স্নিগ্ধ_প্রিয়া #সাদিয়া_শওকত_বাবলি #পর্ব_৪৮

0
434

#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তৃষামের এই অবস্থা দেখে বড্ড হাসি পেল জায়ানের। তবে সে হাসলো না। এই অবস্থায় নিশ্চই হাসাটা দৃষ্টিকটু। অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে জায়ান বলল – বের করতে পারি তবে আমার শর্ত আছে একটা।

তৃষাম জেল থেকে বের হতে মরিয়া হয়ে উঠলো। অস্থির কন্ঠে শুধালো – ভাই আমি তোর সব শর্ত মানতে রাজি তুই দয়া করে আমাকে এখান থেকে বের কর।

জায়ান দেরী করলো না। পকেট থেকে চট করে একটা কাগজ আর কলম বের করে এগিয়ে দিল তৃষামের পানে অতঃপর বলল – নে এই কাগজে সই করে দে।

তৃষাম ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বলল – এটা কিসের কাগজ?

জায়ান ভাবলেশহীন নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল – এখানে লেখা আছে যে আজ থেকে তুই আমার সব কথা মেনে চলবি। এখন চট করে সইটা করে দে তো।

তৃষাম চোখ বড় বড় করে তাকালো জায়ানের পানে। বন্ধু হয়ে বন্ধুকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে এর জন্য সব কথা শুনতে হবে কেন? তৃষাম নাকোচ করে দিল জায়ানের কথা। থমথমে কন্ঠে বলল – আমি কোনো সই করবো না।

জায়ান শীতল দৃষ্টিতে তাকালো তৃষামের পানে। খান। ঠান্ডা কন্ঠে বলল – ঠিক আছে তাহলে আমিও তোকে বাইরে বের করবো না। থাক তুই এখানে।

তৃষাম কাঁদো কাঁদো হলো। জায়ান এই সময়ে এসে তার সাথে এমন একটা চাল খাটাতে পারলো? এখন বিপদে পড়েছে দেখে নয়তো এ ব্যাটাকে সে নির্ঘাত একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়তো। সাথে সাথে তৃষামের উপর হো হো করে হো হো করে হেসে উঠলো তার মস্তিষ্ক। সে জীবনে কি জায়ানকে কোনো শিক্ষা দিতে পেরেছে? উহু পারেনি, আরও উল্টো জায়ানের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে এসেছে। জায়ান পিছন ঘুরলো, চলে যেতে উদ্যত হলো সে পুলিশ স্টেশন থেকে। আঁতকে উঠলো তৃষাম। এখন যদি জায়ান এই ভাবে চলে যায় তাহলে তাকে আর এই জে’লে’র চার দেয়াল থেকে বের হতে হবে না। হন্তদন্ত হলো ছেলেটা, তাড়াহুড়ো করে জায়ানকে ডেকে বলল – আমাকে ফেলে যাস না ভাই। তুই যেখানে বলবি আমি সই করে দিচ্ছি এক্ষুনি। তবুও তুই আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যা।

জায়ান বিস্তর হাসলো। সে জানতো এত রাতে তৃষাম যেহেতু পুলিশ স্টেশন থেকে কল করেছে তার মানে বেচারা আ’কা’ম ঘটিয়েছে কোনো। আর এই সুযোগেই নিজের কাজটা হাসিল করবে জায়ান। তাই তো একবারে কাগজ কলম সাথে নিয়ে চলে এসেছে
এত রাতে দোকান বন্ধ থাকায় স্টাম্প পেপার আনতে পারেনি নয়তো এই কাগজের স্থানে স্টাম্প পেপারই আনতো সে। জায়ান কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল তৃষামের পানে। বাঁকা হেসে বলল – নে এখানে সই কর।

তৃষাম চুপচাপ হাতে নিল কাগজ কলম। অতঃপর থমথমে মুখে সই করে দিল কাগজটায়।

সই করার পরে জায়ান কাগজটা আনলো তৃষামের কাছ থেকে। বিচক্ষণ দৃষ্টিতে একবার চোখ বুলালো সেটায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করলো পর পরই। কাউকে কল করার নাম করে তৃষামের অগোচরে বাথরোব পড়া এবং জে’লে থাকা অবস্থায় ছেলেটার ছবি তুলে নিল গোটা কয়েক। অতঃপর সত্যি সত্যিই জায়ান কল লাগালো কাউকে। দারোগার সাথে বেশ অনেক্ষণ কথা বলে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি ঘটালো সে। একটু পরেই ছেড়ে দিল তারা তৃষামকে।

_____________________________________

সময় গড়িয়েছে। দিনের উজ্জ্বল সূর্যটা ডুবে জানান দিচ্ছে রাতের আঁধারের। পুরো শহরটাও ভরে উঠেছে কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে। তৃষাম আজ বসে আছে তার হোস্টেল কক্ষেই। আর তার পাশে হকস্টিক নিয়ে বসে রয়েছে জায়ান। গতকালের ফেলে রাখা আজ করাবে সে ছেলেটাকে দিয়ে। যদিও আজ আর তৃষাম গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ পায়নি, গা ঢাকা দেওয়ার অবশ্য চেষ্টাও করেনি। কাল একটু শান্তির জন্য গা ঢাকা দিতে গিয়ে যে বিপদে পড়লো ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে আসছে তৃষামের এখনও এখনও। তৃষামের ভাবনার মধ্যেই তাকে তাড়া দিল জায়ান। হকস্টিকটাতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল – পূর্বাশার আম্মুকে কল দে দ্রুত। নয়তো প্রথমে এই হকস্টিক দিয়ে পেটাবো তারপরে কল তোর সই করা কাগজ নিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাব আমি আবার। যে তুই আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখিসনি।

তৃষাম চুপসে গেল। নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো পাখি বেগমকে। একটু সময় রিং হতেই কল ধরলেন পাখি বেগম। তৃষাম একবার তাকালো জায়ানের পানে অতঃপর ঢোক গিলে বলল – আসসালামুয়ালাইকুম ফুপি। কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কেমন আছিস তৃষাম? চীনে যাওয়ার পর তো জায়ান আর তোর কোনো খোঁজ খবরই নেই। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি আমাদের?

তৃষাম মেকি হাসলো নম্র কন্ঠে বলল – না ফুপি। আসলে দেশ থেকে এসে বিভিন্ন কাজে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই আর কি।

– ওহ। জায়ান আর তুই কেমন আছিস?

– এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি আমরা। কিন্তু তোমার সাথে আমার জরুরী একটা কথা ছিল।

তৃষামের মুখে জরুরী কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালেন পাখি বেগম অতঃপর বললেন – কি কথা?

আমতা আমতা শুরু করলো তৃষাম। একটু সময় নিয়ে বলল – আচ্ছা আমাদের পূর্বাশার সাথে জায়ানের বিয়ে দিলে কেমন হয়?

পাখি বেগম অবাক হলেন। তৃষাম হঠাৎ এসব কি বলছে? মাথা টাথা গেছে নাকি ছেলেটার? কোথায় জায়ান আর কোথায় পূর্বাশা। তাছাড়া পূর্বাশা তার প্রথম সন্তান তাকে কিনা অত দূরে চীন দেশীয় কারো হাতে তুলে দিবে? এমনিই মেয়েটা কোনো কারনবশত তার থেকে দূরে চলে গেছে এখন যদি আবার ঐ চীন দেশীয় কারো কাছে বিয়ে দেয় তবে তো মেয়ের আর দেখাই পাবে না। পাখি বেগম সমর্থন জানালেন না তৃষামের কথার। কিছুটা তীক্ষ্ম কন্ঠে বললেন – মাথা খারাপ হয়েছে তোর তৃষাম? পূর্বাশা আমার প্রথম সন্তান ওকে আমি অত দূরে বিয়ে দেব না। পরে দেখা যাবে মাস অন্তর বছর অন্তরও আমি মেয়েটার একটা বার দেখা পাবো না।

তৃষাম আড় চোখে তাকালো জায়ানের পানে। ছেলেটার ফর্সা মুখশ্রী ধীরে ধীরে রক্তিম বর্ণ ধারন করছে। ফাঁকা ঢোক গিললো তৃষাম। আমতা আমতা করে বলল – তুমি শুধু নিজের মেয়ের কথাই ভাবছো নিজের ভাইয়ের কথা ভাবছো না?

– মানে?

– মেঝ চাচার এত বছরের অবস্থা তোমারা তো দেখেছোই। লোকটা কতটা কষ্ট পেয়েছে তা না তোমাদের অজানা আর না আমার। এতকাল পর অবশেষে লোকটা একটু সুখের মুখ দেখেছে, নিজের পরিবারকে ফিরে পেয়েছে। তবুও কিন্তু এখানে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। মেঝ কাকা সুস্থ নয় মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষ আর মিসেস শীও সুন্দরী শিক্ষিত এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমতী একজন নারী। এখন না হয় আবেগের বশে সে মেনে নিয়েছে সবটা কিন্তু পরে যদি উনি কাকাকে ফেলে রেখে চলে যায় কিংবা মেঝ চাচাকে সাথে নিয়ে চীনে চলে আসে তখন উনি যদি কখনও তাকে ছেড়ে আবার চীনে ফিরে আসে তখন কি হবে? জীবনে আর ভাইয়ের দেখাও পাবে না। আর সেখানে যদি জয়ানের পূর্বাশার বিয়ে দিয়ে তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কটা আর একটু পাকা পোক্ত করো মেয়ের বদৌলতেও তোমার ভাইটা ভালো থাকবে। মিসেস শীও চলে গেলেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আবার হতে পারে এই আত্মীয়তার সম্পর্কের জের ধরে তোমরা অনুরোধ করলে আর ওরাও বাংলাদেশেই থেকে গেল।

ভাইয়ের কথা শুনে কিছুটা গলে গেল পাখি বেগম। তৃষাম তো ভুল কিছু বলেনি। এত বছর তার ভাই কতটা কষ্ট সহ্য করেছে তা তিনি নিজের চোখেই দেখেছে। এখন আবার যদি মিসেস শীও তার ভাইকে ফেলে রেখে চলে যায় তবে তার ভাইটা যে ম’রে যাবে। কিন্তু জায়ান? সে কি রাজি হবে? ছেলেটা সুদর্শন বেশ আর তার মেয়ে কৃষ্ণবর্না। পাখি বেগম ইতস্তত করলেন। কন্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বললেন – কিন্তু জায়ান! সে কি আমার মেয়েকে পছন্দ করবে?

তৃষাম হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। পাখি বেগমের এই টুকু কথাতেই সে বুঝে ফেলেছে জায়ানের সাথে পূর্বাশার বিয়ে নিয়ে তার মত রয়েছে। তৃষাম ঠোঁট এলিয়ে হাসলো এবার অতঃপর বলল – আলবাত পছন্দ করবে। পূর্বাশা আর জায়ান ইতমধ্যে দুজন দুজনকে পছন্দ করে।

পাখি বেগম চমকালেন। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল তার। অবাক কন্ঠেই সে শুধালো – ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে?

তৃষাম অপ্রস্তুত হলো। ইতস্তত করে বলল – ঐ মানে আর কি। হয়তো করে, ওদের মধ্যকার সম্পর্ক খুব ভালো তো তাই বললাম।

পাখি বেগম একটু সময় নিলেন। কিছু একটা ভেবে বললেন – দেখ আমি মা তাই বলে মেয়ের বিয়ের সব সিদ্ধান্ত তো শুধুমাত্র আমার একার উপর নয়। দেখি ওল বাবা আসুক তার সাথে কথা বলি। তারপরে তোর বাবা মা আছে, পূর্বাশার চাচারা আছেন সবার সাথে কথা বলি তারপর সিদ্ধান্ত নেব।

– আচ্ছা। এখন তাহলে রাখছি।

– ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।

এই টুকু বলতেই কল কাটলো তৃষাম। হাসি হাসি মুখ করে তাকালো তৃষামের পানে। সাথে সাথেই মুখটা যেন চুপসে গেল ছেলেটার। জায়ানের মুখশ্রী এখনও রক্তিম। এখনও রেগে আছে কেন ছেলেটা? সে কি ভুল করেছে কোনো। ঢোক গিললো তৃষাম অতঃপর শুধালো – কি হয়েছে আবার? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

জায়ান থমথমে কন্ঠে জবাব দিল – তুই শেষে বললি না কেন “তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিবেন। আর উত্তরটা যেন অবশ্যই হ্যা হয়।”

তৃষাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে এক প্রকার ঘটকালি করেছে জায়ান আর পূর্বাশার। এখন ঘটক কি এভাবে হুমকি মূলক কথা বলে বিয়ে পাকা করে? তাও আবার নিজের ফুপির সাথে। আশ্চর্য! বিয়ের চিন্তায় চিন্তায় কি এই ছেলের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটলো নাকি?

_______________________________________

প্রবাহমান সময় বয়ে চলছে নিজের গতিতে। চীনের ঋতুচক্রে শীতের স্থান পরিবর্তিত হয়ে স্থান করে নিয়েছে বসন্তের। রাস্তার আশেপাশের বৃক্ষগুলো ভরে উঠেছে সুন্দর চেরি ফুলের ছোঁয়ায়। এ যেন চীনের নতুন এক রূপ, কেমন মনমুগ্ধকর স্নিগ্ধ এ রূপ। খুব বেশি অপ্রেমিকরাও বোধহয় এই সময়ে এই স্থানের রূপ দেখে প্রেমে না পড়ে থাকতে পারবে না। রাস্তার দুই পাশে নরম স্নিগ্ধ চেরি ফুলের পাপড়িগুলো সর্বদা কেমন বিছিয়ে থাকে, শান্তিময় এক সুন্দর এ পরিবেশ। যদিও বাংলাদেশের বসন্তকালও সুন্দর তবে সেখানে এমন চেরি ফুলের আগমন দেখা যায় না। ইস বাংলাদেশের বসন্তেও যদি চেরি ফুলের সৌন্দর্য যোগ হতো তবে কতই না ভালো হতো। চেরি ফুলের এমন সৌন্দর্যময় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে করতেই এয়ারপোর্টের দিকে সাঁই সাঁই করে ট্যাক্সিতে এগিয়ে যাচ্ছে পূর্বাশা, জায়ান, তৃষাম আর চ্যাং। এবার তাদের বাংলাদেশ ভ্রমনে নতুনভাবে যোগ দিয়েছে চ্যাং ও। হাজার হোক বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। জায়ান আর পূর্বাশার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এত মাস অপেক্ষার পর বেশ কাঠখড় পুড়িয়েই বিয়েটা হচ্ছে তাদের। আর এই কাঠখড় পোড়ানোর মধ্যে এক শুকনো বস্তুর মতো পুড়েছে বেচারা তৃষাম। পিছন থেকে বিয়ের কলকাঠি সব জায়ান নাড়লেও সামনে ফেলেছে তৃষামকে। সবার লাঠি, ঝাটা, গা’লি, সবই মুখ বুঝে হজম করতে হয়েছে বলির শ্রেষ্ঠ পা’ঠা তৃষামকে।

চলবে…….

ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here