ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া মেঘলা দুই

0
501

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া মেঘলা

দুই

“শুক্কুরবার রুপার পাকা দেখা কালকে যেন তোরে নিচে নামতে না দেখি৷”
থমথমে মুখে বললো খোদেজা বেগম৷ বয়স তার কত হবে মেয়েটি জানেনা৷ তবে এখনো তার হুংকারে বাড়ি কাঁপে৷ বড় ছেলে তো এক কথায় মায়েরই ইশারায় চলে৷ স্বামীটা মারা গেছেন যুগ পার হয়েছে বোধহয়৷ বয়স বাড়লেও মহিলাটির শরীর দেখে মনে হয় যেন বয়স সংখ্যা মাত্র৷পা পিছলে পরে হাটুতে ব্যাথা পেয়েছে সপ্তাহখানেক যাবত হাটাচলা করতে লাঠির প্রয়োজন পরছে৷ চুলে পাক ধরলেও মেহেদী দেওয়ার ফলে লাল টকটকে হয়ে আছে কেশ গুলো৷ বিনুনি করলে এখনো কোমর ছাড়ায়৷
“শাহওয়াজ কে গিয়ে চা-টা দিয়ে আয় তো ময়ূরাক্ষী৷”
বড় মায়ের কথায় ধ্যান ভা’ঙলো অষ্টাদশী ময়ূরাক্ষীর৷ দাদিজান এর কথা এখন আর তার গায়ে লাগে না৷ একবারেই লাগে না তা না, মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় তার৷ অম্বরের মত তার ও চোখে মুখে আঁধার নামে কিন্তু অঝোর ধারার মত যখন আঁখি বাঁধ ভাঙে তখনি আগলে নেয় তার রুপাবু৷ আহ্লাদ করে সব কষ্ট যেন নিমেষে ভুলিয়ে দেয়৷
ময়ূরাক্ষী যখন চা নেওয়ার জন্য এগিয়ে যাবে দাদিজান হুংকার তুলে বলে উঠে,
“খবরদার আমার নাতীর ঘরের আশেপাশে যেন তোকে না দেখি মুখপুরী৷ আমার নাতীর কাছাকাছি ও ঘেঁষবি না তুই৷”
কেঁপে উঠলো মেয়েটা৷ সরে এলো দু-কদম,রাবেয়া ও ভয় পেলো যেনো৷ খোদেজা এবার আগের ন্যায় বললো,
“বড় বউ আমার পোলা কি বলছে তোমারে? আমার নাতীর দেখাশোনা তুমি করবা কোনো কাজের লোক বা বাইরের মানুষ না৷”
শেষ এর কথাটা ময়ূরাক্ষীর দিকে তাকিয়েই বললো দাদিজান৷ রসুইঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে৷ ময়ূরাক্ষী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ সে ও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো৷ মৃদুলার কাছে শুনেছে রাস্তায় তাদের কাছে ঠিকানা জানতে চাওয়া লোকটাই এ বাড়ির বড় ছেলে শাহওয়াজ৷ আকবর চৌধুরীর বড় পূত্র৷
অষ্টাদশী ময়ূরাক্ষী খুব একটা বোকাসোকা না হলেও মৃদুলার সে কথা মস্তিষ্কে যেন গেঁথে গেছে৷ তার সাথে লোকটা ও তো বলেছিলো দেখা হলে সত্যি সত্যি চুমু খেয়ে বসবে? ইশ কি কথা বার্তা৷ ওই লোকের সামনে তো ভুল করেও যাবেন না ময়ূরাক্ষী৷
রাবেয়া ও চা নিয়ে বের হলো রাতের খাবারের সময় হয়ে যাচ্ছে স্বামী আর শাশুড়ী জানতে পারলে কেলেংকারী হবে শাহওয়াজ এর ঘরে এখনো চা নাস্তা যায়নি শুনলে৷ রাবেয়া চা টা ধরিয়ে দিলো রুপার হাতে, তার শাহওয়াজ কে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা অনেক৷ স্বামীর ছেলেতো নিজেরো ছেলে কিন্তু কেন যেন সে সাহস হয়ে উঠছে না৷ তা দেখে কি ভাববে ছেলেটা তার জানা নেই৷ এ বাড়ির অনেক কিছু এখনো তার কাছে রহস্যের, বাড়িতে এসেছে তো বহুবছর হলো৷ প্রায় দু-যুগ এখনো যেন সব আবছা অস্পষ্ট৷ শুনেছে শাহওয়াজ বিলেত থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে এখন মা কে নিয়ে ঢাকা থাকেন৷
রুপার হাতে চা তুলে দিয়ে ক্ষ্যান্ত হননি রাবেয়া গুটি গুটি পায়ে মেয়ের পিছু পিছু সে ও ঘর অব্দি এলেন৷ দুয়ার আটকানো রুপা দু দু বার কড়া নাড়ার পর থম থমে মুখে খুললো কপাট শাহওয়াজ৷ গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কি চাই?”
নেড়ে উঠলো রুপার হৃদয়৷ ভাইজান তো আব্বার মতই কেমন থমথমে হয়ে কথা বলে৷ রুপা শুকনো ঢোক গিললো মিনমিনিয়ে বললো,
“ভাইজান আপনার চা নাস্তা নিয়ে এসেছি৷”
শাহওয়াজ দুয়ার ছেড়ে দাড়ালো৷ ইশারায় ভিতরে ঢুকতে বললো তাতে যেন মনে আর একটু জোর পেলো রুপা৷ চকচক করে উঠলো মুখচোখ৷ যেন চাঁদ পেলো হাতে শির নিচু করে কক্ষে প্রবেশ করলো মা বলেছে তাকে ভাইজান এর সামনে মাথা উচু করে কথা বলবিনা ভাইজান এর চোখের দিকে তাকাবি না তাতে অসম্মান করা হবে৷ আর ছোটো বেলা থেকেই রুপা মায়ের এর কথা শুনে চলতেই পছন্দ করেন৷ চা রাখলো বিছানার সাথের টেবিলখানায়৷ এ রুমটায় প্রথম আসলো রুপা৷ ছোটো বেলা থেকে দেখে আসছে এ একটা রুম তার বাবা বেশ যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন তার ছেলের জন্য এ রুমটা পরিষ্কার এর দায়িত্ব আলাদা এক কাজের লোককে দেওয়া৷ যাকে কখনো দেখেনি তার জন্য তার বাবার এত আগ্রহ দেখে মাঝে মাঝে রুপা বেশ আবেগে আপ্লুত হয়ে পরে৷
রুপা এবার মাথা নিচু করেই বললো,
“ভাইজান নয়টা বাজে আব্বা বলেছে খাবার কক্ষে আসতে সেখানে আপনার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিবে৷”
রুপার কথায় তেমন আগ্রহ প্রকাশ করলো না শাহওয়াজ এ বাড়ির সব লোককে চেনেন শাহওয়াজ, না আসলে কি হবে? না দেখলে কি হবে এদের নাড়ী নক্ষত্র সব জানা৷
রাবেয়া এখনো উঁকি দিয়েই দেখছে আগ্রহ নিয়ে৷ কি সুন্দর ছেলেটা একদম যোগ্য জমিদার পূত্র৷ এ ছেলেটি তার ও ভাবতেই কেমন ভালো লাগে৷ শাহওয়াজ নিজের লাগেজ থেকে একটা ব্যাগ বের করলো রুপার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা তোমার জন্য৷তোমার নাম রুপা তাই না? আকবর চৌধুরীর সু-যোগ্য কন্যা?”
ভাইজানের মুখে বাবার নাম শুনে ভরকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুপা৷ বাবার নাম বলতে হয় নাকি?মোটেও পছন্দ হলো না রুপার৷ তবে উপহার না নিয়ে ভাইজান কে অসম্মান করতে পারলো না৷ ভাইজান কি করে জানলো? উপহারের ব্যাগ টা নিলো রুপা চোখে মুখে আনন্দ উপচে পরছে৷ রাবেয়া ও আড়ালে চোখ মুছলো৷ সরে গেলো সে, সে ভেবেছিলো মেয়েটাকে দেখে যদি ভালো মন্দ বলে?
রুপা ও উপহার টা নিয়ে বললো,
“আপনি কি করে জানেন আমার নাম রুপা?”
শাহওয়াজ চায়ে চুমুক বসাতে বসাতে ঠোঁটে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে চোখ ঘুরিয়ে চারোপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বললো,
“সব জানি৷”
রুপা চলে গেলো৷

“আপনি কি আমার বুবুরে চুমু খাইতে আসছেন ভাইজান?”
মৃদুলার কথায় দরজা বন্ধ করতে গিয়েও থামলো শাহওয়াজ৷ রক্ত মাথায় উঠলো তৎক্ষনাৎ, এটাইতো সেই পাঁকা মেয়েটি আবার শুরু করেছে৷
দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“না তোমার বুবুকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছি৷”
ইচ্ছে করছে কানের নিচে দু-চারটা মে’রে দিতে৷ তবুও নিজেকে সংযত করতো এই ভেবে বাচ্চা মানুষ কিছু না বুঝে বলে ফেলে৷ শাহওয়াজ কি বললো কান অব্দি পৌছালো না রুপার৷ সেই আবার বললো,
“আপনি কি রুপাবুর ভাইজান? তাহলেতো আমার ও ভাইজান তাই না?”
শাহওয়াজ একটু নরম হলো দরজা খুললো বললো,
“ভেতরে এসো৷”
ভারী নেত্র পল্লব উপর নিচ করলো মৃদুলা উৎকন্ঠা হয়ে বললো,
“তাহলে আমাকেও রুপাবুর মত উপহার দিবেন?”
শাহওয়াজ হাসলো৷ মুখে বড় দের মত পাঁকা পাঁকা কথা বললেও সভাবসুলব বাচ্চাই মেয়েটা৷ ভেবেছিলো কিছু বলবে৷ মায়া হলো এখন৷ ক্ষানিকটা ঠান্ডা হলো মাথা আবারো বললো,
“আমিতো তোমায় চিনিনা তাই তোমার জন্য আনিওনি কিছু৷ তবে চকলেট দিতে পারবো খাবে?”
কিছু আনেনি শুনে মৃদুলার মুখ খানা ছোটো হয়ে গেলেও চকলেটের কথা শুনে মন নেচে উঠলো হুরমুরিয়ে ঘরে ঢুকলো৷
শাহওয়াজ ব্যাগ এর ছোটো পকেটটা থেকে চকলেট বের করতে যাবে ঠিক তখনি রুনঝুন শব্দ তুলে কুড়িয়ে পাওয়া নুপুর টা নিচে পরলো নিচে৷ কৌতুহল নিয়ে মৃদুলাও তাকালো সে দিকে তড়িৎগতিতে নুপুরটা তুলে নিয়ে বললো,
“ওমা বুবুর নুপুর আপনার কাছে কেন ভাইজান?”
নুপুরটা কখন যে প্যান্টের পকেট থেকে কখন যে ব্যাগে রেখেছে তাও মনে নেই শাহওয়াজ এর৷ এর কথাতো প্রায় ভুলে বসেছিলো৷ মৃদুলার কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো শাহওয়াজ এর৷ অধীক কৌতুহল জাগলো৷ সে ডাগর ডাগর হরিণী চোখের মেয়েটির কথা কি বলছে মেয়েটা? কোথায় সে? কই তাকেতো নিচে দেখলোনা৷
শাহওয়াজ কিছু বলবে তার আগেই মৃদুলার ডাক পরলো৷ মায়ের কন্ঠ শুনে নুপুর রেখেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো মেয়েটা৷ সে যে মা কে বাঘের ন্যায় ভয় পায়৷
শাহওয়াজ এর মনে কৌতুহল বেড়েই চললো, কে সেই মেয়ে? আঁখি ও যে কথা বলে তা বোধহয় সে নারীর নেত্র না দেখলে বুঝতোই না৷ কখনো অগ্নীদৃষ্টি কখনো বা ভীত৷ চোখ দিয়েও যেন হাজার কথা বলে ফেলতে পারে সে মেয়ে৷ একটু দেখায় এত কৌতুহল? ফের কি দেখা হবে সে মেয়েটির সাথে?

..

সন্ধ্যে কে’টে রাত্রি নেমেছে ঘন্টা খানেক আগে৷ ঘড়ির কাঁটায় তখন সারে আটটা বাজে৷ এ বাড়ির নিয়ম নয়টা বাজলে যে যেখানেই থাকুক না কেন খাবার ঘরে থাকতে হবে৷ যার যতই রাজকার্য থাকুক না কেন৷
তবে ময়ূরাক্ষীর মনে অন্য চিন্তা সে যাবে কি যাবে না? দাদিজান বারণ করেছেন কিন্তু একটু আগেই বড় পা ডেকে পাঠিয়েছেন৷
এ সুবিশাল অট্টালিকায় বড় বড় কক্ষ থাকলেও চিলেকোঠার এ ঘরটি ময়ুরাক্ষীর জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে৷ বাড়ির বাইরে কিছুটা দুরই কাজের লোকদের জন্য ঘর বানানো হয়েছে, রাত দশটার পর কোনো কাজের লোকের অন্দরে প্রবেশ নিষেধ তবে সে তো কাজের লোক নয়৷ কি তার পরিচয় তা ময়ূরাক্ষী জানেন না শুধু জানেন সে এ বাড়ির আশ্রিতা৷ বাবা মায়ের কথা জানেন না ময়ূরাক্ষী, শুধু জানেন বড় বাবা নাকি তাকে পেয়ে বাড়িতে এনেছেন৷ সেই শিশুকাল থেকেই বড় মায়ের হাতে মানুষ সে৷ এ বাড়ির প্রতিটা মানুষ ভিন্ন প্রকৃতির৷ খোদেজা বেগমের চার ছেলে এক মেয়৷ পাঁচজন পাঁচ রকমের৷
ভাবতে ভাবতেই নিচে নামলেন ময়ূরাক্ষী, ঘোমটা টেনে রসুই ঘরে প্রবেশ করলো সে৷ সে আসতেই সবাই স্বাভাবিক থাকলেও রাহেলা মানে জমিদার বাড়ির সেঝো বউ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো,
“সারাদিন ধেইধেই করে কোথায় ঘুরে বেড়াস রে ময়ূর? খেয়ে পড়ে তো অন্য ধ্বংস করছিস মাঝে মাঝে টুকটাক কাজে হাত লাগালেওতো পারিস৷
ময়ুরাক্ষী কিছু বললোনা৷ তবে রাবেয়ার এসব কথা পছন্দ হলো না সে বললো,
” মেয়েটা সারা দিনই কাজ করে তোর চোখেই পরেনা রাহেলা৷”
ময়ুরাক্ষী হাসে৷ এইযে তার এ মানুষ টা হলে আর ভয় কিসের?বড় মা পেয়াজ কা’টছে তার হাত থেকে টেনে বটিটা নিলো৷ এর মাঝেই কানে এলো হাসির কন্ঠ রসুই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মায়ের কথার ফোড়ন কেঁটে বললো,
” তুই আবার নিচে নেমে এসেছিস ময়ূর? তোরে না দাদিজান বলছিলো ভাইজান যতদিন আছে ততদিন নিচে কম আসতে?”
রাহেলা বেগম যেন আরো সুযোগ পেলেন বললেন,
“ও শুনবে মায়ের কথা? কিছু না থাকলেইকি? আল্লাহ তো ঢেলে রুপ দিয়ে দিছে ওই রুপ দিয়ে মানুষ কি কইরা ফাসাইবো সব সময় তো তাই ভাবে৷”
মায়ের কথায় পৈশাচীক আনন্দ পেলো হাসি৷ এর মাঝেই পান চিবোতে চিবোতে ঢুকলো খোদেজা৷ ময়ূরাক্ষী তার দু-নয়নের বিষ সবাই জানে৷ রাহেলা, হাসি খুশি হলেও রাবেয়া যেন ভয় পেলো৷ শাশুড়ী কিছু বলবে তার আগেই বললো,
“আম্মা ওকে কিছু বলবেন না, আমিই ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম৷”
খোদেজা কিছু বললেন না শুধু থমথমে কন্ঠে বললেন,
“ঘরে যা ময়ূর৷ তোর খাবার ওখানেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ ”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

[প্রথম পর্বে “ময়ূরাক্ষী” বানানটা ভুল হয়েছিলো৷ এ পর্বতে ঠিক করে দিলাম৷ কেমন হলো জানাবেন]

সূচনা:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/973248687730237/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here