#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
বিশ
“রুপাবু না আত্মহ’ত্যা করছে! সবাই বলতাছে তোমার লাইগা আত্ম’হ’ত্যা করছে রুপাবু৷ সবাই কেমন মিথ্যা কথা কইতাছে৷ আমি এইসব বিশ্বাস করি না৷ ওরা তো তোমারে পছন্দ করে না তাই এইসব বলতাছে তাই না ময়ূরাক্ষী বুবু?”
মৃদুলার কান্নারত কন্ঠ৷ প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে কান্না আটকানোর তবে বারংবার ব্যার্থ হচ্ছে৷ ছোট্ট মৃদুলার পানে তাকালো ময়ূরাক্ষী৷ এই মেয়েটা যে তাকে কত্ত ভালোবাসে! এত ভালো কেন বাসে সে ও জানে না৷
রুপাকে দেখেনি এখনো ময়ূরাক্ষী৷ কি অবস্থা তা ও জানে না! চেচামেচির শব্দে যখন পুকুরপার থেকে মেইন গেটের সামন এলো তখন দেখলো গাড়িটা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে৷
রাহেলা যখন সকলের সামনে থা’প্পর দিয়ে বললো,
“আজ তোর জন্য এই অবস্থা হয়েছে৷ মেয়েটার কিছু হোক তোকে বাড়ি থেকে তাড়াবো৷”
তখন আশেপাশের মানুষের কানাঘুঁষায় শুনেছে রুপা আত্ম’হ’ত্যা করেছে৷
রাহেলাকে কত আকুতি মিনতি করলো তাকে যেন হাসপাতালে নিয়ে যায় রাহেলা ওকে ফেলেই চলে গেলো৷
রুপাবু কেন এমন করলো? তার জন্য আত্মহ’ত্যা করলো? সে তো কিছু করেনি৷
সে তো এমন কিছু চায় ও নি৷ পরক্ষনেই ভাবলো কিছু ময়ূরাক্ষী৷ ডুকরে কেঁদে উঠলো কেমন৷ হ্যাঁ তারই তো দোষ! দাদি বারংবার নিষেধ করেছিলো তাকে আকাশের সামনে না যেতে সে তো তবুও গিয়েছিলো৷
রুপা বলার পর সে না করেনি কেন? গিয়েছিলো কেন?
আর আকাশ? সেই বা কেমন? ময়ূরাক্ষী জানতো কেউ যদি কাউকে ভালোবসে তাহলে নিজের ভালোবাসার মানুষ ছাড়া পৃথিবীর যত রূপবতী মানুষই আসুক না কেন ভালোবাসার মানুষের সামনে সব সৌন্দর্য তুচ্ছ মনে হয়৷
“বুবু তুমি কাইন্দো না৷ আমাদের শাহওয়াজ ভাইজান তো ডাক্তার সব ঠিক কইরা দিবো বলো? ডাক্তার রা তো সব পারে তাই না বুবু?”
মৃদুলা অবুঝ ভঙ্গিতে বললো৷ ময়ূরাক্ষী কেঁদেই চলেছে৷ মুখিটা লাল টকটকে হয়ে গেছে কেমন৷
“ভাইজান তো ঢাকা গেছে৷ রুপাবুর কথা শুনলে ভাইজান কি আসবো না বুবু?”
ময়ূরাক্ষী আপাতত মৃদুলার কথায় কান দিচ্ছে না৷ তার মস্তিষ্ক জুরে একটা কথাই ভাসছে,
“তার জন্য আজ রুপার এমন হলো৷ তার জন্য রুপা আত্ম’হ’ত্যা করলো৷”
এই মানুষটাই তাকে কত্ত ভালোবাসে আর তার জন্যই এ মানুষ টার এমন হাল৷ নিজেকে ক্ষমা করবে কি করে ময়ূরাক্ষী? এ দায় নিয়ে, এ অপরাধবোধ নিয়ে থাকবে কি করে সে? অপরাধবোধ তো তাকে কুড়ে কুড়ে খাবে সব সময়৷
“বুবু তুমি কি আমার লগে কথা কইবা না? আমিতো তোমারে ভুল বুঝি নাই সবার মত৷ আমার সাথে কেন কথা বলতাছো না?”
বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো মৃদুলা৷ দুনিয়ার সবাই না কথা বলুক কিন্তু তার ময়ূরবু তার সাথে কথা না বললে তার চলবেই না৷
সবাই ময়ূরবুকে মন্দ কথা বলে সে তো বলে না৷
মৃদুলার ফুঁপিয়ে উঠা দেখে হুস ফিরলো ময়ূরাক্ষীর৷ বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েটাকে৷
অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“তোর সাথে কথা বলবো না এমন কি হয়? সবাইতো ঠিকি বলেছে আমার জন্যইতো এমন হয়েছে৷ তুই আমায় এত ভালোবাসিস কেন রে মৃদুলা? আমিতো তোদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারি না৷”
মৃদুলা যেন স্বস্তি পেলো৷ নাক টেনে বললো,
“প্রতিদান লাগবো না তুমি ভালোবাসা দিও৷”
এইটুকু বলেই থামলো মৃদুলা, ঘণ নেত্র পল্লব ঝাপটালো কয়েকবার৷ ময়ূরাক্ষী অবাক না হয়ে পারলো না, এইটুকু মেয়ে কি বড় একটা কথা বললো!
মৃদুলা ফের ক্ষুন্ন মনে বিষন্ন গলায় বললো,
“রুপাবু ভালো হইয়া যাইবো তাইনা ময়ুরবু?”
ময়ূরাক্ষীও নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো৷ ঠোঁট কামরে সংযত করলো নিজেকে৷ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,
“ঠিক হয়ে যাবে৷”
,,
আঁধার কেটেও যেন কাঁ’টলো না আঁধার৷ রাত কেঁ’টে সকাল ধরণীতে এলো ঠিকি তবে আঁধার কাঁ’টলো না৷ ভোর শুরু হলো মেঘময় হয়ে৷ চারো দিক তীব্র বাতাস বইছে! কৃষ্ণ ধুসর মেঘে আচ্ছন্ন চারোপাশ৷ সকাল হলেও আধাঁর থেকে আলোর দেখা মেলেনি এখনি৷
তারো বুঝি আজ মন বেজায় ক্ষুন্ন৷ তারো বুঝি মনের অসুখ করেছে৷
অম্বর যেমন ক্ষুন্ন মনা নিকষ আঁধারে আচ্ছন্ন, তেমনই প্রকৃতি যেন বেজায় ক্রুদ্ধ আজ৷ সব ভে’ঙে ভু’ঙে যেন বিনাশ করে দিবে এখনি৷
চারো দিকে ভেজা মাটির গন্ধ আর শীতল হয়ে আছে৷ বাতাসের বেগ এতই তীব্র যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে এখনি৷ বাতাসের শো শো আওয়াজ কেমন ভয়ংকর করে তুলছে চারোপাশ৷
ব’জ্রপা’ত আজ এতই ব’জ্রকন্ঠা যেন আকাশটাই ভে’ঙে পরবে মাটিতে৷ ব’জ্রধ্বনি আজ বারংবার ভয়ংকর শব্দ তুলে গর্জে উঠছে৷ অম্বর আজ অস্থির কেন এত? বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘণ ঘণ৷
প্রকৃতির এমন ক্রুদ্ধ রুপ দেখে মানুষ হতবাক, ভীত৷ অদুরে মাঠে থাকা কুকুরটাও ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিরাপদ স্থান খুঁজছে যেন৷ পাখিরা বোধহয় আজ আর ডানা ঝাপটায়নি৷
তবে এত আধাঁরেও এত মেঘেও বৃষ্টির দেখা নেই৷ সারা রাত বৃষ্টির পর তো ঝলমলে আলোকিত হওয়ার কথা ছিলো৷ কিন্তু আঁধার কাঁ’টলো কই? কিছুক্ষণ পর পর বাতাসের সাথে কয়েক ফোটা পানির ঝাপটা এসে লাগছে গাঁয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে৷
বৃষ্টি টা যদি আসতো অম্বরের মন যেন ক্ষানিকটা চকমকে হতো৷ প্রকৃতি যেন খানিকটা কোমল হতো৷
প্রকৃতির আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত তখন শাহওয়াজ৷ এসেছে মাঝ রাতে ক্লান্ত শরীর তার৷ কাল সকাল থেকে দু-দন্ড শান্ত হয়ে বসতে পারেনি এখনো৷ গা যেন বিছানা বিছানা করছে৷
কাল এখান থেকে ড্রাইভ করে গিয়ে বাড়ি না গিয়েই হসপিটালে গিয়েছিল৷ হসপিটাল থেকে ফিরতে ফিরতে আলো ফুরিয়ে ছিলো৷ ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিবে ভেবেছিলো৷ সকালের দিকে এ বাড়ি আসতো কিন্তু তা আর হলো কই? সাথে সাথেই আসতে হলো এখানে৷ মাঝরাতে বৃষ্টিতে এখানে আসতে হয়েছে৷
রুপার অপরেশন এর সময় থাকতে পারেনি সে৷ এ নিয়ে হুট করেই বেশ আফসোস হচ্ছে৷
এ বাড়ির কারো প্রতি যে এমন তীব্র মায়া জন্মাবে ভাবতে পারেনি শাহওয়াজ৷ মানুষ বলে র’ক্ত কথা বলে! আসলেই কি এমন ঘটেছে? র’ক্তের টান কেবল?
র’ক্ত কথাটা মাথায় আসতেই যেন কিছু কথা মাথায় এলো৷ ঘৃণা জন্মায় শাহওয়াজ এর এ র’ক্তের প্রতি৷
পারলে নিজের শরীর কে’টে র’ক্ত গুলো বের করে ফেলতো৷ স্বার্থপরের র’ক্ত যে তার শরীরে বইছে এ র’ক্ত তাকেও না নিকৃষ্ট বানিয়ে তোলে মাঝে মাঝে এ নিয়ে ভয় হয়৷
তপ্ত শ্বাস টানলো শাহওয়াজ৷ রুপার অপরেশন সাকসেসফুলি হলেও মেয়েটা এখনো আইসি ইউতে৷ তিন তলা থেকে পরেছে মেয়েটা যে বেঁচে আছে এই তো ভাগ্যের বিষয়৷
বাঁচার কথা ভাবতেই কিঞ্চিৎ কষ্টের আভাস পেলো যেন শাহওয়াজ৷ লক্ষ করলো বুক টা ভারি লাগছে কানে বাজছে “ভাইজান” ডাক খানা৷
মনে হচ্ছে এই যেন বলবে, “ভাইজান খুব ভালো হয়েছে?” “ভাইজান চা দিবো৷”
শাহওয়াজ যে দিন মেয়েটাকে সাহসের কথা বললো৷ চাঞ্চল্য হয়ে খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“তুমিতো আমার ভাইজান হও তোমায় ভয় পাবো কেন?”
চোখ বন্ধ করে নিলো শাহওয়াজ৷ ফোস ফোস করে নিশ্বাস নিলো শাহওয়াজ৷ নেত্র পল্লব চঞ্চল হয়ে পলক ঝাপটালো৷ এ ঠান্ডাতেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে৷ কি সাংঘাতিক এমন লাগছে কেন?
এখান থেকে সরে তড়িৎ গতিতে হাটা ধরলো আইসিইউর পথ ধরে৷ গম্ভীর তার দৃষ্টি! নিজের কান্ড নিজেরই বোধগম্য হচ্ছে না তার৷ আইসিইউর সামনে এসে মুখে মাস্ক খানা পরলো শাহওয়াজ অতঃপর ঢুকলো নিঃশব্দে আইসিইউতে৷
মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মেয়েটার৷ নিষ্প্রাণ হয়ে আছে কেমন৷ রেজওয়ান সবটা বলেছে ওকে৷ এখনো সব কিছু ধোঁয়াশা ওর কাছে৷ জানে মেয়েটা আদৌ কি আত্মহ’ত্যা করেছে কি না৷ অথচ মানুষ কত কথা রটাচ্ছে৷
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রুপার সামনেই৷
যদিও আইসিইউতে কাউকে এলাও করেনা, শাহওয়াজ ডাক্তার বলে প্রবেশ করতে পেরেছে৷ মাঝরাতে এসেই কথা হয়েছে ডাক্তারের সাথে৷
আসার পর ময়ূরাক্ষী মেয়েটা কে এখনো দেখেনি একবার ও৷ সে কি আসেনি? নাকি আনেনি কেউ?
বাড়ির সবাইই আছে ওয়েটিং রুম এ৷ কারো সাথে শাহওয়াজ এখনো কথা বলেনি৷ তাদের নিয়ে শাহওয়াজ এর মাথা ব্যাথা নেই৷
কিছুক্ষণ এখানে সব চেক করে বের হলো শাহওয়াজ৷ দরজার সামনেই আসতে হুট করে মুখোমুখি হলো রাবেয়ার সাথে৷
মহিলার দৃষ্টি কৌতুহলী৷ একবার কাঁচ দিয়ে মেয়ের পানে তাকালো উঁকি দিয়ে৷ তারপর শাহওয়াজ এর দিকে তাকালো৷ আজ তার চোখে মুখে জড়তা নেই কান্নারত কন্ঠে বললো,
“আমার মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে আব্বা?”
মহিলার জড়তা না থাকলেও শাহওয়াজ কে জড়তা যেন আষ্টেপৃষ্টে ধরলো৷ তবুও মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
“ফিরেনি৷ ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না৷”
রাবেয়া কান্না করে দিলো আরো৷ শাহওয়াজ এর হাত আঁকড়ে ধরলো৷ এর মাঝেই এলো আকবর চৌধুরী৷ শাহওয়াজ তাকে দেখে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“আপনার স্বামী কাউকে আগলে রাখতে জানেন না৷”
বলেই তাচ্ছিল্য হাসলো৷ আকবর চৌধুরী নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলো৷ কথার মর্ম বুঝলো এবং নিজেকেও বুঝলো৷ আসলেইতো তাই? সে কাউকে আগলেই রাখতে পারেনা৷
শাহওয়াজ রাবেয়ার হাত ছাড়িয়ে সামনের দিয়ে হাটা ধরলো এর মাঝেই রাবেয়া বললো,
“আব্বা তুমিও তো মাঝ রাইতে ভিজা আসছো বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার আসো না হয়৷”
শাহওয়াজ বললো,
“না থাক! ঠিক আছি আমি৷”
এর মাঝেই শোনা গেলো আকবর চৌধুরীর গলা,
“তুমি এখন বাসায় যাবে শাহওয়াজ৷ তোমার কাপড় এখনো ভিজে আছে৷ আমার মেয়ের এ অবস্থায় আমি চাই না আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে পরুক৷”
চলবে,