স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৪২

0
438

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

পূর্বাশা ভাসা ভাসা দৃষ্টি নিয়ে সে কিঞ্চিৎ সময় তাকিয়ে রইলো জায়ানের পানে। অতঃপর হুট করেই বলল – আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন?

জায়ান ভরকে গেল যেন। নিজের কানকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছে না বেচারা। মনে হচ্ছে যেন ভুল শুনেছে সে। পূর্বাশা কিনা তাকে জড়িয়ে ধরতে বলেছে? এও সম্ভব কখনও? যাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে তাকে থাপ্পর খেতে হয় টপাটপ সে কিনা আজ নিজে থেকে জড়িয়ে ধরতে বলেছে জায়ানকে? ছেলেটা আর একটু নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো – কি বললে তুমি আবার বলো?

অপ্রস্তুত হলো পূর্বাশা। ঘোরের বশে জায়ানকে সে বলেছিল জড়িয়ে ধরতে। জড়িয়ে তো ধরলোই না উল্টো এখন আবার বলছে আবার বলতে। এক কথা কতবার বলা যায়? তাও আবার এই ধরনের কথা। আমতা আমতা শুরু করলো পূর্বাশা। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল – কিছু না।

সাথে সাথেই জায়ান হামলে পড়লো পূর্বাশার দিকে। ঝাপটে ধরলো মেয়েটাকে। হকচকিয়ে উঠলো পূর্বাশা। চকিত কন্ঠে বলল – কককি করছেন কি? ছাড়ুন আমাকে।

জায়ান ছাড়লো না পূর্বাশাকে। বরং আরও গাঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরলো পূর্বাশাকে অতঃপর বলল – এত বড় একটা সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করার মতোও বোকা আমি নই কৃষ্ণময়ী।

পূর্বাশা সাথে সাথেই চিমটি কাটলো জায়ানের বক্ষে। ভেংচি কেটে বলল – তাহলে এতক্ষন না শোনার নাটক করছিলেন কেন?

– ও তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তাই আর কি।

পূর্বাশা হাসলো। জায়ানকে আর একটু অবাক করে দিয়ে সেও জড়িয়ে ধরলো ছেলেটাকে। জায়ান অবাক হলো বটে তবে পরক্ষনেই তার ওষ্ঠে ফুটে উঠলো এক চিলতে সুখকর হাসির রেখা।

___________________________________

নতুন দিন, নতুন সময়। বাংলাদেশে মোটামোটি শীত পড়তে শুরু করেছে এই সময়ে। যদিও চীনের মতো অতটা হাড় কাঁপানো শীত নয়। তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই শীতই প্রবল অসহনীয়। বিশেষ করে রাস্তার পাশের ঐ বস্ত্রহীন মানুষগুলোর জন্য। গ্রীষ্মে তবুও তাদের বস্ত্রহীনতা অভিশাপ হয়ে নামে না ততটা তবে শীতে চড়ম অভিশপ্ততা বয়ে আনে তাদের জীবনে। জায়ান ইতমধ্যে চলে এসেছে পূর্বাশাদের বাড়ি থেকে তবে পূর্বাশা আসেনি তার সাথে। সে থেকে গেছে নিজ বাড়িতে। এতদিন পর মেয়েটা বাড়ি ফিরেছে। নিজের বাড়ি রেখে প্রতিটা দিন কি আর নানা বাড়িতে পড়ে থাকা সম্ভব? আর জায়ানেরও কি এত বছর পর নিজের বাড়ি, নিজের পরিচয়, নিজের পিতাকে ফিরে পেয়ে দিনের পর দিন ফুফু বাড়িতে পড়ে থাকা সম্ভব নাকি? যদিও পূর্বাশাকে ঐ নক্ষত্র নামক শিয়ালের আওতায় রেখে আসার কোনো ইচ্ছে ছিল না জায়ানের কিন্তু করার যে কিছু নেই তাকে তো ফিরে আসতেই হতো।

***

রাতের আকাশ, গোল থালার মতো এক রূপালী চন্দ্র স্থান করে নিয়েছে সেখানে। চারদিকে কেমন মিষ্টি একটা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে নীরবে। পূর্বাশা তাদের বাড়ির ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখছিলো আকাশের গোল চাঁদটা। কি ভীষন ভালো লাগছে তার বলার অপেক্ষা রাখে না আর। চীনে হোস্টেলে থাকা অবস্থায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ অনেকদিনই চাঁদ দেখেছে তবে দেশের মাটিতে নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখার মতো অনুভূতি সে অনুভব করেনি। পূর্বাশার বিভোর হয়ে চাঁদ দেখার মাঝেই পাশে কাউকে অনুভব করলো মেয়েটা। পাশ ফিরে তাকালো সে, চোখে পড়লো নক্ষত্রের মুখ খানা। ছেলেটা পূর্বাশা চীন থেকে ফিরে আসার পর থেকে এক দন্ড যেন পিছু ছাড়ছে না তার। সারাদিন যেন সকল স্থানে নক্ষত্র আছেই। এই দুইদিন জায়ান ছিল বিধায় খুব বেশি কাছে আসার সুযোগ পায়নি। এখন তো জায়ানও নেই। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে বোধহয়। পূর্বাশা বিরক্ত হলো কিঞ্চিৎ, বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল – কিছু বলবেন নক্ষত্র ভাই?

নক্ষত্র তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর বলল – আমাকে কি একটা বার মাফ করা যায় না পূর্বা?

– দিলাম মাফ করে তারপর?

– আমরা কি আবার আগের মতো সবটা শুরু করতে পারি না? আবারও প্রণয়ের বন্ধনে নিজেদের সিক্ত করে তুলতে পারি না পূর্বা? আমি তোকে ভালোবাসি পূর্বা, ভীষণ ভালোবাসি। তুই যখন কাছে ছিলি হয়তো আমি তোর মর্মটা বুঝতে পারিনি কিন্তু যখন তুই দূরে চলে গেলি আমি বুঝলাম তোকে ছাড়া আমি ঠিক কতটা অসহায়। তুই ঠিক আমার হৃদয়ে কতটা স্থান জুড়ে ছিলি।

পূর্বাশা হাসলো। আকাশের চাঁদটার পানে তাকিয়ে বলল – আমার দোয়াটা কবুল হওয়ার জন্য আর পরজন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না নক্ষত্র ভাই। এ জন্মেই আপনি আবারও ফিরলেন আমার কাছে আমার প্রণয়ে আসক্ত হলেন।

এইটুকু বলে থামলো পূর্বাশা আবার বলল – কিন্তু আমি আপনাকে ধোঁকা দিতে পারলাম না বোধহয়। আপনার মতো ভালোবাসার অভিনয় করে মাঝ পথে আপনাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারলাম না। তবে চার শব্দের ঐ ভয়ংকর বাক্যটা বেশ সুন্দর ভাবে বলে দিলাম “আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

নক্ষত্র যেন ব্যাকুল হয়ে পড়লো। পূর্বাশার কন্ঠে “ভালোবাসি না” কথাটা দহনের অনলে দগ্ধ করলো তার হৃদয়। দিশেহারা নক্ষত্র হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো পূর্বাশার এক হাত। নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল মেয়েটার ছোট খাটো হাতখানা। ব্যগ্র কন্ঠে বলল – আমি তোকে ভালোবাসি পূর্বা। আমাকে তুই ফিরিয়ে দিস না প্লীজ।

পূর্বাশা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল নক্ষত্রের হাতের মুঠো থেকে। স্বশব্দে একটা চড় বসিয়ে দিল বেচারার গালে। শক্ত কন্ঠে বলল – আমাকে স্পর্শ করার সাহস আপনি কোথা থেকে পেলেন নক্ষত্র ভাই? আপনার মতো প্রতারকের কোনো অধিকার নেই আমাকে স্পর্শ করার।

নক্ষত্র হতবম্ব হলো। আনমনেই নিজের হাতটা চলে গেল গালে। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইলো তার সম্মুখে দাঁড়ানো রনচডন্ডীর অবতার ধারন করা নারীটির পানে। সে ভীত, প্রতিবাদ করতে না জানা, সর্বদা চুপচাপ থাকা মেয়েটাও আজ গর্জে উঠেছে। নিজের স্বপক্ষে প্রতিবাদের তাগিদে মে’রে’ছে কাউকে। পূর্বাশার যেন এখনও ক্রোধ কমেনি। নক্ষত্রকে আরও দুই চারটা চড় থাপ্পর লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে। কি পেয়েছে তাকে? খেলার পুতুল? একবার আসবে, ভালোবাসি ভালোবাসি করে হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চার ঘটিয়ে ধোঁকা দিবে। প্রতারণা করে মৃ’ত্যু’র মুখে ঠেলে দিয়ে চলে যাবে। যখন মেয়েটা নিজেকে সামলে একটু ভালোভাবে বাঁচাতে শুরু করলো এখন আবার এসেছে তার জীবনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে, আবার তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। পূর্বাশা ঘৃনাভরা দৃষ্টিতে তাকালো নক্ষত্রের পানে। কঠিন কন্ঠে বলল – “যে নিজের সুখের খোঁজে আমাকে ইচ্ছেকৃতভাবে হারিয়েছে। সে আর যাই হোক কখনও আমাকে ফিরে পাওয়ার সুখ না পাক।”

কথাটুকু বলেই হনহন করে ছাদ থেকে নেমে গেল পূর্বাশা। নক্ষত্র দাঁড়িয়ে রইলো ওইভাবেই। সত্যিই তো নিজের সুখের জন্য। সুন্দর কাউকে পাওয়ার জন্যই তো সে ছেড়েছিল পূর্বাশাকে। সুন্দর অবশ্য অনেককেই পেয়েছে সে কিন্তু সুখ? সেই সুখ কি আদৌ পেয়েছে নক্ষত্র? যদি পেতোই তাহলে তো আর পূর্বাশার নিকট ছুটে আসতে হতো না তাকে। আবারও নিজের ভালোবাসার কথা জানাতে হতো না।

___________________________________

স্বার্থপর সময় বয়ে চলছে তার আপন গতিতে। কারো সুখ দুঃখ, ভালো থাকা মন্দ থাকা কোনোটাই তার দেখার বিষয় নয়। দেখতে দেখতে জায়ানদের চীনে ফিরে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। তবে চীন থেকে আসার সময় তারা চারজন আসলেও যাবে তিনজন। মিসেস শীও থেকে যাবেন জাফর চৌধুরীর সাথেই। এই কয়টা দিন অনেক দৌড়া দৌড়ি করে সে নিজের বাংলাদেশে থাকার মেয়াদ বাড়িয়েছে বেশ। এখানে থাকতে থাকতে আবার স্থায়ীভাবে এদেশে থাকার ব্যবস্থাটাও করে ফেলবেন তিনি। ইমেইলের মাধ্যমে কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন মিসেস শীও। কলেজের চাকরিটা মূলত তিনি শখের বশে করতেন। তার মূল কর্ম ছিল রেস্টুরেন্ট। বাবার থেকে উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া চীনে বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে তার নামে। এবং তাদের ইনকাম, এত টাকার মূল উৎস সেগুলোই। যা এতদিন সে পরিচালনা করলেও এবার থেকে পরিচালনা করবে জায়ান। বাবাকে ছেড়ে আবার ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে জায়ানের না থাকলেও যেতে হচ্ছে। তার পড়াশোনা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি তার উপর আবার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। সব দিক তো এখন তাকেই সামলাতে হবে।

সকাল সকাল জায়ান, তৃষাম, আর পূর্বাশা একদম তৈরী হয়ে পৌছে গেল এয়ারপোর্টে। তাদের এগিয়ে দিতে দুই বাড়ির অনেকেই এসেছে। তবে একটা মানুষ বেশি এসেছে বোধহয়। আগের বার পূর্বাশাকে এগিয়ে দিতে আসতে নক্ষত্রকে দেখা যায়নি তবে এবার সেও এসেছে। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পূর্বাশা পা বাড়ালো এয়ারপোর্টের দিকে ঠিক তখনই তাকে পিছু ডাকলো নক্ষত্র, বলল – পূর্বা!

পূর্বাশা থমকে দাঁড়ালো। ঘুরে তাকালো পিছনের দিকে। নক্ষত্র এগিয়ে গেল তার দিকে, বলল – সাবধানে যেও।

আরও কিছু হয়তো ছেলেটা বলতে চাইছিলো তাকে তবে জায়নের উৎপাতে আর বলা হলো না। ছেলেটা হিংসায় যেন জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। ব্যস্ত পায়ে সে পূর্বাশা আর নক্ষত্রের মধ্য বরাবর থেকে একবার ওদিকে যাচ্ছে তো একবার এদিকে আসছে। নক্ষত্র কি বিরক্ত হবে পূর্বাশা নিজেই বিরক্ত হলো জায়ানের এমন কান্ডে। নাক মুখ কুঁচকে শুধালো – সমস্যা কি আপনার? এভাবে চর্কির মতো ঘুরছেন কেন?

জায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। সে একবার নক্ষত্রের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ আবার তাকালো পূর্বাশার পানে। অতঃপর তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল – ও তোমার সাথে কথা বললে আমার সহ্য হয় না।

নক্ষত্র হাসলো। সে হয়তো বুঝলো কিছু একটা। আর কথা বাড়ালো না। শুধু এই টুকু বলল – ভালো থাকিস।

কথাটুকু বলেই আবার ফিরে এলো সে আগের স্থানে। আর পূর্বাশাকে নিয়ে জায়ান প্রস্থান করলো তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাড়ির লোকজন এক এক করে সকলে ফিরে যেতে শুরু করলো তবে ফিরে গেল না নক্ষত্র। এয়ারপোর্টের বাইরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সে। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বিমান মাথার উপর থেকে উড়ে যেতে দেখে সেদিকে তাকালো ছেলেটা। এই বিমানেই হয়তো উড়াল দিয়েছে পূর্বাশা। আবার নাও দিতে পারে, তবে নক্ষত্রের কেন যেন মনে হচ্ছে এই বিমানেই রয়েছে পূর্বাশা। আকাশের দিকে মুখ করে বিমানটা যতক্ষন না দৃষ্টি সীমার বাইরে গেল ঠিক ততক্ষন সেদিকে চেয়ে রইলো নক্ষত্র। বিমানটা চোখের সামনে থেকে উধাও হতেই দৃষ্টি নত করলো ছেলেটা। মাটির দিকে মুখ করে বলল – আমার করা অন্যায়ের শাস্তি বোধহয় তোকে আর ফিরে না পাওয়া পূর্বা।

এইটুকু বলে মলিন হাসলো নক্ষত্র আবার বলল – সৃষ্টিকর্তা বোধহয় আমাকে এত বড় শাস্তি না দিলেও পারতো। একটা বার তোকে যদি আমার করে দিতো তবে কি খুব বেশি অন্যায় হয়ে যেতো? আমি না হয় অন্যায় করেছি সেই অন্যায়ের শাস্তি না হয় তোকে আমার কাছে রেখে অন্যভাবে দিতো। তোকে কেড়ে নিয়ে কেন সে অন্যায়ের শাস্তি আমাকে দিল? আমি কিভাবে বাঁচবো তোকে ছাড়া? এতদিন না হয় তবুও একটা আশায় বেঁচে ছিলাম। ভেবেছিলাম তুই ফিরবি, তোর কছে ক্ষমা চাইবো একটা সুযোগ চাইবো। তুই হয়তো সুযোগটা দিবি। কিন্তু আজ তো সে আশাও নিঃশেষ হলো। এবার আমি কোন আশায় বাঁচবো রে পূর্বা।

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here