নিশীভাতি #অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)

2
193

#নিশীভাতি
#অন্তিম_পর্ব (শেষ অংশ)

“আমার সাথে হুমায়রা থাকা মানেই ওর জীবনের ঝুকি। হাফসা মারা গেলো, ফরিদ ভাই মারা গেলেন, হুমায়রার উপর দুবার আক্রমণ হলো। আমি এই পেশা ছেড়ে দিলেও আমার শত্রুরা আমাকে ছাড়বে না। তাই আমি চাই না হুমায়রা আমার সাথে থাকুক। আপনি বরং ওকে নিয়ে যান। দরকার হলে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো……”

কথাটা শেষ করার পূর্বেই শরীফা বেগম ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“বিয়ে কি তোমার কাছে ছেলেখেলা ফাইজান? মাথা কি ঠিক আছে তোমার? ইচ্ছে করছে প্লাস দিয়ে একটা একটা করে তোমার দাঁতগুলো খুলে ফেলতে। বেয়াদব। কথা বলতে জানা না থাকলে তোমার মুখ খুলো না”

কিন্তু ফাইজানের মাঝে খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলো না। সে শুধু মেঝের দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হুমায়রা নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। হুমায়রার মনে হলো কেউ তার কানে গলন্ত শিশা ঢেলে দিয়েছে। ছ্যাত করে উঠলো বুকটা। ডিভোর্স? ফাইজান কি সত্যি এই কথাটা বললো? এতো শক্ত কথাটা অকপটে বলে দিলো। বাধলো না? হুমায়রার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু ফাইজান ফাজলামি করার মতো ব্যক্তি নয়। শরীফা বেগম চিৎকার করলেন অনেকক্ষণ। কিন্তু ফাইজান নিশ্চুপ ছিলো। হুমায়রা শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আম্মা, আপনি শান্ত হন। উনার মাথা ঠিক নেই। আবল তাবল বকছেন তাই”

হুমায়রার কথা শেষ হবার আগেই রাশাদ খুব শান্ত গলায় বললো,
“উনি তো ভুল কিছু বলেন নি। সত্যি তো উনি তোকে নিরাপদ রাখতে পারেন নি। একটুর জন্য তোর প্রাণ বেঁচেছে। কথাটা আমিই বলতাম”
“ভাইজান”
“হুমায়রা, তুই তো অতিমানব নস যে তোর প্রাণ বারবার বাঁচবে। জেনেবুঝে বিপদে থাকা কি ভালো?”
“যখন আমার মৃত্যু লেখা আমি তো মরবোই। এখানে তুমি চাইলেও আমাকে বাঁচাতে পারবে না।“
“একদিন তো মরেই যাবো এই ভেবে আগুনে ঝাপ দিবি তুই? বাচ্চামি করিস না। বাড়ি চল”

রাশাদের কথার প্রেক্ষিতে হুমায়রার অনড় উত্তর,
“আমি যাবো না ভাইজান”

ফাইজান নির্জীব বস্তুর মতো কথাগুলো শুনলো। অনেক সময় চুপ থেকে অবশেষে শরীফা এবং হুমায়রার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার সিদ্ধান্ত কিন্তু বদলাবে না। হুমায়রা রাশাদ সাহেবের সাথেই যাবে”

বলেই নিজ ঘরে চলে এলো। ফাইজানের কথায় প্রচন্ড রাগ হল হুমায়রা, কষ্ট হলো, অভিমান হলো। কিন্তু সেও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। ফাইজানের পিছু পিছু সেও ঘরে গেলো। দরজা আটকে দিলো হুমায়রা। ফাইজানের বাহু ধরে নিজ দিকে ঘোরালো। শক্ত গলায় বললো,
“বাহিরে এগুলো কি বলে এলেন আপনি? আমাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে হয় নি আপনার?”
“তুমি বাচ্চা মানুষ। পরিস্থিতির গভীরতা বুঝো না। আমি তোমার ভালোর……”
“আমার ভালো? আপনার থেকে দূরে সরিয়ে আমার কোন ভালোটা করছেন আপনি?”

কথাটা বলতে বলতেই গলা ধরে এলো হুমায়রার। শক্ত মূর্তিটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। অশ্রুরা এসে দখল করলো চোখের কোন। ফাইজানের হাতটা ধরে বললো,
“কেনো করছেন এগুলো? যা হয়েছে তাতে আপনার কোনো দোষ নেই ফাইজান। আমরা মানুষ। আমাদের কাজ শুধু চেষ্টা করা। আপনি চেষ্টায় কমতি রাখেন নি”
“না, তুমি ভুল। যা হয়েছে, হচ্ছে বা হবে আমার জন্য”

নতমস্তকে অনুতপ্ত স্বরে বললো ফাইজান। হুমায়রা দুহাতে তার মুখখানা আলতো করে ধরলো, অশ্রুসিক্ত নয়ন রাখলো শুকনো মলিন চোখজোড়ায়। কাতর স্বরে বললো,
“যারা দোষ করেছে তারা শাস্তি পাবে ফাইজান। আপনি কোনো দোষ করেন নি। কেউ না জানুক, আমি জানি আপনি ফরিদভাইকে খুব ভালোবাসেন। যা হয়েছে তাতে কারোর হাত ছিলো না। সেভাবে চিন্তা করলে তো ফরিদ ভাই তো আমাকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন। শাস্তি তো আমার পাওয়া উচিত তাই নয় কি? তাহলে আপনি কেনো নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন? নিজেকে কাঠগড়ায় কেন দাঁড় করাচ্ছেন”

ফাইজান হুমায়রার হাত সরিয়ে দিলো। উন্মাদের মতো চিৎকার করে বললো,
“তুমি বুঝছো না হুমায়রা। কেউ বুঝে না। আমি একটা প্যাথেটিক শি’ট। আমি কখনো আমার প্রিয় মানুষদের বাঁচাতে পারি না। আমার কাছে ক্ষমতা কি ছিলো না? ছিলো তো? সারা শহরে আমি ফোর্স লাগিয়েছি। কিন্তু পারি নি কিছু করতে, পেরেছি? হাফসাকেও বাঁচাতে পারি নি। ফরিদ ভাইকেও না।“
“মৃত্যু মানুষ ঠেকাতে পারে না ফাইজান”

হুমায়রার কথাটা যেনো ফাইজানের মস্তিষ্কেই গেলো না। ফরিদের মৃত্যু তাকে এতোটাই ভেতর থেকে চুরমার করে ফেলেছে যে যুক্তি দিয়ে চিন্তাও করতে পারছে না সে। পাগলের মতো আওড়ালো,
“আমি যদি একটু আগে আসতাম, একটু কুইক হতাম তাহলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যেতো। আমি তো সব চেষ্টাই করেছি। আমার ফুল প্রুফ প্লান ছিলো। কিন্তু পারি নি। আমি নিজেকেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। সবশেষে কিন্তু আমি-ই অপারগ। আমি আমার প্রিয় মানুষদের বাঁচাতে পারি নি। আমি তোমাকে নিরাপদে রাখতে পারবো না। প্রতিটা দিন আমার ভয়ে কাটাতে হবে। এই আশংকায় যে ওরা তোমাকেও আমার থেকে কেড়ে নিবে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করবো? হুমায়রা মা আর তুমি বাদে আমার কেউ নেই। বিশ্বাস করো তুমি আমার থেকে দূরে থাকলে ভালো থাকবে। প্রিয়জন দূরে থাকুক, ভালো থাকুক। হুমায়রা আমি বাঁচতে চাই। আমি চাইলেও স্বাভাবিক মানুষ হতে পারবো না। আমি রাজনীতি ছাড়তে পারবো না”

ফাইজানের কথা শেষ হবার পূর্বেই হুমায়রা করুণ কন্ঠে বললো
“আমাকে ছাড়তে পারবেন? আমাকে ছেড়ে ভালো থাকবেন?”

ফাইজান উত্তর দিতে পারলো না। সত্যি তো এটাই যে সে হুমায়রাকে ছাড়া ভালো থাকবে না। হুমায়রা তার থেকে দূরে যাবে কথাটা ভাবতেই মনে হচ্ছে কেউ নিষ্ঠুর ভাবে তার হৃদয় বরাবর ভোঁতা ছুরিঘাত করছে। গলগল করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু সেই রক্তক্ষরণ দৃশ্যমান নয়। কলিজাখানা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে তার। হৃদয় ক্রমশ দূর্বল হচ্চে। পরক্ষণেই হাফসার মরদেহ স্মরণে আসতেই নড়ে চড়ে উঠলো ফাইজান। বিচ্ছেদের নির্মম যন্ত্রণাও সহ্য করে নিবে সে, কিন্তু হুমায়রাকে চিরতরে হারাতে পারবে না। হুমায়রা ব্যতীত জীবন কল্পনায় আনাও যেনো অসহনীয় শাস্তি। ফাইজানকে মৌন থাকতে দেখে অভিমানের প্রাচীর যেনো শক্ত হলো। প্রচন্ড অভিমানের স্বরে বললো,
“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, মাঝপথে হাত ছাড়বেন না”

ফাইজান তাচ্ছিল্যভরে বললো,
“নেতারা কথা রাখে না হুমায়রা”

হুমায়রা বিমূর্ত নয়নে তাকিয়ে থাকলো ফাইজানের দিকে। তার মুখশ্রীর যন্ত্রণাটুকু অনুধাবণ করা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালো। কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে গেলো সে। ফাইজান দৃষ্টি তুললো না। দেখলো না প্রিয়তমার চলে যাওয়া। হাত মুষ্টিবদ্ধ। নিজের অপারগতায় নিজেকে তাচ্ছিল্য ভরে মনে মনে বললো,
“তুমি ব্যর্থ ফাইজান ইকবাল। তুমি ব্যর্থ”

হুমায়রা এক কাপড়ে বেরিয়ে গেলো রাশাদের সাথে। শরীফা তাকে আটকানোর চেষ্টা করলো। সে শান্ত গলায় বললো,
“মাঝে মাঝে কারোর অস্তিত্ব টের পেতে হলে তার বিলীন হওয়া প্রয়োজন। দূরত্ব হয়তো সেই অস্তিত্বকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবে”

সারাটা রাস্তা কোনো কথা বলেনি হুমায়রা। রাশাদও তার মত পরিবর্তনের কারণ শুধায় নি। কিছু কথা থাক হৃদয়ের লুকানো প্রকোষ্ঠে।

***

লেডিস সেলে রাখা হয়েছে যুবাইদাকে। তার ট্রায়াল চলছে। এখানে সব দাগী দাগী আসামী। কেউ খুন করেছে তো কেউ রাহাযানি। পাপ করলে বুঝি চেহারাতেই সেই পাপের নৃশংসতা ফুটে উঠে। ভাষাতেই বর্বরতা প্রকাশ পায়। যুবাইদা ভয়ে থাকে। প্রতিটা সময় যেন আতংক। এক কোনায় ঘাপটি এরে বসে থাকে। পাশে থাকা মহিলা পান খেতে খেতে শুধালো,
“কি রে? কয়টা খুন করে এসেছিস?”

ভাষ্য এমন যেনো খু’ন নয় কোনো মুড়ির মোয়া। যুবাইদা উত্তর দিলো না প্রথমে। ফলে মহিলার রাগ হলো। অকপটে লাথি বসিয়ে দিলো যুবাইদার তলপেটে। ফলে ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো যুবাইদা। মহিলা বিশ্রী গা’লি দিয়ে বললো,
“আইসোস তো জেলেই, আবার নখরা দেখাস কে রে?”

যুবাইদার মুখখানা নীল হয়ে আছে। ব্যাথার জন্য কথাও বলতে পারছে না। এমন সময় লেডি কন্সটেবল এসে বললো,
“হুসনেয়ারা খাতুন যুবাইদা, তোমার লগে দেখা করতে আসছে। আসো আসো”

যুবাইদা যেনো পালিয়ে বাঁচলো। মনে আশা জন্মালো। এই জাহান্নাম থেকে তাকে মুক্তি দিতে কেউ হয়ত এসেছে। কিন্তু মানুষটির মুখ দেখেই চুপসে গেলো যুবাইদার মুখ। কারণ বিপরীতের মানুষটি হুমায়রা। হুমায়রা একা নয়, রাশাদও এসেছে তার সাথে। রাশাদ ছাড়া পেয়েছে? হুমায়রা বেঁচে আছে? তারা তো সাক্ষী দিলে সব শেষ হয়ে যাবে। ফলে কাচুমাচু করে বললো,
“হুমায়রা তুই আইছোস মা। মা আমারে ক্ষমা করি দে। তোর মা টেকার জন্য অন্ধ হইয়্যা গেছিলো। মা আমার, আমারে বাঁচা। রাশাদ বাপ, তোমার মারে বাঁচাও। জানো বাপ এখানে কত খারাপ মানুষ আছে? আমারে মাইর‍্যে লাবে বাপ। আমারে বাঁচাও”

রাশাদ তাচ্ছিল্যভরে বললো,
“তাহলে আপনি আপনার জাতিবর্গকেই পেয়েছেন বলেন, কাঁদছেন কেনো? আপনার তো খুশি হবার কথা”
“কি কও আব্বা, এরা খু’নি, ঠগ”
“যে মানুষ নিজ স্বার্থে তার ছেলেকে মিথ্যে জারজ অপবাদ দিতে পারে? কাউকে খু’ন করে ছেলেকে ফাঁসাতে পারে, নিজের মেয়েকে অপহরণ করাতে পারে, তাকে পু’ড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করতে পারে সে কি ভালো মানুষের কাতারে পরে? আপনি তো ওদের থেকেও জঘন্য”

রাশাদের কথায় চুপসে যায় যুবাইদা। হুমায়রা শান্ত গলায় বললো,
“আমি শুধু দেখতে এসেছি আপনার শাস্তি কি শুরু হয়েছে কি না? চিন্তা করবেন না। শুরু না হলে যেনো শুরু হয় সেই ব্যবস্থা করবো। আপনি যেনো এখানেই পঁচে ম’রেন সেই ব্যবস্থা তো করতে হবে।“
“আমি তোর মা হুমায়রা”
“এই জন্যই চাই আইন আপনাকে শাস্তি দিক। মা না হলে হয়তো এর থেকে বিশ্রী শাস্তির প্রার্থনা করতাম”

যুবাইদা অনেক কাঁদলো কিন্তু হুমায়রা কিংবা রাশাদের মন গললো না। বরং তিক্ত ঘৃণায় ভরে উঠলো হৃদয়।

*****

নিকষ আঁধার। নীলম্বরের চাঁদটাও গা ঢাকা দিয়েছে মেঘের চাঁদরে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের লাইটটাও টিমটিম করছে। ঘন আঁধারের কোলে ভয়াতুর হুমায়রা পথ হারিয়ে ফেলেছে। তার মুখাবয়বে সন্ত্রাশ। কাঁপা স্বরে শুধালো,
“কেউ আছো? আমার ভয় করছে। ফাইজান? আপনি কোথায়? আমার ভয় করছে”

সাড়া না পেয়ে হুমায়রার ভয় বাড়ে। সে আরোও আকুলভাবে ডাকে। কিন্তু ফাইজানের সাড়া নেই। হঠাৎ করে দমকা হাওয়ার মতো একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায় তার সামনে। কালো কিছু ছায়া নেমে আসে। ঘিরে ধরে হুমায়রাকে। অষ্টাদশীর ভয় গাঢ় হয়। দেখতে দেখতেই একটি ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠে। সেই সামান্য আলোতে দেখা যায় কিছু হিংস্র আঁখি। কিছু বোঝার আগেই তারা সেই জ্বলন্ত অগ্নিশিখা নিক্ষেপ করে হুমায়রার গায়ে। মুহূর্তেই জ্বলন্ত লেলিহান শিখায় দগ্ধ হতে থাকা মায়াবিনী। হৃদয়বিদারক চিৎকার কাঁপিয়ে তোলে শান্ত আঁধারে লিপ্ত ধরনী। সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে যায় ফাইজানের। ধরফরিয়ে উঠে বসে সে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ঘেমে ভিজে গেছে গলা ঘাড়। হৃদস্পন্দন বাড়ন্ত। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে অথচ এখনো ঘামছে কপাল। আশপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলো সে তার ঘরে। এখনো রাত। ঘড়ির দিকে তাকালো ফাইজান। ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে তড়িৎ গতিতে ফোন করলো একটি নম্বরে। মানুষটি ফোন ধরছে না, অবশেষে যখন ফোন ধরলো ফাইজান অস্থির স্বরে শুধালো,
“হুমায়রা কেমন আছে?”

মানুষটি উত্তর দিতেই শান্ত হয় সে। ছোট্ট করে “আচ্ছা” বলে ফোন রেখে দেয় সে। গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। জড়িয়ে ধরে হুমায়রার বালিশ, গন্ধ নেইয়। কিন্তু সেই গন্ধ এখন মিলিয়ে গেছে। হুমায়রা নেই তার আশেপাশে। বুকটা এখনো কাঁপছে। চোখ বুজে বা হাতটা রাখে চোখের উপর। ক্লান্ত স্বরে বলে,
“যেদিন তোমার জন্য নিরাপদ আশিয়ানা বানাতে পারবো সেদিন রানীর মতো তোমাকে ফিরিয়ে আনবো। শুধু একটু সময় দাও। আমার কাজ যে শেষ হয় নি”

*************
কঠিন নিরাপত্তার আয়তায় হুমায়রা কোর্টে হাজির হয়। সাক্ষী দেয় জব্বার, যুবাইদা, নাদিম এবং কেতাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে। রাজ সাক্ষী হয় দেলোয়ার সাহেব। পুলিশের থার্ড ডিগ্রিতে আমানের অবস্থা খুব খারাপ। সে এখন হাসপাতালে। শুধু ছেলেকে প্রাণে বাঁচানোর ইচ্ছেতেই সে রাজসাক্ষী হয়। ফলে ৩০২, ৩০৭, ৩৬২, ৩৬৩ ধারায় জব্বার সাহেব এবং নাদিমের ফাঁ’সির আদেশ হয়। ফাঁসি হবে তিন মাস পর। কেতাব সাহেব এবং যুবাইদার যাবজ্জীবনের রায় হয়। ফরিদের মৃত্যুর কাছে এই শাস্তিগুলো যেনো খুব তুচ্ছ। তবুও আক্ষেপ করে না হুমায়রা। কোর্টে একবার দেখা হয় ফাইজানের সাথে কিন্তু কথা হয় না তাদের মাঝে। নিষ্প্রাণ চোখজোড়া তাকিয়ে থাকে শুধু একে অপরের দিকে।

******

জব্বার সাহেব এবং নাদিমের ফাঁসির আদেশ হলো সোমবার। তার এক সপ্তাহ আগে তাদের একটি সেল থেকে অন্য সেলে ট্রান্সফার করা হচ্ছিলো। হঠাৎ একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। যে ভ্যান তাদের নিয়ে যাচ্ছিলো সেই ভ্যানটা দূর্ঘটনার শিকার হলো। একেবারেই খাদে পরে গেলো তা। যখন নাদিম এবং জব্বারের জ্ঞান ফিরলো তারা নিজেদের একটি স্বয়ংক্রিয় ক’রাতের মেশিনে বাঁধা পেলো। করাতটি একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। যে ঘরটিতে তারা আটকানো সেখানে জ্বলছে আগুন। কি নির্মম এই অগ্নিকুন্ড। ধীরে ধীরে করাতটা এগুচ্ছে আর কাটছে তাদের মাংস। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। বাঁচার জন্য চিৎকার করছে তারা। কিন্তু শোনার কেউ নেই। একটা সময় চিৎকার থেমে গেলো। রক্তগুলো মাটি শুষে নিলো। আর আগুন গিলে খেলো নিথর দেহ।

*****

ফাইজান বসে ছিলো তার অফিসে, তার সচিব তানভীর ছুটে এলো। অস্থির লাগছে তাকে। ফাইজান দৃষ্টি না তুলেই বললো,
“কিছু বলবে?”
“অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটেছে”
“কি?”
“পুলিশ ভ্যান থেকে জব্বার এবং নাদিম গায়েব। তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেতাব চৌধুরীর উপর কারা যেনো আক্রমণ করেছে। মেরুদন্দে আঘাত করেছে। বাঁচবে কি না জানা নেই। আর যুবাইদার সাথে কিছু মহিলা আসামীর ঝামেলা হয়েছে। তারা ওর গায়ে এ’সি’ড মেরেছে। শরীরের বেশ অংশ পুড়ে গেছে। জিভ, একটা চোখ, খুব বাজে অবস্থা স্যার”

ফাইজান শান্ত। দায়সারাভাবে বললো,
“এগুলো কি খুব জরুরি কোনো খবর?”
“অদ্ভুত না? এতো সিকিউরিটির মধ্যে এমন কিছু, তাও দিনে দুপুরে”

ফাইজান হাসলো। অদ্ভুত ভাবে বললো,
“দিনে দুপুরেই তো অঘটন ঘটে তানভীর। আর সিকিউরিটি আর এমন কি? বাহিরে সে আমার পাহারায় বসে আছে সে চোখ বন্ধ করলেই একটা বুলেট আমাকে চিরে ফেলবে। তাই এসব নিয়ে ভেবো না। কাজ করো”

তানভীর কথা বাড়াতে পারলো না। এই কয়েকমাসে ফাইজানের মধ্যে বিস্তর একটা পরিবর্তন দেখা গেছে। কেমন যেনো গা ছমছম করে। শুধু তাই নয়, পার্টির সবাই ভয় পায় তাকে। তার প্রভাব যেন বাড়ছে। প্রাক্তন বা প্রবীনরা তার সামনে কথা বলে না। ভয় পায়। হয়তো ফরিদ ভাইয়ের মৃত্যুর প্রভাব এটা। তানভীর হাল ছেড়ে দেয়। এই ফাইজান নামক কুহেলিকা নিয়ে ভাবা ভুল ছাড়া কিছু নয়।

*******

ফরিদের কবরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে ফাইজান। কবরটা বাঁধাই করা হয়েছে। হাফসার কবর ঠিক তার পাশে। মাটির নিচে প্রিয় দুটো মানুষ। ফাইজান দোয়া করলো। তারপর বসে রইলো অনেকক্ষণ। সূর্য তখন ডুবতে বসেছে। আজ অনেক দূরে যেতে হবে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
“ফরিদ ভাই, অবশেষে আমার হাতেও রক্ত লেগেই গেলো। আমি এখন পাক্কা নেতা হয়ে গেছি। রাজনীতির খেলায় আমাকে হারানোর কেউ নেই”

*********

ইলহার এখন শেষ মাস চলে। দেখতে দেখতে ডিউ ডেট চলে এসেছে। পেটটা বড় হয়েছে বেশ। নড়তে পারে না। আল্ট্রাসোনোতে জানা গেছে মেয়ে হবে। রাশাদের মনের আশা অবশেষে পূরণ হবে। আতিয়া খাতুন মুড়ি মেখে আনলেন। ইলহা খেতে খেতে বললো,
“হুমায়রা কই দাদী”
“পরতাছে মনে হয়”

হুমায়রার এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন প্রাকটিক্যাল চলে। মেয়েটিকে যখন সেদিন রাশাদ বাড়ি নিয়ে এসেছিলো মেয়েটি নিশ্চুপ হেটে নিজ ঘরের ডোর দিয়েছিলো। সপ্তাহখানেক কারোর সাথে কথা বলে নি। যেনো শব্দরা সবাই ছুটি নিয়েছে। রাশাদও তাকে জ্বালাতে বারণ করলো। সপ্তাহ খানেক বাদে সে আবার উঠে দাঁড়ালো। কলেজে যেয়ে রেজিস্ট্রেশন করলো। কোর্টে যেইয়ে সাক্ষী দিলো। পরীক্ষাও দিলো। যেনো ইচ্ছে করেই ব্যস্ত রাখছে। ইলহাও ঘাটালো না। থাকুক না নিজের মতো। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শোনা গেলো বাহিরে। রাশাদ তখন বাড়িতে। সে বেরিয়ে আসলো। আগত মানুষটিকে দেখে সবাই যেনো হতবাক। সাড়ে তিনমাস পর আজ ফাইজান এসেছে এখানে।

*****

“আপনি জানেন আমার যে আপনাকে কখনো পছন্দ নয়”

রাশাদের কঠিন বাক্যে আতিয়া খাতুন অস্থির হন। ইলহাকে ফিসফিসিয়ে বলেন,
“তোমার বর এডি কিতা কয়”
“খারাপ তো বলে নি দাদী। ঠান্দা থাকেন”

ইলহা তাকে থামিয়ে দেয়। রাশাদের কথার প্রেক্ষিতে ফাইজানের ছোট্ট উত্তর,
“জানি”

রাশাদের কপালে ভাঁজ পরে। বিরক্ত হয় উত্তরে। তারপর বলে,
“আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে, এটা জানেন?”
“জানি”
“তাও এসেছেন আমার কাছে আমার বোনকে নিতে?”
“হ্যা। কারণ আমি জানি আপনি এগুলো কিচ্ছু করবেন না। করলে প্রতিরাতে আমার ফোন ধরতেন না। আমাকে হুমায়রার খোঁজখবর দিতেন না। আজকেও আমাকে আপনি ফিরাবেন না”

রাশাদের দৃষ্টির ধার কমে না। কিন্তু উপস্থিত বাকিদুজন অবাক হয়। রাশাদ আগের ঝাঁঝেই বলে,
“সেটা মোতেই আপনার জন্য নয়। আমি আমার বোনকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই না। এই যে আপনার মুখ ফা’টা’চ্ছি না সেটাও আমার বোনের জন্য। আপনাকে আমি শেষ সুযোগ দিচ্ছি ফাইজান সাহেব। এরপর আমার বোনের চোখের অশ্রু আসলে কিন্তু আপনার ভালো হবে না। আমি দেখবো না আপনি মন্ত্রী কি না”

ফাইজান হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“সেই সুযোগ দিচ্ছি না”

*****

হুমায়রা তার ঘরে পড়ছে। সামনে এডমিশন। ভাইজানের সাধ্য নেই তাকে দামী কোচিং এ ভর্তি করানোর। সামনে ইলহার ডেলিভারী। সেই টাকা আলাদা করে কোনো টাকাই থাকে না। তবুও ধার করে তাকে একটি ভালো কোচিং এ ভর্তি করিয়েছে সে। বোনের ইচ্ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলা নিয়ে পড়বে। সেই ইচ্ছে পূরণ করানোর যথাযথ চেষ্টা সে করছে। হুমায়রা তাই কোনো ছাড় দিচ্ছে না নিজ চেষ্টায়। ব্যাবহারিক পরীক্ষা শেষ না হলেও তার পড়া শুরু হয়ে গেছে। দরজায় করা নাড়লে সে মৃদু স্বরে বলে,
“দাদি রেখে দাও। আমি পরে খাবো”

মানুষটি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। বসলো খাটে। হুমায়রা তার পড়ায় ব্যস্ত। দাদী না খাইয়ে যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে সে বই বন্ধ করে দিলো।
“আচ্ছা দেও”

বলে পেছনে ফিরতেই থমকে গেলো সে। ফাইজান ঠিক তার মুখোমুখি বসে রয়েছে। হুমায়রা ভাষা হারিয়ে ফেললো। গত সাড়ে তিন মাসের জমানো অভিমানের প্রাচীরটা আবার নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করলো। গলার স্বরে কঠিন হলো। তবুও স্বাভাবিক ভাবে বললো,
“আপনি এখানে?”

নির্লজ্জভাবে ফাইজান বললো,
“আমার বউকে নিতে এসেছি”
“যাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন”

ফাইজানের কাছে উত্তর ছিলো না। হুমায়রা কঠিন স্বরে বললো,
“আপনি চলে যান। আমি যাব না কোথাও। যাবার সময় দরজাটা আটকে যাবেন। আমি পড়ছি। উঠতে পারবো না”

ফাইজান কাতর স্বরে বললো,
“আমাকে কি কিছু বলার সুযোগ দিবে না?”
“নাহ, ইচ্ছে বা সময় কিছুই নেই। যখন ছিলো তখন আপনি আমাকে বলেন নি। নিজের জেদ বজায় রেখেছেন। আমিও মানুষ আমারোও ভালোলাগা, মন্দ লাগা, নিজস্ব সিদ্ধান্ত আছে। সবসময় আপনার কথা মানতে হবে কেনো আমার? বিয়েটা কি শুধু একপাক্ষিক। আপনার মনে হয়েছে আপনি ভাইজানের সাথে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আবার আপনার মনে হচ্ছে এখন আপনি আমাকে নিতে চলে এসেছেন। আমি কি আপনার হাতের পুতুল? আমি পুতুল নই ফাইজান ইকবাল”

হুমায়রা কন্ঠ দলা পাকালো। অভিমানের প্রাচীর গলে অশ্রুতে পরিণত হচ্ছে। চাপা কষ্টগুলো যেনো এবার নিজের নিষ্পত্তি চায়। ফাইজান নতমস্তকে বসে রইলো। কোনো কথা বললো না। হুমায়রা ধৈর্য্যচ্যুত হল। ফলে বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ফাইজানের হাত ধরে টেনে তুললো সে। তারপর দরজার কাছে নিয়ে যেয়ে বললো,
“চলে যান। আর আসবেন না”

তার চোখজোড়া ভেঁজা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আর একটু দাঁড়িয়ে থাকলে নিজেকে আটকাতে পারবে না। সে লালিত প্রণয় নিজের রুপ দেখাবে। তাই টেবিলের দিকে পা বারায় সে। তখন ই পেছন থেকে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরে ফাইজান। হুমায়রা ছাড়াতে চাইলেও যেনো সেই বাঁধন আরোও দৃঢ় হয়। আকুল স্বরে বললো,
“আমার কেউ নেই হুমায়রা। আমি বড্ড একা। আমার তোমাকে চাই”

মানুষটি কাঁদছে। সত্যি মানুষটি কাঁদছে। যে ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলেও কাঁদে না সেই মানুষটি আজ সবচেয়ে অসহায় রুপে নিজেকে প্রকাশ করছে হুমায়রার কাছে। কেনো যেনো বুকটা ছ্যাত করে উঠলো হুমায়রার। মানুষটি তাকে রাশাদের সাথে পাঠিয়ে দেবার পরও যে তাকে নিজের দৃষ্টির আড়াল হতে দেয় নি হুমায়রা জানে। রাশাদের কাছে তার খবর নিতো। হুমায়রা এটা আবিষ্কার করে যখন রাশাদের ফোনের কললিষ্টে ফাইজানের নাম্বার দেখে। শুধু তাই নয়। কলেজে যাবার সময় প্রতিদিন দুটো মানুষকে দেখতো সে। তারা তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তার উপর নজর রাখতো। সিভিল ড্রেসে এই দুজন মানুষ যেনো প্রহরীর মতো হুমায়রাকে গার্ড দিত। তাই অভিমানের প্রাচীর ফাইজানের দৃঢ় আলিঙ্গনের উষ্ণতায় গলে যেতে লাগলো। নিজের অশ্রুও লুকানোর চেষ্টা করলো না হুমায়রা। উলটো ফাইজানকে জরিয়ে ধরে নিজের কষ্টগুলো উজার করে দিল। সময় কাটতে লাগলো সেই সাথে প্রণয়ের ধারে কমতে লাগলো হৃদয়ের দূরত্ব।

***

ফাইজান হুমায়রার হাত ধরে বসে রয়েছে। চোখজোড়া ফুলে গেছে দুজনের। হুমায়রা শুধালো,
“খেয়েছেন কিছু?”

ফাইজান মাথা নাড়িয়ে না উত্তর দিলো। গলা ভেঙ্গে গেছে। স্বর বের হচ্ছে না। নিজের কাজে নিজের হাসলো। নিচু স্বরে বললো,
“দৈত্যের গল্পগুলো আগে বানোয়াট লাগতো। এখন মনে হচ্ছে না, সেগুলো সত্যি। ফাইজান নামক দৈত্যের প্রাণ হুমায়রা নামক পাখির ভেতরে”

ফাইজানের কথায় হাসে হুমায়রা। হাসতে হাসতে ব্লে,
“মাথা আসলেই গেছে। তিন মাসে ঘুমান নি নাকি?”
“উহু, এক মুহূর্তের জন্য না। তোমাকে ছাড়া আমার যে ঘুম আসে না হুমায়রা”

হুমায়রা উত্তর খুঁজে পায় না। শুধু ঠোঁট বিস্তৃত হয়। তখন ই শোনা যায় ইলহার চিৎকার। তার লেবার শুরু হয়ে গেছে। এখনো তো সময় আছে। ব্যাথায় ইলহা নীল হয়ে যায়। ঘামতে থাকে সে। ফাইজান গাড়ি বের করে। এখন ই হাসপাতালে নিতে হবে। রাশাদ ইলহার মাথাটা নিজ কোলে শুইয়ে রাখে। হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“ভয় পাবেন না ইলহা, কিচ্ছু হবে না”

ওমা এতোক্ষণ চিৎকার করতে থাকা, ব্যাথায় কাতরাতে থাকা মহিলাটি শান্ত হয়ে যায়। রাশাদের হাত ধরে ব্যাথা সহ্য করে। ফাইজান অবাক হয়। মনে মনে চায়, একদিন হুমায়রার এমন ভরসার জায়গা হবে সে।

হাসপাতালে পৌছেই ওটিতে ঢোকানো হয় ইলহাকে। ফাইজানের ক্ষমতায় কোনো ত্রুটি করে না তারা। রক্তের ব্যবস্থা করাই থাকে। মিঠু রক্ত দেয়। অবশেষে আঁধা ঘন্টা পর বেরিয়ে আসে ডাক্তার। হাসি মুখে বলে,
“শুভকামনা মেয়ে হয়েছে। মা এবং বাচ্চা উভয় ই ভালো আছে”

দশ মিনিট বাদে একটি নিষ্পাপ কন্যা সন্তানকে রাশাদের হাতে দেয় নার্স। কি মায়াবী মুখাখানা। একেবারে ইলহার প্রতিচ্ছবি। রাশাদের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। সে আস্তে করে মেয়ের কানে আযান দেয়। ফাইজানের বাহু শক্ত করে ধরে হুমায়রা। তার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ফাইজান নিচু স্বরে বলে,
“একদিন আমাদের ঘরেও এমন নিশীভাতি আসবে”

রাশাদ তার মেয়ের নাম রাখে নুর। অর্থাৎ আলো। যে আলো তাদের জীবনের আঁধার শুষে নিবে। কেবিনে ইলহাকে দেওয়া হয় তিন ঘন্টা পর। তার জ্ঞান ফিরেছে কেবল। চোখ মেলতেই চমৎকার একটি দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে। রাশাদের কোলে একটি ছোট্ট শিশু। কি সুন্দর সেই শিশু। না চাইতেও অশ্রু ভিড়ে নয়নে। রাশাদ তার কাছে এগিয়ে আসে। পাশে বসে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার জীবনে নিশীভাতি হয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে নুর দেবার জন্য ধন্যবাদ”

ইলহা হাসে। নুর কেঁদে উঠে। তার এখন মায়ের স্পর্শ চাই। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। হাসপাতালের করিডোরে হাতে হাত রেখে হাটতে থাকে ফাইজান এবং হুমায়রা। এমন একটি হাসপাতালেই তাদের প্রথম দেখা। অপছন্দের মানুষ হিসেবে অনুপ্রবেশ হলেও আজ সে জীবনের অনবদ্য অংশ। হুমায়রা হেসে উঠে। ফাইজান শুধায়,
“হাসছো যে?”
“এমনি। চা খাবেন?”
“তুমি খাবে?”
“হু, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চলুন ভিজি”
“বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হবে”
“আপনি আছেন তো, একটু সেবা করে নিবেন। পারবেন না?”

ফাইজান উত্তর দেবার আগেই অষ্টাদশী তাকে টেনে নিয়ে যায়। আসলেই বৃষ্টি হচ্ছে, মনখারাপের মেঘগুলো বারিরুপে গলে পরছে ধরনীতে। কি অপূর্ব তাদের পতন। সেই পতনের লতাগাছের মতো একটি মেয়ে ভিজছে। ফাইজান এগিয়ে গেলো। দু হাতে তার মুখখানা আগলে ধরলো। বিনা সংকোচে বললো,
“ভালোবাসি নিশীভাতি”

||সমাপ্ত||

[নভেম্বরে যাত্রা শুরু করেছিলাম হুমায়রা, রাশাদ, ইলহা এবং ফাইজানকে নিয়ে। নিজেও জানি না এই গল্পটাকে ঠিক কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। আজ অবশেষে গল্পটা ইতি টানলাম। এর মাঝে আম্মু দ্বিতীয়বার অসুস্থ হলো, আমি আমার মাস্টার্স শেষ করলাম, আমার আব্বু অসুস্থ হলো। অনেক অনেক গ্যাপ নিয়েছি। এটা আমার লেখা সবচেয়ে বড় গল্প। সর্বাধিক সময় নিয়ে লেখা গল্প। সাত মাস যাবৎ লিখেছি একটা গল্প। তবে গল্পের শেষে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। ধন্যবাদ এই সাত মাস আমার সাথে থাকার জন্য। ইনশাআল্লাহ আবার কোনোদিন ফিরে আসবো কোনো গল্প নিয়ে]

মুশফিকা রহমান মৈথি

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here