#অর্ধ_নক্ষত্র ।৩৬।
#লেখনীতে_Aiza_Islam_Hayati
ফাইজ জাহরার চঞ্চল আঁখির পানে চেয়ে গান ধরলো,
~অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি
অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে
ভালবাসবো তোমায়~
গানের শেষ লাইনে এসে যেনো ফাইজ শেষ সুর টানলো জাহরার থেকে নজর সরিয়ে ফেললো।জাহরা খেয়াল করলো এতক্ষন যাবৎ ফাইজ তার দিকেই চেয়ে গান গেয়েছিল।ফাইজ এর চাহনিতে ছিলো এক অন্যরকম ডুবে যাওয়ার মত ভাবান্তর।
সকলে প্রশংসায় মেতে উঠলো ফাইজ এর গানের।সে স্টেজ থেকে নেমে গেলো।সুদূরে চেয়ারে বসে থাকা আরুই সিটি বাজিয়ে বলে উঠলো,”অসাধারণ ফাইজ।”
ইমান বিস্মিত চোখে চাইলো বলল,”তুমি সিটি বাজতে পারো।”
কথাটি শ্রবণ হতেই আরুই মিইয়ে গেলো,হেঁসে আমতা আমতা করে বলল,”ইয়ে এই একটু আধটু আরকি।”
ইমান হো হো করে হেঁসে উঠলো।বলল,”বউ আমি তোমার প্রতি পাগল হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে।কিসব কান্ড করো তুমি,এইসব কান্ড গুলোই এই ইমানকে পাগল করে তোলে তার আরুইর জন্য।”
আরুই বোকা হাঁসলো লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো।ইমান মুচকি হেঁসে তার বউয়ের মাথায় হাত রেখে তাকে টেনে বুকের সাথে লেপ্টে ফেললো।ফিসফিস করে বলল,”খুব ভালোবাসি আরুই আপনাকে।”
আরুই যেনো গুটিসুটি মেরে গেলো।ইমান এর এত ঘনিষ্ঠ হলেই তার হাত পা কাপাকাপি আরম্ভ হয়ে যায়।
.
এক রমরমা অনুষ্ঠানে শেষ হলো রিসেপশন।মেহরা, আরশমান যাচ্ছে শেইখ বাড়ি।আমজাদ তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দেয়ার পূর্বে মেহরার উদ্দেশ্যে বলে,”বউমা তুমি এলে তারপর শশুর বউমা মিলে একটা আড্ডা দেবো কেমন।”
মেহরা ফিক করে হেসে দিলো বলল,”ওকে বাবা।”
মেহরা এই একটি দিনেই খুব করে মিশে গিয়েছে শশুর শাশুড়ি নামক নতুন মানুষ গুলোর সঙ্গে।যাদের সঙ্গে ভালো করে দু একটা কথা অব্দি হলো না তার।
প্রশান্ত,জুনায়না গাড়িতে উঠে বসেছে তারা যাচ্ছে জুনায়নার বাড়ি।আজ মেয়ের রিসেপশানেই আসতে পারলেন না আঞ্জুমান,পায়ে চোট পেয়েছিলেন তিনি।
আরশমানদের গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পূর্বে জাহরা তার মা ও বাবার উদ্যেশে বলে,”বাবা মা আমাকে হসপিটাল যেতে হবে।তোমরা বাড়ি যাও মেহরা ভাইয়াকে নিয়ে।”
মায়া চিন্তিত কণ্ঠে বলে,”এই রাতে তুই একা কী করে যাবি?”
পিছন থেকে ভেসে আসে ফাইজ এর কন্ঠ,”আন্টি আমার সঙ্গে যাবে জাহরা।”
মায়া চায় ফাইজ এর দিকে কিছুটা চিন্তা মুক্ত কণ্ঠে শুধায়,”ঠিক আছে বাবা,কিন্তু বাবা তুমি কী ওকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবে?”
জাহরা মা কে প্রতিউত্তর করতে চাইলে ফাইজ জাহরাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই উত্তর করে,”জি আন্টি আমি পৌঁছে দিবো আপনি চিন্তা করবেন না।”
.
গাড়ি দুইটি ছেড়ে দিলো।ফাইজ জাহরার জন্য নিজের গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল,”এইযে জাহরা ওঠো গাড়িতে।”
জাহরা লেহেঙ্গা ধরে ওঠার চেষ্টা করে।ফাইজ জাহরার লেহেঙ্গা এক পাশ ধরে সাহায্য করে জাহরাকে গাড়িতে উঠে বসতে।জাহরা মোলায়েম হেঁসে বলে,”ধন্যবাদ।”
“রেখে দাও তোমার ধন্যবাদ তোমার কাছে দরকার নেই আমার।”,বলে গিয়ে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে।
জাহরা হেঁসে বলে,”ইশ মিস্টার ফাইজ আজ না আপনাকে আমার ড্রাইভার ড্রাইভার লাগছে।”
ফাইজ ভ্রু কুঁচকে চায় জাহরার দিকে ঝুঁকে এসে বলে,”কী বললে?”
“ইয়ে মানে ভাই ভাই লাগছে।একবারে বড় ভাই।”
ফাইজ তার শাহাদাত তর্জনী নিজের দিকে তুলে বলে,”আমাকে তোমার বড় ভাই লাগছে?”
জাহরা অন্য দিকে মুখ করে বলে,”তাহলে আর কী লাগতে পারে এই আধ বুড়ো কে?”
ফাইজ নিজের স্থানে এসে বলে,”আমি আধ বুড়ো না বরং তুমি বুড়ি, বুড়ীদের নানি তুমি বুঝলা।”
জাহরা ভাব নিয়ে বলে,”আই এম দা অনলি ওয়ান সুন্দরী।”
“নো সুন্দরী অনলি কটকটি।”,বলেই ফাইজ মিটমিট করে হাঁসলো গাড়ি স্টার্ট করলো।
..
রাতের আকাশে চাঁদের আলোয় যেনো মেঘের ছড়াছড়ি দৃষ্টিগোচর হয় উঠছে।চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারিপাশ।
মেহরা নিজের ঘরের বারান্দার ফ্লোরে বসে চেয়ে আছে আকাশ পানে।পাশেই ফ্লোরে তার পড়ে থাকা ফোন বারবার বেজে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।এসপি,এএসপি সকলেই ফোন করে যাচ্ছে মেহরাকে।সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সকল জায়গায় এখন ম্যাজিস্ট্রেটরা তল্লাশি নামক তদারকী টা বাড়াবে বলে।রোহান ও তার বাবার সকল কারবার ফাঁস হলো বলে।
ফোন এর বেজে ওঠা শব্দ যেনো মেহরার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতে পারছে না,সে ভাবনার জগতে ডুব দিয়েছে।মেহরা আরশমান বাড়িতে এসেছে এক ঘন্টা হবে বইকি।মেহরা যখন ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে তখন তার চোখে পরে আরশমান।মেহরার ঘরের সকল জিনিস আরশমান চোখ বুলিয়ে দেখছিল বলছিল,”আমার বউয়ের ঘরটি কিন্তু খুব গোছালো,কিন্তু আমার বউটার মনের ভিতর টা খুব অগোছালো।আমার বউটাকে গুছিয়ে দিতে পারলে আমার থেকে বেশি প্রশান্তি হয়তো কেউই পাবে না। “,পিছন থেকে দাড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে আরশমান এর কথন শুনেছিল মেহরা।
.
মেহরা বিড়বিড় করে আওড়ালো,”আর কতদিন এই অগোছালো জীবন নিয়ে ঘুরঘুর করবো। আরশমান সত্যি বলছে,জীবন টাকে গুছিয়ে নেয়া খুব দরকার।আমার ভিতরের মানসিক চাপ থেকে অন্তত মুক্তি মেলবে আমার।”
মেহরার ভাবনার মধ্যে আরশমান এসে চুপটি করে বসে যায় মেহরার পিছনে।মেহরা অনুভব করে তার পিছনে কেউ বসে আছে নিশ্চই আরশমান।মেহরা চুপ করে রয় কোনো কথাই শুধায় না সে।আরশমান পড়ে থাকা ফোনটি হাতে তুলে নেয় অন/অফ বাটন চেপে ধরে রেখে বন্ধ করে দেয় ফোনটি।কণ্ঠের রেশ টেনে বলে,”ফোন বন্ধ করে দিয়েছি মেহরা।আপনার কী চিন্তা হচ্ছে খুব?”
মেহরা প্রতিউত্তরে বলে,”তেমন চিন্তা হচ্ছে না তবে অন্যায় কারবারের সাথে জড়িত সকলকে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে পারব তো আমরা?নাকি কালই আমাকে আর জুনায়নাকে সাসপেন্ড করে দেয়ার ব্যবস্থা করবে?”
আরশমান হাত বাড়িয়ে মেহরার খোপা করা কেশ উন্মুক্ত করে দিলো,পিঠে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কেশ।মেহরা ক্ষীণ কণ্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,”বাঁধা চুল গুলো কেনো খুলে দিলেন আরশমান?”
আরশমান নিঃশব্দে হাঁসে মেহরার চুলের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে দেয় আলতো করে ম্যাসাজ করে দিতে শুরু করে।মেহরা আবেশে আঁখি পল্লব বুজে নেয়,তার মাথা যন্ত্রণা করছিল খুব, এই ম্যাসাজ টার খুব প্রয়োজন ছিলো।আরশমান বলল,”ম্যাজিস্ট্রেটরা নামছে তল্লাশি চালাতে,এখন কে কী করবে?আর রইলো সাসপেন্ড দেখা যাবে।”
মেহরা আশ্বস্ত হলো।আরশমান মেহরার চুলের ভাঁজ থেকে হাত সরিয়ে মেহরার বাহু ধরে তাকে টেনে নিজের খুব নিকটে নিয়ে আসে। বক্ষের সঙ্গে লেপ্টে জড়িয়ে ধরে মেহরাকে।মেহরা কিছুটা হাসফাঁস করে পরমুহুর্তেই বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজের ভর টুকু ছেড়ে দেয় আরশমান এর উপর।আরশমান উপলব্ধি করে তা,মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মেহরার।
মেহরা কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ রয়ে বলে,”আরশমান।”
“জি বলুন।”
“আমি আপনাকে সুযোগ দিতে চাই।আপনি গুছিয়ে দিন আমার জীবনটাকে।এই অগোছালো জীবন সইছে না আমার।গুছিয়ে দিবেন না আমার জীবনটাকে?”, দ্বিধাহীন কণ্ঠে কথাগুলো বলে দিলো মেহরা।
আরশমান অধর ছোঁয়ালো মেহরার চুলের ভাঁজে নম্র কণ্ঠে বলল,”আপনার জীবন মানেই আমার জীবন মেহরা।আপনি তো আমার প্রাণ ,আর নিজের প্রাণ টাই যদি অগোছালো হয় তবে আমি কি করে স্বস্তিতে থাকি বলুন।”
মেহরা এবার প্রতিউত্তর করলো না,এক হাতে আরশমান এর পিঠের দিকে টিশার্ট খামচে ধরে রাখলো।আরশমান দুই হাতে আরও দৃঢ় ভাবে জড়িয়ে নিলো মেহরাকে,বলল,”আকাশ এর বুকে ছেড়ে দিন আপনার সকল কষ্ট।আকাশ তার বিশালতায় আপনার কষ্ট গুলো তার কোনো না কোনো স্থানে জায়গা করে নিবে,কষ্ট গুলোকে ঢেকে দিবে তার মেঘের আড়ালে।অতঃপর জীবনের এক নতুন সূর্য উদয়ে সাহায্য করবে আপনাকে;আমাকেই আপনি নাহয় আপনার সেই আকাশ ভেবে নিন মেহরা।”
আজ যেনো ইচ্ছে করছে আরশমানকে জাপটে জড়িয়ে মনের ভিতর চেপে রাখা সকল কষ্ট গুলো তাকে বলে দি।মনকে হালকা করে ফেলি।এবার মেহরা দুই হাতে খামচে ধরে রাখলো আরশমান এর টি শার্ট।কথা বলতে চেয়েও বলতে পারলো না,কণ্ঠে সকল কথা দলা পাকিয়ে এসেছে।
আরশমান বলে,”কাদতেঁ ইচ্ছে করছে মেহরা?”
মেহরা মাথা নাড়ালো।
“তাহলে কেঁদে ফেলুন।কিন্তু এবারই শেষ আর কখনও যেনো আপনার চোখে অশ্রু না দেখি।”
..
বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে আঞ্জুমানকে নিয়ে গল্পের আসর বসায় জুনায়না, প্রশান্ত।এখন দুজনেই ঘরে চলে এসেছে,প্রশান্ত ট্যাব ও ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।জুনায়না বারান্দায় দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।প্রশান্ত ল্যাপটপ এর স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে চাইলো জুনায়নার দিকে।চেয়ে রইলো মুগ্ধ নয়নে, পূর্বে তো এতটা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখতে পারতো না জুনায়নাকে।জুনায়নার সঙ্গে চোখাচোখি হলো প্রশান্তর।জুনায়না হাঁসলো ভ্রু নাচিয়ে চোখের ইশারায় যেনো জিজ্ঞেস করলো,”কী দেখছেন এমন করে?”
প্রশান্ত চোখের ইশারায় বলল,”তুমিটাকে”
জুনায়না ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটিয়ে অনিমেষ চেয়ে রইলো প্রশান্ত’র দিকে।প্রশান্ত ল্যাপটপ কোল থেকে নামিয়ে এগিয়ে গেলো জুনায়নার দিকে,প্রশান্তকে এগিয়ে আসতে দেখে জুনায়না ফোনের ওপর পাশের মানুষটিকে বলল, পরে কথা বলছি।বলে ফোন কান থেকে নামিয়ে নিলো।প্রশান্ত সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই জুনায়না প্রশান্তর দুই কাঁধে হাত রেখে বলে,”আজ এমন করে তাকিয়ে আছেন যে প্রশান্ত বাবু?”
“বউকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি।”
জুনায়না ঠোঁট কামড়ে হাঁসলো।সে পায়ের পাতায় উচুঁ হলো কিছুটা প্রশান্তর দুই গালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলল,”আমি তো এই প্রশান্তকে দেখে প্রতিদিনই মুগ্ধ হই।শখের পুরুষ যে আপনি আমার।”
🍁
এক নতুন দিনের আরম্ভ হলো।সূর্য তার প্রকট রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরণীতে সকাল থেকে একের পর এক সদ্য পাওয়া সংবাদ দেখাচ্ছে টিভির পর্দায়।আরশমান উপভোগ করলো প্রত্যেকটি সংবাদ।গতকালের একটি ঘটনার মাধ্যমে যে এত দ্রুত তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে আরশমান ওত টা আশা করেনি।
এসপি ও এএসপি তারা তাদের পদ নিয়ে টানাটানিতে পড়েছে একপ্রকার।এক রাতেই যেনো একেকজনের অবস্থা নাজেহাল হয়ে উঠেছে।মেহরা গিয়েছে থানায়।
আরশমান প্রথম সংবাদ দেখেই মেহরাকে ফোন করেছিল হেঁসে বলেছিল,”মেহরা আপনার পদ নিয়ে টানাটানি কী করবে দেখুন না তারা তাদের পদ ধরে রাখতে পারে কিনা।”
মেহরা ও জুনায়নার মস্তিষ্ক থেকে অর্ধাংশ চিন্তা যেনো নেমে যায়।
..
হাসপাতাল এ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বিভাগে নতুন কয়েকজন ডাক্তার এসেছে।ফাইজ তাদের সঙ্গে দাড়িয়ে কথনে মগ্ন।সুদূরে দাড়িয়ে জাহরা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে সকলে দিকে।নবীন ডাক্তারদের মধ্যে একজন পুরুষ বাকিরা নারী ডাক্তার।
জাহরা বিড়বিড় করে,”এমন মেয়েদের মাঝে খাম্বার মত দাড়িয়ে আছে কেনো এই ফাজিল?”
#চলবে।