#নিশীভাতি
#৫৯তম_পর্ব
“কি চাই?”
ওপাশের মানুষটিও বিনা ভনীতায় বললো,
“তুই জানোস কাওছার আর রাশেদের আইজ বাজারে মারপিট হইছে। শুধু তাই না, কালকেরা বিচার বইবো। হুনছি কাওছারের নাক ফাটায়ে দিছে, দাঁত ভাইঙ্গে দিছে। বাজারের মানুষেরা যাইয়্যা থামাইছে”
যুবাইদার কন্ঠে উৎকুন্ঠা, চিন্তা। রাশাদ কাওকে মারতে পারে কথাটা শুনতেই স্তম্ভিত মূর্তমান দাঁড়িয়ে রইলো হুমায়রা। কথারা যেনো হুট করেই উধাও হয়ে গেলো মস্তিষ্ক থেকে। কিয়ৎকাল এভাবেই কাটলো নিশ্চুপ। ফোনটা কেটে গেলো কি না নিশ্চিত হতে যুবাইদা শুধালো,
“হুমায়রা শুনছিস?”
শুনছে সবটাই কিন্তু শব্দগুলো বর্তমানে দিশেহারা। মস্তিষ্ককোষের প্রতিটি নিউরণে আন্দোলিত হচ্ছে একটি ই প্রশ্ন। ভাইজান কেনো মারলো কাওছারকে! রাশাদের স্বভাবে উগ্রতা কিংবা ব্যাভিচারিতা নেই। শান্ত, ধৈর্য্যশীল মানুষটির রাগও সে গিলে ফেলে ঝামেলা করবে না তাই। সেকারণেই দিনের পর দিন কাওছারকে সহ্য করেছে। আগে কি কম খারাপ কাজ করেছে কাওছার? তবুও রাশাদ সবটা সহ্য করেছে। তবে এমন কি হলো যে সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে? যুবাইদা আরোও দু-তিনবার ডাকতে স্বম্বিৎ ফিরলো হুমায়রার। ছোট্ট করে বললো,
“হু”
যুবাইদা এবার ভরসা পেলো যেনো। ব্যস্ত হয়ে বললো,
“তোরে আমি কইছিলাম, কাওছারের মতো বদ মানুষ পৃথিবীতে দুইডা নাই। তোরে কইছিলাম, ওরে থামাইতে হইবো আগেই। কিন্তু তুই হুনোস নাই। এখন ও আমার পোলাডার জীবন নষ্ট করার ধান্দায় আছে।”
এর মাঝেই হুমায়রা শান্ত গলায় শুধালো,
“আপনি জানেন কিভাবে?”
প্রশ্নটার জন্য যেনো প্রস্তুত ছিলো যুবাইদা। ধীরে সুস্থে বললো,
“উনি গেছিলেন গেরামে আমার কাগজ আনতি। আমি কইছিলাম ছেলেডারে দেইখে আসেন। উনার সামনেই নাকি ঘটনা হইছিলো। আমার তো ভাইব্যাই হাত পা ঠান্ডা হইয়ে যাইতেছে। না জানি বিচারে ও কেমনে ফাসায় রাশাদরে”
হুমায়রার যুবাইদার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তার মাথা ধরেছে। সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছে না। তাই শীতল কন্ঠে বললো,
“আমি রাখছি”
যুবাইদার অনেককিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও হুমায়রার অনিচ্ছার কারণে বলার সুযোগ হলো না। ফোন কাটতেই পাশে এতোক্ষণ সব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা মানুষটি বললো,
“তোমার মার সাথে তোমার যোগাযোগ হচ্ছে?”
ফাইজানের প্রশ্নে হুমায়রা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। ক্লান্ত বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো যেনো। অপরাধী স্বরে বললো,
“দাদা মারা যাবার রাতে উনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তার আগে আমার সাথে রাস্তায় একবার দেখা হয়েছিলো। কথাটা আমি কাওকে জানাই নি”
“কেনো?”
“বাড়ির পরিস্থিতি ভালো ছিলো না। আব্বাকে নিয়ে খুব ঝামেলা গেছে। এর মাঝে উনার কথা বললে দাদী ক্ষেপে যেতেন।“
“আমাকে জানাও নি যে”
“সুযোগ হয় নি, আপনি ব্যস্ত ছিলেন”
ফাইজান কিছুসময় মৌন রইলো। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আছে। হুমায়রা নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে। তার মাঝে অপরাধবোধ। মনে মনে নিজেকে দোষীর স্থানে দাঁড় করিয়েছে সে। যদিও জানে না আসলে কি ঘটেছে। কিন্তু বারবার একটাই সন্দেহ হচ্ছে কাওছার নিশ্চয়ই ভাইজানের জন্ম পরিচয় নিয়ে জলঘোলা করেছে। হুমায়রা রাশাদের এতো বড় সত্যটা গোপন করে কি ভুল করলো? হয়তো গোপন না করলে পরিস্থিতি এমন নাও হতে পারতো। এর মাঝেই কানে গম্ভীর স্বর এলো,
“তুমি এখনো আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছো”
হুমায়রা অপ্রস্তুত হলো কিঞ্চিত। ক্ষুদ্র হৃদয়ে সংকোচ হলো। তবুও সেই সংকোচ ভুলে বললো,
“দাদা মারা যাবার দিন মা আমাকে খুব কঠিন একটা সত্য বলেছিলেন। আমার ধারণা আব্বা সেই সত্যকে হাতিয়ার বানিয়ে ভাইজানের উপর শোধ তুলতেছে। দাদার সম্পত্তির ভাগ না পাওয়ায় সে অনেক চেতে ছিলেন। খুব ঝামেলাও করেছেন। কিন্তু দাদী তাকে পাত্তা দেন নাই। আমার মনে হয় সেই ক্ষোভ থেকেই উনি ভাইজানকে বদনাম করতে চাইছে। আমার ভাইজান অহেতুক কারোর সাথে জোরে অবধি কথা বলে না, তাহলে সে কেনো আব্বাকে মারবে?”
ফাইজান কিছুসময় মৌন থেকে খুব ধীর এবং গম্ভীর স্বরে শুধালো,
“ভদ্রমহিলা তখন কিসের কথা বলছিলো, যা তুমি শুনো নি”
হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। ধীরে ধীরে সবটা খুলে বললো। নিজের পরিবারের কুৎসিত কথাগুলো বলতে তার বিব্রতবোধ হচ্ছিলো। কিন্তু লুকানো সমীচিন নয়। ফাইজান তার স্বামী। স্বামী স্ত্রীর মাঝে গোপনীয়তা ছাই চাপা দাবানলের মতো, ধীরে ধীরে সম্পর্কের ভিত্তি পুড়িয়ে দিতেও সময় নেয় না। আর এক না এক সময় এই সত্য সবাই জানবেই। তাই হুমায়রা সবটা খুলে বললো। সবটা শুনে ফাইজানের কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো। তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠলো তিক্ত বিরক্তির ছাপ। কঠিন স্বরে বললো,
“তুমি বাড়ির কাউকে কেনো এই কথাগুলো জানাও নি?”
“বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করে বলবো। দাদী আব্বাকে ঘর থেকে বের করে দিলে একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম, এখন অন্তত সে আমাদের জীবন থেকে চলে গেছে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। উলটো…”
“স্বাভাবিক কি নয়? কাওছার সাহেব কেমন মানুষ সেটা তো তোমার অজানা নয়। টাকার জন্য সে কতটা নিচে নামতে পারে সেটাও তোমার জানা। তাহলে সম্ভাব্য ঘটনা জানার পরও তোমার লুকিয়ে যাওয়া উচিত হয় নি।“
“ভাইজানকে কি করে জানাতাম এই সত্যটা, সে কি মানতে পারতো? তার জন্মের উপর প্রশ্ন উঠতো, তার উপর উঠতো। মানুষটা আর কত সইবে বলুন তো, একা কাধে একটা সংসার টানা কি কম কথা? শত কষ্টের মাঝেও সে সেই দায়িত্বের ভার টেনে যাচ্ছে, এক প্রান্তে এসে জানতে পারলো এরা কেউ তার আপন নয়। আফ্র যে আপন সে তাকে ছেড়ে নিজের আখিরাত গুছাচ্ছে, সে কি করে মানবে বলুন? আমার ভাইজান ভেঙ্গে পড়বে”
ফাইজান বিনা সংকোচে বললো,
“তোমার ভাইজান এতো দূর্বল নন। সে কাওছার সাহেবের সন্তান নয় এই কথাটা বাহিরের কারোর কাছ থেকে শোনার থেকে তোমার থেকে শোনাটা কি ভালো ছিলো না? এখন তো নিশ্চয়ই সবাই ব্যাপারটা জানবে, এর মাঝে যদি রাশাদ সাহেব জানতে পারেন তুমি সবটা জানতে সে কি ব্যাপারটা মানতে পারবে? পৃথিবীতে অনেককিছুই তিক্ত হয়, অসহনীয় হয়; কিন্তু আমাদের সেটা মেনে নিতে হয়। সে কি কাওছার সাহেবের ঔদ্ধত আচারণ মেনে নিচ্ছেন না? তোমার মার ব্যাপারগুলো মেনে নিচ্ছে না? তার কষ্ট হতো কিন্তু সত্যটা ঠিক মেনে নিতেন”
হুমায়রা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। ফাইজান কপাল ঘষলো, তার গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“কাল বিচারের সময় আমরা সেখানে উপস্থিত থাকবো”
এটুকু বলেই সে নিজ ঘরের দিকে প্রস্থান করলো। হুমায়রার মনে হলো ভাইজানের সাথে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো না ঠিক কি কথা বলবে।
****
মধ্যরাত। দরজার খিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইলহা। রাশাদ এখনো বাড়ি ফিরে নি। আতিয়া খাতুন পায়চারী করছেন উঠানে। এতোরাত হয় না রাশাদের। কিন্তু আজ রাত হচ্ছে। বাজারের ঝামেলার কথা বাড়ি অবধি চলে এসেছে। কাওছারকে রাশাদ মেরেছে সেটা আতিয়া খাতুনের কানে এসেছে। এখন বাতাসে এই কথাই ঘুরছে। রসিয়ে রসিয়ে কথার বেগ বাড়ছে। কথাটা শোনামাত্র আতিয়া খাতুন তাজ্জব হলেন। নাতী তার এমন কিছু করতে পারে তা অকল্পনীয়। উপরন্তু সে এখনো বাড়িতে আসে নি। এর মাঝেই হেডলাইটের আলো আঁধার চিরলো। আতিয়া খাতুন হাক দিলেন,
“রাশাদ, আইছোস ভাই”
কলপাড়ে মোটরসাইকেলটা থামালো রাশাদ। এসেই হাতমুখ ধুলো সে। পাশে রাখা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ভিটায় প্রবেশ করলো সে। হারিকেনের আলোতে পরিষ্কার হলো রাশাদের থমথমে মুখ। ইলহা দরজা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তাকে জাগতে দেখে রাশাদ গম্ভীর স্বরে শুধালো,
“আপনি ঘুমান নি?”
“এখন বাজে কয়টা খবর আছে আপনার?”
ইলহার সাথে সাথেই আতিয়া খাতুন বলে উঠলেন,
“ছিলি কই ভাই এতোক্ষণ, চিন্তা হয় না? আর তোর ফোন বন্ধ কে রে?”
রাশাদ খুব শান্ত গলায় বললো,
“মোবাইলে চার্জ ছিলো না, আমি শহরে গেছিলাম মাল আনতে। খিদা লাগছে দাদী, খাবার দাও। কাজের মধ্যে খাইতে পারি নাই”
রাশাদের অত্যাধিক স্বাভাবিক আচারণে আতিয়া খাতুন কিছুটা অবাক হলেন। খুব নরম স্বরে তিনি শুধালেন,
“ভাই, আজকেরা বাজারে…”
“তোমার ছেলে ঔদ্ধত্য আচারণ আমার আর সহ্য হচ্ছিলো”
“তাই বইল্ল্যা বাপের গায়ে হাত তুলবি?”
“সে তো সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে আমি তার সন্তান ই না। আমার মা অন্য কারোর সাথে শুয়ে আমাকে জন্ম দিয়েছে। তাহলে আমি কেনো তাকে বাপ মনে করে তার সম্মান রক্ষা করবো?”
অকপটে রাশাদ কথাখানা বললো। তার কন্ঠ স্বাভাবিক। কোনো অনুতাপ, দুঃখের ছিটে নেই। তবুও যেনো আতিয়া খাতুনের চিন্তার মেঘ সরলো না। বরং রাশাদের এই কাঠিন্য তাকে বিচলিত করছে বারংবার। রাশাদ আবার বলল,
“দাদী, খানা নাই আজ আমার জন্য?”
“কি কস ভাই, এই বউ সোয়ামীরে খাওন দাও যাও”
ইলহা সাথে সাথেই রান্নাঘরের ছোট পাঁচ ওয়াটের লাইটটা জ্বালানো। দাও দাও করে জ্বলে উঠলো কাঠের চুলো। রাশাদ দায়সারা ভাব নিয়ে খেলো। কালকের বিচারের তার পরোয়া নেই। ফলে ইলহা এবং আতিয়া খাতুনের চিন্তা বাড়লো বই কমলো না। মাঝে হুমায়রা ফোন করেছিলো, সেও ভাইজানকে নিয়ে মারাত্মক চিন্তিত। কাল সেও আসছে। অথচ সে তো জানে না ভাইজান যে কেমন পাথরের ন্যায় আচারণ করছে। আচ্ছা, রাশাদের দুঃখগুলো কি এখন এতোটাই অহেতুক হয়ে গেছে যা আর বর্ষিত হয় না? নাকি রাশাদের হৃদয়খানা বেশি কঠিন হয়ে গেছে?
*****
শেষরাত্রী, প্রসাবের চাপে খুব ভেঙ্গে গেছে ইলহার। প্রেগন্যান্সির পর থেকে এখন ঘনঘন প্রসাব হয় শুধু। এমন কি ঘুমের মাঝেও দু তিন বার বাথরুমের দিকে ছুটতে হয়। ঘুমটা একটু গাঢ় হলেই সেটা ভেঙ্গে যায়। রাতের বেলায় একা একা বের হতেও ভয় করে। ফলে রাশাদকে ডেকে উঠায় সে। রাশাদও কোনো বিরক্তি ছাড়া উঠে যায়। এটাই হয়তো প্রেগন্যান্সির সৌন্দর্য্য যেখানে দুটো মানুষের তাদের স্নেহকে পৃথিবীতে আনার জন্য রাত দিন নানা কষ্ট সহ্য করে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো রাশাদ আঁধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি ক্লান্ত, প্রাণহীন। তাকিয়ে আছে হারিকেনের নিভূ আলোটার দিকে। ইলহা তার গায়ে স্পর্শ করতেই চমকে উঠলো যেনো। ইলহা ধীর স্বরে শুধালো,
“কি চিন্তা করছেন?”
রাশাদ হাসলো একটু। তারপর অপ্রতীভ স্বরে বললো,
“ভাবছি যদি কাওছার সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমার অস্তিত্বটা কি?”
ইলহা চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো যেনো। সাথে সাথেই রাশাদকে সে জড়িয়ে ধরলো। সেই আলিঙ্গনের উষ্ণতা পৌছে গেলো ক্লান্ত হৃদয়ের অন্তরীক্ষে। ধরা গলায় বললো,
“আপনি সবসময় আমার জন্য রাশাদ ই থাকবেন। সেই রাশাদ যে আমাকে একটি বন্দিখাঁচা থেকে মুক্ত করেছেন। সেই রাশাদ যে আমার মনে ভালোবাসার মুকুল ফুটিয়েছে। সেই রাশাদ যার জন্য মিষ্টতায় আমি লিপ্ত থাকি সবসময়। আপনার বাবা কে, মা কে তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসতো না। আজও আসে না রাশাদ। আমার জন্য আপনিই যথেষ্ট”
ইলহা এখনো জড়িয়ে ধরে আছে রাশাদকে। রাশাদ কিছুক্ষণ অবরুদ্ধ রইলো। বিমূঢ় চেয়ে রইলো। ভেতরটায় ঝড় উঠেছে। তীব্র কালবৈশাখী। না এই ঝড় দুঃখের মোটেই নয়। ঝড়টা শান্তির, কি শীতল অনুভূতি! অবশেষে ইলহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। মৃদু হেসে বললো,
“আপনি না থাকলে বোধ হয় আজ আমি ভেঙ্গে পড়তাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ ইলহা। আমার জীবনে আমার নিশীভাতি হবার জন্য। আমার এইনিগূঢ় আঁধার জীবনটা আলোকিত করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ”
ইলহা এখনো লেপ্টে আছে বলিষ্ট দেহের সাথে। এই মানুষটি ভেঙে গেলে তার জীবনটাও যে অন্ধকার হয়ে যাবে। কারণ সেই তো তার নিশীভাতি।
*******
নিষ্ঠুর উত্তাপে দেলোয়ার সাহেবের বাগানে বিচার বসলো। উত্তাপের বিভীষিকায় তখন হাসফাস করছে ধরণী। ঘাসগুলোও যেনো জ্বলন্ত লাভা। পৃথিবীর ক্রুর মানুষগুলোকে এবার যেনো দয়া দেখাবে না পৃথিবী। গরমের উন্মাদনা মানুষের স্বভাবের মাঝেও যেনো ছড়িয়ে পড়িয়েছে। ঘর্মাক্ত শরীরে দীর্ঘ উত্তেজনা নিয়ে তারা প্রতীক্ষিত বিচারের। দেলোয়ার সাহেব তার চেয়ারম্যানের ভুমিকা পালন করছেন। আমান কাওছারের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপর দিকে রাশাদ দোষীর কাতারে পড়েছে। দেলোয়ার সাহেবের প্রথম প্রশ্নই ছিলো,
“রাশাদ তোমাকে আজীবন ভদ্র ছেলে হিসেবেই জেনে এসেছি। কিন্তু এখন তোমার এই রুপ তো মানতে কষ্ট হচ্ছে। তোমার নামে বিচার এসেছে তুমি নাকি কাওছারকে মেরেছো? তার চোয়াল বাকিয়ে দিয়েছো। তাকে আহত করেছো। এটা তো অন্যায়। এর বিনিময়ে কাওছার তোমার কাছ থেকে ভর্তুকি চাইছে”
“আর উনি যে আমার নামে যাচ্ছে তাই ছড়াচ্ছেন সেটার বেলায় কি হবে দেলোয়ার কাকা? সেটার বিচার করবেন না আপনি?”
রাশাদের অকপটের প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো দেলোয়ার। রাশাদ না থেমেই বললো,
“জিজ্ঞেস করুন উনাকে আমাকে নিয়ে কি কি বলেছে, আমি তার সন্তান নই। আমার মাঝে তার রক্ত নেই। তার সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছি। নানাবিধ কথা। এতোদিন আমি তাকে সহ্য করেছি। আর সহ্য হচ্ছিলো না। হ্যা, আমি ভুল করেছি। তাকে মারা আমার উচিত হয় নি। তবে তার ভাগ্য ভালো যে আমার রাগ তখন নিয়ন্ত্রণে ছিলো, নয়ত”
“নয়ত কি, মাইরে লাইতি আমারে। হারামীর পুত, আয় মার”
এর মাঝে ফোঁস করে উঠলো কাওছার। রাশাদ তার কথার উত্তর দিলো না। এদিকে দেলোয়ার তাকে থামার আদেশ দিলেও সে থামলো না। অন্যদিকে ফাইজান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মামার দিকে। বিচারসভার তার উপস্থিতি বেশ বিপাকেই ফেললো যেনো দেলোয়ারকে। আমান তখন কাওছারের পক্ষ নিয়ে বললো,
“মিথ্যে কথা, কাওছার কাকা এমন কিছুই করেন নি। আসলে রাশাদ ভাইয়ের ক্ষোভ কাওছার কাকার উন্নতির জন্য। তার পাশেই দোকান দিয়েছে, দু হাত ভরে কামাই। এটাই সহ্য হচ্ছে না”
“হ, ঠিক। ওয় চায় না আমি খায়ে পরে বাঁচি। এইডাই সমস্যা। আর যা সত্য আমি তো সেটাই কইছি, ভুল কি কইছি। ও তো আমার পোলা না। আরে যে মহিলা আমারে বিয়ার পর নিজের শরীর ধরতেই দেয় নাই সেই মহিলার পেটে আমার বাচ্চা থাহে কেমনে? বেডি আমার আগে বিয়া ছিলো। ওর বাপে আমাদের ঠকায়ে আমার লগে বাচ্চা সহ বিয়া দিছে। আমি জানি কিন্তু লোকের ভয়ে চুপ ছিলাম। নিজের ছেলের মত পালিছি। কালসাপটা আমারেই ছোবল দিছে”
কাওছারের কথাটার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না যেনো। উপস্থিত মানুষের মাঝে কানাগোসা শুরু হলো। আমান তাকে ইশারা করলো যেনো থেমে যায় কিন্তু সে থামলো না। সে বলতেই থাকলো,
“একদম মায়ের মত হইছে হাতায়ে লয়ার স্বভাব। আমার বাপেরে ফুসলায়ে আমার সম্পত্তি হাতায়ে লইছে। ও ত আমার পোলাই না, তাইলে আমার বাপের সম্পত্তিতে ওর ভাগ হয় কি করে?”
রাশাদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভেতরটা যেনো ঝাঝরা হয়ে গেলো মুহূর্তেই। দেলোয়ার বুঝলো না বিচারটা কি নিয়ে করবে? এর মাঝে ফাইজান স্থির কন্ঠে বললো,
“যে পুরুষ আঠাশ বছর পর বলে তার ছেলে তার ছেলে নয়, কারণ বিয়ের পর সে তার স্ত্রীকে ছুতে পারে নি। সেই পুরুষকে কি বলা হয় আমার জানা নেই। তবে আমি তো তাকে কাপুরুষ ছাড়া কিছুই বলতে পারছি না। এখন সম্পত্তি না পাওয়ার ক্ষোভ দেখাচ্ছে সে আমার শ্যালকের উপর। যদি কালসাপই হতো তাহলে এতোটা বছর এই কাপুরুষকে পালতো কি? দাদা তাকে সম্পত্তি দেয় নি তার স্বভাবের কারণে। কাওছার সাহেবের স্বভাব তো অজানা কারোর নয়। আর সম্পত্তি দেন নি এটাও মিথ্যে। একটা জমি বেঁচে তাকে মোটা অংক দেওয়া হয়েছে ঋণ পরিশোধের জন্য। এটা কি সকলের অজানা। এখন এসব বিষয় নিয়ে ঘাটানো মানে মানুষের সময় নষ্ট। উনি ভর্তুকি চাইছে, আমি ভর্তুকি হিসেবে উনার চিকিৎসার খরচ দিয়ে দিচ্ছি। বিচার শেষ করেন মামা”
দেলোয়ার সাহেব না চাইতেও বিচার শেষ করলেন। রাশাদ মূর্তমান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদিকে আমানের মুখখানা শক্ত। কাওছার ভেবেছিলো এই সুবাদে সে সম্পত্তি হাতিয়ে নিবে কিন্তু সেটা হলো না। সে সবার সামনে হাসির পাত্র হয়ে গেলো। বিচারে হুমায়রাও ছিলো। আমানের সাথে তার চোখাচোখি হলো কিয়ৎকালের জন্য। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা ছাড়া যেনো আর কিছুই লক্ষ হলো না। এর মাঝে ফাইজানের সাথে সে মুখোমুখি হলো। ফাইজান তাচ্ছিল্য ভরে বলল,
“মানুষ হিসেবে এখনো তুমি কাঁচাই হয়ে গেলে আমান”
যা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা মনে হলো আমানের।
*****
সবাই বাড়ি যাবার জন্য রওনা হলেও রাশাদ গেলো না। সে বললো,
“তোমরা যাও, আমার একটু একা সময় চাই”
তাকে কেউ ঘাটালো না। কারণ তার নিষ্প্রাণ মুখখানা ভেতরের আত্মার জানান দিচ্ছে। আতিয়া খাতুন শুধু এটুকু বললো,
“ভাই, তুই কিন্তু সারাজীবন ই আমার ভাই”
রাশাদ মলিন হাসলো। সত্যটা মেনে নিতে সময় লাগছে তার। হুমায়রা ভাইজানের দিকে চেয়ে আছে। তার শক্ত ভাইজানটা আরোও একবার যেনো হারিয়ে গেছে দোদুল্যমান পরিস্থিতির চাপে।
রাশাদ সরাসরি গেলো শামসু মিঞার কবরে। কবরের পাশে অনেকটা সময় বসে রইলো। আজ এই মানুষটার অনুপস্থিতি তার খুব অনুভব হচ্ছে। মানুষটা থাকলে হয়তো একটু হলেও সাহস পেত। আচ্ছে জন্মপরিচয় কি সব? এতোকাল যে পরিবারকে ভালোবেসেছে আজ হুট করে সব মিথ্যে হয়ে যাবে। কই, সে তো তাদের আজও ভালোবাসে। আজও তার দাদা-দাদী, বোন ই তার পরিবার। তারাও কি এটাই মানবে!
***
ভোরের তীব্র সূর্যালোক গ্রামের মানুষের মাঝে ভীতির জন্ম দিলো। গ্রামের মরা পুকুরের পাড়ে জড় হয়েছে জনভীড়। সকলের মুখে আতংক, মিচমিচে কালো ত্রাস। কি বিশ্রী ভয়ংকর দৃশ্য। সাহসী কিছু মানুষ তা দেখিছে, অনেকেই লোমহর্ষক দৃশ্যটি দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এক বৃদ্ধা তো হরহর করে বমি অবধি করে দিয়েছে। কারণ মরা পুকুরের কুচুরিপানার ধারে অবহেলায় পড়ে আছে কাওছারের ত্রিখন্ডিত লাশ……
চলবে
(অত্যন্ত দুঃখিত ছয়দিন পর গল্প দিচ্ছি। আসলে একসাথে পুরো গল্পটা লিখে শেষ করায় সময় লেগেছে। এখন আর মিস হবে না। ইনশাআল্লাহ টানা সাতটা পর্ব আসবে। দয়া করে লাইট থেকে পড়বেন না, কারণ পর্বটা বেশ বড়)
মুশফিকা রহমান মৈথি