নিশীভাতি #৬০তম_পর্ব

0
166

#নিশীভাতি
#৬০তম_পর্ব

ভোরের তীব্র সূর্যালোক গ্রামের মানুষের মাঝে ভীতির জন্ম দিলো। গ্রামের মরা পুকুরের পাড়ে জড় হয়েছে জনভীড়। সকলের মুখে আতংক, মিচমিচে কালো ত্রাস। কি বিশ্রী ভয়ংকর দৃশ্য। সাহসী কিছু মানুষ তা দেখছে, অনেকেই লোমহর্ষক দৃশ্যটি দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এক বৃদ্ধা তো হরহর করে বমি অবধি করে দিয়েছে। কারণ মরা পুকুরের কুচুরিপানার ধারে অবহেলায় পড়ে আছে কাওছারের ত্রিখন্ডিত লাশ। বড় নৃশংসতার সহিত তিন ভাগ করে গ্রামের মরা পুকুরে ফেলে গেছে তাকে। এই পুকুরে মানুষ ময়লা ফেলে বিধায় পানি অপরিষ্কার। এই পানি ব্যাবহার অযোগ্য। নামায শেষে পুকুরের দক্ষিণ ঘরের বউ এসেছিলো ময়লা ফেলতে। সেই প্রথম দেখেছে এই দৃশ্য। চিৎকার করে জায়গায় জ্ঞান হারালো সে। তার চিৎকার আশেপাশের মানুষ জড় হলো। কাওছারের নিথর মাথাখান দেখে চিনতে পারলো মানুষটি যে কাওছার। অনেকে লাশ দেখে “আহারে” বললো। সাথে সাথে সকালের তপ্ত কিরণের ন্যায় গ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো “শামসু মিঞার পোলা কাওছাররে কেউ মারি লাইছে”

বাতাসের মৃত্যু গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো বাড়ি অবধি। মিঠু ছুটতে ছুটতে এলো বাড়িতে। চেঁচিয়ে ডাকলো রাশাদকে। মিঠুর ডাক শুনে বেরিয়ে আসলো হুমায়রা এবং আতিয়া খাতুন। আতিয়া খাতুন তখন রুটি ভাজছিলেন। তাওয়ায় রুটি ফেলেই সে বেরিয়ে এলো। মিঠু হাপাতে হাপাতে বলল,
“দাদী, গজব হইছে”

তার রক্তশূন্য মুখখানা দেখে হুমায়রা তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে এলো। গ্লাস এগিয়ে বললো,
“আগে পানি খা তুই”

এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করলো সে। তবুও তার মুখশ্রী থেকে সন্ত্রাশ কাটলো না। দাওয়ায় বসলো একটু। হাটু কাঁপছে। কারণ নৃশংস দৃশ্যটি সেও তো দেখেছে। হুমায়রা ব্যাগ্র কন্ঠে শুধালো,
“গজব কি হইছে সেটা তো কও”
“কাওছার কাকা মরে গেছে। কেউ তারে কাইটা মরা পুকুরে ভাসায় দেছে”

মিঠুর কথা শেষ হবার আগেই আতিয়া খাতুন দপ করে বসে পড়লো। তার মুখে কোনো কথা নেই। এই মুহূর্তে ঠিক কিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে বৃদ্ধার মস্তিষ্ক তা অনুধাবণ করতে পারছে না। শুধু কাওছারের মুখখানা ভাসছে চোখের সম্মুখে। এর মাঝেই চোখ ডলতে ডলতে শার্টটা গায়ে গলাতে গলাতে বেরিয়ে এলো রাশাদ। চোখজোড়া তার লাল হয়ে আছে। বিনিদ্র রাতের প্রমাণ তার শান্ত রক্তিম চক্ষুদ্বয়। ঘুমজড়ানো স্বরে শুধালো,
“কি হয়েছে রে মিঠু?”
“কাওছার কাকারে কারা যেনো মাইরে ভাসায় দেছে”

রাশাদ কিছু সময় চেয়ে রইলো মিঠুর দিকে। ভাবলো ছেলেটা সাতসকালে ফাজলামি করছে? কিন্তু না এটাই যে নির্মম সত্য। আতিয়া খাতুনের চোখ থেকে পানি পড়ছে। মনে হলো তার বুকখানা কেউ খামছি দিয়ে ছিড়ে ফেলেছে। সন্তান নিকৃষ্ট হলেও তো সে তার মা, মা কি সন্তানের মৃত্যু কামনা করতে পারে? ফাইজান বের হলো সবার পরে। ঘটনায় তাকে দেখালো একেবারে স্বাভাবিক। তার মাঝে বিস্ময়ের রত্তিভর অস্তিত্ব নেই, যেনো এটা তার জানাই ছিল।

********

কাওছারের মৃত্যুর খবর চেয়ারম্যান বাড়ি অবধি গেলো। দেলোয়ার সাহেব বিশ্বাসই করতে চাইলেন না। বাহিরের সোরগোলে না চাইতেও ঘুম থেকে চোখ ডলতে ডলতে বের হলো আমান। কাজের মেয়ের মুখে বর্ণনা শুনে তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। গায়ে কাঁটা দিলো ভীতিহিম। কাল রাত বারোটা পর্যন্ত এই বাড়িতেই সে মদ খেয়ে প্রলাপ বকেছে। আমান যদিও তার কাজে বিরক্ত ছিলো। কারণ অতিরিক্ত কথা বলার জন্য তাদের প্লান ভেস্তে গেছে। তার পরিকল্পনা ছিলো কোনো মতে রাশাদদের বাড়িতে কাওছারকে ঢুকিয়ে দিবে। সামনের বৃহৎ পরিকল্পনার জন্য রাশাদদের বাড়িতে কাওছারের থাকা প্রয়োজন। কিন্তু লোকটার বেকুবপনা আর ফাইজানের বুদ্ধিমত্তার কাছে চালটা একেবারে ফিকে হয়ে গেলো। রাগ বেশিক্ষণ অবধি দেখাতেও পারলো না, দু বোতল কেরু শেষ করার পর তাদের বনিবনাও হয়ে গিয়েছিলো। তন্দ্রালু মস্তিষ্কে কাওছারের মৃত্যুর খবরে সে যেনো ভীষনভাবে বিস্মিত হয়েছে। চোখে মুখে অবিশ্বাস। দেরি না করেই বাসি মুখে ছুটলো খুনের জায়গায়।

এতোক্ষণে গ্রামের প্রতিটি প্রাণ উপস্থিত হলো ঘটনাস্থলে। দেলোয়ার সাহেব পুলিশ খবর দিলেন। তদন্ত শুরু হলো মরা পুকুর থেকে। গতরাতে বিনা নোটিশেই বর্ষণ হয়েছে। ফলে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলো না। বর্ষণের লীলা রক্ত অবধি ধুয়ে গেছে। আর মরা পুকুরে সর্বদা জঞ্জালের বাস। তাই অনেক খোঁজাখুজির পরও এসআই এর হাতে কিছু মিলল না। আমানের গা কাঁপছে। খুন সেও করেছে, কিন্তু এতোটা নৃশংসভাবে কেউ কিভাবে হত্যা করে? খুব ধারালো কিছু দিয়ে নয় বরং ভোঁতা অস্ত্রের ব্যাবহারে কেঁটেছে সে লাশ। এতোটা সময় সে কি করে পেলো? কোনো তাগড়া মানুষ ছাড়া এটা সম্ভবই নয়। আমানের সাথে কথা বললো পুলিশ। কাওছার এখন আমানদের বাড়ির পেছনের লাগোয়া ঘরে থাকে। গতরাতে সে কখন বের হয়েছে, তার সাথে তার কি সম্পর্ক এই সব কিছুই নিপুন ভাবে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জানলো পুলিশ। অতঃপর রাশাদের নিকট শুধালো,
“আপনার আব্বার কোনো শত্রু ছিলো কি?”

সাথে সাথেই আমান বলে উঠলো,
“সবচেয়ে বড় শত্রু তো ও নিজেই। ওই খু/ন করেছে কি না কে জানে?”

আমানের কথায় ফাইজান বেশ বিরক্ত হলো। দেলোয়ার সাহেবও ছেলেকে থামানোর চেষ্টা করলেন। অহেতুক কথা বলার তো কিছু নেই। ফাইজান গম্ভীর স্বরে বললো,
“অফিসার, আপনার দায়িত্ব তদন্ত করা, দোষীকে ধরা। একজন অর্ধমাতালের বক্তব্য সেই কাজে কতটা সাহায্য করবে আমি জানি না। নিজেই ভেবে দেখুন একজন ছেলে কেনো তার বাবাকে খু/ন করবে? কিসের লোভে? কি মতলব? এই প্রশ্নের উত্তর পেলেই দেখবেন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে”

ফাইজানের সামনে এস.আই “জ্বি স্যার, হ্যা স্যার” ছাড়া কিছু বলার সুযোগ পেলো না। রাশাদ ফাইজানের দিকে চাইতে সে হাসলো। যার অর্থ, “চিন্তা করবেন না”।

এদিকে আমান ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফাইজানের দিকে। এই কাঁটাটা না সরানো অবধি শান্তি মিলছে না তার।

*******

কাওছার নামক মানুষটি পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেছে আজ চারদিন। ধরণীর মানুষেরা তাকে ভুলতে বসলেও কিছু মানুষের কথার মাঝে সে বেঁচে আছে। আর কিছু মানুষের স্মৃতিতে সে বেঁচে আছে। হুমায়রা এবং রাশাদের অবস্থাটি এর কোনো ভাগের মাঝেই পড়ে না। কারণ তাদের স্মৃতি কাওছারকে নিয়ে খুব বাজে, তার কথা, কাজ প্রতিটি স্বভাব তাদের কষ্ট, দূর্ভোগ ছাড়া কিছুই দেয় নি। আজও তার স্মৃতিতে সেই কালো রাতের কথা স্পষ্ট যেদিন এই বাবা নামক মানুষটি তার ঘরে রাতের আঁধারে একটি পরপুরুষকে পাঠিয়েছিলো মাত্র বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে। বাবা শব্দের প্রতি সেই রাতে ঘৃণা জন্মেছিলো তার। তাই কাওছারের মৃত্যুতে তার চোখে পানি আসে নি। তবে আক্ষেপ হয়েছে খুব। আক্ষেপ পিতার অভাবে। কাওছার যদি আর পাঁচটা বাবার মত হতো তাহলে তাদের জীবন হয়তো ব্যতিক্রম হতো। অবশ্য যা হয় নি তা নিয়ে চিন্তা করাটাও হাস্যকর। রাশাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আকস্মিক মৃত্যু তাকে চমকালেও দুঃখের আভাস পায় নি। কারণ যে মানুষ জীবিত থাকতে কষ্ট দেয় তার জন্য মৃত্যুর পর দুঃখ আসে না। বাড়ির সব প্রাণ স্বাভাবিক থাকলেও আতিয়া খাতুনের কষ্টটা চাপা থাকছে না। স্বামীকে হারিয়েছেন মাস গড়াতেই ছেলের এমন মৃত্যু। এই দুঃখটাও বিচিত্র প্রকৃতির। আক্ষেপ, গ্লানি, অপরাধবোধ, মমতা সবকিছু যেনো মিশ্রিত। রাশাদ বাড়ি ফিরলেই তিনি শুধান,
“কোনো খবর পাইলি? থানা থেকে লোক আইছিলো?”

রাশাদ শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,
“না দাদী”

*****

কাঁচের ধার গলে কড়া রোদ প্রবেশ করছে কেবিনে। ইলহা ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারের উপর ছেড়ে দিয়েছে। মস্তিষ্ক আজকাল বেশ ক্লান্ত। সেই সাথে শরীরও। পেটটা বাড়ছে, সেই সাথে আতংক, ভয়ও বাড়ছে। চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। এসব হরমোনাল ব্যাপার স্যাপার। ইলহা বুঝে। যেমন গত চারদিও যাবৎ তার মস্তিষ্কে একটাই চিন্তা। কাওছারের মৃত্যুর রাতে রাশাদ কোথায় ছিলো? সেদিন রাতে অনেক রাত অবধি জেগে ছিলো ইলহা। ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে বারবার দেখছিলো বাড়ির প্রবেশদ্বারে। হুমায়রা, আতিয়া খাতুন, ফাইজান সবাই যখন ঘুমে ইলহা তখনও সজাগ। চিন্তা হচ্ছিলো। ফোন করছিলো মানুষটির ফোনে কিন্তু মানুষটি ধরে নি। মানুষটি যে ধাক্কা খেয়েছে সেটা সয়ে নেবার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন জানে ইলহা। কিন্তু মানুষটির সাথে সংসার তো কম দিনের নয়। সে জানে তার শেষ ঠিকানা এই বাড়ি। একটা সময় ক্লান্ত শরীর আর জেগে থাকতে পারলো না। সকালে উঠতেই প্রথম চিন্তা হলো মানুষটি। পাশ ফিরতেই দেখলো রাশাদ ঘুমিয়ে আছে। তার ঘুমন্ত মুখখানা দেখতেই উদ্বিগ্ন, ব্যাকুল হৃদয় শান্ত হয়ে গেলো ইলহার। কিন্তু সেই শান্তি স্থায়ী হতে পারলো না কাওছারের মৃত্যু সংবাদ শুনে। কেনো যেনো বারবার ভয় হচ্ছে, রাশাদের উপর আবার কোনো বিপদ না আসে।

এর মাঝে নার্সের ডাক পড়লো। সে ছুটে এসে জানালো, ১৪১৩ নম্বর রোগীর অবস্থা ভালো নেই। কথাটা শুনতেই বুক ধক করে উঠলো ইলহার। তাড়াতাড়ি উঠতেও পারলো না। শরীর ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। নার্স এসে তাকে ধরলো। বললো,
“ম্যাডাম আস্তে উঠুন”
“স্যারকে খবর দিয়েছো?”
“হ্যা, ম্যাডাম”

সাথীর অবস্থা ভালো নয়। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। হাতে পায়ে পানি চলে এসেছে। অথচ গত পরশুই তাকে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়েছে। সে খাওয়া দাওয়াও করছে না ঠিক মত। স্যাচুরেশন একেবারেই ব্যালেন্স হচ্ছে না। তার হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও কমে গেছে। ব্লাড দিতে হবে। ইলহা নার্সকে বললো,
“ডায়ালাইসিস দিতে হবে, তুমি ব্লাড ব্যাংক এ খোঁজ নাও। ব্লাড লাগবে এবি পজেটিভ। আমি স্যারের সাথে কথা বলছি”

ডাক্তার এলেন দুঘন্টা পর। কিছু ঔষধ দিলেন। ডায়ালাইসিসের ব্যাবস্থা করতে বলেছেন তিনি। কিন্তু বিপদ হলো ডোনার নিয়ে। কাজের মেয়েটি কোনো রুপ সাহায্য করতে পারলো না। কারণ সেই ক্ষমতা তার নেই। সে শুধু তার মালিককে ফোন করে জানালো এখানের অবস্থা। মালিক হয়তো বিপরীতে না বোধক কোনো উত্তর পাঠালো। ইলহা তখন বললো,
“আমার ব্লাড গ্রুপ সেম। আমি ব্লাড দিচ্ছি”

সাথে সাথেই নার্স বললো,
“ম্যাডাম আপনার বাইশ সপ্তাহ চলে এখন ব্লাড দেওয়া ঠিক হবে না। আমরা ম্যানেজ করার ট্রাই করছি”

কিন্তু এবি পজেটিভ ব্লাড ম্যানেজ করা বেশ ঝামেলা হলো। ব্লাড ছাড়া ডায়ালাইসিসও দেরি হচ্ছে। এদিকে ইলহার অস্থিরতাও বাড়ছে। উদ্বিগ্নতা ছড়িয়ে পড়ছে চোখে মুখে। তার অস্থিরতা সকলের চোখেও পড়ছে। কিন্তু কারণটা কেউ ধরতে পারছে না। সে বহুবার বলছে সে ব্লাড দিবে, কিন্তু কেউ দিচ্ছে না। অবশেষে একটি ওয়ার্ড বয় বললো,
“ম্যাডাম আমি রক্ত দিতাছি, আপনি অস্থির হইয়েন না”

ইলহার মনে হলো তার প্রার্থনা অবশেষে যেনো। অবশেষে সাথীর ডায়ালাইসিস সম্পন্ন হলো। তবে এটুকু বুঝতে বাকি রইলো না সাথীর শরীরের অবস্থা ভালো হবার নয়।

*******

বিকালের তপ্ত রোদ আঙ্গিনায় এসে ছড়িয়ে পড়ছে। ধান বিছিয়ে রাখা আঙ্গিনাময়। এমন সময় এস.আই এর আগমন ঘটলো। হুমায়রা তখন আতিয়া খাতুনের সাথে ধান ছড়াচ্ছিলো। পুলিশকে দেখতেই কিছুটা অবাক হলো তারা। ইলহা বাসায় আসে নি। রাশাদ তখনো দোকানে। ফাইজান শহরে গিয়েছে পার্টির কাজে। তাদের দেখে হুমায়রা শুধালো,
“কি চাই আপনাদের?”
“রাশাদ সাহেব কোথায়? উনাকে একটু আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে”………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here