#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#বোনাস_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
মুষলধারে বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে থামার নাম নেই,আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে বিকট শব্দে।এরূপ বৈরী আবহাওয়া তে পাহাড় টাকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে।আর্মিদের বুটের চাপে পাহাড়ি লালচে মাটি গলে গলে যাচ্ছে।
আর্মির রেসকিউ টিম দুটো হেলিকপ্টার দিয়ে সমানে পুরো পাহাড় চক্কর কেটে যাচ্ছে।প্রায় দুশো সোলজার পুরো পাহাড় তল্লাশি চালিয়েও কিছুই পেলো না।
কয়েকজন সোলজার মিলে খালের পাশে যাবার জন্য জন্য প্রস্তুতি নিলো।
আদ্রিয়ান নাফিজ মাহমুদ কে ফোন করে সব কিছু জানালে তিনি হেলিকপ্টার সহযোগে দ্রুত এসে পড়েন।
মেয়ের এহেন বিধস্ত অবস্থা দেখে গোপনে চোখের জল মুছে ফেলেন নাফিজ মাহমুদ।
স্বর্গের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নেই।কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে।ফ্যালফ্যাল চোখে বিবর্ণ মুখে সবকিছু দেখে যাচ্ছে শুধু।
দুটো ক্যাপ্টেন মেয়ে তাকে সামলে রেখেছে।
ঘন্টা খানেক পর দুজন সোলজার কাঁদাযুক্ত পায়ের একটা জুতা আর ভাঙা স্মার্ট ওয়াচ নিয়ে ফিরে আসলেন।
এগুলো যে মুহিতের চিনতে এক সেকেন্ড ও সময় লাগলোনা স্বর্গের।
সোলজার এর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জুতা আর ঘড়ি বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
নাফিজ মাহমুদ মেয়েকে কিভাবে সামলাবেন আর বোনকে কি জবাব দিবেন এটা ভেবেই তার বুকে ব্যাথা শুরু হচ্ছে থেকে থেকে।
মেজর অদ্রিয়ান একটি জিপার ব্যাগে ভরে ফেললো মুহিতের জিনিস গুলো।
সারা দিনের তল্লাশি চালিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে চললো রেসকিউ টিম।
নিকটস্থ আর্মি ক্যাম্পে স্বর্গকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আজকের মতো আপাতত তল্লাশি শেষ করতে হলো,কাল সকালে আবার চেষ্টা চালাতে হবে।
―――――-;
নামিরার লেবার পেইন উঠেছে সকাল থেকে,তাকে হসপিটাল এ আনা হয়েছে।ওটি রুমে নার্স আর ডক্টর নামিরার পাশে রয়েছে।
সোহাগ থেকে থেকে শুধু ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছে,বেসিনে বার বার চোখ মুখ ধুয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
মিসেস তারিন তসবিহ পড়ছেন,
আধ ঘন্টা পরেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
সোহাগ যেনো আরো উন্মাদ হয়ে গেলো
তার একটাই চিন্তা
―নামিরা ঠিক আছে তো?
কিছু সময় পর একটা নীল টাওয়েল এ মুড়িয়ে বাচ্চা টিকে নিয়ে একজন নার্স সমেত ডক্টর বেরিয়ে এলেন।
সোহাগ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
―কংগ্রাচুলেশন্স মি,সোহাগ।
―ইটজ এ বয়।
ইউর ওয়াইফ ইজ আউট অফ ড্যাঞ্জার, ইউ ক্যান ভিজিট হার।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে কেঁদে উঠলো সোহাগ।
মুকিতের মুখের আদল তার ছেলের চেহারায়।
সোহাগ বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে মিসেস তারিনের কাছে দিতে দিতে বলে উঠলো
―মা নিন আপনার ছোট মুকিত।
নাতির চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন মিসেস তারিন,
চোখে তার খুশির অশ্রু কনা।
মুহিত কে খবর জানাতে নামিরার পাশে বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে সোহাগের ফোন থেকে কল করলেন মুহিত এর নম্বরে।
পর পর দুবার ডায়াল করেও ব্যার্থ হলেন মিসেস তারিন।
ভাবলেন হয়তো ব্যাস্ত আছে।
এর পর নাফিজ মাহমুদের নম্বর ডায়াল করলেন ফোন তুললেন না তিনি।
চিন্তিত হয়ে বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন দিলেন।
সমানে রিং বেজে যাচ্ছে তনুজা ফোন তুলছেন না।
নিজের মেয়ের কপাল কি তবে খারাপ হলো এতোটা?
তার মেয়েটা কিভাবে নিজেকে গুছাবে?
স্বর্গ তো জানে মুহিত তার হবু বর,এই দাগ কিভাবে যাবে স্বর্গের মন থেকে।
তনুজার কান্না যেনো আর বাঁধ মানছে না।
টেলিফোনের কর্কশ রিং আবার বেজে উঠলো।
নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন কানে তুললেন তনুজা।
ভারী স্বরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তারিনের উৎকণ্ঠা মিশ্রিত আওয়াজ পাওয়া গেলো।
―তোমরা কেউ ফোন ধরছো না কেনো তনুজা?
তনুজা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে আমতা আমতা করতে লাগলেন।
এর পর বললেন রান্না করছিলাম আপা।
মিসেস তারিন সকল কুশলাদি বিনিময় করার পর জানালেন
― নামিরার ছেলে বেবি হয়েছে
―মুহিত এলে যেনো তাকে কল করে।
―আচ্ছা আপা বলবো।আল্লাহ হাফেজ।
তনুজা ফোন কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
কিভাবে বাঁচবে তারিন নিজের অন্ধেরজষ্ঠী টাকেও যদি হারিয়ে ফেলেন?
সুখ কোনোভাবে তার মাকে শান্ত করে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
******
দ্বিতীয়বারের মতো অভিযান চলছে কালা পাহাড় নামক স্থান টিতে।
মেজর আদ্রিয়ান,সিলেট ক্যাম্প এর মেজর তুষার জাওয়াদ দাঁড়িয়ে আছে স্পেশাল ফোর্সের দুটো মাল্টিপারপাস ক্যানাইনস (কুকুর)এলেক্স আর জাস্টিন কে নিয়ে।
মুহিতের ব্যাবহার করা কাপড় শুকিয়ে তাদের দৌড়াতে দেয়া হলো।
কুকুর দুটো দৌড়ে পাহাড়ের পাশে খালটিতে চলে গেলো।
সেখানে গিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগলো উপরের দিকে তাকিয়ে।
মেজর আদ্রিয়ান কুকুরের দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি তাক করে একটি বড় গাছ দেখতে পেলো।কুকুর দুটো পাহাড় বেয়ে গাছের দিকে চলে যেতে চাচ্ছে।
মেজর তুষার এলেক্স কে নিয়ে সেই গাছের কাছে গেলে কুকুর বার বার গাছে উঠার জন্য গাছ খামচে চলছে।
দুজন সোলজার এর মধ্য থেকে একজন সোলজার গাছে উঠে গেলো।
সেখানে কি আছে জিজ্ঞেস করলো আদ্রিয়ান।
সোলজার জবাব দিলো রক্ত আর শার্টের ছেড়া টুকরো স্যার।
এবার ও খালি হাতে ফিরলেন দুই মেজর।
তারা শার্টের টুকরো এনে একটি জিপার ব্যাগে রাখতে রাখতে নাফিজ মাহমুদ এর উদ্দেশ্যে বলেন
―স্যার মেজর মুহিত কমপক্ষে দুশো মিটার উপর থেকে পড়েছে,আমরা ওখানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাইনি।
পাশের যেই খালটা আছে সেটা প্রচুর খরস্রোতা।
আমার মন বলছে মেজর প্রথমে গাছের উপর পড়েছে সেখানে বাড়ি খেয়ে খালটিতে পড়েছে।
গাছে উপর পড়ার কারণে তার শার্টের হাতার কিছু টুকরো কাপড় আর রক্ত গাছের ডালে পাওয়া গিয়েছে আর খালটিতে পরে থাকলেও তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কারন পানির স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
মেজর অদ্রিয়ানের সকল বক্তব্য শুনে মাথার ক্যাপ খুলে বগলে রাখলেন নাফিজ মাফমুদ।
মনে তার একটাই চিন্তা তার মেয়েটাও তার বোনের মতো সারা জীবন নিজেকে অপয়া দোষী সাব্যস্ত করে বেঁচে থাকবে!
আবার সেই একই অতীতের পুনরাবৃত্তি?
কোন পাপের শাস্তি এটা?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোনে জমা জল মুছে আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এলেন নাফিজ মাহমুদ।
স্বর্গকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবেন।
আর সিলেটের আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এর জেনারেল এর সাথে কথা বলে মুহিতের ছবি দিয়ে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিতে আর বিভিন্ন ক্যাম্প এর আর্মিদের বলে দিতে তারা যেনো মুহিতের খুজ পাওয়া মাত্র তাদের জানায়।
―――――.
স্বর্গ কোনো ভাবেই মুহিত কে না নিয়ে যাবে না এখান থেকে।তার বিশ্বাস মুহিত এখানেই কোথাও আছে কিন্তু আর্মি দের গাফিলতির জন্য তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বর্গের জেদ চূড়ান্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।
নাফিজ মাহমুদ বুঝতে পারলেন মেয়ে মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে।
জোর করে হেলিকপ্টার এ তুলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তারা।
********
কেটে গিয়েছে সতেরো টি দিন।কোনো ভাবেই মুহিতের খবর পাওয়া যায়নি।বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ মুহিতের নিখোঁজ সংবাদ ই যেনো প্রধান হেডলাইন।
নামিরা ,তারিন নাফিজের কাছে ফোন করে পাগল হয়ে যাচ্ছে মুহিত কেনো ফোন ধরছে না।
নাফিজ বুকে পাথর বেঁধে চূড়ান্ত এক মিথ্যে বলে দিলেন তারিন কে
―আপা মুহিত কে হঠাৎই মিশনে যেতে হয়েছে।
ও ভালো আছে।তুমি তো জানো আফ্রিকা কেমন দুর্গম জায়গা।
ওখানে জঙ্গলে কি আর নেটওয়ার্ক আছে ?
ছয় মাস পরেই ফিরে আসবে,ওখানে আর্মি ক্যাম্প এর সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে।মুহিত ভালো আছে।
তাকে নামিরার বাবুর কথা বলা হয়েছে, অনেক খুশি হয়েছে মুহিত।
ফোন কেটে বিছানায় ছুড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন নাফিজ মাহমুদ।
―――――
একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে যার বয়স পাঁচ কি ছয়, গায়ের রঙ তাম্র বর্ণের,কোঁকড়া চুল গুলো খোপার মতো করে বাধা,ছোট ছোট চোখ,বোঁচা নাক,পরনে কাজিম পিন পোশাক ।
মেয়েটির নাম ডিকো।
সে খুব মনোযোগ এর সহিত অবচেতন একটি আগন্তুক কে দেখে যাচ্ছে।আগন্তুক আজ পনেরো দিন ধরে তাদের বাড়িতে আছে,
আচ্ছা উনি কখনো ঘুম থেকে উঠেনা কেনো?
বাচ্চা মেয়েটির মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
লোকটির চেহারা তাদের মতো নয়,অনেক ফর্সা,কি সুন্দর দেখতে!
দেবতাদের মতো,আর কতো লম্বা!
―গায়ে ক্ষতের কোনো অভাব নেই তবুও যেনো চেহারায় রাজ্যের মায়া।
আচ্ছা তার গালে থুতনিতে চুল কেনো গজিয়েছে?
তার বাবা দাদার তো নেই।
লোকটিকে তার মা বাবা নদীর পাড় থেকে তুলে এনেছে।
আচ্ছা লোকটি কি দেবতা উবলাই নাংথউ?
দেবতা বলেই কি বাবা মা উনাকে এতো যত্ন করে?
#চলবে