স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৪১

0
487

##স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪১

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

বেলা গড়ালো। জায়ান আর তৃষাম আজ আর তাদের বাড়িতে ফিরলো না। পাখি বেগমের আদর আপ্যায়নে থেকে গেল এ বাড়িতেই। আর খুব সুন্দরভাবে ঘাঁটিও গাড়লো পূর্বাশার কক্ষেও। জায়ান এমনিইও এ বাড়ির কাউকে চিনে না, অন্য কোনো কক্ষে একা একা বসে থাকতে অস্বস্তি লাগে কেমন একটা। আর রয়েছে তৃষাম, ও থাকাও যা না থাকাও তাই। এসে থেকে পূর্বাশার কাজিন বোনদের পিছনে ছুঁকছুঁক ভাব‌। ও ব্যাটাকে ঐ কাজিন নারী মহলে ফেলে এসেই এখানে বেশ আয়েশ করে শুয়ে রয়েছে পূর্বাশার কক্ষে। পূর্বাশা শুধুমাত্র অগ্নি দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে জায়ানের কর্মকাণ্ড বলতে পারছে না কিছুই। মুখ খুললেই আবার চেঁচিয়ে উঠছে তার মা। তবুও পূর্বাশা এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – সমস্যা কি আপনি এখানে এসে শুয়ে পড়েছেন কেন?

– দেখছি।

– কি?

– তোমার ঘর বিছানা কেমন তা। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি এসে থাকতে হবে না?

– শ্বশুর বাড়ি কিসের শ্বশুর বাড়ি? আমি তো আপনাকে বিয়েই করবো না।

– তোমাকে করতে হবে না আমি করবো। তুমি শুধু সময় মতো কবুল বলে দিও।

– আপনি একটা…

কথাটুকু বলেই জায়ানের দিকে তেড়ে গেল পূর্বাশা। কিন্তু কিছু করার আগেই তার ঘরের দরজায় টোকা দিল কেউ। পূর্বাশা ফিরে তাকালো সেদিকে। দেখলো নক্ষত্র দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে এলো পূর্বাশার, বলল – আপনি!

নক্ষত্র ভিতরে এলো। জায়ানের পানে একবার তাকিয়ে বলল – দেখতে এলাম।

– ওহ।

জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। বিছানা ছেড়ে সে উঠে এলো, দাঁড়ালো পূর্বাশার পাশে। নক্ষত্রের পানে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল – আপনি নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন না কেন এখনও?

পূর্বাশা চোখ গরম করে তাকালো জায়ানের পানে। কটমট করে বলল – ঝামেলা না করে তৃষাম ভাইয়ের কাছে যান। আর ভুলে যাবেন না উনি কিন্তু আমার ফুফাতো ভাই ও লাগেন।

পূর্বাশার কথায় জায়ানের মধ্যে কোনো হেলদোল পরিলক্ষিত হলো না। তবে নক্ষত্রের দৃষ্টিও তীক্ষ্ম হলো এবার। তীক্ষ্ম কন্ঠে সে বলল – আমার বাড়ি যাওয়া নিয়ে দেখছি তোমার অনেক তাড়া।

– অনেকটা।

নক্ষত্র অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের পানে তবে তার কথার কোনো উত্তর দিল না। এই ছেলে যে ভীষন পরিমানে অভদ্র স্বভাবের তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। এখন এর সাথে কথা বলা মানেই ঝামেলা বাড়ানো। নক্ষত্র দৃষ্টি সরালো জায়ানের উপর থেকে। অতঃপর তাকালো পূর্বাশার পানে। নরম কন্ঠে বলল – তোর সাথে কিছু কথা বলার আছে আমার।

নক্ষত্রের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই জায়ান উত্তর দিল – কি কথা?

নক্ষত্র এবার বিরক্ত হলো বেজায়। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে বলল – আমি তোমাকে বলিনি। আমি পূর্বাকে বলেছি।

জায়ানের দৃষ্টি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। হুট করে সে একটু বেঁকে গেল পূর্বাশার দিকে। কন্ঠটা খাদে নামিয়ে শুধালো – তোমার ফুফাতো ভাইকেও কি এখন আমার চাপা মা’ই’র দিতে হবে?

কথাটা কর্ণে পৌঁছাতেই প্রথমে ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটা। জায়ান আবার বলল – নক্ষত্রকে চাপা মা’ই’র দিলে কিন্তু সে মাইরের ডোসটাও তেমন হবে। বলা যায় না পুরুষ মানুষ হিজড়াদের দলেও যোগ দিতে হতে পারে।

জায়ানের কথায় যেন আঁতকে উঠলো সে। চাপা মা’ই’র! তাহলে তো নক্ষত্রের বংশ নির্বংশ। হ্যা সে নক্ষত্রকে পছন্দ করে না এই বলে তো তো নক্ষত্রের বংশ নির্বংশ হোক এটা চায় না। তাছাড়া নক্ষত্রের বংশ নির্বংশ মানেই হলো তার ফুফুর বংশ নির্বংশ। একটা মাত্র ছেলে তার ফুফুর। কেশে উঠলো পূর্বাশা। কাশতে কাশতে জায়ানকে বলল – আপনি আমার রুম থেকে বের হন।

ছেলেটা সাথে সাথেই পূর্বাশার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো। শক্ত কন্ঠে বলল – এমনিও এই রুম থেকে আমি কোথাও বেরুতাম না আর এখন তো আরও বেরুবো না।

– আমার পূর্বার সাথে জরুরী কথা আছে।

নক্ষত্রের এরূপ কথায় যেন আরও শক্ত হলো জায়ানের কন্ঠস্বর। কন্ঠে অধিক পরিমাণ কাঠিন্য এনে সে বলল – যা বলার আমার সামনেই বলুন।

নক্ষত্রও যেন এর অপেক্ষাই করছিলো। সেও তার কথাগুলো জায়ানের সম্মুখেই বলতে চেয়েছিল। জায়ানকে বুঝাতে চেয়েছিল তার এবং পূর্বাশার সম্পর্কটা। তাকে যে পূর্বাশা ভালোবাসতো সে কথা। জায়ানের এ বাড়িতে আসার পর পূর্বাশার সাথে অতিরিক্ত চিপকে থাকা, তার প্রতি খুঁটিনাটি খেয়াল রাখা দেখেই নক্ষত্র আন্দাজ করে নিয়েছিল যে জায়ানের ভিতরে পূর্বাশার জন্য কিছু তো আছে। নক্ষত্র বিচক্ষণ পুরুষ। এই টুকু বুঝতে তার খুব একটা সময় লাগেনি। তাই তো জায়ানকে জানিয়ে শুনিয়েই সে পূর্বাশার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। নক্ষত্র একবার তাকালো জায়ানের শক্ত মুখ খানার পানে অতঃপর বলা শুরু করলো – আমি দুঃখিত পূর্বা। আমি জানি আমি যে ভুলটা করেছি তার ক্ষমা হয় না কোনো। তবুও ক্ষমা চাইছি আমি তোর কাছে। আমাকে কি একটা বার ক্ষমা করা যায় না?

নক্ষত্রের কথায় ভ্রু কুঁচকালো পূর্বাশা, বলল – কোন ভুল?

– যে ভুলের কারনে তুই আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি, দেশ ছেড়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি।

পূর্বাশা কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো নক্ষত্রের পানে অতঃপর হুট করেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল – লাইক সিরিয়াসলি নক্ষত্র ভাই? আপনি এতটা ভুল ধারনা নিয়ে বসবাস করছেন কিভাবে? আমি আপনার জন্য আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নেইনি আমি নিজের থেকে নিজে মুক্তি পথ খুঁজতে, এই সমাজ থেকে মুক্তি পেতে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর কি বললেন? দেশ ছেড়ে যাওয়া, তাও আমি আপনার জন্য দেশ ছাড়িনি, আমি দেশ ছেড়েছি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, এই চিরচেনা সমাজ থেকে একটু দূরে গিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে।

এইটুকু বলে থামলো পূর্বাশা অতঃপর আবার বলল – ক্ষমা চাইছেন আমার কাছে নিজের করা ভুলের জন্য? কিন্তু আপনার করা কাজটি তো ভুল ছিল না, ছিল অন্যায়। মানুষ না জেনে কোনো কাজ করে ফেললে তাকে ভুল বলা যায় কিন্তু জেনে শুনে করলে কি তাকে আদও ভুলের আওতায় ফেলা যায় নক্ষত্র ভাই?

নক্ষত্র অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বাশার পানে। মেয়েটা চোখ রাখলো তার চোখে। মৃদু হেসে বলল – মাত্র পনেরো দিন, দুঃখিত পনেরো দিন তো ছিল আমাদের সম্পর্কের বয়স তার আগে পুরো পাঁচটা মাস আপনি আমাকে ভালোবাসার কি নিখুঁত অভিনয়টা করে গেলেন। আমাকে ভালোবাসতে শিখালেন, আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে শিখালেন অতঃপর একদিন এসে খুব সহজে বলে দিলেন সবটাই অভিনয় ছিল আপনার, কোনো ভালোবাসা ছিল না এখানে। মাত্র একটা চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য আপনি ব্যবহার করেছেন আমাকে। আচ্ছা নক্ষত্র ভাই আপনি কি জানতেন না কারো সাথে ভালোবাসার অভিনয় করা, তার হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চার করে তাকে পায়ে ঠেলে দেওয়া অন্যায়? আপনি কি জানতেন না কারো হৃদয় ভাঙলে বিপরীত দিকের মানুষটার নিদারুণ যন্ত্রনার কথা? আপনি জানতেন। আর সবটা জেনে শুনেই আপনি আমার সাথে দিনের পর দিন ভালোবাসার অভিনয় করে গেছেন। আমাকে ঠকিয়েছেন, প্রতারনা করেছেন আমার সাথে। আপনি যা করেছেন সবটা আপনার জানা ছিল তবুও আপনি করেছেন। তবে কি আপনার কর্ম ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় নক্ষত্র ভাই?

নক্ষত্র শুনলো সবটা। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। জীবনে করা চড়ম ভুলটার জন্য অনুতাপে হৃদয় দগ্ধ আজ। নিজের স্বপক্ষে দুই চার বাক্য কন্ঠে আনার মতো শক্তি যেন পাচ্ছে না। শক্তি পাচ্ছে না বললে অবশ্য ভুল হবে, খুঁজে পাচ্ছে না। সে যে ভুলটা করেছে যদিও তা পূর্বাশার মতে অন্যায় সেই অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আদও কি কিছু বলার থাকতে পারে তার? তবুও শেষ চেষ্টা নক্ষত্র করতে চাইলো। পূর্বাশার পানে একটু এগিয়ে বলল – প্লীজ পূর্বা মাফ করে দে আমাকে। তুই ভুল বলিস আর অন্যায় বলিস যাই বলিস না কেন আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দে।

পূর্বাশা হাসলো। চোখের কোনে অল্পস্বল্প অশ্রুর অস্তিত্ব টের পেল সে। খুব সংগোপনে সে অশ্রুটুকু মুছে ফেললো মেয়েটা। পরক্ষনেই শক্ত কন্ঠে বলল – আমার এই মুহূর্তে এসব কথা আর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না নক্ষত্র ভাই। আপনি বরং এখন আসুন।

নক্ষত্র তবুও গেল না। ব্যাকুল ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে হাত ধরতে চাইলো পূর্বাশার। কিন্তু পারলো না। তার আগেই তার পথ আগলে দাঁড়ালো জায়ান। শক্ত কন্ঠে বলল – শুনলেন না পূর্বাশা আপনাকে চলে যেতে বলেছে?

নক্ষত্র করুন দৃষ্টিতে একবার তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর নীরবে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। নক্ষত্র যেতেই জায়ান ফিরে তাকালো পূর্বাশার পানে। দৃষ্টি নরম হলো তার। কোমল কন্ঠে বলল – এই ছেলেটার জন্য তুমি আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে কৃষ্ণময়ী?

পূর্বাশা তাকালো জায়ানের পানে। শক্ত কন্ঠে বলল – না আমি কারো জন্য আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নেইনি। কেন আপনি শুনলেন না যে উনাকে বললাম আমি নিজের থেকে নিজে মুক্তি পেতে, এই সমাজ থেকে মুক্তি পেতে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

– কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের পিছনে কোথাও না কোথাও স্থানটা নক্ষত্রের ছিল। যা তোমাকে তোমার জীবনের উপর ঘৃনা বাড়াতে বাধ্য করেছিল। আর সেই ঘৃনা থেকে বাঁচতেই তুমি আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে।

এই টুকু বলে থামলো জায়ান আবার বলল – আচ্ছা আ’ত্ম’হ’ত্যা করেই কি তুমি মুক্তি পেয়ে যেতে কৃষ্ণময়ী? এই সুন্দর জীবনটা নিঃশেষর মধ্যেই কি সুখ পেতে তুমি বলো? আসলে সুখ শান্তি কারো জীবনেই ভরপুর নয়। তুমি খুঁজে দেখো এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ সুখী কেউ নেই। কুৎসিত মানুষগুলো তার রূপের আফসোসে অসুখী, খুঁজে দেখো সুন্দরী মানুষগুলোও তার রূপের জন্যই অসুখী। অতিরিক্ত সৌন্দর্যের জন্য তার স্বামীর কাছে সে সর্বদা সন্দেহের পাত্রী, রাস্তাঘাটে বেরুলে ছেলেদের উত্যক্তকরন। এখানে ওখানে, চাকরি, সোসাল মিডিয়া, রেস্টুরেন্ট, বাস সর্বত্র নিজের রূপ সৌন্দর্যের জন্য তারা হ্যারা হয়রানির স্বীকার। সমাজের মানুষজন তার দিকে সুনজর দেওয়ার তুলনায় কুনজর বেশি দেয়। আবার খুঁজে দেখবে গরীবরা তার অর্থহীনতার জন্য অসুখী আবার ধনীরা তাদের অর্থের জন্যই অসুখী। এই পৃথিবীতে আমরা সবাই অসুখী, সকলে মুক্তির উপায় খুঁজে ফিরি প্রতিনিয়ত। কিন্তু মুক্তি পাই কতজন? তাই বলে কি আমরা নিজেদের জীবনের নিঃশেষ ঘটাই? না আমরা বেঁচে থাকি। সমাজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়ে বেঁচে থাকি। আ’ত্ম’হ’ত্যা’ কখনও কোনো বিষয়ের সমাধান হতে পারে না। তার থেকে আমাদের উচিৎ নিজেকে ভালোবাসা, নিজের জন্য বাঁচা। অন্যের দিকে না তাকিয়ে শুধু মাত্র নিজের দিকে দেখে সুন্দর এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

পূর্বাশা শুনলো জায়ানের সব কথাগুলো। মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল মেয়েটার চিত্ত। এই ছেলেটা এত সুন্দর কথা বলতে পারে? মাঝে মাঝে যেন কল্পনা মনে হয় সব। পূর্বাশা ভাসা ভাসা দৃষ্টি নিয়ে সে কিঞ্চিৎ সময় তাকিয়ে রইলো জায়ানের পানে। অতঃপর হুট করেই বলল – আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন?

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

বেলা গড়ালো। জায়ান আর তৃষাম আজ আর তাদের বাড়িতে ফিরলো না। পাখি বেগমের আদর আপ্যায়নে থেকে গেল এ বাড়িতেই। আর খুব সুন্দরভাবে ঘাঁটিও গাড়লো পূর্বাশার কক্ষেও। জায়ান এমনিইও এ বাড়ির কাউকে চিনে না, অন্য কোনো কক্ষে একা একা বসে থাকতে অস্বস্তি লাগে কেমন একটা। আর রয়েছে তৃষাম, ও থাকাও যা না থাকাও তাই। এসে থেকে পূর্বাশার কাজিন বোনদের পিছনে ছুঁকছুঁক ভাব‌। ও ব্যাটাকে ঐ কাজিন নারী মহলে ফেলে এসেই এখানে বেশ আয়েশ করে শুয়ে রয়েছে পূর্বাশার কক্ষে। পূর্বাশা শুধুমাত্র অগ্নি দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে জায়ানের কর্মকাণ্ড বলতে পারছে না কিছুই। মুখ খুললেই আবার চেঁচিয়ে উঠছে তার মা। তবুও পূর্বাশা এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – সমস্যা কি আপনি এখানে এসে শুয়ে পড়েছেন কেন?

– দেখছি।

– কি?

– তোমার ঘর বিছানা কেমন তা। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি এসে থাকতে হবে না?

– শ্বশুর বাড়ি কিসের শ্বশুর বাড়ি? আমি তো আপনাকে বিয়েই করবো না।

– তোমাকে করতে হবে না আমি করবো। তুমি শুধু সময় মতো কবুল বলে দিও।

– আপনি একটা…

কথাটুকু বলেই জায়ানের দিকে তেড়ে গেল পূর্বাশা। কিন্তু কিছু করার আগেই তার ঘরের দরজায় টোকা দিল কেউ। পূর্বাশা ফিরে তাকালো সেদিকে। দেখলো নক্ষত্র দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে এলো পূর্বাশার, বলল – আপনি!

নক্ষত্র ভিতরে এলো। জায়ানের পানে একবার তাকিয়ে বলল – দেখতে এলাম।

– ওহ।

জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। বিছানা ছেড়ে সে উঠে এলো, দাঁড়ালো পূর্বাশার পাশে। নক্ষত্রের পানে তাকিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল – আপনি নিজের বাড়িতে যাচ্ছেন না কেন এখনও?

পূর্বাশা চোখ গরম করে তাকালো জায়ানের পানে। কটমট করে বলল – ঝামেলা না করে তৃষাম ভাইয়ের কাছে যান। আর ভুলে যাবেন না উনি কিন্তু আমার ফুফাতো ভাই ও লাগেন।

পূর্বাশার কথায় জায়ানের মধ্যে কোনো হেলদোল পরিলক্ষিত হলো না। তবে নক্ষত্রের দৃষ্টিও তীক্ষ্ম হলো এবার। তীক্ষ্ম কন্ঠে সে বলল – আমার বাড়ি যাওয়া নিয়ে দেখছি তোমার অনেক তাড়া।

– অনেকটা।

নক্ষত্র অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো জায়ানের পানে তবে তার কথার কোনো উত্তর দিল না। এই ছেলে যে ভীষন পরিমানে অভদ্র স্বভাবের তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। এখন এর সাথে কথা বলা মানেই ঝামেলা বাড়ানো। নক্ষত্র দৃষ্টি সরালো জায়ানের উপর থেকে। অতঃপর তাকালো পূর্বাশার পানে। নরম কন্ঠে বলল – তোর সাথে কিছু কথা বলার আছে আমার।

নক্ষত্রের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই জায়ান উত্তর দিল – কি কথা?

নক্ষত্র এবার বিরক্ত হলো বেজায়। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে বলল – আমি তোমাকে বলিনি। আমি পূর্বাকে বলেছি।

জায়ানের দৃষ্টি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। হুট করে সে একটু বেঁকে গেল পূর্বাশার দিকে। কন্ঠটা খাদে নামিয়ে শুধালো – তোমার ফুফাতো ভাইকেও কি এখন আমার চাপা মা’ই’র দিতে হবে?

কথাটা কর্ণে পৌঁছাতেই প্রথমে ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটা। জায়ান আবার বলল – নক্ষত্রকে চাপা মা’ই’র দিলে কিন্তু সে মাইরের ডোসটাও তেমন হবে। বলা যায় না পুরুষ মানুষ হিজড়াদের দলেও যোগ দিতে হতে পারে।

জায়ানের কথায় যেন আঁতকে উঠলো সে। চাপা মা’ই’র! তাহলে তো নক্ষত্রের বংশ নির্বংশ। হ্যা সে নক্ষত্রকে পছন্দ করে না এই বলে তো তো নক্ষত্রের বংশ নির্বংশ হোক এটা চায় না। তাছাড়া নক্ষত্রের বংশ নির্বংশ মানেই হলো তার ফুফুর বংশ নির্বংশ। একটা মাত্র ছেলে তার ফুফুর। কেশে উঠলো পূর্বাশা। কাশতে কাশতে জায়ানকে বলল – আপনি আমার রুম থেকে বের হন।

ছেলেটা সাথে সাথেই পূর্বাশার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো। শক্ত কন্ঠে বলল – এমনিও এই রুম থেকে আমি কোথাও বেরুতাম না আর এখন তো আরও বেরুবো না।

– আমার পূর্বার সাথে জরুরী কথা আছে।

নক্ষত্রের এরূপ কথায় যেন আরও শক্ত হলো জায়ানের কন্ঠস্বর। কন্ঠে অধিক পরিমাণ কাঠিন্য এনে সে বলল – যা বলার আমার সামনেই বলুন।

নক্ষত্রও যেন এর অপেক্ষাই করছিলো। সেও তার কথাগুলো জায়ানের সম্মুখেই বলতে চেয়েছিল। জায়ানকে বুঝাতে চেয়েছিল তার এবং পূর্বাশার সম্পর্কটা। তাকে যে পূর্বাশা ভালোবাসতো সে কথা। জায়ানের এ বাড়িতে আসার পর পূর্বাশার সাথে অতিরিক্ত চিপকে থাকা, তার প্রতি খুঁটিনাটি খেয়াল রাখা দেখেই নক্ষত্র আন্দাজ করে নিয়েছিল যে জায়ানের ভিতরে পূর্বাশার জন্য কিছু তো আছে। নক্ষত্র বিচক্ষণ পুরুষ। এই টুকু বুঝতে তার খুব একটা সময় লাগেনি। তাই তো জায়ানকে জানিয়ে শুনিয়েই সে পূর্বাশার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। নক্ষত্র একবার তাকালো জায়ানের শক্ত মুখ খানার পানে অতঃপর বলা শুরু করলো – আমি দুঃখিত পূর্বা। আমি জানি আমি যে ভুলটা করেছি তার ক্ষমা হয় না কোনো। তবুও ক্ষমা চাইছি আমি তোর কাছে। আমাকে কি একটা বার ক্ষমা করা যায় না?

নক্ষত্রের কথায় ভ্রু কুঁচকালো পূর্বাশা, বলল – কোন ভুল?

– যে ভুলের কারনে তুই আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি, দেশ ছেড়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি।

পূর্বাশা কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো নক্ষত্রের পানে অতঃপর হুট করেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল – লাইক সিরিয়াসলি নক্ষত্র ভাই? আপনি এতটা ভুল ধারনা নিয়ে বসবাস করছেন কিভাবে? আমি আপনার জন্য আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নেইনি আমি নিজের থেকে নিজে মুক্তি পথ খুঁজতে, এই সমাজ থেকে মুক্তি পেতে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর কি বললেন? দেশ ছেড়ে যাওয়া, তাও আমি আপনার জন্য দেশ ছাড়িনি, আমি দেশ ছেড়েছি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, এই চিরচেনা সমাজ থেকে একটু দূরে গিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে।

এইটুকু বলে থামলো পূর্বাশা অতঃপর আবার বলল – ক্ষমা চাইছেন আমার কাছে নিজের করা ভুলের জন্য? কিন্তু আপনার করা কাজটি তো ভুল ছিল না, ছিল অন্যায়। মানুষ না জেনে কোনো কাজ করে ফেললে তাকে ভুল বলা যায় কিন্তু জেনে শুনে করলে কি তাকে আদও ভুলের আওতায় ফেলা যায় নক্ষত্র ভাই?

নক্ষত্র অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো পূর্বাশার পানে। মেয়েটা চোখ রাখলো তার চোখে। মৃদু হেসে বলল – মাত্র পনেরো দিন, দুঃখিত পনেরো দিন তো ছিল আমাদের সম্পর্কের বয়স তার আগে পুরো পাঁচটা মাস আপনি আমাকে ভালোবাসার কি নিখুঁত অভিনয়টা করে গেলেন। আমাকে ভালোবাসতে শিখালেন, আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে শিখালেন অতঃপর একদিন এসে খুব সহজে বলে দিলেন সবটাই অভিনয় ছিল আপনার, কোনো ভালোবাসা ছিল না এখানে। মাত্র একটা চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য আপনি ব্যবহার করেছেন আমাকে। আচ্ছা নক্ষত্র ভাই আপনি কি জানতেন না কারো সাথে ভালোবাসার অভিনয় করা, তার হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চার করে তাকে পায়ে ঠেলে দেওয়া অন্যায়? আপনি কি জানতেন না কারো হৃদয় ভাঙলে বিপরীত দিকের মানুষটার নিদারুণ যন্ত্রনার কথা? আপনি জানতেন। আর সবটা জেনে শুনেই আপনি আমার সাথে দিনের পর দিন ভালোবাসার অভিনয় করে গেছেন। আমাকে ঠকিয়েছেন, প্রতারনা করেছেন আমার সাথে। আপনি যা করেছেন সবটা আপনার জানা ছিল তবুও আপনি করেছেন। তবে কি আপনার কর্ম ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় নক্ষত্র ভাই?

নক্ষত্র শুনলো সবটা। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার। জীবনে করা চড়ম ভুলটার জন্য অনুতাপে হৃদয় দগ্ধ আজ। নিজের স্বপক্ষে দুই চার বাক্য কন্ঠে আনার মতো শক্তি যেন পাচ্ছে না। শক্তি পাচ্ছে না বললে অবশ্য ভুল হবে, খুঁজে পাচ্ছে না। সে যে ভুলটা করেছে যদিও তা পূর্বাশার মতে অন্যায় সেই অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আদও কি কিছু বলার থাকতে পারে তার? তবুও শেষ চেষ্টা নক্ষত্র করতে চাইলো। পূর্বাশার পানে একটু এগিয়ে বলল – প্লীজ পূর্বা মাফ করে দে আমাকে। তুই ভুল বলিস আর অন্যায় বলিস যাই বলিস না কেন আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দে।

পূর্বাশা হাসলো। চোখের কোনে অল্পস্বল্প অশ্রুর অস্তিত্ব টের পেল সে। খুব সংগোপনে সে অশ্রুটুকু মুছে ফেললো মেয়েটা। পরক্ষনেই শক্ত কন্ঠে বলল – আমার এই মুহূর্তে এসব কথা আর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না নক্ষত্র ভাই। আপনি বরং এখন আসুন।

নক্ষত্র তবুও গেল না। ব্যাকুল ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে হাত ধরতে চাইলো পূর্বাশার। কিন্তু পারলো না। তার আগেই তার পথ আগলে দাঁড়ালো জায়ান। শক্ত কন্ঠে বলল – শুনলেন না পূর্বাশা আপনাকে চলে যেতে বলেছে?

নক্ষত্র করুন দৃষ্টিতে একবার তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর নীরবে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। নক্ষত্র যেতেই জায়ান ফিরে তাকালো পূর্বাশার পানে। দৃষ্টি নরম হলো তার। কোমল কন্ঠে বলল – এই ছেলেটার জন্য তুমি আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে কৃষ্ণময়ী?

পূর্বাশা তাকালো জায়ানের পানে। শক্ত কন্ঠে বলল – না আমি কারো জন্য আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নেইনি। কেন আপনি শুনলেন না যে উনাকে বললাম আমি নিজের থেকে নিজে মুক্তি পেতে, এই সমাজ থেকে মুক্তি পেতে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

– কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের পিছনে কোথাও না কোথাও স্থানটা নক্ষত্রের ছিল। যা তোমাকে তোমার জীবনের উপর ঘৃনা বাড়াতে বাধ্য করেছিল। আর সেই ঘৃনা থেকে বাঁচতেই তুমি আ’ত্ম’হ’ত্যা’র সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে।

এই টুকু বলে থামলো জায়ান আবার বলল – আচ্ছা আ’ত্ম’হ’ত্যা করেই কি তুমি মুক্তি পেয়ে যেতে কৃষ্ণময়ী? এই সুন্দর জীবনটা নিঃশেষর মধ্যেই কি সুখ পেতে তুমি বলো? আসলে সুখ শান্তি কারো জীবনেই ভরপুর নয়। তুমি খুঁজে দেখো এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ সুখী কেউ নেই। কুৎসিত মানুষগুলো তার রূপের আফসোসে অসুখী, খুঁজে দেখো সুন্দরী মানুষগুলোও তার রূপের জন্যই অসুখী। অতিরিক্ত সৌন্দর্যের জন্য তার স্বামীর কাছে সে সর্বদা সন্দেহের পাত্রী, রাস্তাঘাটে বেরুলে ছেলেদের উত্যক্তকরন। এখানে ওখানে, চাকরি, সোসাল মিডিয়া, রেস্টুরেন্ট, বাস সর্বত্র নিজের রূপ সৌন্দর্যের জন্য তারা হ্যারা হয়রানির স্বীকার। সমাজের মানুষজন তার দিকে সুনজর দেওয়ার তুলনায় কুনজর বেশি দেয়। আবার খুঁজে দেখবে গরীবরা তার অর্থহীনতার জন্য অসুখী আবার ধনীরা তাদের অর্থের জন্যই অসুখী। এই পৃথিবীতে আমরা সবাই অসুখী, সকলে মুক্তির উপায় খুঁজে ফিরি প্রতিনিয়ত। কিন্তু মুক্তি পাই কতজন? তাই বলে কি আমরা নিজেদের জীবনের নিঃশেষ ঘটাই? না আমরা বেঁচে থাকি। সমাজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়ে বেঁচে থাকি। আ’ত্ম’হ’ত্যা’ কখনও কোনো বিষয়ের সমাধান হতে পারে না। তার থেকে আমাদের উচিৎ নিজেকে ভালোবাসা, নিজের জন্য বাঁচা। অন্যের দিকে না তাকিয়ে শুধু মাত্র নিজের দিকে দেখে সুন্দর এক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

পূর্বাশা শুনলো জায়ানের সব কথাগুলো। মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল মেয়েটার চিত্ত। এই ছেলেটা এত সুন্দর কথা বলতে পারে? মাঝে মাঝে যেন কল্পনা মনে হয় সব। পূর্বাশা ভাসা ভাসা দৃষ্টি নিয়ে সে কিঞ্চিৎ সময় তাকিয়ে রইলো জায়ানের পানে। অতঃপর হুট করেই বলল – আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন?

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here