নিশীভাতি #৬৩তম_পর্ব

0
164

#নিশীভাতি
#৬৩তম_পর্ব

ফাইজান ফোনটি ধরতেই আতিয়া খাতুন বৃদ্ধ স্বর কানে আসলো,
“জামাই, বুবু তো বাড়ি ফিরে নাই এখনো”

ফাইজানের কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ পড়লো। গাঢ় স্বরে শুধালো,
“ও কি কলেজে গিয়েছে? একা গিয়েছে?”
“কলেজে যায় নাই, তোমার কাছে গেছে। তুমি না গাড়ি পাঠাইলে?”

ফাইজান একটু সময় নিলো। কপালের ভাঁজ আরোও তীক্ষ্ণ হলো। অবাক স্বরে শুধালো,
“আমি গাড়ি পাঠিয়েছি?”
“হ, পোলাডা তো সেইডাই কইলো। হুমায়রা তো ওর গাড়িতেই উঠিছে”

ফাইজান সাথে সাথেই ফরিদের দিকে চাইলো। ক্ষীণ স্বরে শুধালো,
“তুমি কি গাড়ি পাঠিয়েছো ফরিদ ভাই?”

ফরিদ মা নাড়িয়ে “না” বোধক উত্তর দিলো। ফাইজানের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। শীতল স্বরে বললো,
“আচ্ছা গাড়ি কখন এসেছিলো?”
“এই তো দু ঘন্টা তো হইবোই। কালা গাড়ি, এক্কেরে তোমার মতো গাড়ি। পোলাডারেও বুবু চেনে”

ফাইজান কিছুসময় ভাবলো। তারপর আশ্বাস দিয়ে বললো,
“দাদী, আমি দেখছি। ইনশাআল্লাহ হুমায়রা পৌছে যাবে। চিন্তা করবেন না”

বলেই ফোন রেখে দিলো ফাইজান। ফরিদ ফোন রাখার সাথে সাথেই বলল,
“আমি তোমাকে এটাই ইনফর্ম করতে এসেছি। হুমায়রার ভাবী আমাকে ফোন করেছিলো। তিনিও একই কথা বলেছে তুমি নাকি গাড়ি পাঠিয়েছো। ফাইজান আমার মনে হয় হুমায়রা বিপদে পড়েছে। ওর ফোন কিন্তু বন্ধ”

ফাইজান ফরিদের কথা শুনছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। একটা কথা মাথায় আসছে না, যেখানে সে হুমায়রাকে বারণ করে দিয়েছে কলেজ ছাড়া কোথাও না যেতে তাহলে সে কেনো গিয়েছে! হুমায়রা অবাধ্য মেয়ে নয়, সে না জেনে বুঝে কখনো কাজ করে না। তাহলে যে কেউ এসে ফাইজানের নাম নিলেই সে কেনো সেই গাড়িতে উঠে পড়বে? হুট করেই স্মরণ হলো, মিটিং এ থাকতে ফোন ভাইব্রেট করছিলো বেশ কয়েকবার। ফাইজান দ্রুত ফোনটা হাতে নিলো। কললিস্ট চেক করতেই দেখলো চারবার ফোন করেছে হুমায়রা। একের পর এক মিটিং এ থাকায় ফোন হাতেই নিতে পারে নি ফাইজান। হঠাৎ একটা নোটিফিকেশনে চোখ আটকে গেলো। হুমায়রা ম্যাসেজ করেছে। ম্যাসেজ অন করতেই সেখানে পর পর দুটো ম্যাসেজ লেখা। প্রথমটি ছিলো,
“মা ফোন করেছিলো, ভাইজানকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেটা শুনতেই তিনি বিচলিত হয়ে গেছে। সে রাতে নাকি ভাইজান তার সাথে ছিলো। সে সাক্ষী দিতে রাজী। এখন ই পুলিশ স্টেশনে যেতে চায় সে। আমাকে বলেছে দেখা করতে। সে শহর থেকে আসছে”

দ্বিতীয়টি হলো,
“গাড়ি চলে এসেছে। আমি বের হচ্ছি”

ম্যাসেজগুলো দেখা মাত্রই যেনো সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো ফাইজানের কাছে। হুমায়রা তাকে ফোনে না পেয়ে ম্যাসেজ করেছিলো। তাই যখন গাড়ি এসে বলেছে তখন হুমায়রা ভেবেই নিয়েছে ফাইজান ম্যাসেজ দেখেই গাড়ি পাঠিয়েছে৷ আর যে ছেলেটি গাড়ি নিয়ে গিয়েছে সে তার পরিচিত। তাই সন্দেহ করার কোনো অবকাশ ছিলো না। এদিকে ফরিদ এখনো বিচলিত। ফাইজানের এই শান্ত রুপ তাকে বিরক্ত করছে। সে ব্যস্ত গলায় বললো,
“তুমি কি বসে থাকবে? আমাদের হুমায়রাকে খোঁজা প্রয়োজন”

ফাইজান এবারো উত্তর দিলো না। সে মোবাইলে শুধু কিছে দেখতে ব্যস্ত। যা ফরিদকে আরোও বেশি বিরক্ত করছে। ফরিদ অধৈর্য্য হচ্ছে। ফাইজান তার কথা অগ্রাহ্য করে কাউকে ফোন করলো। তারপর খুব শান্ত গলায় বললো,
“ঢাকা মেট্রো ১৩-৫৬৪৮ গাড়িটি এখন শহরের বাহিরে আছে। হাইওয়ে থেকে বিশ কিলো ভেতরে। আমি লোকেশন পাঠাচ্ছি, আপনারা ফোর্স নিয়ে আসুন। আমার মনে হয় প্লেসটা কেতাব চৌধুরীর ফার্ম হাউজ। আর রাশাদ সাহেবকে একটা নিরাপদ জায়গায় শিফট করুন। উনাকে ফোন, টিভি এগুলো থেকে দূরে রাখবেন। বোনপাগল উনি, প্লান ভেস্তে যাবে তখন। অবশেষে ঘুঘু ফাঁদে পা দিয়েছে”

তার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। ফোন কেটেই ফাইজান শান্ত স্বরে বললো,
“একটা প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা করো ফরিদ ভাই, এখন ই”

ফাইজানের কথাটা বুঝতে যেনো সময় লাগলো ফরিদের। হতবিহ্বল তার চাহনী। চোখে অবিশ্বাসের ছিটে। বিমূঢ় স্বরে শুধালো,
“তুমি গাড়ির লোকেশন কি করে জানো? আর কিসের প্লান? রাশাদ সাহেবকে কোথায় শিফট করা হবে ফাইজান? এখন প্রেস কনফারেন্স কি হুমায়রাকে খোঁজার থেকে বেশি জরুরি! আমার মাথায় কিছু আসছে না। একমিনিট, তুমি জানতে এমন কিছু হবে?”

ফরিদের কন্ঠে সুপ্ত ক্ষোভ, অবিশ্বাস। সে উত্তরের অপেক্ষা করছে। তাকে খুব বিচলিত লাগছে। ফাইজান তার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব শীতল স্বরে বললো,
“না, জানতাম না। অনুমান করেছিলাম”
“তাও তুমি হুমায়রাকে কি’ড’ন্যা’প হতে দিলে?”
“সর্ষের ভুত ধরার এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না ফরিদ ভাই। হুমায়রা যদিও আমার প্লানের ভেতর ছিলো না। কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম”
“আজকের দিনে যা যা ঘটেছে সব প্লান ছিলো?”
“হ্যা”

ফাইজানের ছোট্ট “হ্যা” ফরিদকে অবাক করলো। ফরিদের বিশ্বাস হচ্ছে না ফাইজান এতো বড় একটা রিস্ক নিয়েছে। আজকের ঘটনা সবকিছুই ফাইজানের একটি সুপ্ত ফাঁদ ছিলো তার অজানা শত্রুকে ধরতে। শুধু আজকের নয়। কাওছারের সাথে রাশাদের ঝামেলার দিন থেকেই তার উপর সন্দেহে হচ্ছিলো কোথাও ঝামেলা আছে। গ্রামে যেয়ে আমান এবং কাওছারের অসম্ভব সখ্যতায় যেনো সন্দেহটা বাড়ে। রাশাদ কাওছারের ছেলে নয়, ঘটনাটি যখন খুব বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে পারলো না তখন ফাইজানের সন্দেহ ছিলো কাওছার এখন অকেজো। তাই ওকে কেউ টাকা দিয়ে পুষবে না। কারণ সে ফাইজান বা হুমায়রা কারোর ধারে কাছেও ঘেষতে পারবে না। ফাইজানের অনুমান সঠিক হলো। কাওছার সেরাতে মা’রা গেলো। ফাইজানের ধারণা ছিলো এই খু’নটা বেশ বড় স্ক্যান্ডালের রুপ নিবে। এবং তাই হয়েছে। যখন স্ক্যান্ড্যাল সামলাতে ফাইজান ব্যাস্ত থাকবে তখন এমন কিছু ঘটবে যা ফাইজানকে ভেঙ্গে দিবে। এবং সেটা তার কাছের কেউ ই করবে। তাইতো ফাইজান তার গাড়িগুলোর জিপিএস ডিভাইসের মাধ্যমে লোকেশন ট্রাক করেছে। শুধু তাই নয় সে হুমায়রার বাড়ির প্রতিটি কোনায় ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে, যেনো কেউ যদি ঘরে আসে সেটা ধরা পড়ে। রাশাদকে পুলিশে ধরাটা একটি নাটক ছিলো শুধু ওদের আশ্বস্ত করতে যেনো তারা ভাবে তারা ফাইজানের থেকে এগিয়ে আছে। সিসি টিভি ফুটেজ খুব আঁধার হলেও মানুষটির মুখখানা ঠিক ধরা পড়েছে। সেজন্যই প্রেস কনফারেন্স ডাকতে বলেছে ফাইজান। সব কিছু জেনে ফাইজানের উপর ফরিদের ক্ষোভ ক্রোধে পরিণত হলো যেনো। চেঁচিয়ে বললো,
“হুমায়রাকে ওরা কিডন্যাপ করেছে ফাইজান। ওদের মাথায় কি চলছে আমরা কিছুই জানি না। তুমি একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন কিভাবে বিপদে ফেলাতে পারলে?”
“এছাড়া আর কি উপায় ছিলো? প্রতিটা সময় ভয়ে বাঁচা? কখন ওরা আমার বা আমার প্রিয় মানুষের উপর আক্রমণ করে? তোমার কি মনে আমি সব জেনে বুঝে হুমায়রাকে বিপদে ফেলবো? ভোটের আগে চামেলীর এক্সিডেন্ট, শপথ গ্রহণের পর আমার উপর হামলা, এখন কাওছার সাহেবের মৃত্যু, রাশাদ সাহেবের জেলে যাওয়া সব কিছু কাকতালীয়? ফরিদ ভাই এই সব কিছু হচ্ছে আমাকে সরানোর জন্য।”

ফাইজানের শানিত কন্ঠে পুনরায় অবাক হলো ফরিদ। তার ক্রোধ বাড়লো। তীব্র স্বরে বললো,
“আমি ভেবেছিলাম তুমি মানুষ হয়ে গেছো। ভুল ছিলাম। তুমি সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হয়ে গেছো ফাইজান। যারা নিজের চেয়ারটা বাদে কিচ্ছু দেখতে পারে না। এতোদিন সবাই বললেও আমি বিশ্বাস করতাম হাফসার মৃত্যুটা দূর্ভাগ্য ছিলো। কিন্তু না হাফসার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী ছিলে। আজও যদি হুমায়রার কিছু হয় সেটার জন্য দায়ী তুমি হবে”

বলেই ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো ফরিদ। ফাইজান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফরিদের যাবার পথে।

****

হুমায়রা জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে একটি ঘরে। মাথার উপর একটি স্বল্প ভোল্টের লাইট জ্বলছে। যার আলো সম্পূর্ণ ঘরকে আলোকিত করতে পারে নি। ঘরটিতে দুটি জানালা আছে কিন্তু তা বদ্ধ। দেওয়ালের রঙও খসে পড়ছে। মাঝে মাঝে টিকটিকির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার ঠিক সম্মুখে বসে রয়েছে যুবাইদা। তার মুখে বিশ্রী হাসি। পুলিশ স্টেশনে যাবার কথা ছিলো তাদের। নাদিম যখন এসে বললো,
“ফাইজান ভাই গাড়ি পাঠিয়েছে”

হুমায়রার মনে হয়েছিলো তার ম্যাসেজ পেয়েই গাড়িটা ফাইজান পাঠিয়েছে। কিন্তু থানার দূরত্ব তো বেশি নয়। আশেপাশের রাস্তাটা অপরিচিত ঠেকল হুমায়রার কাছে। ফলে সে নাদিমকে শুধালো,
“এটা কোন রাস্তা? আমরা থানা যাচ্ছি না?”
“না, আগে ভাই এর অফিস যাবো। তারপর যাবো থানা”
“এই রাস্তা তো শহরের না”
“শহরের রাস্তায় জ্যাম হচ্ছে। এটা শর্টকাট”

তখনও সন্দেহ গভীর হয় নি হুমায়রার। কিছুক্ষণবাদে নাদিম একটি বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
“ভাবী, পানি খান। গরম অনেক। রাস্তাও তো বড়”

সেটাই ভুল ছিলো হুমায়রার। পানিটুকু খেতেই কয়েক মুহূর্তবাদে জ্ঞান হারালো হুমায়রা যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে একটি জঞ্জালপূর্ণ ঘরে বন্দি পেলো। তার সামনে একটি অপরিচিত পুরুষ বসে রয়েছে, যাকে সে কখনো দেখে নি। হুমায়রা শীতল স্বরে বললো,
“আমাকে এখানে কেনো আনা হয়েছে?”
“বাঘরে শিকার করতে হইলে ভেড়া বলি দিতে হয়। তুমি হলো আমাদের ভেড়া”

শ্লেষ্মাজনিত কন্ঠে পুরুষটি কথা বললো।হুমায়রার বুঝতে সময় লাগলো। হতবাক স্বরে বললো,
“মানে?”

পুরুষটির হাসি আরোও কুৎসিত রুপ নিলো। হুমায়রার হাত বাঁধা।হুট করেই ত্রাস জমলো হুমায়রার হৃদয়ে। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো ভয়ের স্রোত। সে তো গাড়িতে ছিলো। গাড়ি তো ফাইজানের অফিসে যাবার কথা ছিলো। হতবাক স্বরে বললেন,
“আপনি কি চান?”
“আমি কি চাবো? ”
“তাহলে আমাকে বেঁধে রেখেছেন কেন?”
“সময় হইলেই বুঝবা”

লোকটির কথা কিছুই বুঝতে পারলো না যেনো হুমায়রা। তার ভয় গাঢ় হলো। গাড়ি কি তবে ফাইজান পাঠায় নি। এর মাঝেই লোকটি একজনকে ডাকে,
“হুসনেয়ারা, আমাদের অতিথিরে একটু খাওন দিয়ে যাও। যতই হোক মন্ত্রীমশাইয়ের বউ সে”

কথাটা শুনতেই একজন মহিলা ঘরে প্রবেশ করে। যাকে দেখতেই হুমায়রার চোখ বিস্ফারিত হয়। অবিশ্বাস তীব্র ভাবে ছেয়ে যায় মুখে। অস্পষ্টস্বরে বলে,
“আম্মা”….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here