নিশীভাতি #৫৫তম_পর্ব

0
399

#নিশীভাতি
#৫৫তম_পর্ব

গভীর রাত। আঁধার গিলে ফেলেছে রুপালী চাঁদকে। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। সেই ভয়ানক ডাক রাতের রহস্যপু্রীতে ভয় মিশিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ নেই। হারিকেনের ধিকধিক আলোয় পড়ছে হুমায়রা। আগামী পরশু পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফরিদের নাম ভেসে উঠেছে। ফোনটা ধরতেই ফরিদের অস্থির কন্ঠ কানে এলো,
“ফাইজানের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে হুমায়রা। ফাইজানকে কারা যেনো শুট করেছে! গুলি একেবারে হার্টের পাশ থেকে চলে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি”

ফরিদের কাঁপা স্বরের কথাগুলো যেনো মস্তিষ্ক অনুধাবণ করতে পারলো না। স্তব্ধ বসে রইলো হুমায়রা। মাথাটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। মনে হলো শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখছে। যে স্বপ্ন থেকে খুব তাড়াতাড়ি ওঠা উচিত, নয়তো সেই স্বপ্ন হুমায়রাকে গিলে খাবে। ফলে বিমূঢ় স্বরে শুধালো,
“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”

ফরিদ অপরাধী কন্ঠে বললো,
“আমারো এটাই আফসোস আমি মজা করছি না। আমি এড্রেস পাঠিয়ে দিচ্ছি। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি আমি”

ফরিদের কন্ঠ এখনো কাঁপছে। সে ফোন কেটে দিলো। একটু বাদেই একটা ম্যাসেজ এলো। হাসপাতালের এড্রেস দেওয়া। ইতোমধ্যে হুমায়রার দরজায় ক্রমাগত করাঘাত পড়ছে। রাশাদের উদ্বিগ্ন স্বর কানে আসছে। হুমায়রার মনে হলো পাজোড়া ভারী হয়ে গেছে। কেউ যেনো টন ওজনের পাথর লাগিয়ে দিয়েছে পায়ে। দশ কদমের দরজাটাও দশ কিলোমিটার মনে হলো। হুমায়রা দরজা খুলতেই দেখলো রাশাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখখানা শুকনো। হাতে মোবাইল, সেখানে একজন নারী সংবাদপাঠক বলছেন,
“রাজধানীর ভাড়া বাসায় ডেলিভারি ম্যানের বেশে এসে তথ্য এবং সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ফাইজান ইকবালকে গুলি করে হত্যা করার প্রচেষ্টা, বিস্তারিত রিপোর্ট জানাচ্ছেন আমাদের সাংবাদিক নুরুল ইসলাম…………”

ফরিদ মিথ্যা বলে নি। সত্যি ফাইজানের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। হুমায়রা শরীরের ভার নিতে পারলো না। ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে। রাশাদ দ্রুত পায়ে বোনকে ধরলো। হুমায়রা জড়ানো স্বরে বললো,
“ভাইজান, রাতেও উনার সাথে কথা হইছে। উনি আমাকে বললো জানো, ভালো করে পড়ো, প্রেসার নিবে না একদম। ঘুমের অবহেলা করবে না। এটুকু সময়ে কি থেকে কি হয়ে গেলো?”

রাশাদ বোনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। হুমায়রা কাঁপছে। তার চোখজোড়া টলমল করছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে বড় বড় করে। ইলহা এলো একটু বাদেই। শোয়া থেকে উঠতে কষ্ট হয় এখন খুব। খবরটা দেখে তারও আত্মা কেঁপে উঠলো। হুমায়রা নিজেকে সামলাতে পারছে না। কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছে। রাশাদ বোনের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে বললো,
“ফাইজান সাহেবের কিচ্ছু হবে না। উপরে একজন আছে। তুই শুধু তার কাছে প্রার্থনা কর”

হুমায়রা এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ফাইজান নামক মানুষটি তার জীবনের সাথে এমনভাবে মিশে আছে যে তাকে বাদে জীবন কল্পনা করতেও ভয় পায় হুমায়রা। মুখে স্বীকার না করলেও এটাই সত্য যে সে ফাইজানকে প্রচুর ভালোবাসে। মানুষটি তার জীবনে বটবৃক্ষের মতো নিজের ছায়া বেষ্টন করে রেখেছে। হুট করে সেই ছায়া ব্যতীত তার জীবনটা কল্পনাও করতে পারে না হুমায়রা। রাশাদ বোনকে আগলে ধরে রইলো। হুমায়রা কাঁধছে। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো সে। কিন্তু অশ্রু বাঁধ মানছে না। এক ঘন্টা পর গাড়ি এলো। রাশাদ এবং হুমায়রা গাড়িতে উঠলো। ইলহা গেলো না। কারণ আতিয়া খাতুন এখনো কিছুই জানেন না।

হুমায়রা সকল ঢাকায় পৌছালো তখন পশ্চিম আকাশে কেবল আলোর রশ্নি দেখা যাচ্ছে। নরম সমীরণে শহরটিকে স্বচ্ছ দেখাচ্ছে। এই শহর কখনোই ঘুমায় না। সকালের কিরণ প্রকাশের পূর্বেই মানুষ রাজপথে নামে নিজ কাজে। ঝাড়ুদারেরা ঝাড়ু দিচ্ছে। গাড়ি চলছে টুকটাক। শ্রমিকেরা রাস্তার ধারে কাজের খোঁজে প্রতিক্ষিত। হুমায়রার শুন্য নয়ন পিচঢালা রাস্তায়। ফাইজান বলেছিলো,
“তোমার পরীক্ষা শেষ হলে তোমাকে ঢাকায় নিয়ে আসবো। তুমি এখানে পড়াশোনা করবে”

কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিগুলো এখনো ফাঁকা আওয়াজ। গাড়ি থামলো দশ তালা উচ্চ এক হাসপাতালের সামনে। পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং। সাংবাদিকের ঢল সেখানে, পুলিশের দু-তিনটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে। হাসপাতাল গার্ড তাদের আটকাতে পারছে না। যতই হোক, সাতসকালের এটাই তো ব্রেকিং নিউজ। ফরিদকে ফোন করলে সে পেছনের একটি রাস্তা দিয়ে গাড়িটি প্রবেশ করতে বলল। রিসিপসনে সাংবাদিকেরা গিজগিজ করছে। একটা সংবাদ পাবার প্রতীক্ষায় তারা গতকাল রাত থেকেই এখানে বসে আছে। ফাইজানের অপারেশন হয়েছে খুব দ্রুত। কিন্তু এখনো ডাক্তার কিছু জানাচ্ছে না। প্রায় ছয় ঘন্টা হয়ে চললো ঘটনার। হুমায়রাকে যখন জানানো হয়েছে তখন ফাইজানকে অলরেডি হাসপাতালে না হয়ে গিয়েছিলো। করিডরে যেতেই শরীফাকে দেখতে পেলো হুমায়রা। শাশুড়ীকে দেখেই ছুটে জড়িয়ে ধরলো সে। শরীফা শক্ত হয়ে বসে ছিলেন। তিনি এক ফোঁটা অশ্রুও ফেললেন না। খুব শক্ত গলায় বললেন,
“হুমায়রা শক্ত থাকো মা, এটা পরীক্ষা চলছে। আমিও দিয়েছি। এখন তোমার পালা”

শরীফার দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকাল হুমায়রা। শরীফা তার অশ্রু মুছে দিলো। হাতদুটো শক্ত করে ধরলো। আশ্বাস দিলেন যেনো ফাইজানের কিচ্ছু হবে না। এদিকে রাশাদ শুধালো,
“এসব হলো কি করে? সিকিউরিটি ছিলো না বাসায়?”

ফরিদ নত মস্তকে অপরাধী স্বরে বললো,
“ছিলো”
“তাহলে?”

ফরিদ নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে এতো কিছু হয়ে গেল। দেলোয়ার সাহেব যাবার পর, তার সাথে ফাইজানের সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। ফাইজান বরাবরই নিজ মর্জির মালিক। সে নিজের মর্জি ব্যতীত কোনো কাজ করে না। তাই মনোক্ষুদ্ধ হয় ফরিদ। তর্ক করবে না বলেই সে বেরিয়ে হবে বাসা থেকে। যাবার সময় বলে বের হয়,
“আমি রাতে ফিরবো না”

এই ঘরটা ফাইজানের ভাড়া বাসা। ঢাকা আসলে এই বাসায় ই উঠে সে। ফরিদও থাকে তার সাথে। একটা কাজের লোক আছে ছোটা। সে কাজ করে চলে যায় সন্ধ্যার সময়। আজ সেই ছেলেটি আসে নি। ঘরে রান্নাও ছিলো না। তাই খাবার বাহির থেকে অর্ডার করে ফাইজান। ডেলিভারি বয় বিধায় দারোয়ানও তাকে বাধা দেয় নি। দুর্বৃত্ত সেই সুযোগ নিয়ে উপরে যায়। ফাইজান দরজা খুলতেই তাকে শুট করে। একটি গুলো তার বাহুতে লাগে। আরেকটি হার্টের ঠিক পাশ দিয়ে। ভাগ্য ভালো ছেলেটি নিশানা মোটেই সঠিক ছিলো না। নয়তো ফাইজানকে হাসপাতাল অবধি আনা যেনো না। যেহেতু বন্ধুকে সাইলেন্সার ছিলো না। গুলির শব্দে বিল্ডিং এর সবাই সজাগ হয়ে যায়। দারোয়ান ছুটে উপরে আসে। তাকে ধাক্কা দিয়েই শুটার পালায় সিড়ি দিয়ে। দারোয়ান ই তখন ফরিদকে ফোন করে। ফরিদ যতক্ষণে আসে ততক্ষণে এম্বুলেন্স চলে আসে। হাসপাতালে আসার পথেই সে শরীফা এবং হুমায়রাকে ফোন করে জানায়। কিভাবে এর মধ্যে প্রেস জেনে গেছে কেউ জানে না। পুলিশ, প্রেস একাকার অবস্থা হাসপাতালে। এদিকে এখনো অবধি ডাক্তার কিছুই জানাচ্ছেন না। অপারেশন তো সাক্সেসফুল হয়েছে। তবে তারা এখনো কোনো আপডেট কেনো জানাচ্ছে না এটাই কেউ বুঝছে না। মিনিট ত্রিশেক বাদে পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারে অস্থিরতা দেখা গেলো। একজন নার্স ছুটতে ছুটতে বের হলো ডাক্তারকে ডাকার জন্য, রাশাদ তাকে আটকাতেই জানালো,
“প্যাশেন্টের অবস্থা ভালো নেই”……………

চলবে

[আসসালামু আলাইকুম, অবশেষে পাঁচদিন পর গল্প দিচ্ছি। গত চারদিন আমি প্রচন্ড অসুস্থ ছিলাম। জ্বর হয়েছিলো। জানিনা করোনা না টাইফয়েড। বাট খুব বাজে জ্বর ছিলো। আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলাম না। শুধু আমি না, আমার পুরো পরিবার শুদ্ধ জ্বরে ভুগেছি। তাই গল্প দিতে পারি নি। আজও খুব বেশি সুস্থ নই। তবুও ছোট একটি পর্ব দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল বড় পর্ব দিবো]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here