ এতো রাতে আসব?
‘ হুম।
‘ যদি বাড়ির কেউ আমাদের দেখে ফেলে তাহলে…

জুইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়ন বলল…
‘ কেউ দেখবে না জুই। আমি আছি, আপনি আসুন।

‘ কোথায় আসব?

‘ গেইট সামনে আসুন। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।

আয়ন কল কেটে দিতেই জুই বিছানার পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াল। কাঁধের দুপাশে ওড়নাটা জড়িয়ে সেঁজুতি দিকে তাকাল। সেঁজুতির ঘুমের গভীরতা পরখ করে পা টিপে টিপে চোরের মতোন করে বের ঘর থেকে। চারপাশে নিস্তব্ধতা দেখে জুই খানিকটা স্বস্থির হলো। তারপরও আশেপাশে সর্তক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে গেল নিচে। বিয়ে বাড়ি হলেও চারপাশে বাড়ির জনকে কোথাও দেখল না জুই। তবে নিচের কক্ষগুলো হতে মানুষের কথা ভেসে আসছে। জুই বুঝল বাড়ির মানুষ ক্লান্ত বিদায় যার য়ার রুমে রেস্ট নিচ্ছে। তবে এখনো ঘুমাই নি। বাড়ির বড়োরা জাগ্রত আছে ভেবেই জুইয়ের বুক টিপ টিপ করল ভয়ে। যদি কোনো কারণে এতো রাতে জুই রাদিফের সঙ্গে একত্রে ধরা পড়ে যায় তাহলে বিশ্রী একটা কান্ড ঘটে যাবে এই বাড়িতে। বোনের নতুন সংসারেরও জুইয়ের জন্য ঝামেলাও হবে। সবচেয়ে বড়ো কথা জুইয়ের বাপ-চাচার কানে এসব গেলে ওর গলা চেপে বিয়ে দিয়ে দিবে। নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করেই জুইয়ের বুক কাঁপল ভয়ে। সেই ভয়ের আভাস জুইয়ের চোখে মুখেও ফুটে উঠল। ওড়নার এক টুকরো আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সর্তকের দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে বেড়িয়ে গেল বাহিরে। অদূরে ফেইরী লাইটের ছাঁদে নিচে কাউকে জড়সড় হয়ে হাঁটতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল আয়ন। গাড়ি সাথে এতক্ষণ পিঠ ঠেকিয়ে জুইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। জুইয়ের গায়ে সাদা জামাটা যেন জুইয়ের গায়ের রঙ্গের সাথে মিলে গেল। আয়ন এক দৃষ্টিতে জুইয়ের হেঁটে আসা পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বাসার সেন্ডেল পরিহিত জুইয়ের পা জোড়া ঝলমল করছে একজোড়া রুপার নুপুর। সেখান থেকে হাল্কা শব্দ ভেসে আসছে কানে। সেলোয়ারটা একটু উপরে পড়ায় ফর্সা পা গুলো দৃশ্যমান আয়নের চোখে। দূর থেকে আয়নকে দেখে চিনতে না পারলেও মুখোমুখি এসে রাদিফের জায়গায় আয়নকে দেখে মূহুর্তে ভয়ার্ত হলো জুই। ইতস্ততায় অল্প একটু থেমে আবারও জড়তার পা ফেলে সামনে এগোতে এগোতে আশেপাশে তাকিয়ে রাদিফকে খোঁজল। জুই মনে করলো রাদিফের সঙ্গে আয়ন এসেছে। হয়তো আশেপাশে কোথাও রাদিফও আছে। কিন্তু তারপরও জুই আয়নকে ভয় পেল। বয়সে আয়ন ফাহাদের চেয়েও বড়ো। এতো বড়ো মানুষের সামনে রাদিফের সঙ্গে কথা বলাটা দৃষ্টি কঠোর দেখাতে পারে বলে জুই জড়াতায় হাসফাস করলো। রাদিফ কেন আয়নকে সঙ্গে রাখল সেটাও বুঝল না। জড়তার জুই কাছাকাছি আসতেই দেখেই আয়ন জুইয়ের দিকে তাকিয়ে ওকে নিয়ে জুইয়ের জড়তাটুকু দেখলো। জুই সবসময়ই এমন করে আয়নের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে। জড়তায় সিঁটিয়ে যায়। আয়নের সঙ্গে অপরিচিত মতোন আচরণ করে। তখন আয়নের মনে হয় জুই আয়নের সাথে সম্পর্কের কথাটা হয়তো ভুলে যায় নয়তো ফোনে এতো আগ্রহ দেখিয়ে সরাসরি কেন ইগনোর করবে। বেশ দূরত্ব রেখে জুইকে সামন-সামনি দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে আয়ন ডেকে বলল…

‘ কাছে আসুন জুই।
চমকে উঠার মতোন জুই আয়নের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলা বলল।
‘ জ্বি আমি?
‘ জ্বি।

জুই হাসফাস করে ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকিয়ে আবারও রাদিফকে খোঁজল। আয়ন জুইয়ের খোঁজা খুঁজির ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই তীক্ষ্ণ গলায় বলল…

‘ জুই আপনি কি কাউকে খোঁজছেন?

জুই ভয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে ছোট করে বলল…
‘ জ্বি।
আয়নের সন্দেহ বাড়ল। মূহুর্তে গম্ভীর হলো। ভারি গলায় বলল…
‘ কাকে?

আয়নের হঠাৎ ভারি গলায় ভয় বাড়ল জুইয়ের। গায়ের ওড়ানাটা আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে ইতস্ততায় বলল…
‘ উনি কোথায় ভাইয়া?
‘ উনি কে জুই? কাকে খোঁজছেন আপনি?
হাসফাস করে আবার আশেপাশে তাকাল জুই। রাস্তা এপাশ ওপাশ কাউকে দেখতে না পেয়ে জড়তায় মিইয়ে বলল…

‘ আসলে…
জুইয়ের ভয় আর জড়তা বলছে সে এই মূহুর্তে আয়নকে এখানে আশা করেনি। অথচ আয়ন নিজে ফোন করে জুইকে নিচে আসতে বলেছিল। সেটা জুই মেনেই নিচে আয়নের সঙ্গে দেখা করতে আসল। তাহলে এখন ভয় পাচ্ছে কেন আয়নকে? আয়ন তীক্ষ্ণ গলায় বলল…

‘ আসলে কি জুই? আপনি কি রাদিফকে খোঁজছেন?

আয়নকে পুলিশের মতোন জেরা করতে দেখে এবার সত্যি সত্যি ভয়ে আড়ষ্ট হলো জুই। গলা শুকিয়ে আসতেই জুই মাথা নাড়িয়ে আয়নের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল..
‘ হুম।
‘ কেন?
‘ আপনার ভাই আমাকে বলেছিল এখানে আসতে।

জুইয়ের কথায় অবিশ্বাস্য নজরে জুইয়ের দিকে তাকাল আয়ন। আয়নের হঠাৎ দৃষ্টি বদলে জুই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আয়ন জুইয়ের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো…
‘ আপনার রাদিফের সঙ্গেও কথা হয় জুই?

আয়নের অবিশ্বাস্যের কথাটা জুইয়ের কেমন যেন লাগল। রাদিফের সঙ্গেও কথা হয় মানে কি? জুই তো প্রথম থেকেই রাদিফের সঙ্গে ছাড়া অন্য কারও সাথে কথা বলে না তাহলে এই লোক জুইকে এমন করে বলছে কেন? তাছাড়া জুইয়ের কথায় এই লোক এতো চমকাচ্ছে বা কেন? জুইয়ের জানা মনে রাদিফ আর জুইয়ের সম্পর্কে কথাটা আয়নের জানার কথা। যেহেতু রাদিফ আয়নের সামনেই জুইকে এতো রাতে দেখা করতে বলেছে তারমানে আয়নের জানা কথার ওদের সম্পর্কের কথাটা। জুই আয়নের কথাটা না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল…
‘ জ্বি হয়।
জুইয়ের সম্মতিতে আয়নের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার নেয় শকট হলো। অবিশ্বাস্য নজরে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…

‘ আপনি কতো জনের সঙ্গে কথা বলুন জুই?

আয়নের কথাটা পছন্দ হলো না জুইয়ের। খানিকটা অসন্তুষ্টি গলায় বলল…

‘ আমি বাজে মেয়ে নয় ভাইয়া। প্লিজ আমাকে ওভাবে ভাববেন না।

‘ আপনাকে কিভাবে ভাববো জুই বুঝান আমাকে? আমি নাহয় সেভাবেই চিন্তা করি আপনাকে নিয়ে। আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিচ্ছেন জুই। রাদিফের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি?

আয়নের হঠাৎ রেগে গিয়ে পরপর প্রশ্ন করার ধরণটা পছন্দ হয়নি জুইয়ের। আশেপাশে রাদিফকে কোথাও দেখতে না পেরে জুই চলে যেতে চেয়ে খানিকটা অসন্তুষ্ট গলায় বলল…

‘ আমি গেলাম ভাইয়া। আপনার ভাই আসলে বলবেন আমি চলে গেছি।

কথাটা বলেই জুই পিছন মুড়তে নিলে তক্ষুনি কানে আসল আয়নের শক্ত গলার ধমক…

‘ আপনি কোথাও যাবেন না জুই। আমার কথা শেষ হয়নি। আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিবেন না জুই তাহলে বিপদে কিন্তু আপনিই পড়বেন।

আয়নের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝল না জুই। এই মূহুর্তে আয়নের সামনে দাঁড়িয়ে ঝামেলা বাড়াতে চাচ্ছে না বলেই আয়নকে অপেক্ষা করে জুই আবারও চলে যেতে নিতে তৎক্ষনাৎ আয়ন তেড়ে এসে জুইয়ের বাহু চেপে নিজের কাছে টানল। নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে আয়ন বলল…

‘ আমাকে ঠকাবেন না জুই আমি কিন্তু সহ্য করবো না এসব।

আয়নের হঠাৎ বাহু টেনে ধরায় জুই তাল সামলাতে না পেরে আয়নের বুকে এলিয়ে পড়লো খৈ হারিয়ে। আয়নের হঠাৎ কান্ডে ভয় পেল জুই। সেই সাথে প্রচন্ড রাগে শরীরও কাঁপছে। ছিটকে আসার মতোন জুই আয়নকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাতে চাইলে ব্যর্থ হয় সে। আয়নের শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাতের থেকে জুই নিজের বাহু ছাড়াতে ছটফট করে শক্ত গলায় বলল…

‘ ছাড়ুন ভাইয়া লাগছে আমার। এসব কোনো ধরনের অভদ্রতা? একটা মেয়েকে কেন এভাবে হেনস্ত করছেন? ছাড়ুন বলছি।

‘ ভদ্রলোকের ভদ্রতা ছুটে গেলে তাঁরা সাংঘাতিক রকমের অভদ্র হয়ে পড়ে জুই। আপনি আমাকে অভদ্র হতে বাধ্য করছেন। আপনি কেন রাদিফের সঙ্গে কথা বলেন?

‘ ছাড়ুন ভাইয়া লাগছে আমার।

‘ আমারও লাগছে জুই। খুব লাগছে। আপনার থেকে হাজার গুণ বেশি লাগছে আমার। পার্থক্য শুধু আপনার ব্যথাটা দৃশ্যমান আর আমারটা অদৃশ্য। আপনি আমাকে বুঝান জুই কেন রাদিফের সঙ্গে কথা বলেন। কি সম্পর্ক আপনার ওর সাথে? রাদিফের যে গার্লফ্রেন্ড আছে সেটা জেনেও কথা বলেন আপনি?

জুই নিজের বাহু ছাড়াতে চেয়ে জেদি গলায় বলল..
‘ উনার গার্লফ্রেন্ড আমিই। এবার ছাড়ুন।

স্তব্ধতা নেয় আয়ন শকট হয়ে জুইয়ের মুখের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মন ভাঙ্গনে আয়নের হাতটা কেঁপে উঠতে জুই নিজের বাহু ছাড়িয়ে নিল আয়নের হাত থেকে। আয়ন স্তব্ধ হয়ে জুইকে শুধিয়ে বলল…

‘ আপনারা রিলেশনের আছেন কবে থেকে জুই? কতো বছর ধরে?

‘ বছর নয় তিন মাস ধরে কথা হয় আমার উনার সাথে।

জুইয়ের কথায় আয়ন আরও চমকে উঠলো। একটার পর একটা ব্রজপাত যেন আজ আয়নের মাথায় পড়ছে। তিনমাস ধরে যদি জুই রাদিফের সঙ্গে কথা বলে তাহলে আয়নের সঙ্গে জুইয়ের এতোদিন ধরে কি চলে? আয়নও তো জুইয়ের সঙ্গে তিনমাস ধরে কথা বলছে। জুই কি তাহলে প্লে-গার্লের মতোন রাদিফ আয়নের সঙ্গে কথা বলল এতোদিন। আয়ন কি খুব ঠকে গেল জুইয়ের থেকে? ভালোবাসা এতো ছলনা করলো জুই আয়নের সাথে? কই কখনো তো আয়নের মনে হয়নি জুই আয়নকে ছাড়া অন্য কারও সাথে কথা বলছে। মাঝেমধ্যে জুইয়ের ফোন এক দুইবার ওয়েটিং পেলে আয়ন বুঝতো হয়তো রিদের সঙ্গে মায়া কথা বলছে। কিন্তু এখন শুনছে অন্য কথা, জুই নাকি এতোদিন রাদিফের সঙ্গে কথা বলতো। যদি জুই তাদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে থাকে তাহলে এই মূহুর্তে আয়নকে কেন শুধু একা অস্বীকার করছে। রাদিফই সব আয়ন কিছু না? আয়নের সাথে কথা বলার এতো মিষ্টি মিষ্টি মূহুর্ত গুলো সব ভুলে গেল? কিছু মনে নেই? জুই তো আয়নের সাথেও কথা বলতো তাহলে?

‘ আমার সাথে আপনার কি ছিল জুই? আমাকে কেন আগ্রহ দেখিয়ে মায়া বাড়িয়ে এভাবে ঠকালেন?

জুই খানিকটা বিরক্ত হলো আয়নের কথায়। আয়নকে ব্যক্তিত্ববান পুরুষ মনে করেছিল জুই। কিন্তু এই মূহুর্তে আয়নের পাগলামোতে জুইয়ের আয়নকে অসভ্য ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারছে না। তাছাড়া এখানে আসার পর থেকে আয়ন জুইয়ের উপরের একটার পর একটা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। জুই কখন আয়নের সঙ্গে কথা বলেছিল? শুরু থেকে জুই শুধু রাদিফের সঙ্গে কথা বলতো। তাহলে এই লোক আসল কোথায় থেকে? রাগান্বিত গলায় জুই বলল…

‘ আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিবেন না ভাইয়া। আমি আপনাকে ঠকালাম কখন? আপনার সঙ্গে আমার কখনো কিছু ছিল না।

জুইয়ের পুনরায় আয়নকে অস্বীকার করাতে এবার আয়ন ভয়ংকর রেগে গেল। তৎক্ষনাৎ পুনরায় জুইয়ের বাহু টেনে গাড়ির সাথে চাপাল। মানুষ বলে না শান্তিশিষ্ট মানুষ গুলা রেগে গেলে ভয়ংকর হয় আয়নের ক্ষেত্রেও তাই হলো। পরপর জুইয়ের অস্বীকারে আয়ন মেজাজ হারাল। ভয়ংকর রেগে হুংকারে বলল…

‘ এতো মিথ্যা কিভাবে বলেন জুই? আমাকে সামনে রেখে কিভাবে অস্বীকার করে যান। রাদিফ এতো প্রিয় আপনার? কি জানেন রাদিফের সম্পর্কে? রাদিফের বিয়ে পযন্ত ঠিক ওর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে। রিদের বিয়েটা হলেই রাদিফের বউ ঘরে তুলবে বড়োরা। রাদিফের তিন বছরের রিলেশনে আপনি ঢুকেছেন তিনমাসের ছলনা হয়ে।

আয়নের কোনো কথা জুই বিশ্বাস করলো না। তার কারণ ওদের ফোন আলাপে রাদিফ বলেছিল জুই ছাড়া রাদিফ দ্বিতীয় কোনো নারী সঙ্গে কথা বা রিলেশনে নেই। এখন জুই রাদিফের কথা বিশ্বাস না করে এই অসভ্য লোকটার কথা কেন বিশ্বাস করবে? জুই ছটফট করে আয়নকে নিজের থেকে দূরে সরাতে চেয়ে বলল…

‘ আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনার কথা আমি বিশ্বাস করিনা। আপনি একটা মিথ্যাবাদী লোক। উনি আমাকে বলেছেন আমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীর সঙ্গে উনি কথা বলে না।

‘ নারী বড়ই ছলনাময়ী জুই। আপনাকে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস হতো না। আমার সত্যিটা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না অথচ রাদিফের হাজারটা মিথ্যা আপনার বিশ্বাস হয়। আমাকে বিশ্বাস না করলে কল দিন আপনার প্রেমিককে। চেক করে দেখুন রাদিফ এখনো হয়তো ওর হবু বউয়ের সাথে কথা বলছে ফোনে।

‘ মোটেও না। উনি এক্ষন আমাকে কল করে নিচে ডাকল দেখা করতে। আপনি মিথ্যা বলছেন।

আয়ন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল…

‘ আমাকে আর রাগাবেন না জুই। এমনিতেই আমার মাথা ধপধপ করছে আপনার বেঈমানীতে। আপনাকে এখানে আমি ডেকেছি। রাদিফ উপরে নিজের রুমে আছে। ফোন করুন ওকে। ওয়েট আপনার হয়ে আমিই করছি।

বলেই আয়ন জুইকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ফোনটা পকেটে থেকে বের করে রাদিফকে কল লাগাল স্পিকারের রেখে। সত্যি সত্যি রাদিফের কলটা ওয়েটিং দেখালো। জুই আয়নের ফোনের স্ক্রিনের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল অপরিচিত নাম্বার দেখে। জুই ভাবলো হয়তো এটা রাদিফের তৃতীয় নাম্বার হবে। আর নয়তো জুইয়ের কাছে রাদিফের আরও দুটো নাম্বার আছে যে গুলো দিয়ে ওরা কথা বলে। যদিও নাম্বার গুলো জুইয়ের মুখস্থ করা আছে। আয়ন রাদিফের ওয়েটিং নাম্বারটা দেখল জুইকে। জুইয়ের বুকটা হঠাৎই ধুক করে উঠলো অজানা ভয়ে। মনে মনে আল্লাহ কাছে অসংখ্য দোয়া করল যেন আয়নের কথা গুলো মিথ্যা হয়। রাদিফ যেন জুইকে ছাড়া অন্য কোনো নারীতে জড়িত না থাকে। এর মধ্যে রাদিফ আয়নের কলটা রিসিভ করে উচ্ছ্বসিত গলা বলল…

‘ হ্যাঁ আয়ন ভাই বলো।

রাগান্বিত আয়ন কথা পেঁচাল না রাদিফের সঙ্গে। এমনই আয়নের রাগে শরীর কাঁপছে। সে জানে রাদিফ কার সাথে কথা বলছিল। তারপর জুইকে শুনানোর জন্য আয়ন রাদিফকে প্রশ্ন করার মতোন করে বলল…

‘ এতোরাতে তোর ফোন ওয়েটিং কেন? কার সাথে কথা বলছিস?

‘ রাহার সাথে ভাই। কেন কি হয়েছে? কিছু বলবে?

‘ রাহার সাথে তোর কয় বছরের রিলেশনশিপ জানি রাদিফ?

‘ তিন বছরের ভাই। তুমি তো জানোই তাহলে আবার প্রশ্ন করছো কেন?

আয়ন এবার কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি রাদিফকে জুইয়ের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বলল…

‘ তাহলে জুইয়ের সাথে কি চলে তোর? ওর সঙ্গে কেন কথা বলিস? কয়টা লাগে তোর? বেয়াদব হয়েছিস?

‘ কি বলছো ভাই? আমি আবার কার সাথে কথা বলব? জুই কে আবার? আমি রাহাকে ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলি না।

রাদিফের কথায় আয়ন অতি রাগে দাঁত পিষল। একদিকে জুই আয়নকে অস্বীকার করছে আর অন্যদিকে রাদিফ জুইকে অস্বীকার করছে। দুটোই মিথ্যাবাদী। আয়ন দাঁতে দাঁত চেপে বলল…

‘ রাদিফ মিথ্যা বলবি না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। রাহার সাথে থাকা অবস্থায় জুইয়ের সাথে কেন রিলেশনে গেলি তুই? সবকিছু তোদের কাছে ফান মনে হয়? মানুষের ফিলিংসের কোনো মূল্য নেই তোদের কাছে?

শেষে কথা গুলো আয়ন জুইকেও খোঁচা মেরে বলল।আয়নের কথায় হতবুদ্ধি হলো রাদিফ। প্রথমত জুই কে? তাঁকেই চিনতে পারছে না রাদিফ। অথচ আয়ন ভাই রেগে যাচ্ছে ওর উপর। রাহা ছাড়া রাদিফ সত্যি অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে না তাহলে এই জুই নামের কার কথা বলছে আয়ন? রাফিদ উত্তেজিত গলায় আয়নকে বুঝাতে চেয়ে বলল…

‘ আমি সত্যি বলছি আয়ন ভাই। বিশ্বাস করো আমার জুই নামের কারও সাথে কোনো রিলেশন নাই। তাছাড়া জুই কে আমিতো সেটাই চিনতে পারছি না। তুমি বলো ভাই জুই কে? আগে আমাকে জুইকে চিনাও তারপর বলছি আসলে কিছু হয়েছে কিনা।

রাগে আয়ন আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে জুই রাগান্বিত ভঙ্গিতে কল কেটে দেয়। আয়নের শক্ত হয়ে উঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে জুই কটাক্ষ করে বলে…

‘ এতো মিথ্যা কতো সাজাবেন আপনি? নিজের কথা সত্যি করার জন্য আপনি কাকে ফোন দিয়েছেন? ওটা রাদিফের কন্ঠ ছিল না। আমি উনার সাথে তিনমাস ধরে কথা বলছি, আমি চিনি উনার ফোনের কন্ঠ কেমন।

আয়ন রাগে জুইকে কিছু বলবে তার আগেই জুই আয়নকে থামিয়ে দিয়ে বলল…

‘ আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আমি আপনাকে প্রমাণ দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।

কথাটা বলেই জুই নিজের ফোনে রাদিফ নামে সেইভ করা নাম্বারে কল মিলাতেই মূহুর্তে আয়নের হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। আয়ন রাগে সেই কল কাটতে কাটতে বলল…

‘ আপনি আমাকে কেন ফোন দিচ্ছেন?

কল কেটে যেতেই জুই ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বিরক্তি নিয়ে আয়নকে শুধিয়ে পুনরায় একই নাম্বারে কল দিতে দিতে বলল…

‘ আপনাকে কেন ফোন দিতে যাব আমি? আজব! আমি আপনার ভাইকে কল দিচ্ছি। উনার নাম্বার এটা।

আবারও আয়নের ফোনে রিং হতেই আয়ন হাত বাড়িয়ে নিজের ফোনটা জুইয়ের মুখের সামনে ধরে বলল…

‘ এই দেখুন আপনি কাকে ফোন দিচ্ছেন জুই। নিজের প্রেমিকের নাম্বারটাও মুখস্থ রাখতে পারেন না। আমার সাথে গুলিতে ফেলছে কেন?

জুই আয়নকে শক্ত গলায় কিছু বলতে গিয়েও চমকে উঠে আয়নের ফোনে নিজের নাম্বারটা, জুই নামে সেইভ দেখে। চমকে উঠার মতোন জুই কাঁপা কাঁপা হাতে আয়নের ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে পাশাপাশি দুটো ফোন ধরতে দেখল রাদিফের নামের কলটি সরাসরি আয়নের ফোনে যাচ্ছে। মূহুর্তে জুইয়ের মাথা টনটন করে উঠলো ব্যথায়। সমস্ত কাঁয়া কেঁপে উঠল অবিশ্বাস্যে। টলমল হাতে নিজের ফোনের কলটি কেটে দিতেই আয়নের ফোনের কলটিও কেটে গেল মূহুর্তে। অবিশ্বাস্যের মতোন জুই পুনরায় একই ভাবে কল মিলাল রাদিফের নাম্বারে আবারও সেই কলের রিং বাজল আয়নের ফোনে। জুইয়ের মতো করে আয়ন দেখল জুইয়ের ফোনে আয়নের নাম্বারটা রাদিফ❤️ নামে সেইভ করা। ভিতরকার অস্থিরতায় মূহুর্তে কপালের কানিশ বেয়ে ঘাম ঝড়ল জুইয়ের। অবিশ্বাস্য গলায় আয়নকে শুধিয়ে বলল জুই…

‘ রাদিফের ফোন আপনার কাছে কেন?

আয়ন নিজের ফোন জুইয়ের থেকে কেড়ে নিতে নিতে বলল…

‘ আমার মতোন করে আমার ফোনটাকেও মিথ্যা বানিয়ে দিবেন জুই?এটা আমার ফোন। রাদিফের নয়।

‘ নাম্বারটা কার?
‘ ওটাও আমার।

‘ কিন্তু আমি যে তিনমাস ধরে এই নাম্বারে কথা বলছিলাম তাহলে ওটা কে ছিল?

‘ ওটাও আমি ছিলাম। নাম্বার যেহেতু আমার কথাও আমিই বলেছিলাম। কিন্তু আপনি তো এতক্ষণ যাবত আমার সাথে কথা বলার বিষয়টি অস্বীকার করে যাচ্ছেন। সেজন্য রাদিফও আপনাকে অস্বীকার করল।

মন ভাঙ্গনে জুই আয়নকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বলে আবারও জুই আয়নকে শুধাতে চেয়ে বলল…

‘ আপনি মিথ্যা বলছেন। এটা আপনার নাম্বার কিভাবে হয়? এটাতো আপনার ভাই রাদিফের নাম্বার হওয়ার কথা।

‘ এখন কি আমার মতো করে আমার নাম্বারটাও অস্বীকার করতে চাচ্ছেন জুই?

‘ তারমানে আপনি আমাকে এখানে ডেকেছেন?

‘ হ্যাঁ।

‘ আমি এতোদিন ধরে আপনার সাথে কথা বলছিলাম?

‘ আমিতো সেটাই বলছি কিন্তু আপনি আমাকে অস্বীকার করছেন জুই।

জুইয়ের শরীর হঠাৎ দূর্বল হওয়ার মতোন নেতিয়ে পড়ল। কোনো রকম গাড়ি ধরে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। আয়নের উদ্দেশ্য দূর্বল গলায় বলল…

‘ আমি আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে চাই। আপনি আমার কলটা একটু রিসিভ করুন।

আয়ন বিরক্ত চোখে জুইকে দেখল। এর মধ্যে জুই কল দিল আয়নকে। আয়ন জুইয়ের ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলতে তুলতে বলল…

‘ বলুন জুই।

দুজন মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলাতে আয়নের কন্ঠ সরাসরি জুইয়ের কানে ভারি খাচ্ছিল বলে জুই আয়নকে দূরে যেতে চেয়ে বলল।

‘ আপনি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।

আয়ন সত্যি সত্যি দূরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়াল। মূলত আয়নের মাথায় আসছে না জুই এমন কেন করছে? এতোদিন পরে এখন আবার নতুন করে কিসের কন্ঠ শুনবে জুই আয়নের?

‘ আপনি নতুন করে আবার কি শুনতে চান জুই?

আয়নের কন্ঠে আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতোন জুই স্তব্ধ হলো। বুক কাঁপল। চোখে পাতাও ভিজে উঠলো মূহুর্তে। জুই ঠোঁট কামড়িয়ে কান্না আটকে বলল…

‘ তারমানে আমি রাদিফ মনে করে এতোদিন আপনার সাথে কথা বলে এসেছি ডাক্তার সাহেব? আপনি ছিলেন রাদিফের নামের পিছনে ব্যক্তিটা? এটা আমাকে আগে কেন বলেন নি আপনি? আপনি আমার ফিলিংস নিয়ে খেলেছেন ডাক্তার সাহেব। আমি নয়, আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আমার আপনাকে ঘৃণা করা উচিত।

জুইয়ের কথায় হতবুদ্ধি হয়ে জুইয়ের দিকে ঘুরে তাকাল আয়ন। এবার তার মাথাও বাজ পড়লো মনে হয়৷ একে একে দুজনের সকল ভুল ভেঙ্গে গেল। কিন্তু নতুন ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হলো আবার। আয়ন জুইয়ের কথায় বুঝতে পারলো জুই এতোদিন আয়নকে রাদিফ মনে করে কথা বলে এসেছিল। অথচ ফোনের পিছনে যে রাদিফ নয় আয়ন ছিল সেটা আয়ন কখনো জুইকে বলেনি আর না জুই কখনো আয়নকে তার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করেছে। যদি জুই সত্যিটা জানতে চেয়ে আয়নকে প্রশ্ন করতো তাহলে অবশ্যই আয়ন সত্যিটাই বলতো জুইকে। এতো ভুল বুঝাবুঝি কিভাবে মিটাবে দুজন?

~~
রাতের চটা পেরিয়ে পৃথিবীতে ভোর নামলো। উজ্জ্বল আলোয় স্নিগ্ধ পরিবেশ। বসন্ত পেরিয়ে গরমের আবির্ভাব হয়েছে সেই মাসখানেক আগেই। এই ধরণীতে কাঠখড় গরমের আভাস। শরীর জ্বালার মতোন উত্তাপ সূর্যের আলো। তবে সকালের পরিবেশটা নরমই হয়। শীতল আর ঠান্ডাময় হয়। এমন একটা সকালে ঘুম ভাঙলো মায়া। সকাল তখন ৫ঃ০৭ ঘরে। খুব সকালে মায়ার ঘুম ভাঙ্গার অভ্যাস থাকলেও আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুম গেল ওর। ঘুমের মধ্যে অল্পসল্প নড়তে চাইতে নিজেকে বন্দী মনে হলো কোথাও। নড়তে চেয়ে নড়তে পারলো না সে। মায়া কোথায় আছে সেটা বুঝতে না পেরে আবারও নড়েচড়ে উঠতে চাইলে মায়ার মুখ ঠেকল কারও গলদেশে। মায়া নিজের নাক ঘষল সেখানটাই। নাকে খোঁচা খোঁচা সুইয়ের মতো কিছু বিঁধতে শরীর শিরশির করলো মিষ্টি ব্যথায়। নাক মুখ কুঁচকে ঘুমের মধ্যে মায়া নিজের একটা হাত নাকের ব্যথিত জায়গায় ঘষতে চাইলে বুঝল সে হাতও উপরের তুলতে পারছে না। মোট কথা শরীর নড়াতে পারছে না। মায়া অনুভব করলো ওর শরীর শক্ত কিছুর সাথে সাপের মতোন পেচিয়ে আছে। মায়া ঘুমের রেশ কাটাতে না পেরে চোখ বন্ধ অবস্থায় হাতড়ে দেখতে চাইল মায়া কোথায় আছে। হাতড়ানো অবস্হায় মায়া বুঝতে পারলো সে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ওর ডানহাতটা নিচে আর বামহাতটা উপরের। বন্দী মায়ার বামহাতটা রাখল কিছু একটার উপরে। যেটা মায়ার শরীরকে পেচিয়ে শুয়ে আছে সেটার কোনো এক জায়গায় হবে মায়ার হাতটা। ঘুমের মধ্যে মায়া হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারলো সে বেশ শক্ত আর উষ্ণ আরামের মধ্যে কিছু একটা সাথে শুয়ে আছে। মায়া আবার হাতড়াল। হাতড়াতে হাতড়াতে মায়ার হাতটা কারও কোমর থেকে পিঠে গিয়ে থামল। মায়া বুঝতে পারলো সে কারও শরীর হাতরাচ্ছে। কিন্তু কার? মায়া কি কোনো পুরুষের সাথে শুয়ে আছে? সর্বনাশ! মায়া চমকে উঠার মতোন তড়াক করে চোখ মেলে তাকাল। চোখে অন্ধকার ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পেল না। কারও গায়ের কর্ড়া পারফিউমের ঘ্রাণে মায়া বুঝতে পারলো সে রিদের দুই বাহুতে আটকে। মায়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যাক অন্য কোনো পুরুষের সাথে তো আর শুয়ে নেই মায়া। মায়া স্বস্তির হতে গিয়ে হতে পারলো না মায়াকে এভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে দেখে রিদকে। মায়া এই রুমে কখন আসল সেটাও জানে না। মায়ার যতটুকু মনে আছে লাস্ট টাইম মায়া রিদের সঙ্গেই ছিল ঐরকম একটা আপত্তিকর পরিস্থিতিতে। তারপর আর কিছুই মনে নেই। খুব সম্ভব মায়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল? তারপর? তাহলে কি এই লোক মায়াকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে? সর্বনাশ বাড়ির লোক দেখেছে সেটা? মায়াকে রাতে শ্রেয়ার রুমে না দেখে অবশ্য এতক্ষণ খোজাখুজি হয়ে গেছে বাড়িতে? মুক্তা জুই নিশ্চয়ই ওর জন্য চিন্তা করছে। সবচেয়ে বড়ো কথা মায়ার নিখোঁজ হওয়ার কথাটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওর বাড়িতেও চলে গেছে? মায়া নিজের ভাবনায় ভয়ভীতি হলো। রিদ থেকে ছাড়া পেতে চেয়ে বুঝল ওরা দুজনই কাত হয়ে শুইয়ে আছে। রিদ দু’হাতে মায়ার পিঠ জড়িয়ে বুকে বেঁধে রেখেছে মায়াকে যার জন্য মায়ার মুখ রিদের গলদেশে ঠেকিয়ে। আর এতক্ষণ মায়া রিদের কোমর থেকে পিঠ পযন্ত হাতড়াচ্ছি নিজের অবস্থান বুঝতে। মায়া রিদের শক্তহাতে বেরে পড়ে লজ্জায় সিঁটিয়ে গেল। সেই সাথে শরীর টনটন করে উঠলো ব্যথায়। মায়ার পা দু’টোও সেই কখন থেকে অবশ হয়ে আছে ভারি কিছুর জন্য। মায়া পা নড়াতে চেয়ে আবারও চমকে উঠলো। কারণ রিদ মায়ার উরু বরাবর তার এক পা তুলে দিয়ে মায়াকে কোলবালিশের মতোন দু’হাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে। এবার ভিষণ লজ্জা পেল মায়া। বুকটা টিপটিপ করলো অস্থিরতায়। ওহ কি সারারাত এইভাবে ঘুমিয়ে ছিল লোকটার সাথে? ইশ কি লজ্জা! এতো লজ্জায় মায়া নিশ্চয়ই ওর স্বামীকে আর মুখ দেখাতে পারবে না। মায়া লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে রিদ থেকে ছাড়া পেতে চেয়ে আস্তে করে রিদের হাত গুলো নিজের উপর থেকে সরাল। তারপর রিদের ঘুমের সুযোগ নিয়ে খুবই আস্তে ধীরে নিজের উরু থেকে রিদের ভারি পা সরিয়ে চুপিচুপি খাট থেকে নামল। গায়ের ওড়ানাটার খোঁজ করতে দেখল সেটা অবহেলায় ফ্লোরে পরে। মায়া কি ওড়না ছাড়া লোকটার সাথে ঘুমি ছিল? ইশ! মায়া আবারও লজ্জায় আছড়ে পরে দ্রুত ফ্লোর থেকে নিজের ওড়ানা গায়ে জড়াতে জড়াতে ঘাড় বেঁকে তাকাল রিদের দিকে। রিদ এখনো মায়ার দিকেই কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। যেভাবে মায়াকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল সেভাবেই আছে। শুধু রিদের বুকে মায়া নেই। মায়া চোরের মতোন কর্ণার টেবিল হতে নিজের ফোনটা উঠিয়ে বিনা শব্দের খালি পা টিপে রুমে থেকে বের হতে বুক চেপে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজ বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে মায়া। রিদের ঘুম থেকে উঠার আগেই মায়া পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
মায়া বুকে হাত রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মধ্যে নাকে বাজল কর্ড়া পারফিউমের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণটা মায়া চিনে রিদর শরীরে ঘ্রাণ। যতবার রিদ মায়ার সামনে এসেছিল ঠিক ততবারই মায়া এই সুগন্ধিটা পেছিল। মায়া নিজের কাঁধে নাক বাজিয়ে শ্বাস টানতেই বুঝতে পারলো রিদের শরীরের ঘ্রাণ মায়ার শরীরে মৌ মৌ করছে। মায়া চমকে উঠলো। বারবার নাক বাজিয়ে নিজের শরীর শুকলো। বাপরে মায়ার পুরো শরীরে শুধু রিদ রিদ গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই মূহুর্তে মায়া যদি কারণও সামনে যায় তাহলে নিশ্চিত ওহ ধরা পড়ে যাবে। সবাই বুঝে যাবে মায়া যে রিদের সাথে রাতে ছিল। কি সাংঘাতিক ব্যাপার। লোকটার শরীরে ঘ্রাণটা কেমন মায়াকে টানছে। মায়া ভীতু চোখে আশেপাশে তাকাল। চারপাশটা কেমন অচেনা অপরিচিত ঠেকল। এটা ফাহাদদের বাড়ি নয় সেটা চট করে বুঝে গেল মায়া। তাহলে মায়াকে এই লোক কোথায় নিয়ে এসেছে এটা কার বাড়ি? মায়ার জানে মতো এটা খান বাড়িও নয়। কারণ মায়া খান বাড়িতেও গিয়েছিল দুইবার। ওর চেনা আছে খান বাড়ি। তাহলে এটা কোথায়? কে থাকে এখানে? নিজের চিন্তা ভাবনার মাঝে মায়া ভয় পেল না। বরং নির্ভয়ে থাকল রিদ পাশে আছে বলে। তবে কৌতূহল হয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে সামনে এগোল। করিডোরে সামনে মায়া দেখতে পেল একটা লম্বা সিঁড়ি নিচের ড্রয়িংরুম অবধি গিয়েছে। নিচে গেল না বরং সেই সিঁড়ির মাথায় বসল। কার না কার বাড়ি। মায়া যদি কৌতূহল নিয়ে নিচ অবধি যায় তাহলে নিশ্চয়ই কারও না কারও সামনে পরে যাবে সে, তখন হবে আরেক বিপদ। অপরিচিত দেখে যদি মায়াকে জিগ্যেসা করে সে কে? কার সাথে এই বাড়িতে এসেছে? রাতে কোথায় ছিল? তখন মায়া কি বলবে? মায়ার কাছে তো এসবের উত্তর নেই। আবার মায়া রিদের ভয়ে রুমেও যেতে পারছে না বলে ওহ এখানেই বসে থাকবে বলে ঠিক করলো। হাতের ফোনটার লক খুলতেই মায়ার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটলো। মায়ার জামাই তো আর জানে না মায়া যে ওদের সম্পর্কে অবগত তাহলে এই বিষয়ে লোকটাকে একটু হেনস্ত করলে কেমন হবে? অবশ্যই দারুণ হবে। মায়াকে এই লোক কম নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাইনি। সামনে থেকেও মায়ার কাছে নিজের পরিচয় না দিয়ে শুধু ওকে হেনস্ত করেছে। এবার মায়ার পালা। মায়াও এই লোকটাকে এবার আচ্ছা মতোন জব্দ করবে বলে ঠিক করলো। হাতের ফোনটায় রিদকে কল দিতেই রিদ সেই কল রিসিভ করলো বেশ কিছুক্ষণ পরে। মায়ার রিদকে কল রিসিভ করতে দেখে চট করে কান্না করার মতোন নাক টেনে বলল…

‘ হ্যালো।
রিদ ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর করলো…
‘ হুম।

রিদের মাতাল কন্ঠে মায়ার বুকটা ধুক করে উঠলো। বাপরে এই লোকের সবকিছুই মারাত্মক। মায়া এতো ঘায়েল হতে হতে না জানি আবার হার্টে সমস্যা হয়ে যায় ওর। রিদের কন্ঠে মায়া এক মূহুর্তে জন্য নিজের অভিনয়ের কথা ভুলে গেলেও পরমূহুর্তে ঠিকই মনে পড়লো সে এখন অভিনেত্রী। রিদকে জব্দ করতে চেয়ে আবারও নাক টেনে কাঁদার মতোন করে বলল…

‘ হ্যালো! শুনছেন? আমি না আপনাকে ঠকায়ছি। আমার বড়ো আপুর ভাসুর রিদ খান আমার সাথে রাতে ঘুমাইছে। এখন আমি আর আপনার বউ না।

মায়া কথায় চট করে রিদের ঘুমের রেশ কেটে গেল। ফোনটা কানে নিয়েই মাথা উঁচিয়ে তাকাল নিজের পাশে। সে একাই বিছানায় শুয়ে। মায়াকে নিজের পাশে বিছানায় দেখতে না পেয়ে বুঝল বেয়াদব বউটা তাঁকে ঘুমের মধ্যে রেখেই পালিয়েছে। হয়তো আশেপাশে কোথাও থেকে রিদকে কল করে তাঁর নামেই বিচার দিচ্ছে। রিদও দমে যাওয়ার পাবলিক না। বোকা বউটাতো আর জানে না তার স্বামীকে দমানো দায়। রিদ কাত হওয়া থেকে সেই ভাবে উপুড় হয়ে বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বলল…

‘ সমস্যা নাই বউ! রিদ খান আমার বউয়ের সাথে ঘুমাইছে আমিও ওর বউয়ের সাথে ঘুমাব, তাহলেই হিসাব বরাবর হবে। আমার বউয়ের সাথে ঘুমানোর শোধ, আমি ওর বউয়ের সাথে ঘুমিয়ে তুলবো।

রিদের কথায় মায়া চট করে কল কেটে থমথমে খেয়ে বসল। রিদকে জব্দ করতে চেয়ে যেন ওহ নিজেই জব্দ হয়ে গেল যেন। এই ধন্ধিত লোককে মায়া আদৌ জীবনে জব্দ করতে পারবে বলে মনে হয়না। মায়া একটা কথা বললে এই লোক মায়াকেই কেমন ওর নিজের কথায় ফাঁসিয়ে দেয়। এই যেমন এখন দিল। রিদ খান আর ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটার বউতো মায়া নিজেই। দু’টো মানুষই তো এক। ফোনের লোকটা যদি রিদ খানের বউয়ের সাথে ঘুমিয়ে শোধ তুলতে চাই? তাহলে সে মায়ার সাথেই আবার ঘুমাবে। ঘুরেফিরে মায়াকে মায়ার কথায় ফাঁসি দিল। মায়া নিজেকে নিয়ে বড্ড আফসোস করলো। সে একটু চালাক হতে পারলে হয়তো কোনো না কোনো ভাবে নিজের স্বামীকেও কথার জ্বালে ফাঁসাতে পরতো। মায়ার যা বুদ্ধি সেতো ইহজীবনে এই লোকের সাথে কথায় পেরে উঠবে না। আর না এই লোককে কখনো জব্দ করতে পারবে। আহা মায়ার আরও একটা নতুন আফসোস যোগ হলো নিজের স্বামী চতুর বলে।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here