#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪৫
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পূর্বাশার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো আরও। কপালে ভাঁজ ফেলে সে ফের প্রশ্ন করলো – এই জন্যই আপনি আমাকে বিভিন্ন তাল বাহানায় হোস্টেলে না যেতে দিয়ে এখানে রেখে দিয়েছেন তাই না?
– হুম।
জায়ানের সর্বদার মতো গা ছাড়া জবাব। তবে প্রতিবার ছেলেটার এমন গা ছাড়া ভাবের পূর্বাশা রেগে গেলেও এবার ভেংচি কাটলো সে। মুখ বাঁকিয়ে বলল – তা আগে বললেই হতো। এত কায়দা করে রাখার কি ছিল?
– তোমাকে আগে বলে একশত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তেল দিয়ে রাখার চেয়ে এমন কায়দা করে রাখাটা আমার কাছে অধিক সহজ মনে হয়েছে তাই।
পূর্বাশা একবার বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো জায়ানের পানে। তবে বলল না কিছুই। কথায় কথা বাড়ে। এমন একটা সুন্দর মুহুর্ত সে কিছুতেই এই লোকের সাথে ঝগড়া করে নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয়। পূর্বাশা হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ কোনাগুলো। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বরফের স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জায়ানের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো, মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো পূর্বাশার হাসি খুশি মুখটার পানে। চীনে আসার পর মেয়েটাকে এত খুশি সে কখনও হতে দেখেনি আগে। আজ প্রথমবারের মতো মেয়েটার ওষ্ঠে উপচে পড়া হাসির আবিষ্কার করতে পেরেছে জায়ান। জায়ানের ভীষন হিংসা হলো তুষার গুলোকে। তার প্রেয়সি তাকে দেখে তো কখনও এত আনন্দিত হয় না যতটা এই তুষার পাত দেখে হচ্ছে। আবার এই তুষার গুলো কেমন আলতোভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে পূর্বাশাকে। সে থাকতে কেন অন্য কিছু ছুঁয়ে দিবে তার প্রিয়তমাকে? হৃদয়ে হিংসার আবির্ভাব ঘটলেও শুধুমাত্র পূর্বাশার খুশির জন্য তা সে দমন কররো। আরও কিছুটা সময় নিয়ে জায়ান দেখলো পূর্বাশাকে। যখন দেখলো মেয়েটা ছোটাছুটি করতে করতে তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তখন সেও ছুট লাগালো পূর্বাশার পিছনে। গলা উঁচিয়ে বলল – এই পেঙ্গুইন দাঁড়াও।
পূর্বাশা থমকে দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে পেঙ্গুইন খোঁজার চেষ্টা করলো। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো বরফের মধ্যে পেঙ্গুইনের আবির্ভাব ঘটেছে কিন্তু যখনই তার মস্তিষ্কে হানা দিল পেঙ্গুইনটা তাকে বলা হয়েছে তখনই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো সে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – পেঙ্গুইন কে?
জায়ান হাসলো। এক ভ্রু নাচিয়ে জবাব দিল – কেন তুমি, আমার ছোট খাটো একটা পেঙ্গুইন।
পূর্বাশা যেন তেতে উঠলো আরও। আশেপাশে কিছু খুঁজলো ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে। কিন্তু তেমন কিছু না পেয়ে কতগুলো বরফ তুলে নিল হাতের মধ্যে। দুই হাতের সাহায্যে বরফ কনাগুলো গোলাকৃতির রূপ দিয়ে ছুঁড়ে মারলো জায়ানের পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল – আমি পেঙ্গুইন হলে আপনি তো সাদা ভাল্লুক।
– আসো তাহলে তোমাকে একটু কামড়ে দেই।
কথাটা বলেই জায়ান ধাওয়া করলো পূর্বাশাকে। পূর্বাশাকেও আর পায় কে? জায়ানের থেকে নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সেও ছুট লাগালো তার সম্মুখের দিকে। তবে একটু দৌড়েই বাঁধলো বিপত্তি। লম্বা শীত পোশাক, তার মধ্যে আবার বরফ এর মধ্যে কি আর জোরে দৌড়ানো যায়? একটু জোরে দৌড়াতে গিয়েই পূর্বাশা উল্টে পড়লো, মুখটা ঢুকে গেল বরফের মধ্যে। হকচকালো জায়ান। ব্যাকুল হলো তার হৃদয়। দৌড়ে গেল সে মেয়েটার কাছে। বরফের মধ্য থেকে টেনে তুললো পূর্বাশাকে। অস্থির কন্ঠে বলল – তুমি ঠিক আছো তো?
পূর্বাশা অপ্রস্তুত হলো। কি এক লজ্জাজনক ব্যাপার। সে বরফের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। এমনি পড়তো তা নয় একদম উল্টে গিয়েছে। ঠোঁট টেনে জোরপূর্বক হাসলো মেয়েটা। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল – আমি ঠিক আছি।
জায়ান চিন্তিত হলো। হাত টেনে বাসার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো পূর্বাশাকে এবং বলল – বাসায় চলো তোমাকে আর বরফে নাচানাচি করতে হবে না।
সাথে সাথেই পূর্বাশা প্রতিবাদ জানালো জায়ানের কথার। ছেলেটার হাতের মুঠো থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে বলল – না আমি এখানেই থাকবো বাসায় পরে যাব।
– এমনিতেই বরফ পড়ার কারনে বাইরে প্রচুর ঠান্ডা। তার উপর উল্টে পাল্টে এখানে ওখানে পড়ে যাচ্ছো। ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। তার থেকে বাসায় ফিরে চলো।
পূর্বাশা কি বুঝলো জানা নেই। সে আর জায়ানের কথার পৃষ্ঠে খুব বেশি প্রতিবাদ জানালো না। শুধু পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে বাড়িয়ে দিল জায়ানের দিকে, বলল – আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিন।
জায়ান পূর্বাশার কয়েকটা ছবি তুলে দিল আবার দু’জনে মিলে বেশ কয়েকটা সেলফিও তুলে নিল বরফের মধ্যে অতঃপর চলে গেল ফ্ল্যাটে।
____________________________________
ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাতের গভীরতা। চারদিকে শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেছে। ক্ষানিক আগে মাঝে মাঝে দুই একটা ট্রাকের শব্দ কর্ণে এলেও এখন তাও আসছে না। পূর্বশা শরীরে কোম্বল জড়িয়ে বসে রয়েছে বিছানায়। যদিও কক্ষে হিটার চালু করা আছে তবুও যেন হাত পা গরম হচ্ছে না মেয়েটার। হয়তো দীর্ঘক্ষণ বরফের মধ্যে থাকার কারনে। তখনই জায়ান দুই হাতে দুই মগ কফি নিয়ে প্রবেশ করলো কক্ষে। একটা মগ পূর্বাশার পানে এগিয়ে দিয়ে বলল – খেয়ে নাও।
পূর্বাশা কফির মগটা হাতে নিল। মগে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে তাকালো জায়ানের পানে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো – এখানে এখনও দাড়িয়ে রয়েছেন কেন? নিজের রুমে যান আপনি।
জায়ান গেল না। উল্টো কফির মগটা হাতে নিয়ে সে ধপ করে বসে পড়লো পূর্বাশার পাশে। কপাল টান টান করে বলল – আমার বাড়ি আমি যেখানে খুশি থাকবো তোমার কি?
পূর্বাশা কফি পান করা বন্ধ করলো। কফির মগটা বিছানার পাশের টেবিলে রেখে বিরস মুখে বলল – মিসেস শীও তো বেশ ভালো এবং ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। তার ছেলে হয়ে আপনার ঘাড়ের রগ এমন বাঁকা কিভাবে হলো বলুন তো জায়ান।
জায়ান কফির মগে চুমুক দিতে দিতে নির্বাকার ভঙ্গিতে বলল – এটা তোমার নানার জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারনে। তোমার নানার ঘাড়ের দুই চারটা রগ বাঁকা ছিল বিধায়ই তো আমাকে আর আমার মাকে ভুগতে হয়েছে এত বছর, সাথে আমার বাবারও এই অবস্থায় উপনিত হতে হয়েছে। উনার ঘাড়ের রগগুলোর কারনেই আমার ঘাড়ের রগ গুলোও বাঁকা, হাজার হলেও তিনি আমার বাপের বাপ অর্থাৎ আমার দাদা।
পূর্বাশা বরাবরের মতো হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। এই লোককে কখনও কোনো কথা বলে জিতে যাওয়া তার কপালে নেই। সর্বদা এ তার কথা দ্বারা যুক্তি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল পূর্বাশা। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল – ঠিক আছে আপনি থাকুন এ রুমে আমিই বরং অন্য রুমে যাচ্ছি।
কথাটা বলেই পূর্বাশা পা বাড়ালো রুমের বাইরের দিকে কিন্তু যেতে পারলো না পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো জায়ান। পূর্বাশা থমকে দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে ভ্রু কুঁচকে তাকালো জায়ানের পানে অতঃপর বলল – সমস্যা কি?
জায়ান দুষ্টু হাসলো। উপরের ঠোঁট দ্বারা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল – আজ ভাবছি তোমার সাথে ঘুমাবো।
শিউরে উঠলো পূর্বাশা। কি বিদঘুটে ছেলেটার ঠোঁট কামড়ানো। ঠিক যেন ছিঃ ছিঃ ভাবতেই শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো পূর্বাশার। দ্রুত হাত ঝাড়া দিয়ে জায়ানের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল – আআআপনি একটা অ’স’ভ্য নি’র্ল’জ্জ পুরুষ মানুষ।
জায়ান উঠে দাঁড়ালো। পূর্বাশার পানে এগিয়ে যেতে যেতে বলল – আমি জানি।
জায়ানকে নিজের দিকে আসতে দেখে পূর্বাশা যেন অপ্রস্তুত হলো আরও। হৃদ যন্ত্রটা কেঁপে উঠছে বারংবার। অজানা ভয়ে, সংকোচে শরীর মনে শিহরণ জাগছে বারবার। জায়ানকে নিজের আরও নিকটে আসতে দেখে ঢোক গিললো পূর্বাশা। এক দৌড়ে চলে গেল রুমের বাইরে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে অন্য রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল দ্রুত। জায়ান হেসে উঠলো। ঘর কাঁপিয়ে হাসলো সে।
______________________________________
বেলা গড়িয়েছে। সকালের সূর্যটা আকাশে দেখা দিয়ে বেশ অনেক সময় আগেই। নিস্তব্ধ শহরটাও তার ব্যস্ততায় ভরে উঠেছে। পূর্বাশা আর জায়ান মাত্রই কলেজে এসেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, একদম খেয়েদেয়ে কলেজে পৌঁছেছে তারা। পূর্বাশা কলেজে পদার্পণ করেই জায়ানের থেকে বিদায় নিয়ে গেল তার হোস্টেলের দিকে। নিজ হোস্টের কন্ঠের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দরজায় আঘাত করতেই সেনজেই এসে দরজাটা খুলে দিল, চোখ মুখে মেয়েটার লাজুক ভাব। পূর্বাশা ভ্রু কুঁচকালো এর আবার কি হয়েছে? হঠাৎ তাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে কেন মেয়েটা? নিজের ভ্রু দ্বয় কুঁচকে রেখেই কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করলো। সুজা আর জেফির পানে তাকিয়ে যেন আরও অবাক হলো পূর্বাশা। তাদের চোখ মুখেও লাজুকতার ছাপ। আবার তিনজন কি কি যেন ফিসফিস করে বলছে, সাথে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। পূর্বাশার অস্বস্তি হলো। এরা তার দিকে তাকিয়ে এমন কেন করছে? তবে কি তার মুখে কিছু লেগে আছে? পূর্বাশা দ্রুত আয়নার কাছে গেল। আয়নার প্রতিবিম্বে নিজের চেহারাকে উল্টে পাল্টে দেখলো, নাহ তেমন কিছুই তো নজরে পড়ছে না। তাহলে এদের এমন অদ্ভুত আচরনের কারন কি? পূর্বাশা এবার গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো সেনজেই, জেফি আর সুজার সম্মুখে। সন্দিহান কন্ঠে শুধালো – কি হয়েছে?
তিনজনই লাজুক হাসলো। তবে তার মধ্য থেকে জেফি উঠে জিজ্ঞেস করলো – রাত কেমন কাটলো? জায়ান ভাই এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল তোমাকে?
এই টুকু বলেই আবার লাজুক হাসলো তিনজন। পূর্বাশা চমকালো, অপ্রস্তুত হলো বেশ। এরা কোন রাতের কথা বলছে এরা? তবে কি এরা জেনে গেছে কাল রাতে পূর্বাশা জায়ানের সাথে ছিল? কিন্তু কিভাবে জানলো? নাকি কাল রাতে হোস্টেলে ফিরেনি বলে সন্দেহের বশে এরা এই কথা বলছে। আমতা আমতা শুরু করলো পূর্বাশা। তুতলিয়ে বলল – ককককোন রাতের কথা বলছো তোমরা? আর রাতে আবার জায়ান আসবে কোথা থেকে?
পূর্বাশার কথা শেষ হতে না হতেই সুজা তার মোবাইলে কিছু একটা বের করে ধরলো পূর্বাশার সম্মুখে। মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল পূর্বাশার। এ তো জায়ানের উইচ্যাট একাউন্ট, যেখান থেকে চার ঘন্টা আগে একটা ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাতের আঁধারে পূর্বাশা বরফের মধ্যে ছোটাছুটি করছে। ভিডিওটা দেখতে দেখতেই মেয়েটার চোখ পড়লো ভিডিওটার ক্যাপশনের পানে। বেশ সুন্দর করেই ক্যাপশনে লেখা –
“উইথ মাই পার্সনাল পেঙ্গুইন” ( আমার ব্যক্তিগত পেঙ্গুইনের সাথে।)
হঠাৎ এমন কিছু দেখে হয়তো পূর্বাশার রেগে যাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু মেয়েটা রাগলো না, উল্টো তার হৃদয় ছেয়ে গেল প্রশান্তিতে। আনন্দিত হলো তার মন। আর এই আনন্দ থেকেই এক দুঃসাহসিক কর্ম ঘটিয়ে ফেললো পূর্বাশা। নিজের মোবাইলটা বের করে জায়ানের সাথে তোলা কাল রাতের ছবিগুলোর মধ্যে একটা ছবি পোস্ট করে দিল উইচ্যাটে। ক্যাপশনে লিখে দিল –
“উইথ মাই পার্সনাল পোলার বি’য়া’র” ( আমার ব্যক্তিগত সাদা ভাল্লুকের সাথে )
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link