#স্নিগ্ধ_প্রিয়া
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৫০
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
গলার স্বর বাড়িয়ে বলল – নিচ থেকে হাওয়া ঢুকছে তৃষাম, হাওয়া ঢুকছে।
তৃষাম যেন বিরক্ত হলো চ্যাং এর কথায়। লুঙ্গি পড়ে হাওয়া ছাড়া আর কি আশা করে এই হাদারাম? তৃষাম বিরক্তিভরা কন্ঠে চাইনিজ ভাষা তুলে বলল – নিচ থেকে যেহেতু ফাঁকা তখন শুধু হাওয়া না আগুন, পানি, কাঁদা সব ঢুকবে।
চ্যাং খুব একটা পাত্তা দিল না তৃষামের কথায়। নিজের পড়নের লুঙ্গিটা একটু সময় নিয়ে নাড়িয়ে চারিয়ে দেখলো অতঃপর হেসে বলল – আই লাইক দিস লুঙ্গি তৃষাম। চীনে যখন ফিরবো তখন আমি বাংলাদেশ থেকে অবশ্যই কিছু লুঙ্গি নিয়ে যাব।
বাংলাদেশে এত কিছু থাকতে এই ছেলে কিনা শেষ পর্যন্ত লুঙ্গিতে মজলো? এত সুন্দর সুন্দর জিনিস থাকতে শেষে কিনা এ ব্যাগ ভরে চীনে লুঙ্গি নিয়ে যাবে? তৃষাম মুখ বাঁকানো। বাংলা ভাষায় বলল – পাগলে পাগল চিনে আর চ্যাং মাছে চিনে লুঙ্গি।
তৃষামের কথা বুঝলো না চ্যাং। মাথা চুলকে সে চাইনিজ ভাষায় শুধালো – কিছু বললি?
– হ্যা বলেছিলাম যে বাংলাদেশ থেকে চীনে যাওয়ার সময় তোকে শ খানেক লুঙ্গি উপহার দেব। সেই লুঙ্গি পড়ে পড়ে তুই চীনের রাস্তায় হাওয়া খাবি।
চ্যাং আনন্দিত হলো। লুঙ্গি ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল – অবশ্যই, কিন্তু এখন বাইরে যাবি না? ওখানে গান চলছে নিশ্চই সবাই উপভোগ করছে।
তৃষামের মুখশ্রী থমথমে হলো। এই লুঙ্গি পড়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান? অসম্ভব। মান ইজ্জত নিলামে উঠে যাবে নির্ঘাত। তৃষাম থমথমে কন্ঠেই শুধালো – না
চ্যাং ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল – কেন? এখন তো আমরা জামা কাপড়ও পড়ে ফেলেছি তাহলে অনুষ্ঠানে যেতে সমস্যা কি?
তৃষাম প্রথমে ভাবলো চ্যাং কে সব বুঝিয়ে বলবে কিন্তু পরক্ষনেই তার ভাবনা বদলালো। পরে যদি তার বুঝানোতে ছেলেটা চীনে লুঙ্গি নিতে না চায়। এ ব্যাটাকে তো তো অবশ্যই চীনের রাস্তায় সে লুঙ্গি পড়িয়ে হাঁটাবে। তৃষাম কন্ঠ নরম করলো। বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল – আসলে আজ অনুষ্ঠানের একটা ড্রেস কোড আছে ঐ পাজামা পাঞ্জাবী, তা তো আমাদের নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এই পোশাকে আমরা আর অনুষ্ঠানে যেতে পারবো না।
চ্যাং এর মুখশ্রীতে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটে উঠলো। বাংলাদেশে এসেছিল বেচারা বন্ধুর বাঙালি বিয়ে দর্শনে। তা কিনা এই ড্রেস কোড আটকে দিল।
____________________________________
উৎসব মুখর পরিবেশ। বড় বড় বক্সে উচ্চস্বরে বিভিন্ন গান বাজছে। কিছু ছেলেমেয়েরা নাচছে আবার কিছু ছেলেমেয়েরা দর্শকের ভূমিকা পালন করে হাতে তালি দিচ্ছে । মাঝে মাঝে আবার একজন একজন করে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়ে যাচ্ছে সকলে পূর্বাশা আর জায়ানের গালে। জায়ান বড় বড় চোখ করে দেখছে সবটা। বাঙালি বিয়ের রীতিনীতি সম্পর্কে তার জানা নেই খুব বেশি। ঐ যতটুকু মোবাইলে ভিডিওতে দেখেছে ততটুকুই জানে সে। সকলকে পূর্বাশার গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিতে দেখে দেখে জায়ান হুট করেই সামনে রাখা বাটি থেকে একটু হলুদ তুলে লাগিয়ে দিল পূর্বাশার গালে। হকচকালো মেয়েটা, আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সকলে ঠোঁট টিপে হাসছে। লজ্জায় পড়লো পূর্বাশা। দাঁতে দাঁত চেপে কন্ঠটা একটু খাদে নামিয়ে বলল – আপনি আমাকে হলুদ কেন লাগলেন?
জায়ান মৃদু হাসলো অতঃপর বলল – সবাই লাগাচ্ছিলো তো।
– সবাই লাগাবে আপনি লাগাতে পারবেন না।
জায়ান ভ্রু কুঁচকালো। কপাল কুঁচকে শুধালো – কেন আমার বউকে সবাই হলুদ লাগাতে পারবে আমি কেন পারবো না।
পাশ থেকে বোধহয় পূর্বাশার কাজিন সম্প্রদায়ের কেউ শুনে নিল কথাটা। সে হেসে বলল – পূর্বা থাক না। দুলা ভাইয়ের একটু তোমাকে হলুদ ছোঁয়াতে ইচ্ছে করছিলো ছুঁইয়ে দিয়েছে। তাকে কিছু বলিস না।
পূর্বাশা অপ্রস্তুত হলো বেশ। লজ্জালু ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকালো সে তবে বলল না আর কিছুই।
________________________________________
দিন গড়িয়েছে । গায়ে হলুদ শেষে এবার চলে এলো বিয়ের দিন। বাড়ির সকলে জায়ানকে নিয়ে এবাড়িতে বউ নিতে চলে এসেছে। গেটের সম্মুখে এ বাড়ির অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে টাকা নিয়ে রীতিমতো বিশাল এক যু’দ্ধ জয় করে ভিতরে প্রবেশ করেছে জায়ানরা। আজ অবশ্য সাথে মিসেস শীও আর জাফর চৌধুরীও এসেছেন। ছেলের বিয়ে সেখানে মায়ের আসাটা খুব একটা ভালো দেখায় না বিধায় মিসেস শীও আসতে চাইছিলেন না। কিন্তু সে না আসলে জাফর চৌধুরীকে সামলাবে কে? তাই বাড়ির সকলে এক প্রকার জোর করে নিয়ে এসেছে তাকে। জায়ানকে আজ পুরোপুরি বাঙালিয়ানা ভাবে বরের বেশে সাজানো হয়েছে। শরীরে পাঞ্জাবী, মাথায় টোপর আর মুখে রুমাল পুরো বাঙালি। বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই বড়রা বরযাত্রীতে আসা সকলকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। জায়ানকে নিয়ে বসানো হলো স্টেজে। তার পাশাপাশি আবার বসেছে তৃষাম, চ্যাং আরও কাজিন মহলের কিছু সদস্য। স্টেজে বসতেই তৃষাম নিজের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাপড়ের ব্যাগ বের করলো। ব্যাগের ভাজ খুলে সেখানে ভরে রাখলো জায়ানের জুতা আর তার নিজের জুতা। জায়ানের জুতা যদিও তার এভাবে ব্যাগে ভরার কোনো ইচ্ছে ছিল না তবুও ভরলো নয়তো এই বিয়ে বাড়ির মেয়েগুলোর কাছে যে তারা হেরে যাবে। মেয়েগুলো জুতা চুরি করে তাদের নাস্তানাবুদ করবে তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও জায়ানের জুতা ব্যাগে ভরে রেখেছে আর নিজের তো ফাটা কপাল, সব স্থানে গিয়ে সবার মধ্যে সেই ফেঁসে যায় তাই নিজের জুতাও ব্যাগ ভরেছে আজ। সমস্যা হলো এখন এই জুতোর ব্যাগ সে রাখবে কোথায়? আশেপাশে কোথাও রাখলে যদি কেউ পাশ থেকে সরিয়ে দেয়। নাহ এই জুতার ব্যাগ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না একদম। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ভাবলো তৃষাম অতঃপর জুতার ব্যাগটা নিচে রেখে তার উপর বসে পড়লো তৃষাম।
বেশি সময় ব্যয় না করে পূর্বাশাকেও সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসা হলো স্টেজে। আজ লাল লেহেঙ্গাতে সাজানো হয়েছে পূর্বাশাকে, সাথে পার্লারের ভারী মেকআপ। যদিও এই ভারী মেকআপের একদম পক্ষপাতী ছিল না পূর্বাশা। তবুও বাড়ির সকলের জোরাজুরিতে করতেই হলো। সকলের এক কথা – একদিনই তো সাজবি। বিয়ে কি আর বারবার হবে নাকি?
অগত্যা পূর্বাশাকে মেনে নিতে হলো সবার কথা। জায়ান আজও হা হয়ে গেছে পূর্বাশাকে দেখে। প্রতিদিন যেন মেয়েটার নতুন নতুন এক রূপ খুলছে। কি সুন্দর লাগছে আজ পূর্বাশাকে। জায়ানের পলক ফেলতে যেন ভুলে গেছে। বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে পূর্বাশার পানে। আশেপাশের সকলে জায়ানের কার্যকলাপ দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে। পূর্বাশার লজ্জা লাগলো। পাশে বসে জায়ানকে খোঁচা মেরে ফিসফিসিয়ে বলল – ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? সবাই কি ভাবছে।
জায়ান পূর্বাশার দিক থেকে নিজের দৃষ্টি সরালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে সকলকে দেখে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
যথা সময়ে শরিয়ত মোতাবেক এবং রেজিস্ট্রারি উভয়ভাবেই বিয়ে সম্পন্ন হলো। এবার এলো বিদায়ের পালা। একটা বিয়ের শুরুটা ঠিক যতটা আনন্দ উল্লাসে শুরু হয় ঠিক ততটা বিষাদময় হয় এই বিদায় বেলাটা। এই বেলাটাকে অতিক্রম করেই একটা মেয়ে বাবার ঘরের বাসিন্দা থেকে পরের ঘরের বাসিন্দা হয়ে যায়। পূর্বাশা যতই বাড়ি ছেড়ে চীনে থাকুক না কেন তাই বলে কি তার মা বাবার প্রতি টান কোনো অংশে কম নাকি? আজকের পর থেকেই বাবা মায়ের থেকে পর হয়ে যাবে মেয়েটা। এতদিন পর্যন্ত মেয়েটা যে বাড়ি নিজের বলে দাবি করতো আজকের পর থেকে বলতে হবে বাবার বাড়ি। ভাবতেই বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো পূর্বাশার। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। ভরকে গেল জায়ান। পূর্বাশার এমন কান্নার সে কারন খুঁজে পেল না কোনো। সে তো মেয়েটাকে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও তো নয়। জায়ান ভ্রু কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করলো চারদিক। অনেকেই কাঁদছে। আচ্ছা তাদের মেয়েকে নিয়ে সে কি মে’রে ফেলবে? এত কান্নার কি আছে? কাঁদতে কাঁদতেই পূর্বাশাকে গাড়িতে তুলে দিল সবাই। জায়ানও বসলো তার পাশে। গাড়িতে উঠেও কান্না থামলো না মেয়েটার। একইভাবে কেঁদে যাচ্ছে। জায়ান কপাল কুঁচকালো অতঃপর বলল – আমি কি দেখতে খারাপ?
পূর্বাশা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়ালো বুঝালো “না”
জায়ানের কুঁচকানো কপাল কুঁচকে এলো আরও। বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো – তাহলে কাঁদছো কেন? মনে হচ্ছে যেন তোমাকে ধরে বেঁধে কোনো জীব জন্তুর সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পূর্বাশা ভরকে গেল। কান্না থামিয়ে অবাক চোখে সে চেয়ে রইলো জায়ানের পানে।
______________________________________
বাসর রাত। পূর্বাশাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে জায়ানের ঘরে। চারদিকে ফুলে ফুলে সজ্জিত ঘর খানা। ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে বারি খাচ্ছে মেয়েটার। আর তার সাথে সাথে হৃদয়ে কম্পন জাগছে তার। কেমন অদ্ভুত এক শিহরণে আবিষ্ট হচ্ছে মেয়েটা। লজ্জা ভয় সংকোচ ঘিরে ধরেছে তাকে। আচ্ছা জায়ান স্বামী হিসেবে কেমন হবে? খুব ভালোবাসবে কি তাকে? লোক মুখে শোনা যায়, একজন ছেলে প্রেমিক হিসেবে যতটা উত্তম হয় স্বামী হিসেবে কখনও ততটা উত্তম হয় না। ধীরে ধীরে তার ভালোবাসা কমতে থাকে তবে কি জায়ানের ভালোবাসাও ধীরে ধীরে কমবে? পূর্বাশার ভাবনার মধ্যেই দরজা খোলার শব্দ কর্ণে পৌঁছালো তার। পূর্বাশা আড় চোখে তাকালো অতঃপর দেখলো জায়ান দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে। পূর্বাশার হৃদয় কেঁপে উঠলো কিছুটা। ছোট্ট হৃদযন্ত্রটার গতি যেন বেড়ে গেল বেজায়ভাবে। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো মেয়েটা। তবুও নিজের লজ্জা চেপে মা চাচিদের কথা অনুযায়ী জায়ানের পা ছুঁয়ে সালামের সিদ্ধান্ত নিল সে। খাট থেকে পা বাড়াতেই যেন আঁতকে উঠলো মেয়েটা। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া বাচ্চাদের মতো এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেললো, গায়ে জড়ানো পাঞ্জাবীটাও ছুঁড়ে ফেললো দূরে। নিমেষেই জায়ানের ফর্সা উদম শরীরটা দৃশ্যমান হলো পূর্বাশার সম্মুখে। হকচকালো মেয়েটা, একি বাসর ঘরে ঢুকেই কোনো কথা না বার্তা না জামা কাপড় খুলে ছোড়াছুড়ি শুরু করেছে কেন ছেলেটা? তবে কি এ এসেই অ্যাকশনে নেমে যাবে? ঢোক গিললো পূর্বাশা। হৃদয়ে অজানা আশঙ্কার সঞ্চার হলো মেয়েটার।
চলবে…….
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://www.facebook.com/groups/233071369558690/?ref=share_group_link