ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা আঠারো

0
430

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

আঠারো

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত তখন! আঁধার ধরণীকে গ্রাস করেছে আলো ফুরিয়েছে সেই কখন৷ এই কৃষ্ণ কালো মত আঁধার নেমে এলো সৌহার্দ্যনিবাসে৷ ঝলমলে হৈ-হুল্লোড় করা সৌহার্দ্যনিবাস হুট করেই নিরব, নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো৷ এত এত আলোর মাঝেও যেন অন্ধকার নেমে এলো৷ অতঃপর বুক জুড়ে কষ্ট আর আহাজারি৷
নির্লিপ্ত হয়ে বৈঠক খানায় বসে আছে রুপা তার চারোপাশে বসে আছে তার বাড়ির লোকেরা৷ শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে এক এক জন৷ শান্তনা গুলো কেমন বিষাক্ত লাগছে তার৷
কিছুক্ষণ পর পর কেমন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে বুক চিড়ে৷ নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরি উপহাস করতে ইচ্ছে করছে৷
কেন সে রাজি হলো এই বিয়েতে? সে তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়নি! রুপার পড়াশোনার ইচ্ছে ছিলো ব্যাপক৷
কে বলেছি তার পিছু নিতে কে বলেছিলো বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে? কেই বা বলে ছিলো নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত করাতে? কে বলেছিলো এত আশা দিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য করাতে? সে অপেক্ষায় ছিলো পথ চেয়ে ছিলো৷ এ অপেক্ষা টা কি না করালে হতো না? সবেইতো সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভুতি গুলো ডানা ঝাপটাচ্ছিলো৷
এর মাঝেই ডানা গুলো কেঁ’টে দিলো যেন৷
তবে এটা ভেবে নিজেকে শান্তনা দিতে পারছে বহুরুপী মানুষকে ভালোবাসতে শুরু করেনি৷

“কইছিলাম ওই মুখপুরিরে বেশি মাথায় তুলতে না৷ তুলছিলি না? এখন তোর কপাল খানা পুড়ায়া দিলো দেখলিতো?”
রাহেলার কন্ঠে হুস ফেরে রুপার৷ রুপা আজ নির্বাক কিছু ভাবতে বা বলতে ইচ্ছে করছে না তার৷ আপাতত তার মস্তিষ্ক এত চাপ নিতে পারছে না৷

নূর জামান মানে রাহেলার স্বামী দূর থেকেই গলা খাকারি দিলো স্ত্রীর কথায় অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আম্মা মাফ করবেন একটা কথা বলছি৷ শুধুই কি ময়ূরাক্ষীর জন্য বিয়েটা ভে’ঙেছে? বড় ভাইজানের দরকার কি ছিলো এখন শাহওয়াজ কে এখানে আনার? আর আনার আগে তাদের এ ব্যাপার টা খোলামেলা বলা দরকার ছিলো৷”
চাচার পানে তাকালো রুপা৷ খোদজা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে৷ রাহেলার ব্যাপার টা বেশ লাগছে আকবর চৌধুরীর দাপট টা যদি এবার একটু কমে৷

রুপা তপ্ত শ্বাস টানলো৷ সে কেবল আজ নিরব দর্শক৷ আকাশের বাড়ি থেকে হুট করেই জানিয়েছে তারা ছেলেকে এ বাড়িতে বিয়ে দিবে না৷ প্রথম কারণ আকবর চৌধুরীর দুইটা বিয়ে এবং সে ছেলেকে এখানে আনা৷ আর দ্বিতীয়টি তাদের ময়ূরাক্ষীকে বউ হিসেবে চায় রুপা কে না৷
আজ রুপার আকাশের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব জানতে ইচ্ছে করছে কেন তাকে ভালোবাসি বললো যদি পছন্দই না ছিলো৷
সে ভালোবাসা কেমনই ছিলো যা অন্য রুপার থেকে দ্বিগুণ সুন্দরী মেয়ে দেখে মন পালটে যায়? ওটা কি আদৌ ভালোবাসা বলে?
আর শাহওয়াজ এর সাথেও তো সে দিন কত কথা বললো আকাশ৷
“দেখছিস রাবেয়া কইছিলাম কিন্তু পাত্তা দেছ নাই৷ সতীনের পোলার লাইগা মাইয়াটার বিয়া ভাইঙ্গা গেলো৷ এহন এই মাইয়া বিয়া করবো কে? টাকা থাকলেই সব হয় না৷”
রেজওয়ান সবেই নিচে নেমেছিলো হুট করে মহিলার কথা শুনে চোখ কুঁচকে আসে তার৷ আগের কথা গুলো কর্ণকুহর হয়নি তবে বিয়ে করবে কে এ কথাটা শুনেছে রেজওয়ান৷
ভারী অদ্ভুত এ জুগে এসেও এ মহিলা এসব বলছে?
এমন ভাব করছে যেন বিয়ের আসরে বর আসেনি৷ রুপার বিরক্ত লাগলো৷

রাবেয়ার ও পছন্দ হলো না কথা খানা উঠলো রুপা এবার৷
জামা কাপড় গুলো খুলতে হবে সকাল থেকে পরে আছে৷ যা হওয়ার হয়েছে বাঁচা গেছে বিয়ের পরে বা বিয়ের আসরে যে এমন হয়নি৷
সব থেকে বড় কথা মানুষ চিনতে পেরেছে এই অনেক৷ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে হাটা ধরলো নির্লিপ্ত হয়ে৷ পেছন থেকে রাহেলা বললো,
“আহারে মাইয়াটা কষ্টে পাথর হয়ে গেছে৷”
হুট করেই হাসি পেলো রুপার৷ কেন যেন একটু আগের মন খারাপ টা নেই৷ মনে হচ্ছে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে৷ তবুও উত্তর দিলো না রাহেলার কথার৷সামনে হাটা ধরলো৷ ময়ূরাক্ষীকে দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটা গেলো কোথায়? কেউ বকেছে নাকি?

যাওয়ার আগেই রুপা মা কে কন্ঠ নামিয়ে বললো,
“আমি একটু ঘুমাবো মা৷ কেউ যেন আমায় না ডাকে৷”
মেয়ের এমন কথায় রাবেয়ার মন ক্ষুন্ন হলো৷ মেয়েটা কি কষ্ট লুকাচ্ছে?
তার মেয়েটা বুঝি বেশি বড় হয়ে গেছে? এমন কেন হলো তার মেয়ের সাথে? মেয়েটাতো কোনো পাপ করেনি৷ কেঁদে উঠলো রাবেয়া৷
এর মাঝে বাড়িতে প্রবেশ করলো আকবর চৌধুরী৷ বাড়িতে তার পার্টি অফিসের মানুষেরা ছিলো তারা চলে গেছে তাদেরই এগিয়ে দিতে গিয়েছিলো সে৷
এমন একটা পরিস্থিতি হবেকে জানতো? ওই ছেলের পরিবার কে ছাড়বে না সে৷ দেখে নিবে৷

স্ত্রিকে কাঁদতে দেখে রাগ হলো তার গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আহা ঘ্যান ঘ্যান করো না তো রাবেয়া৷ মেয়ে ভেসে যায়নি বা আজ ওর বিয়ে ছিলো না৷ তোমাদের আহাজারি এমন কান্না বৈঠক দেখে মনে হচ্ছে মেয়ের বিয়ের আসর থেকে বিয়ে ভে’ঙেছে৷ আকবর চৌধুরীর মেয়ে ও হাজার পাত্র লাইন লেগে থাকবে৷ আমি যদি এ বাড়িতে এ নিয়ে কথা বলতে শুনি বা ময়ূর কে কেউ কিছু বলেছে শুনি তবে তার এ বাড়িতে সে দিনই শেষ দিন৷”
দাম্ভিকতার সাথে কথা গুলো বললো আকবর চৌধুরী৷ যেন কিছু হয়ই নি৷ এসব তার জন্য ব্যাপারই না৷
তার চিন্তা মেয়ের বিয়ে নিয়ে না৷ তার চিন্তা সামনেই ইলেকশন তার আগে এমন একটা কান্ড তা নিয়ে৷

রাবেয়া কাচুমাচু খেয়ে বসলেন৷ কথা গুলো যেন তার গায়ে লাগলো৷ এ লোকের দাম্ভিকতা সহ্য হলো না৷ ভা’ঙবে তবুও মচকাবে না৷

নিজের ঘর থেকে জামা কাপড় পালটিয়ে ছাদে এলো রুপা ময়ূরাক্ষীকে খুঁজতে৷ ভেবেছিলো ঘুমাবে একটু কিন্তু পাজি মেয়েটা এত জ্বালায় ঘুমাতে পারলো কই চিন্তায়?
মেয়েটা বুবুর ঘুম একটুও বোধহয় দেখতে পারেনা নয়তো এখন কোথায় যাবে আবার?
ময়ূরাক্ষীর ঘরটা খোলা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ঘরে প্রবেশ করলও৷ ঘরে আলো জ্বালানো কিন্তু মেয়েটা নেই৷ অদ্ভুত তো মেয়েটা গেলো কই?

বুক টা কেমন কেঁপে উঠলো৷ মেয়েটাকে কি কেউ কিছু বলেছে? বাগানে আছে নাকি তা দেখার জন্য ছাদের এক কোণে এলো এখান থেকে বাগান স্পষ্ট দেখা যায়৷
এ সাইডটায় রেলিং নেই অর্ধেকটা ভে’ঙে গিয়েছিলো তাই আপাতত এই সাইডের পুরোটা ভা’ঙা হয়েছে নতুন করে বানাবে৷
বাড়িটা অনেক পুরোনো ওর দাদার সময়কার তাই অনেক কিছু মেরামত করতে হচ্ছে৷
রুপা এগোলো আরেকটু একেবারে কার্নিশ এর কাছাকাছি৷
উঁকি ঝুঁকি মারলো নিচের দিকে এর মাঝেই পেছন থেকে পুরুষালি কন্ঠ পাওয়া গেলো৷ বললো,
“আরে আরে আত্ম’হ’ত্যা করবেন নাকি বিয়ে হলো না তাই? আপনাকে এমন ভাবিনি আগে৷”
আকস্মিক তাকালো রুপা ভ্রু কুচকে বললো,
“পাগল হয়েছেন আপনি আমি……!!”
আর কিছু বলবে কিন্তু এর মাঝেই ঘটলো বিপত্তি পা টা পিছলে এলো অন্তর আ’ত্মা কেঁপে উঠলো পুরো৷ রেজওয়ান তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো হাত ধরার জন্য কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না আর৷ থমকালো যেন ধরণী বাতাস গুমোট হয়ে এলো কয়েক সেকেন্ড এর মাঝে ছোট্ট দেহটা যেন মাটিতে গিয়ে পরলো তিন তলার উপর থেকে৷

..

“আজকাল বাবার কাছে গিয়ে মা কে ভুলে যাচ্ছো নাকি?”
সবেই হসপিটাল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো শাহওয়াজ৷ সকালে ও বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে সরাসরি হসপিটালে যেতে হয়েছিলো৷ এই সবেই আসলো এ বাড়ি৷ কিন্তু মা কে কি করে বলবে আবার যেতে হবে ভেবে পাচ্ছে না৷
এ পেশেন্ট টা অনেক দিন যাবত তার কাছেই চিকিৎসা নিচ্ছে অপরেশন এর সময় আরো পরে হলেও হুট করেই বেশি অসুস্থ হয়ে পরায় আসতেই হলো ঢাকা৷
মায়ের এহেন কথা শুনে মাথায় চিরুনী চালাতে চালাতে হাসলো কেবল৷
এই ভদ্রমহিলাই শাহওয়াজ এর পৃথিবী৷ মধুলতা তার মায়ের নাম মধুর মতই মিষ্টি তবে বাইরের দিক দিয়ে অতীব কঠিন৷
মানুষ কে বোঝায় তার মত কঠিন মানুষ দুনিয়াতে নেই৷ পেশায় একজন সফল অধ্যাপিকা এবং লেখিকা শাহওয়াজ৷ এর দেখা সব থেকে সফল নারী, একজন ভালো মানুষ এবং ভালো মা৷
বাইরে পড়াশোনা করার চিন্তাটা শাহওয়াজ এর কখনোই ছিলোনা মায়ের কাঠিনত্বেই তাকে হার মানতে হয়েছে এবং নিজের নামের পাশে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শব্দ টা বসাতে পেরেছে৷
গ্রামের টিপিকাল কোনো মেয়ে হলে হয়তো সন্তান নিয়ে ভেঙে পরতো? খেই হারাতো? নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতো না৷ বাবার ঘাড়ে বসেই জীবন কাটাতো যেহেতু বাবা বিত্তশালী৷ কিন্তু তার মা ভেঙে পরেনি বুদ্ধি, জ্ঞান দিয়ে এগিয়ে গেছে৷ বাবার ঘাড়ে বসেও খেতে হয়নি৷ নিজের ক্যারিয়ার কে এগিয়েছে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷
তাদের সব কিছুতে এক টা মানুষের নাম না বললেই না৷ তার নানা নানি যদি না থাকতো বোধহয় তার মা এত টা জোর পেতো না৷
“তোমায় ভুলবো কেন? তুমিইতো পাঠালে সেখানে৷এখন ভাবছি সেখানেই বিয়ে করে বউ নিয়ে থেকে যাবো৷ কি বলো ভালো হবে না?”
হেসে হেসেই উত্তর দিলো শাহওয়াজ৷ মধুলতা গম্ভীর মুখে তাকালো ছেলের দিকে৷ ছেলেটা আস্ত পাজি মায়ের সাথে রসিকতা করে৷
মধুলতা ছেলের বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দিলো,
“ছি! এ কেমন ললজ্জাহীন কথাবার্তা প্রহর? মা হই আমি তোমার৷ আর কিসের বিয়ে? বয়স হয়েছে তোমার? আমার ছেলেকে আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছি না৷”
তার মা তাকে আদর করে প্রহরই ডাকে৷ মায়ের কথায় ক্যাবলাকান্তর মত আয়নাতে তাকালো নিজের দিকে৷ যাক বাবা তাকে ছোটো লাগে কোন দিক দিয়ে? আটাশ বছর চলছে বড় হবো কি আটান্ন বছরে?
শাহওয়াজ ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরলো৷ কুঁচকে গেলো পুরো টান টান বিছানা টা৷ ইশ কত্ত দিন পর নিজের ঘরে এলো৷ হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে বললো,
“আটাশ বছর চলছে মা৷ ঠিক সময় বিয়ে দিলে আমার ছেলে মেয়েরো বিয়ে দিতাম এত দিনে আর তুমি এসব বলছো?”

চলবে,

[নোট:১৩৩৫ শব্দ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here