#অতুলনীয়া
#পর্বঃ২৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ফাতেমা আজ বাড়িতে ফিরতেই শুনতে পায় তার ভাই-ভাবির গোপন কথা। তাদের কথা কানে আসতেই ফাতেমা হতবাক হয়ে যায়। তারা দুজন ফাতেমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিল! মোহনাই মূলত এই প্রসঙ্গ তুলেছিল। সে ফাহিমের উদ্দ্যেশ্যে বলছিল,
“তুমি ফাতেমার কথাটা একটু ভেবে দেখো। ওর জীবনের তো এখনো অনেক গতিপথ বাকি। একবার নাহয় একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে জীবনের সবথেকে বড় ভুল কাজটা করেছে..কিন্তু সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সম্ভাবনাও তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি তাইনা?”
ফাহিম উত্তরে শান্তস্বরেই বলল,
“তাহলে তুমি কি চাও? কি করা উচিৎ এখন আমার?”
“তুমি ফাতেমার জীবনটা আবার গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো৷ ওর জন্য একটা ভালো ছেলে..”
মোহনা নিজের বলা কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ফাতেমা চলে আসে তাদের কথার মাঝে। এসেই নম্র কন্ঠে বলে,
“দুঃখিত তোমাদের কথার মাঝে এভাবে ঢুকে পড়ার জন্য কিন্তু আমার কিছু কথা বলার আছে তোমাদেরকে। আমি জানি, তোমার আমার খারাপ চাও না, ভালোই চাও৷ কিন্তু আমার ভালো চাইতে গিয়ে তোমরা যা করতে চাইছ আমি এখন সেটার জন্য প্রস্তুত নই৷”
ফাতেমার এহেন কথা শুনে মোহনা বলে,
“কেন প্রস্তুত নও তুমি ফাতেমা? তোমার জীবনে তো এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। এত জলদি কেন হার মানতে চাইছ?”
“আমার জীবনের এখন একমাত্র উদ্দ্যেশ্য, আমার মেয়ে, আমার ফারিয়াকে ভালো করে মানুষ করা। এছাড়া আমি আর কিছু চাই না৷ আর তাছাড়া একে তো আমি ডিভোর্সি তার উপর একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা আছে, কে বিয়ে করবে আমায়? আর আমি যদি বিয়ে করেও নেই তাহলে আমার ফারিয়ার ভবিষ্যৎ কি হবে? কেউ কি অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসা দিতে পারে? যেখানে ওর বাবার থেকেই পর্যাপ্ত ভালোবাসা পায়নি সেখানে অন্য কারো থেকে ভালোবাসা আশা করা ঠিক নয়। আমি এমন কিছু আশা করছিও না। জাস্ট আমার কিছু ভালো লাগছে না। তোমরা প্লিজ আর এই বিষয় নিয়ে কথা বলো না।”
মোহনা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই ফাহিম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“এই ব্যাপারে আর কথা না এগোনোই ভালো কারণ ফাতেমা এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।”
মোহনা দমে যায়। আর এগোয় না কথা। ফাতেমাও নিজের রুমে চলে যায়। বিয়ের কথা শুনে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। এখন সে তার বাকিটা জীবন নিজের মেয়েকে নিয়েই কাঁটাতে ইচ্ছুক। অন্য কিছু নিয়ে ভাবনা একদম নেই তার। ফাতেমা নিজের রুমে এসে ঘুমন্ত ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এখন তুই আমার সব। তোকে ছাড়া আর অন্য কোন কিছুকে আমি গুরুত্ব দিবো না। আমার কাছে তুই ছাড়া আর কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোকে বুকে জড়িয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিব।”
৪৯.
ফাতেমা নতুন একটা শাড়ির বুটিক হাউজ খুলেছে। এজন্য তার বড় ভাই ফাহিম ও বান্ধবী শ্রেয়ার অবদান অনস্বীকার্য। তাদের সহায়তায় ফাতেমা সব কিছুর জোগাড় করেছে। বর্তমানে সে নিজের বুটিকে এসেই বসে আছে। প্রথম প্রথম হলেও তার ত্রেতার অভাব নেই। অনলাইনের সুবাদে যাদের সাথে সে পরিচিত হয়েছিল তারা সবাই এখন ফাতেমার রেগুলার কাস্টমার হয়ে গেছে৷ তাই ফাতেমার দিনকাল ভালোই যাচ্ছে। এর পাশাপাশি সে পড়াশুনাও চালিয়ে যাচ্ছে এবং নিজের মেয়েকে যথেষ্ট সময়ও দিচ্ছে। এর বাইরে আর কি চাই জীবনে!
নেহা মির্জা ফাতেমার বুটিক হাউজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা, ❝ফারিয়া বুটিক হাউজ❞
নেহা মির্জা বারকয়েক সেটা পড়লো। এমন সময় তার ফোনে কেউ কল দিলো। ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে কেউ বলে উঠল,
“তুমি কি ওখানে পৌঁছে গেছ?”
“হ্যাঁ, আমি বুটিকের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি।”
” যা, যা বলেছি তাই করবা। কোন ভুল যেন না হয়। ফাতেমার বিশ্বাস তোমাকে জয় করতেই হবে।”
নেহা মির্জা আচ্ছা বলে কলটা কে*টে দেয়। অতঃপর এগিয়ে যায় বুটিকের ভেতর। ফাতেমার একদম কাছে গিয়ে বলে,
“হ্যালো…”
ফাতেমা ভদ্রতার সহিত হেসে বলে,
“জ্বি, বলুন কি প্রয়োজন।”
“আপনিই ফাতেমা খাতুন তাইনা?”
“জ্বি, আমি ফাতেমা খাতুন। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
“আমাকে না চেনাটাই স্বাভাবিক। তবে আমার নাম বললে ঠিকই চিনবেন। আমার নাম নেহা মির্জা।”
হঠাৎ করেই ফাতেমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে শক্ত কন্ঠে বলল,
“নয়না মির্জার বড় বোন নেহা মির্জা?! আপনি কি করতে এসেছেন এখানে?”
“বড়বোন নয়, সৎবোন।”
ফাতেমা একটু শান্ত হয়। নেহা মির্জা বলতে থাকে,
“নয়না যতটা না অন্যায় তোমার সাথে করেছে তার থেকে দ্বিগুণ বেশি অন্যায় ও আমার এবং আমার মায়ের সাথে করেছে। আমাদের জীবনটা একেবারে নরক করতে দিয়েছে। ওর জন্য আমি কখনো শান্তি পাইনি কখনো না…”
ফাতেমা নেহা মির্জার ব্যাপারে এত কিছু জানত না। শুধু জানত সে নয়নার সৎ বোন। ছোট থেকেই হোস্টেলে রাখা হয়েছিল নেহাকে। আর একটু বড় হবার পর সে চলে যায় লন্ডনে। তাই ছোটবেলা থেকে নয়নার সাথে বন্ধুত্ব থাকার পর তার বড় বোনকে সেভাবে জানার সুযোগ হয়নি। নেহা মির্জা ফাতেমার সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। ফাতেমাও তার সাথে কিছুটা কথা বলে। এরপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। তখন নেহা মির্জা বলেন,
“আমি তাহলে এখন যাই। আবার কিন্তু আসবো।”
ফাতেমা মৃদু হেসে বলে,
“আচ্ছা।”
৫০.
বিকেলবেলায় বুটিক থেকে বেরোলো ফাতেমা। তবে সে আজ বেশ বিপদেই পড়ে গেলো। আজ শ্রমিক সংগঠনের ধর্মঘটের কারণে রাস্তায় কোন রিক্সা বা সিএনজি নেই। শুধু কিছু প্রাইভেট কার আর মোটরসাইকেল দেখা যাচ্ছে। ফাতেমা বেশ অসহায় বোধ করল। এখান থেকে তার বাসা প্রায় অনেকখানি দূরত্বের পথ। হেটে যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। তাই এখন কিভাবে যাবে সেটা বুঝতে পারল না সে। এমন সময় তার সামনে এসে বাইক নিয়ে থামলো কেউ। ফাতেমার লোকটাকে ঠিক চেনা চেনা লাগল। লোকটা হেলমেট খুলতেই সম্পূর্ণ রূপে চিনতে পারলো। ইনি তো ইন্সপেক্টর নুহাশ খন্দকার। নুহাশ ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এখানে?!”
“জ্বি, কেন, কোন সমস্যা?”
“আজ তো এখানে শ্রমিক ধর্মঘট চলছে। যায়গাটা সেইভ না।”
“একচুয়ালি এখানে আমার শাড়ির বুটিক। আমি সকালে যখন এসেছিলাম তখন এত ঝামেলা ছিল না।”
“ওহ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনি এখন এখানে তো কোন যানবাহন পাবেন না। আর এখান থেকে আপনার বাসাও বেশ খানিকটা দূরে। আপনি চাইলে আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।”
ফাতেমা কিছুটা ইতস্তত বোধ করল। তবে তার কাছে এখন এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই আর বেশি কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেল। নুহাশ খন্দকার তাকে বাইকে বসতে বললো। ফাতেমা বেশ দূরত্ব রেখেই বসল। অতঃপর নুহাশ খন্দকার বাইক চালাতে শুরু করল। তিনি বেশ আস্তেই চালাচ্ছিলেন যাতে ফাতেমার কোন অসুবিধা না হয়। নুহাশ আজ পুলিশ ইউনিফর্মে নয় সিভিল ড্রেস পড়েছে। ফাতেমার ব্যাপারটা একটু অবাক লাগল। একজন অন ডিউটি পুলিশ অফিসার সাধারণত সিভিল ড্রেস পড়ে না। তাই সে আর কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে নুহাশ খন্দকারকে এই বিষয়ক প্রশ্ন করল। নুহাশ হেসে বলল,
“অপরাধী ধরতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের অনেক গোপন মিশনে থাকতে হয় গোপন পরিচয়ে।”
ফাতেমা আর কথা বাড়ালো না। বাকি পথটা তাদের নিভৃতেই কে*টে গেলো। ফাতেমাদের বাড়ির সামনে এসে বাইক থামিয়ে নুহাশ বললো,”এসে গেছি।”
ফাতেমা নুহাশকে ভেতরে আসতে বললে সে আপত্তি জানায়। ফাতেমাও জোর করে না। এমন সময় নুহাশ খন্দকারের ফোনে কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,
“কি বলছ তুমি? নয়না মির্জা জেল থেকে পালিয়ে গেছে!”
ফাতেমার কানে কথাটা আসতেই বরফের মতো জমে গেল সে!
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨