#তুমি_আছো_মনের_গহীনে
#পর্ব- ১০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মায়রাকে খুবই যত্ন সহকারে আইস্ক্রিম খায়িয়ে দিচ্ছে অভ্র। যা মেহেভীন আড়াল থেকে খুব ভালোভাবেই দেখতে পারছে। মায়রার ঠোটের কোনে আইস্ক্রিম লেগে গেলে,তা টিস্যু দিয়েও খুবই যত্ন নিয়ে মুছে দিচ্ছে অভ্র। সকালেই খুব তাড়াতাড়িই মেহেভীন ঘুম থেকে উঠে পড়ে আজ ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।আরহামের মা মেহেভীনকে নিজের হাতেই ব্রেকফাস্ট করে দেন। মেহেভীন ব্রেকফাস্ট বানাতে চাইলেও, তাতে সবসময় তিনি বাঁধা দেন।তার ভাষ্যমতে, এইসময় মেহেভীনের একদমই রান্নাঘরের আশে-পাশে থাকা উচিৎ নয়।
মেহেভীন মাঝে মাঝে মনে হয় , উনি কতটা ভালো মানুষ। উনি যখন সত্যিটা জানবে, তখনো কি মেহেভীনকে এইভাবে ভালোবাসবে? নাকি মিথ্যে বলার অপরাধে মেহেভীনকে ঘৃণা করবে। মেহেভীন দুটানায় পড়ে যায়। পরক্ষনে মেহেভীনের আরেকটা কথায় মাথায় আসে,তিনিও তো একজন মা। তিনি নিশ্চই বুঝেন একটা মা তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে ঠিক কী কী রকতে পারে।
তিনি নিশ্চই সত্যিটা জানলে, মেহেভীনকে ঘৃণা করবেন না।বরং আগের মতোই আগলে রাখবেন।
আরিয়ানের যেহুতু আজকে হসপিটালের চাপ আছে তাই আরিয়ান আগেই চলে গেছে। এখন যেহুতু বাড়িতে আরহাম আছে,তাই বাধ্য হয়েই মেহেভীনকে আরহামের সাথে বেড়োতে হয়েছে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। কেননা আরহামের মা মেহেভীনকে কিছুতেই এক ছাড়বেন না।আরহামের যেহুতু আজ প্রথম এমডি হিসেবে জয়েনিং, তাই সে আজকে তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠেছে। গাড়িতে উঠার সময়, মেহেভীন এক বিপত্তি ঘটিয়ে ফেলেছিলো,তা হলো সে আরহামকে সামনে রেখেই, পিছনের সিটে বসতে গিয়েছিলো। তখন আরহাম ভ্রু কুচকে বলে,
”হেই স্টুপিড মেয়ে তুমি আমাকে নিজের ড্রাইভার মনে করো? সামনে বসো জাস্ট স্টুপিড।’
মেহেভীন নাক ফুলিয়ে বলে,
‘একদম আমাকে স্টুপিড় মেয়ে বলবেন না। বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন বলে কী একেবারে মাথা কিনে নিয়েছেন?’
আরহাম গাড়ি থেকে বেড়িয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে নিজের পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে, নিজেও বসে পড়ে। মেহেভীনকে কিছু বলার কোনপ্রকার সুযোগ না দিয়েই, যুবক নিজের ভ্রু খানিক্টা আরো কুচকে বললো,
‘দেখো মেয়ে আজকে আমার কাছে একটা ইম্পোর্টেন্ট দিন। সকাল-সকাল তোমার সাথে ঝগড়া করে, সেই মুডটা নষ্ট করতে চাইছি না। তাই তুমিও একদম চুপ হয়ে যাও। বেশি বকবক করবে না।’
আরহাম কথাটি বলেই, গাড়ি চালু করে দিলো। মেহেভীন নাক ফুলিয়ে বসে থাকে। আরহাম তা গাড়ির মিরর দিয়ে ঠিকই দেখেছিলো। মেহেভীনকে এইভাবে নাক ফুলাতে দেখে,আরহাম আলতো হাঁসে। যা মেহেভীনের চোখে ঠিকই পড়েছে। লোকটার নাকের মাঝ বরাবর একেবারে ছোট্ট তিল আছে, যা শুধুমাত্র হাঁসলেই গাঢ়ো হয়ে উঠে। আরহামকে তখন আরো ভালো লাগে দেখতে। মেহেভীন মুখ ঘুড়িয়ে বিড়বিড় করে আরহামকে বকতে লাগলো। ভার্সিটির কাছে আসতেই, মেহেভীন দ্রুত নেমে যায়। দ্রুত নেমে যাওয়ার কারনে, মেহেভীন একটু হলেও পড়ে যেতো,
কিন্তু আরহাম দ্রুত মেহেভীনের হাত ধরে ফেলে।
আরহাম তখন রাগান্বিত সুরে বলে,
”এই মেয়ে দেখেশুনে চলতে পারো না? একটুর জন্যে হলেই তো পড়ে যেতে। ‘
মেহেভীন বিড়বিড় করে বলে,
”এই লোকটার মুখ এতো তেঁতো কেন? সারাদিন শুধু বকে। ”
‘এই মেয়ে কি এতো বিড়বিড় করছো? ‘
‘কিছু না হুহ। ‘
‘দেখে-শুনে চলাফেরা করবে স্টুপিড মেয়ে একটা। ‘
আরহামের কথার বিপরীতে মেহেভীন কথা শুনাতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার আগেই আরহাম গাড়ি নিয়ে চলে যায়। চলে যাওয়ার আগে ভালো করে বলে যায় মেহেভীন যেন সে আসার আগে একা একা না যায়।
মেহেভীন শুধু মুখ বেকায়। একদিনেই এক লোকটা তার উপর হুকুমজারি করা শুরু করে দিয়েছে। নিজেকে কী ভাবে কে জানে? মেহেভীন কিছুতেই ওই বেশরকম লোকটার কথা শুনবে না। কথায় কথায় শুধু স্টুপিড বলে।
কথাটি ভেবে মেহেভীন ভার্সিটিতে পা রাখতে গেলেই,তার চোখে পড়ে যায় অভ্র ও মায়রার সেই আইস্ক্রিম খাওয়ার দৃশ্য। মায়রা বিদেশ থেকে এসে, মেহেভীনের ভার্সিটিতেই ভর্তি হয়। মেহেভীনের দুই ব্যাচ সিনিয়র মায়রা। আজকে মায়রা অভ্রের সাথে ভার্সিটিতে আসার সময়, মায়রা অভ্রের কাছে আবদার করে বসে,সে আজকে আইস্ক্রিম খাবে। যদিও অভ্রের কোন ইচ্ছে ছিলো না,তবুও মায়রার জন্যে ভার্সিটির পাশে একটি আইস্ক্রিম পার্লারে মায়রাকে নিয়ে গিয়ে, নিজের হাতে আইসক্রিম খায়িয়ে দেয়। মায়রার বান্ধুবীরা তো এই দৃশ্য দেখে,হাঁসতে হাঁসতে বলে,
”সত্যি যাই বলিস। আমাদের মায়রা ভাগ্য করে এমন বর পেয়েছে। আমাদের অভ্র ভাইয়া কত ভালোবাসে মায়রা। হায় তাদের এই ভালোবাসায় যেন কারো নজর না লাগে।’
মায়রা লজ্জা পায় তাদের কথা শুনে। অভ্র চুপ থাকে। কোথাও না কোথাও এইসব কিছুর সাথেই মেহেভীন জড়িয়ে আছে। অভ্রের মধ্যে একটা ‘তুমিহীনা ‘নামক শূন্যতা কাজ করছে। কই তার ভালোবাসা মায়রা তো তার খুব কাছেই আছে৷ তবুও কেন এতো শূন্যতা কাজ করছে তার?
মেহেভীনের এই দৃশ্য দেখে, পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। অভ্রের ভেনালা আইস্ক্রিম খুব পছন্দ করতো। তাই মেহেভীম ইউটিউভ দেখে ভেনালা আইস্ক্রিম বানানো শিখে নিয়েছিলো। অভ্রকে সে নিজ হাতেই আইস্ক্রিম খায়িয়ে দিতো, তখন অভ্রেরও বাচ্ছাদের মতো মুখে আইস্ক্রিম লেগে থাকতো। তখন মেহেভীন হাঁসতে হাঁসতে অভ্রের মুখে লেগে থাকা আইস্ক্রিম খুব যত্নের সাথে মুছে দিতে। আচ্ছা অভ্রের ও কি এইসব স্মৃতি মনে পড়ে? হয়তো একটুও না। মেহেভীন মনে মনে বলে,
।”আর কতভাবে আমাকে তোমার দহনে পুড়াবে অভ্র? আর কতভাবে আমাকে শাস্তি দিবে। তোমার দেওয়া শাস্তিগুলো যে আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আমিও যে দিনশেষে মানুষ। তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে এই শাস্তিগুলো যে আমি নিতে পারছি না। ‘
মেহেভীন ঢুকরে কেঁদে উঠে। পরক্ষনে সে তার সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। সে আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,
”এইযে আমার বেবী তুমি কিন্তু একদম ভাববে না তোমার মা দূর্বল। সে সকল অবস্হায় নিজেকে শক্ত রাখবে অন্তত তোমার জন্যে হলেও। ‘
মেহেভীন কথাটি বলেই উল্টো রাস্তায় হাট ধরে। আজকে সে ঠিক করেছে।আজকে কিছুক্ষন হাটবে। আজ আর সে ক্লাস করবে না। প্রেগন্যান্ট অবস্হায় হাটাহাটি করলে, তার এবং বেবীর দুজনেই ভালো হবে। মেহেভীন এখন এই মুহুর্তে অভ্র নামক প্রতারককে নিয়ে ভাবতে চায়না বরং তার সমস্ত চিন্তা ভাবনা তার সন্তানকে ঘিড়ে।
_______
আরহাম অফিসে ফরমাল ড্রেসাপের সাথে প্রবেশ করে। আরহামের ড্রেসিং চেন্স বরাবরই খুব ভালো। তার শার্টের সাথে হাল্কা নেবী ব্লু ব্লেজারটা বড্ড মানিয়েছে। অফিসের নতুন এমডিকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে যায়। সবার আগে তাহসান এগিয়ে এসে,তার বন্ধুর হাতে ফুলের তোরা এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘অভিনন্দন আমাদের কম্পানির নতুন এমডি মিঃ আরহাম হাসান তালুকদার। দয়া করে আপনার এই সামান্য কর্মচারীর ফুল গ্রহন করবেন?’
আরহাম ক্ষিপ্ত গলায় বললো,।
”একটা থাপ্পড় খাবি তুই। আমরা আগেও ফ্রেন্ডস ছিলাম। এখনো আছি। আমার পজিশন চেঞ্জে কিচ্ছু পরিবর্তন হবে না। ‘
‘আম জাস্ট কিডিং আরহাম। তুই এতো সিরিয়াস নেস কেন? এই ফুল নে আর আমাকে ধন্য কর। ‘
আরহাম মুচকি হেঁসে ফুলের তোরাটা হাতে নেয়।
মেহেভীন হাটতে হাটতে আরো অনেকগুলো অফিসে গেলো ইন্টারভিউয়ের জন্যে এপ্লাই করতে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এর মাঝে আরিয়ান ফোন করেছিল। মেহেভীন আরিয়ানকে ভরসা দিয়ে বলেছে সে ঠিক সময় বাসায় পৌঁছে যাবে। মেহেভীন বাসে উঠে বসে। বাসে তেমন সিট নেই। মেহেভীন পিছনের দিকে গিয়ে, একটা সিটে বসে পড়ে। সেখানে একজন বয়স্ক লোক বসে ছিলো। সে বিভিন্নভাবে মেহেভীনের দিকে কুনজর দিচ্ছিলো। যা মেহেভীন খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলো। যেহুতু লোকটা মেহেভীনের পাশেই বসে ছিলো, সুতরাং মেহেভীনের অস্বস্হি অনেকটাই প্রখর হয়ে উঠেছিলো। তখনি সেখানে পুরুষকন্ঠে কেউ বলে,
”এক্সকিউজ মি! মিঃ বুড়ো আংকেল আপনার সিট সামনে অথচ আপনি পিছনে বসে আছেন। কাইন্ডলি আপনি সামনে যাবেন? ‘
পরিচিত কন্ঠ শুনে, মেহেভীন তাকিয়ে দেখে আরহাম। নিজের ব্লেজার টা কাঁধে ঝুলিয়ে বসে দাড়িয়ে আছে তীক্ন দৃষ্টি নিয়ে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে কিছুটা ক্লান্ত তার সাথে কিছুটা রেগেও আছে। কিন্তু ঠিক কার উপর রেগে আছে,তা বুঝা যাচ্ছে না। মেহেভীনের উপর নাকি বয়স্ক লোকটার উপর?
বয়স্ক লোকটা মেকি হাসি দিয়ে বলে,
‘না বাবা। আমার সমস্যা নেই। আমি এখানেই ঠিক আছি। ‘
আরহাম দাঁত কিড়মিড় করে, বয়স্ক লোকটার দিকে ঝুঁকে বলে,
‘তা সমস্যা হবে কিন্তু? যুবতী মেয়ে পাশে থাকলে সমস্যা তো থাকবেই না। কবরে এক পা গেছে,তাও মেয়েদের দিকে বাজে নজরে তাকাতে লজ্জা করেনা? আপনাদের মতো কিছু মানুষের জন্যেই আজ মেয়েরা কোথাও একটু স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। আপনার পাশে বসে থাকা মেয়েটিও কিন্তু সম্পুর্ন বোরখা পড়ে বসে আছে,তবুও বোরখা পড়েও,আপনার বাজে নজর থেকে সে নিজেকে হেফাজত করতে পারছে না। আপ্নারা ঠিক কবে ভালো হবেন? স্পিক আউট। ‘
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
শেষের কথাগুলো আরহাম কিছুটা চিৎকার নিয়েই বলে । যার কারনে বয়স্ক লোকটি একপ্রকার লজ্জা নিয়েই বাস থেকে নেমে যায়। আরহাম রাগ করতে করতে মেহেভীনের পাশে বসে বলে,
”কালকে রাতে তোমার ঢাকায় একা থাকার ব্যাপারে কেন মানা করেছিলাম জানো? কেননা আমাদের দেশটাই এমন হয়ে গেছে। এখানে বয়স্ক লোকদের কাছেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। সারাক্ষন শুধু মেয়েদের উপর বাজে নজর।’
মেহেভীন চুপ হয়ে যায়। তার এইরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। অন্তত আশিক নামক ভয়ংকর পুরুষের থেকে সে এইটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আজকে
সত্যি আরহাম সঠিক সময়ে এসে, মেহেভীনকে একপ্রকার বাচিয়ে দিয়েছে। আরহামের জন্যে মেহেভীনের মনে শ্রদ্ধা জায়গা করে নিলো। মেহেভীন এক পলক আরহামের দিকে তাকায়। কানে হেডফেন লাগিয়ে সে গান শুনতে ব্যস্ত। হয়তো নিজের রাগটুকু দমন করার প্রচেস্টা। মেহেভীন পরম নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাসে এলেই তার ঘুম পায়। মেহেভীন এইটুকু জানে, সে আরহামের কাছে নিরাপদই থাকবে। গান শুনতে শুনতে আরহাম খেয়াল করে, মেহেভীন ঘুমাতে ঘুমাতে ঝিমুচ্ছে,যার কারনে তার মাথা বার বার জানালার কাছে বারি খাচ্ছে।
‘স্টুপিড মেয়ে একটা। ঠিক মতো ঘুমাতেও পারেনা।’
কথাটি বলে আরহাম মেহেভীনের মাথা তার কাঁধে রাখে,যেন মেহেভীন ব্যাথা না পায়। আরহাম মেহেভীনের দিকে এক পলক তাকায়। ঘুমন্ত অবস্হায় মেয়েটিকে কতটা নিষ্পাপ লাগে। আরহাম তার দৃষ্টি সরিয়ে, আবারো ফোন টিপতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
[চলবে]
[কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু]
গল্প দিতেও ইচ্ছে করে না এখন 🙂। আমরা সামনে পরীক্ষা তারপরেও আপনাদের জন্যে লিখি,কিন্তু আপ্নারা আমার ছোট্ট গ্রুপে রিভিউও দেন না+এক্টিভও থাকেন না।🙂।
আমার গ্রুপে -রিমির গল্পকথার ক্যানভাস।