#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
বারো,
গ্রামের এ জায়গাটা গ্রামের একেবারে মাঝ বরাবর, জায়গাটা একবার চোখ বুলিয়ে একটা দলিলে সই করলো৷ পাশে থাকা শাহওয়াজ এর বন্ধু রেজওয়ান বড় একটা ব্রিফকেস তুলে দিলো লোকের কাছে৷ সাথে সাথেই দুজন বড় একটা সাইনবোর্ড দাঁড় করালো জায়গার মাঝ বরাবর৷ যাতে লেখা “মধুলতা” জেনারেল হসপিটাল এর নিজস্ব জমি৷ জমির মালিকের নাম শাহওয়াজ প্রহর ৷ তৃপ্তিকর হাসলো প্রহর দলিল টা হাতে নিয়েই কালো গাড়িতে থাকা একটা বৃদ্ধর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এইযে ইয়াং ওল্ড ম্যান এবার তোমার হসপিটাল কে ছাড়াবে আমার হসপিটাল৷ চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম না? মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ করবো? করে দেখালাম৷”
গাড়ির ভেতরে থাকা মানুষ টি শাহওয়াজ এর অতীপ্রিয় নানা জান৷ যে ছাড়া শাহওয়াজ অসম্পূর্ণ৷ যে না থাকলে হয়তো মায়ের গর্ভেই মারা যেতো বা মা কে নিয়ে রাস্তাতেই রাত পার করতে হতো৷ যার ছায়ায় বড় হয়েছে শাহওয়াজ এবং এ রঙিন দুনিয়া চিনেছে৷
শাহওয়াজ এর চোখে এখনো হাজার স্বপ্ন৷ হাজার বাসনা সব যে পূর্ণ করতে হবে৷ তার সাথে তার মায়ের প্রতি অন্যায়ের সব তো শোধে আসলে পূর্ণ করতে হবে৷
বৃদ্ধ লোকটির চোখ মুখে তৃপ্তির হাসি৷ চোখ ছলছল করছে কিন্তু পুরুষদের যে মেয়েদের মত কাঁদতে মানা৷ তবে দুষ্টুমির ছলেই নাতীর উদ্দেশ্যে বললো,
“জমি কিনেছো সবে৷ হসপিটাল টা দাঁড় করাও তারপর না হয় আমার হসপিটাল কে টেক্কা দিতে আসবে৷ এখনো একটা ইট ও বসলো না সে এসেছে আমার হসপিটাল কে টেক্কা দিতে৷”
নানা জানের কথা শুনে শাহওয়াজ এর বন্ধু রেজওয়ান হেসে উঠলো হু হু করে৷ শাহওয়াজ ও হাসলো! কিছু কিছু হার ও জেতার আনন্দ দেয়৷ এ মানুষ টির কাছে না হয় হেরেই গেলো? তার মায়ের স্বপ্ন তার গ্রামেই তাদের একটা হসপিটাল হবে আর একটা এতিমখানা৷ একটু আগেই রেজিস্ট্রি হয়েছে৷রেজিস্ট্রি অফিসে অর্ধ টাকা পরিশোধ করেছিলো এখন রেজওয়ান ব্যাংক থেকে অর্ধ টাকা নিয়ে এলো এখন হাতে তুলে দেওয়া হলো৷
হাসি ঠাট্টার মাঝেই শাহওয়াজ এর নানাজান আশরাফ শুধালো,
“ঢাকা ফিরছো কবে? তোমার যে একটা ডাক্তারি সার্টিফিকেট আছে তা কি বেমালুম ভুললে নাকি?”
শাহওয়াজ তপ্ত শ্বাস টানলো৷ তা কি আর ভোলা যায়? তবে যাচ্ছে কবে সে আপাতত জানে না৷ এ বাড়িতে আসার পক্ষে কখনোই ছিলেন না তার নানা৷ এখানে আসা নিয়ে সে এখনো নারাজ শাহওয়াজ খুব ভালো করে জানে৷
শাহওয়াজ উত্তর দিলো,
“যাবো৷ ওখানকার কিছু কাজ সারতে হবে তারপর এখানে এসে এ হসপিটালের কাজটা ধরতে হবে৷”
আশরাফ কথাটা শুনেও না শুনার ভান করে রইলো৷ তার ভাষ্যমতে যেখানে সব শেষ হয়ে গেছে আরো আগে সেখানে আসার কোনো কারণ নেই৷ শাহওয়াজ এখন পূর্ণবয়স্ক এবং স্বাবলম্বী৷ এমন না শাহওয়াজ ছোটো এখানে না আসলে বাবার কাছে না আসলে বাবা আইনি ঝামেলা করবে৷ যখন সময় ছিলো তখনি খোঁজ নেয়নি এখন এসেছে ছেলেকে নিয়ে দরদ দেখাতে৷
আশরাফ স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালো,
“তার খোঁজ পেয়েছো?”
শাহওয়াজ মলিন কন্ঠে উত্তর দিলো,
“এখন অব্দি না৷”
আশরাফ সাহেব নিরাশ হলেন৷ জলজ্যান্ত একটা মানুষ কোথায় যাবে? ওদিকে তার মেয়ে যে পথ চেয়ে আছে খবর জানার জন্য৷
“আসসালামু আলাইকুম আব্বা৷ ”
হুট করে চেনা কন্ঠে ধ্যান ভাঙলো আশরাফ সাহেবের৷ ক্রোধ গুলো প্রশমিত হলো৷ হুট করে চোখ মুখ কঠিন রঙ ধারণ করলো আশরাফ চৌধুরীর৷ শিরশির করে উঠলো শরীর৷ ড্রাইভার এর উদ্দেশ্যে বললো গম্ভীর স্বরে,
“গাড়ি স্টার্ট দাও৷”
সাথে সাথেই নিমেষে গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো৷ শাহওয়াজ, রেজওয়ান তাকিয়ে রইলো৷ ঘুরে পিছনে থাকা মানুষ টা কে পরখ করলো৷ আকবর চৌধুরী ঠায় দাঁড়িয়ে৷
তার দৃষ্টিও নত৷ শাহওয়াজ ঠোঁট এলিয়ে বাঁকা হাসলো৷ বাহ! আকবর চৌধুরী ও নত হয়? তার চোখে মুখে অপরাধ বোধ৷
শাহওয়াজ এবার এগিয়ে গেলো জমিটির দিকে এর মাঝেই আকবর চৌধুরী পেছন থেকে বললো,
“আমার ছেলে জমি কিনলো আমায় তা শুনতে হলো অন্য জনের কাছে৷ একবার জানাতেও পারতে আজ জমির সব কিছু ঠিকঠাক করবে৷”
শাহওয়াজ এখনো সামনের দিকেই তাকানো, আকবর চৌধুরীর কথায় তেমন পাত্তা দিলো না মনে হলো৷ তবে উত্তর দিলো,
“রেজিস্ট্রি হয়েছে সকালে৷ নানাজান এসেছিলো তাই আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি৷আর আপনাকে তো সে দিন সকালেই জানিয়েছিলাম জমিটি দেখতে আসবো আমি৷ পছন্দ হয়ে গেছে কিনে ফেললাম৷”
ছেলের এমন কথায় আহত হলো আকবর চৌধুরী৷ বক্ষ খানায় জ্বলন ধরলো, আচ্ছা এ জ্বলন কি তার ছেলের দেহেও ছিলো এত দিন? যখন প্রয়োজনে তার জন্মদাতা পিতা সামনে ছিলো না? তার মধুলতার বক্ষে এখনো কি এমন জ্বলন যতবার মনে পরে তার স্বামী অন্য কারো এখন?
তাদের থেকে তার জ্বলন টা কমই লাগলো আকবর চৌধুরীর৷
মানুষের সব থেকে বড় দূর্বলতা তার বিবেক৷ বিবেক যখন নিজেকেই নিজের কাছে দোষী সাব্যস্ত করে তখন মৃত্যু কে এর থেকে সহজ যন্ত্রণা মনে হয়৷
আকবর চৌধুরী নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“তোমার জমি পছন্দ হয়েছে জানলে আমি এ জমি তোমায় কিনে দিতাম৷”
শাহওয়াজ তাচ্ছিল্য হেসে বাবার মুখোমুখি দাঁড়ালো অতঃপর তাচ্ছিল্য কন্ঠেই বললো,
“শাহওয়াজ প্রহর কারো জিনিস নিতে চায় না৷ তার মা এবং নিজের জন্য নিজেই যথেষ্ট৷ সামনে তাকান পড়ে দেখুন ওই লেখা টা৷”
আকবর চৌধুরী বেশ কৌতুহল নিয়ে পড়লো৷ নির্নিমেষে চেয়ে রইলো৷ চমকালো থমকালো! এ স্বপ্নটা তো তার পূর্ণ করার কথা ছিলো৷
..
চৌধুরী বাড়ি আলো ঝলমল করছে চারোপাশ৷ মরিচা বাতি লাগানো হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েই বুঝি৷ অথচ কাল আংটি পরাবে আর বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে৷
সন্ধ্যা হলো সবে, চিলেকোঠার ঘর টা ঝাড়ু দিলো ময়ূরাক্ষী সাথে এত্ত বড় ছাদটা ও৷ সেঝোচাচি বলেছে প্রতি কোণা কোণা যেন ঝকঝকে চকচকে করতে হবে৷
শরীর ঝিমিয়ে আসছে বার বার দূর্বলতা টা কা’টেনি এখনো৷ তবে মনের দিক দিয়ে ফুরফুরে তার রুপাবুর বিয়ে বলে কথা৷
সব ময়লা গুলো জমালো এক সাথে৷ ময়লা বলতে গাছের পাতাই৷ ময়লা গুলো এক সাথে তুলে নিচে নিয়ে যাবে ফেলার জন্য নিচে পর্যন্ত ভালোই এলো ময়লার ডাস্টবিন টা বাইরে বাগানে সেখানে যাওয়ার জন্য অন্দরের মেইন দরজার সামনে আসতেই হুট করেই হোচট খেলো আর ঘটলো অদ্ভুত এক কান্ড সব ময়লা গিয়ে পরলো সামনে থাকা শাহওয়াজ আর রেজওয়ান এর মাথায়৷
শাহওয়াজ কথা বলতে বলতে ঢুকছিলো বাড়ির ভেতর সাথেই ছিলো রেজওয়ান৷ ময়ূরাক্ষী বড় বড় চোখ করে সামনের দিকে তাকালো৷ যাক বাবা কি করলো এটা? আশেপাশে তাকিয়ে দৌড় দেওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনি পেছন থেকে লম্বা বিনুনিটা ধরে ফেলে শাহওয়াজ থেমে যায় ময়ূরাক্ষী৷ এবার বুঝি রক্ষে নেই! শাহওয়াজ দাতে দাত চেপে বলে,
“এই পেয়ে পালাচ্ছেন কোথায়?”
ময়ূরাক্ষী থামে শাহওয়াজ বিনুনি টা ছেড়ে দেয়৷ মেয়েটা মাথায় ঘোমটা তুলে শিড় নিচু করে দাঁড়ায়৷ তবে সামনে ঘুরেনি৷ শাহওয়াজ কে দেখলেই তার লজ্জা গুলো উপচে পরে শরীরে কম্পন ধরে৷ আজ সারাদিন পালিয়ে পালিয়ে ছিলো কিন্তু সেই সামনাসামনি পরেই গেলো৷
ময়ূরাক্ষীর উত্তর না পেয়ে শাহওয়াজ ফের বলে,
“কি করলেন এসব? আমাদের দেখে কি ডাস্টবিন মনে হয়?”
ময়ূরাক্ষী কিছু না বুঝেই ফট করে বলে,
“আমিতো করিনি”
রেজওয়ান কেবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে৷ সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ আচ্ছা ধরিবাজ মেয়েতো ময়লা ফেলে বলে সে করেনি৷ রেজওয়ান একবার নিজের দিকে তাকিয়ে অসহায় এর মত নিশ্বাস নিয়ে বলে,
“আমি জানতাম জমিদার বাড়িতে রাজকীয় ভাবে ফুল দিয়ে ওয়েলকাম করা হয়৷ কিন্তু এ যুগের জমিদার বাড়িতে যে ময়লা দিয়ে ওয়েলকাম করা হয় তা তো জানা ছিলো না৷”
রেজওয়ান এর কথায় বড়সড় একটা ধমক দিলো৷ এতক্ষণে রুপাও এসেছে৷ রেজওয়ান এর কথায় লজ্জিত হলো রুপা৷ ময়ূর টা না বাচ্চাই রয়ে গেলো৷ কে বলেছে এত সব কাজ করতে? রুপা বললো,
“দুঃখিত ভাইজান বুঝতে পারেনি ময়ূর৷ আর ময়ূর তোকে এসব করতে বলেছে কে?সামনে ঘুরিস না কেন? সামনে ঘুর অসম্মান করা হচ্ছে না ভাইজান কে?”
শেষের কথা গুলো ময়ূরাক্ষীকে উদ্দেশ্য করে বললো রুপা৷ ময়ূরাক্ষী এবার ঘুরলো৷ শির এখনো নিচেই৷ রেজওয়ান থমকালো মেয়েটিকে দেখে৷ এর কথাই কি বলেছিলো শাহওয়াজ?নিঃসন্দেহে রূপবতী৷ যাকে বলে চোখ ধাঁধানো রুপ৷ শাহওয়াজ গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ওকে নিয়ে ভেতরে যাও আসছি আমি৷”
রেজওয়ান অবুঝের মতই পা বাড়ালো ভেতরে৷ রুপা ভেতরে নিয়ে গেলো রেজওয়ান কে৷
ময়ূরাক্ষীও যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনি শাহওয়াজ বললো,
“আপনাকে যেতে বলেছি আমি?”
ময়ূরাক্ষী শুকনো ঢোক গিললো৷ মাথা দু-পাশ নাড়ালো৷ যার মানে “না৷” শাহওয়াজ হাসলো প্রথমে রাগ হলেও রাগ টা যেন মিহিয়ে গেলো৷ শাহওয়াজ স্বর পালটে বললো,
“মাথা তুলে উপরের দিকে তাকান ময়ূরাক্ষী৷”
ময়ূরাক্ষী চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো৷ ওই আঁখি যুগল এত কেন আকৃষ্ট করে শাহওয়াজ কে? মেয়েটাকে তাকাতে বললো সে চোখ বন্ধ করে আছে৷ শাহওয়াজ তা দেখে হাসলো কিঞ্চিৎ সামনে গেলো শাহওয়াজ তাতেই যেন প্রাণ পাখিটা উড়লো৷ লজ্জায় জড়তায় ময়ূরাক্ষীর মাথা খানা ঘুরে এলো একেবারে বক্ষে গিয়ে পরলো শাহওয়াজ এর৷ অবাক হলো শাহওয়াজ৷ এইটুকুতেই এমন? প্রসস্থ হাসলো সাথে সাথেই সামনে থেকে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠ কর্ণকুহরে ভেসে এলো যা শুনে ভরকালো শাহওয়াজ,
“হায় আল্লাহ, ভাইজান বুবুতো আবার জ্ঞান হারাইছে৷এবারো কি চুমু দিয়ে বুবুরে ঠিক করবেন? ”
চলবে ইনশা-আল্লাহ,
[নোট: ১২৭০ শব্দ]