#তুমি_আছো_মনের_গহীনে
#পর্ব- ৩০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
সকলেই বেড়িয়ে যেতেই, রুশা আরহামের হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কেঁদে ফেলে। রুশার কান্নার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। আরহামের অস্বস্হি হচ্ছে তার হাত এইভাবে ধরে রাখার কারণে। আরহাম অস্বস্হি নিয়েই বললো,
‘ কি করছেন কি মিস রুশা? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?
হাত ছাড়ুন প্লিয। ‘
‘ স্যার আপনার হাতদুটো ধরারও কি অধিকার নেই আমার? জানি নেই তবুও একটু ধরতে দিন না। আপনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সাধ্যি তো নেই আমার। অন্তত হাতদুটো ধরতে দিন দয়া করে। ‘
আরহাম নিজের হাতজোড়া তৎক্ষনাক ছেড়ে দিয়ে, কাঠিন্য গলায় বললো,
‘ এইসব কি ছেলেমানুষী করছেন মিস রুশা? এখন আপনার আবেগীর বয়স নয়। যথেষ্ট ম্যাচুরেটি আছে আপনার মধ্যে যতটুকু আমি জানতাম। আমি আশা করবো,আপনি নিশ্চই আবেগী হয়ে এমন কিছু করবেন না যাতে, আমার চোখে আপনার প্রতি যে সম্মানটুকু আছে তা নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। ‘
‘ স্যার কাউকে ভালোবেসেছেন কখনো? হ্যা ভালো তো বেসেছেনই তাইনা? আপনার স্ত্রীকে। কি নাম যেন মেহেভীন। হুম মেহেভীনকে আপনি খুব ভালোবাসেন তাইনা স্যার? ‘
রুশার প্রশ্নে আরহাম নিশ্চুপ হয়ে যায়। আরহামের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। তার খুব করে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে, যা চাইলেও সে আপাতত বলতে পারছে না।
আরহামের থেকে কোনপ্রকার জবাব না পেয়ে, কান্নার বেগ দ্বিগুন করে রুশা বললো,
‘ স্যার জানেন? ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার যন্ত্রনাটা একটা মানুষকে তীলে তীলে শেষ করে দেয়।আজ হয়তো সেই কষ্টটাকে আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন না। আসলে আমরা তখনি অন্যজনের কষ্ট অনুভব করতে পারে,যখব তা আমাদের সাথে ঘটে।’
রুশার কথায় আরহামের অধরের কোণে বাঁকা হাসি ফোটে উঠে। আরহামের অদ্ভুদ হাসির মানে বুঝতে অক্ষম হলো রুশা। আরহাম ধীর গলায় বললো,
‘ আপনি এখন আসতে পারেন মিস রুশা। ‘
রুশা জানে শত সে কথা বললেও আরহাম তার কথা বুঝাতে পারবে না। তাই রুশা আর কথা বাড়ালো না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিঃশব্দে বেড়িয়ে গেলো।
আরহাম জানালার কাছে ঘেষে দাড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো,
‘ নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের সামনেই অন্য কারো হতে দেখেছি। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে রেখেছিলাম,যেন সে সুখে থাকে। কেননা আমার ভালোবাসা আমাকে শেখায়, নিজের ভালোবাসা আমাকে শেখায়, নিজের ভালোবাসার মানুষের সুখেই প্রকৃত সুখ। থাকুক না সে অন্য কারো গল্পের নায়িকা হয়ে। তবুও তো সে সুখে আছে।
কিন্তু নিয়তি হয়তো অন্য কিছু চেয়েছিলো। ‘
আরহাম তার ফোনে কারো ছবি বের করে, প্রাপ্তির হাসি দেয়।
_________
আরহাম, আরিয়ান ও মেহেভীন আজ অভ্র এবং মায়রার সাথেই খাবে। মেহেভীন আজ ইচ্ছে করেই আরহামের পাশে বসে আছে। আরহাম বার বার মেহেভীনকে ধমকে ধমকে এইটা সেইটা খাওয়ার জন্যে বলছে। বেচারী মেহেভীন ও ধমক খেয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করলো। আরহামের বকা না খেলে, তার তো আবার খাবার পেটেও যায়না। আরহামকে দেখেই বুঝা যায়, তার কতটা চিন্তা হচ্ছে মেহেভীনকে নিয়ে। মেহেভীন খেয়াল করছে, অভ্র বার বার আড়চোখে তাদের দিকে তাঁকাচ্ছে। অভ্রের এমন চাহনীতে মেহেভীনের মাথায় চট করে একটা শয়তানী বুদ্ধি চেপে বসলো। ওয়েটার টেবিলে মেহেভীনের জন্যে সুপ রেখে চলে যায়। মেহেভীন একপ্রকার ইচ্ছে করেই, গরম সুপটা খেতে গিয়ে, নিজের হাতে ফেলে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাথায় কুকড়ে উঠে। মেহেভীনের আওয়াজে সবার চোখ মেহেভীনের দিকে যায়। মেহেভীনের হাতে এইভাবে সুপ পড়ে যাওয়ায়,আরহাম তৎক্ষনাক ওয়েটারকে দিয়ে বরফ আনিয়ে নিয়ে, মেহেভীনের হাতে হাল্কা করে চাপ দেয়,যেন জায়গাটায় ফোসকা পড়ে না যায়। কেননা সুপটা বেশ গরম ছিলো। আরহাম রাগান্বিত সুরে বললো,
‘ দিনে একটা স্টুপিডের মতো কাজ না করলে তোমার কি হয়না? সুপটাও ঠিক মতো খেতে পারো না তুমি। ‘
মেহেভীন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ হুম খেতে পারি না তো। আপনি বরং খায়িয়ে দিন। ‘
মেহেভীনের এমন আবদারে অবাক হয় আরহাম। কেননা মেহেভীন নিজ থেকে কখনোই তার কাছে খেতে চাইনি। আরহাম কিছু না ভেবে মেহেভীনকে চামচ দিয়, সুপটুকু খায়িয়ে দেয়।
আরহাম ও মেহেভীনের কান্ড দেখে, আরিয়ান স্মিত হেসে বলে,
‘ ভাই কি মোহাব্বত নজর যেন লাগে। ‘
আরহাম উত্তর দিলো না,কেননা সে জানে আরিয়ান সবসময় তার মজা উড়াবেই। মেহেভীন খেতে খেতে খেয়াল করছে, অভ্র খাচ্ছে না। রাগে চোখজোড়া লাল হয়ে গেছে একপ্রকার। বেচারা না পারছে সহ্য করতে, না পারছে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে। আরহাম এবং মেহেভীনকে এইভাবে দেখে মন ক্ষুন্ন হলো মায়রার। আচ্ছা সে ও তো প্রেগন্যান্ট তাহলে অভ্র কেন তার আরহামের মতো যত্ন নেয়না? মায়রার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে বসলো।
আজ কেন মেহেভীনকে মায়রার থেকেও বেশি সুখী দেখাচ্ছে,যেখানে মায়রার সুখে থাকার কথা ছিলো। মায়রা কিছু একটা ভেবে বলে,
‘ আরহাম ভাইয়া তো মেহেভীন মানে ভাবির ভালোই খেয়াল রাখে। অভ্র ও ঢাকাতে আমার এইরকম খেয়াল রাখতো। এইসময়টা আমাকে তো অভ্র চোখেই হারাতে চাইতো না। ‘
অভ্র অবাক পানে মায়রার দিকে তাকায়, যার অর্থ হচ্ছে এতোগুলো মিথ্যে মায়রা কেন বললো? সবার আর বুঝতে বাকি রইলো না মায়রাও প্রেগন্যান্ট।
আরিয়ান অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ বাহ ভাই তোর ঘরেও যে এইরকম সুখসংবাদ আসতে চলেছে,তা বললি না যে? এতোটাই পর আমরা? ‘
অভ্র কিছু বলতে চাইবে, তার আগেই মায়রা লজ্জামাখা কন্ঠে জবাব দিলো, ‘ আসলে অভ্র বরাবরই লাজুক। তাই আসলে বলতে পারেনি। ‘
মেহেভীন শক্ত করে নিজের জামা চেপে ধরে আছে। চোখ তার ছলছল করছে৷ হয়তো এখন আখিজোড়া থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে মেঝেতে। মেহেভীন কোনরকম উঠে দাড়িয়ে বললো,
‘ আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমি আসছি। ‘
মেহেভীনের দিকে অভ্র অপরাধীর ন্যায় তাকালো। মেহেভীন তা উপেক্ষা করে, নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। তখনি হুট করে অভ্রের ফোন বেজে উঠলো। অভ্র ‘ এক্সকিউজ মি ‘ বলে সাইডে চলে গেলো। অভ্র তাকিয়ে দেখে রাইসার ফোন।যে সম্পর্কে অভ্রের খুব কাছের বন্ধু হয় । রাইসা হঠাৎ ফোন করলো কেন? রাইসা মেহেভীন এবং অভ্রের ব্যাপারে সবকিছুই জানতো। এমনকি ক্লাবে রাতের ঘটনা সম্পর্কেও সে মোটামোটি জানে। রাইসা আপাতত তার কাজের জন্যে ক্যানাডা গিয়েছে। রাইসাকে এতোদিন পর, ফোন করতে দেখে অভ্র অবাক হয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললো,
‘ রাইসা তুই? ‘
‘ মেহেভীন আর তোর সম্পর্কে সবাই শুনলাম। তুই মেহেভীনকে ইউস করেছিস অভ্র? ছিহ। আজকে আমি আমাদের আরেক বন্ধু কায়েফ এর থেকে সব জেনে, তোকে ফোনটা দিলাম। তুই এতোটা নিঁখুতভাবে কি করে অভিনয় করলি অভ্র? তোর অভিনয় দেখে মনে হতো তুই সত্যি ভালোবাসতি মেহেভীনকে। ‘
অভ্র উদাসীন গলায় বললো,
‘ হুম বুঝলাম। আমি খারাপ। আমি অভিনয় করি। কিন্তু মেহেভীন তো খুব সুখেই আছে। তুই জানিস মেহেভীন বিয়ে….’
বাকিটুকু বলার আগেই, রাইসা বললো,
‘ আমি এখন সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি না। তুই জানিস তুই ঠিক কতটা অপরাধ করেছিস মেহেভীনের সাথে? সে সম্পর্কে একটুও ধারনা আছে তোর? সেদিন হোটেলে কি হয়েছিলো জানিস? ‘
‘ কি বলতে চাচ্ছিস তুই? হোটেলে সেদিন কি হয়েছিলো? ‘
রাইসা কিছু বলতে পারলো না তার আগেই ফোন কেটে গেলো। অভ্র বুঝলো নেট প্রব্লেম এর জন্যে ফোনটা কেটে গেছে।
_______< মেহেভীন রুমে ঢুকেই মেঝেতে বসে, ঢুকড়ে কেঁদে উঠলো। মায়রা অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছে। ভাবতেই মেহেভীনের শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। আচ্ছা মেহেভীন ও তো অভ্রের সন্তানের মা হতে চলেছে, তাহলে তার নিয়তিটা এমন কেন হলো? সে কেন পেল না তার সন্তানের মর্যাদা? মেহেভীন কান্নামিশ্রিত গলায় বললো, ' অভ্র! তুমি আজ বড্ড সুখি তাইনা? নতুন অতিথি আসতে চলেছে তোমার। সেই অতিথিকে নিয়ে তোমার কত্ত আয়োজন। তোমার এবং মায়রার সন্তান তোমার পরিচয়ে হেঁসে খেলে জীবন পার করে দিবে,কিন্তু আমার সন্তান কি করবে? আজ না হয় সে আরহাম সাহেবের সন্তানের পরিচয়ে ধীরে ধীরে আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে, কিন্তু যখন সে এই পৃথিবীতে আসবে,তখন তো সবাই সব কিছু জেনে যাবে। সবাই জানবে আমার সন্তানের কোন বাবার পরিচয় নেই। কেউ তো আসল সত্যটা জানতে চাইবে না অভ্র। এই সমাজটা তো আমার এবং আমার সন্তানের দিকে আঙ্গুল তুলবে। নিষ্ঠুর এই সমাজে আমার সন্তানের উপাধি হবে, সে অবৈধ সন্তান। আমি কী করে তা সহ্য করবো? ' মেহেভীনের চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। আরহাম ' মেহেভীন ' বলে রুমে ঢুকতেই, মেহেভীন পিছনে ঘুড়ে গেলো। আরহাম দুধের গ্লাস টা রেখে বললো, ' নীচে তো খেলে না। এখন এই দুধটা চুপচাপ খেয়ে নাও। ' মেহেভীন ভেজা গলায় বললো, ' আমি এখন খাবো না। প্লিয আমাকে জোড় করবেন না। ' কথাটি বলেই মেহেভীন তার চোখের জল আরহামের থেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, যদিও আরহামের চোখে তা এড়ায়নি। আরহামের মনে প্রশ্ন জাগে মেহেভীন কাঁদছিলো? কেন কাঁদছিলো? তাহলে কি মেহেভীনের মন খারাপ। আরহাম কিছু একটা ভেবে,মেহেভীনের দিকে এগিয়ে এসে বললো, ' ওকে দুধ খেতে হবে না। চলো আমার সাথে। ' ' কোথায়?' ' একটা জায়গায়। ' 'কিন্তু কোন জায়গায়? ' সঙ্গে সঙ্গে আরহাম মেহেভীনের ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে, নিচু গলায় বললো, ' হুশ কোন কথা নয়। চলো আমার সাথে। নো কুয়েশচেন। ' আরহাম মেহেভীনের হাত ধরে, বাইরের দিকে নিয়ে যায়। মেহেভীন বুঝতে পারছে না আরহাম তাকে হঠাৎ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মেহেভীনকে অবাক করে দিয়ে, আরহাম...... চলবে....কী? [লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি] [কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু]