#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
চীনের উজ্জ্বল আকাশ। সূর্যটা বেশ দারুনভাবে জ্বলছে আজ। এতে অবশ্য শীত কমেনি একটুও। শীত সে শীতের মতোই প্রকোপ আকার ধারন করেছে। বাংলাদেশে মোটা শীত পোশাক গুলোর ব্যবহার না করলেও চীনের এয়ার পোর্টে নেমেই সেগুলোর প্রয়োজন পড়লো জায়ান, পূর্বাশা আর তৃষামের। খুব সুন্দরভাবে সেগুলো শরীরে জড়িয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো তিনজন। কিন্তু কলেজের সম্মুখে আসতে আলাদা হয়ে গেল তিনজন। জায়ান তার ফ্ল্যাটে চলে গেল। পূর্বাশা তার হোস্টেলে আর তৃষাম তার হোস্টেলে।
___________________________________
সময় গড়ালো। দিনের সূর্যটা ডুবে গিয়ে রাতের দেখা মিলেছে। ব্যস্ত শহরটা ভরে উঠেছে কৃত্রিম আলোয়। সেই দুপুরের আগে চীনের মাটিতে পা রেখেছে পূর্বাশারা। কিন্তু এখন অব্দি জায়ানের খবর নেই কোনো। একের পর এক কল করে যাচ্ছে অথচ তার রিসিভ করার কোনো নাম গন্ধ নেই। সেদিন একটু কি না কি জড়িয়ে ধরেছিল তাতেই বোধহয় সাপের পাঁচ পা দেখে দেখেছে ছেলেটা। ছেলেদের এই একটা প্রচন্ড বাজে অভ্যাস পটানোর সময় কত শত মিষ্টি কথা, সারাক্ষণ তার পিছনে পড়ে থাকা, কল দেওয়ার আগে ধরা আর একবার পটে গেলে ব্যস আর খোঁজই পাওয়া যায় না। আর সেখানে পূর্বাশা তো এখনও নিজের মনের কথা জানায়নি জায়ানকে। তার ভালোবাসাও গ্রহন করেনি তার মধ্যেই অবহেলা শুরু করেছে? ক্রোধে ফুঁসে উঠলো মেয়েটা। যদিও এরপর সে আর না কল করতো আর না কিছু বলতো। একদম একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়তো। এখন শুধুমাত্র একটা প্রয়োজন আছে বলে জায়ানকে চাই। ছেলেটার ব্যাগের মধ্যে তার মহা মূল্যবান সম্পদ আমের আচার রয়েছে। আসার সময় নিজের ব্যাগে জায়গা না হওয়ায় তৃষামের ব্যাগে আচাড়টা দিয়েছিল কিন্তু জায়ান হিংসার দাপটে সেখান থেকে আচার নিয়ে নিজের ব্যাগে রেখেছে। আর এখন কলই ধরছে না। পূর্বাশা ক্রোধে গজগজ করতে করতে হোস্টেল থেকে বেরুলো। এখন সে জায়ানের ফ্ল্যাটে যাবে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অল্প সময়ের মধ্যেই জায়ানের ফ্ল্যাটের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো পূর্বাশা। হাত বাড়িয়ে কলিং বেল টিপলো। এক বার, দুই বার, তিন বার না কেউ দরজা খুললো না। ক্রোধ সরে গিয়ে এবার ভয় হতে শুরু করলো পূর্বাশার। কল করলো তা ধরলো না জায়ান, এখন কলিং বেল টিপছে তাও দরজা খুলছে না। এমন করার ছেলে তো জায়ান নয়।ছেলেটা ঠিক আছে তো? নাকি কোনো বিপদ আপদ ঘটেছে? ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো পূর্বাশার। অস্থির হলো মেয়েটার চিত্ত। কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথে এবার জোরে জোরে করাঘাত করতে শুরু করলো ফ্ল্যাটের দরজায়। গলা উঁচিয়ে বলল – দরজা খুলুন জায়ান ভাই, দরজা খুলুন।
ক্ষানিক পরই দরজাটা খুলে গেল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাকালো পূর্বাশা। চমকে উঠলো সে। জায়ান দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সম্মুখেই, ফর্সা ঘুমঘুম মুখশ্রীর উপরে উসকো খুসকো হয়ে লেপ্টে রয়েছে কালো চুল। শরীরে জড়ানো ধূসর রঙা এক খানা টিশার্ট আর পড়নে টু কোয়ার্টার প্যান্টের অস্তিত্ব। ফর্সা কালো লোম যুক্ত পা জোড়া বেরিয়ে রয়েছে বাইরেই। হৃদ যন্ত্রটা যেন লাফিয়ে উঠলো পূর্বাশার। অদ্ভুত এক শিহরণে আবিষ্ট হলো মেয়েটা। নিমেষেই একটু আগের ক্রোধ, ভয় দুটোই যেন ভুলে বসলো সে। ছেলেটা এত সুদর্শন কেন? এত সুদর্শন হতে কে বলেছে তাকে? ঢোক গিললো পূর্বাশা। আমতা আমতা করে বলল – আমার আমের আচার নিতে এসেছিলাম।
জায়ান দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো, বলল – ভিতরে এসো।
পূর্বাশা ভিতরে গেল না। এদিক ওদিক এলো মেলো দৃষ্টি ফেলে বলল – না ভিতরে যাব না আমি। আমাকে আমার আমের আচার দিয়ে দিন আমি চলে যাব।
জায়ান ভ্রু কুঁচকালো। তাকিয়ে দেখলো অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্বাশাকে। হয়তো বুঝলো সে কিছু। এমনিতেও পূর্বাশাকে তার থেকে অধিক কেউ বোঝে না। মেয়েটার মুখ দেখেই সে মনের খবর বলে দিতে পারে। পূর্বাশার মুখ পানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো জায়ান অতঃপর আবার বলল – ভিতরে এসো।
কথাটুকু বলে আর পূর্বাশাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সময় ব্যয় না করে চলে গেল ভিতরে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলেও জায়ান যখন আচাড় নিয়ে ফিরলো না তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই ভিতরে গেল পূর্বাশা। দেখলো জায়ান পায়ের উপর পা তুলে আয়েশী ভঙ্গিতে টিভি দেখছে। মেজাজ চটে গেল মেয়েটার। তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে এ কিনা এখানে বসে টিভি দেখছে? পূর্বাশা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো জায়ানের পাশে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনি এখানে বসে বসে টিভি দেখছেন?
জায়ান টিভির দিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিল – তোমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে কে? তোমাকে তো আমি ভিতরে আসতে বলে তবেই এলাম।
দাঁতে দাঁত চাপলো পূর্বাশা, বলল – আমার আচাড় দিন আমি চলে যাই।
জায়ান উত্তর দিল না কোনো। সোফা থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা আটকালো অতঃপর একটা চিরুনি নিয়ে এসে বসে পড়লো সোফার পাশে মেঝেতে। চিরুনিটা পূর্বাশার পানে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – মাথায় চিরুনি করে দাও তো।
পূর্বাশা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো জায়ানের পানে। মুখ বাঁকিয়ে বলল – আমি আপনার চুলে চিরুনি করতে আসিনি এখানে, এসেছি আচাড় নিতে। আচাড় দিন চলে যাই।
– চুল এলোমেলো করে আমি আচাড় দিতে পারবো না। আগে চুল ঠিক করে দাও তারপর তোমার আচাড় পাবে।
পূর্বাশা আশ্চর্য হলো। অবাক সুরে বলল – আচাড়ের সাথে চুলের কি সম্পর্ক?
– কে জানে! তোমাকে যা বলেছি তুমি তাই করো নয়তো তোমার আচাড় আজ আর পাচ্ছো না তুমি।
পূর্বাশা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জায়ানের পানে তবে বলল না কিছুই। কি বলবে সে? পূর্বাশা বেশ ভালোভাবেই জানে যে জায়ান যখন বলেছে তার চুল ঠিক করে না দিলে আচাড় দিবে না তার মানে দিবে না। এই ছেলের ঘাড়ের দুই চারটা রগ যে বিধ্বংসী আকারে বাঁকা তা এতদিনে আর বুঝতে বাকি নেই পূর্বাশার। মনের ক্রোধ মনে চেপে রেখেই জায়ানের হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বসলো সে সোফায়। আলতো হাতে চিরুনি করে দিতে লাগলো ছেলেটার চুলের ভাঁজে। প্রেয়সীর স্পর্শে যেন শিহরণ খেলে গেল জায়ানের সর্বাঙ্গে। হৃদয়ে চলতে থাকা অস্থিরতার ভাবটা যেন নিমেষেই উধাও হলো। শান্তিতে ভরে উঠলো হৃদয় কুঠুরি। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করলো ছেলেটা। পূর্বাশা চুলে চিরুনি করতে করতে হঠাৎ করেই জায়ানের শান্তির ১২ টা বাজিয়ে এক গোছা চুল টেনে ধরলো এক হাতে। হকচকিয়ে উঠলো জায়ান। কন্ঠে “আহ” করে ব্যথাতুর ধ্বনি তুলে বলল – কি করছো কি? চুল টানছো কেন আমার?
পূর্বাশা দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে বলল – কতবার কল করেছি, কল রিসিভ করেননি কেন?
জায়ান উল্টো হয়ে ঘাড় কাত করে তাকালো পূর্বাশার পানে অতঃপর বলল – ঘুমে ছিলাম আমি টের পাইনি তুমি কল করেছো।
– এত ঘুম কেন আপনার যে এতবার কল করলেও ধরতে পারেন না।
– এত ঘুম কোথায়? এতদিন বাড়িতে বাবার কাছে ছিলাম রাতে ঠিকমতো ঘুমাইনি একদিনও। তাই এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধহয়।
এই টুকু বলে থামলো জায়ান। পূর্বাশার পানে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে বলল – তুমি আমাকে একবার বিয়ে করেই ফেলো না কৃষ্ণময়ী বিশ্বাস করো সারারাতে আমি একটুও ঘুমাবো না আর না তোমাকে একটুও ঘুমাতে দেব।
পূর্বাশার একটু সময় লাগলো কথাটা বুঝতে। তবে কথাটা মস্তিষ্কে হানা দেওয়ার সাথে সাথে কান গরম হয়ে উঠলো মেয়েটার। কি নির্লজ্জ কথাবার্তা? লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠলো পূর্বাশা। জায়ানের চুল ছেড়ে দিয়ে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে শুরু করলো এদিক ওদিক। জায়ান লক্ষ্য করলো তা। এবার সে সম্পূর্ণরূপে ঘুরে বসলো পূর্বাশার দিকে ফিরে। মৃদু কন্ঠে শুধালো – আমাকে বিয়ে করছো কবে?
পূর্বাশা অপ্রস্তুত হলো আরও। আমতা আমতা করে বলল – করবো না আমি আপনাকে বিয়ে।
– কেন?
– জানি না।
জায়ান হয়তো বলতে চাইলো আরও কিছু কিন্তু তার আগেই ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা বেজে উঠলো। ছেলেটা আর কথা না বাড়িয়ে উঠে গেল। দরজা খুলে দেখতে পেল ভেলিভারি ম্যান এসেছে খাবার নিয়ে। বিশাল একটা খাবারের প্যাকেট, জায়ান খাবারের প্যাকেট টা নিজের হাতে নিল, ভিতরে এসে দুটো প্লেট এনে খাবারগুলো নিয়ে বসলো আবার মেঝেতে। পূর্বাশারও হাত টেনে নামিয়ে বসালো মেঝের উপরে অতঃপর প্যাকেট থেকে একের পর এক খাবার বের করে পূর্বাশার পানে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল – খাওয়া শুরু করলো।
পূর্বাশা বড় বড় চোখ করে তাকালো খাবারগুলোর দিকে। অবাক কন্ঠেই বলল – এত খাবার কে খাবে?
– কেন তুমি আর আমি।
– এত খাবার? আর তাছাড়া আমি খেয়ে এসেছি এখন খাব না। আপনি আমার আচাড় দিন আমি চলে যাই।
– যাবে তো খেয়ে যাও। তোমার জন্যই আমি এত খাবার অর্ডার করিয়েছি। এখন তুমি না খেলে কতগুলো খাবারের অপচয় ঘটবে বুঝতে পারছো? প্রতিদিন বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে অনাহারে কাটায় আর তুমি কিনা খাবার সম্মুখে পেয়েও অপচয় করবে?
পূর্বাশা আর দ্বিরুক্তি করলো না। নিশ্চই খাবার অপচয় করাটা ঠিক হবে না তার। তাই আর কোনো কথা না ভেবে খাওয়া শুরু করলো সে। একটু তাড়াহুড়ো করেই খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো পূর্বাশা অতঃপর বলল – আমার আচাড়টা দিন তাড়াতাড়ি আমাকে এখন হোস্টেলে ফিরতে হবে নয়তো কতৃপক্ষ হোস্টেল বন্ধ করে দিবে।
জায়ান ভাবলেশহীন, নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল – তোমার হোস্টেল ইতমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
পূর্বাশা চমকালো, দ্রুত মোবাইল বের করে সময় দেখলো। চোখ যেন কপালে উঠলো তার। ১১ টার বেশি বেজে গেছে। এই জায়ানের কথায় কথায় এতক্ষন সময়ের দিকে খেয়ালই ছিল না মেয়েটার। এখন কি করবে সে? কোথায় যাবে? হোস্টেলে গেলে, হোস্টেল কতৃপক্ষ জীবনেও এখন ঢুকতে দিবে না তাকে। পূর্বাশা চিন্তিত হলো। অস্থির কন্ঠে বলল – এখন কি হবে? আমি কোথায় থাকবো আজ রাতে?
জায়ান তাকালো পূর্বাশার অস্থিরতায় ছায়া মুখ পানে। শীতল হলো তার দৃষ্টি, ঠান্ডা কন্ঠেই বলল – কেন আমার ফ্ল্যাটে আমার সাথে থাকবে।
চকিত হলো পূর্বাশা। চড়ম বিস্ময় নিয়ে তাকালো সে জায়ানের পানে। কি বলল ছেলেটা? সে আজ তার ফ্ল্যাটে থাকবে তার সাথে তাও বিয়ে ব্যতীত? এই ছেলের মাথায় কি ঘুরছে? নির্ঘাত এত কথার জালে পেঁচিয়ে ইচ্ছে করে জায়ান তাকে দেরী করিয়েছে। ফুঁসে উঠলো পূর্বাশা, দাঁতে দাঁত চেপে বলল – আপনি ইচ্ছে করে আমার দেরী করিয়েছেন তাই না?
জায়ান খেতে খেতেই ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিল – অনেকটা।
পূর্বাশা চটে গেল আরও। তাতানো কন্ঠে বলল – আপনি একটা বদ বাজে পুরুষ মানুষ। আমি দরকার হলে রাস্তায় থাকবো আজকে রাতে তবুও তো আপনার ফ্ল্যাটে আপনার সাথে থাকবো না।
জায়ান কোনো ভনিতা ছাড়াই জবাব দিল – দরজা ওই দিকে।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link