#গল্পঃ_আশার_হাত_বাড়ায়
#পর্বঃ_৩৯ (মিশ্র গল্প)
#লীলাউদ্যান (আংশিক অংশ)
#ইশরাত_জাহান
🦋
স্নিগ্ধ সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসার সামনের গাছগুলোতে পানি দিতে থাকে রিমলি।মিসেস জুঁই এলো সেখানে।রিমলির পাশে দাঁড়ালো।এই কয়েকদিনে ছেলের চলাফেরায় মিসেস জুঁই বুঝতে পেরেছেন তার ছেলে এই শ্যামবর্ণের কন্যাটির প্রেমে পড়েছে। রিমলিকে তারও ভালো লাগে।বিষয়টি যেহেতু ভালোবাসার তাই দেরি করতে চায় না মিসেস জুঁই।ছেলে মেয়ে এক অপরকে চাইলে এভাবে এক ছাদের নিচে আলাদা রাখলে বিপদ আরো বেশি বেড়ে যায়।তাই তিনি রিমলির ব্যাপারে জানতে চান।রিমলির মতামত থাকলে বিয়ে নিয়ে কথা বলবে সৃষ্টি বেগমের সাথে।রিমলির পাশে এসে বলেন,”টবগুলো শুকিয়ে গেছে।এখানে একটু বেশি পানি দেওয়া লাগবে।”
রিমলি টবে পানি দিতে থাকে।মিসেস জুঁই বলেন,”জানো আমার ফুল কেনো এত প্রিয়?”
মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে দিলো রিমলি।মিসেস জুঁই বলেন,”আমার বড়বোন জিনিয়া আর আমি জুঁই।আমার মা আমাদের মিল রেখে জ দিয়ে ফুলের নাম রাখে।নিজের নামের জন্যই আমার কাছে ফুল আরো বেশি প্রিয়।ছোটবেলা থেকে মনে হতো আমি নিজেই একটি ফুল।সেই সোনালী দিনগুলোর কথা এখন শুধু স্মৃতির পাতায় আটকে আছে।”
“আমাদের সবারই ছোটবেলায় আবারও ফিরে যেতে ইচ্ছা করে।তাই না আন্টি?”
“আমার তো খুব ইচ্ছা করে।বিশেষ করে দিনদিন চুল পাকতে শুরু করেছে যে।মনে হয় এইতো সেদিনই আমি স্কুল থেকে এসে মাকে জড়িয়েছিলাম।পুরোনো দিনে ফেরত গেলে বাবা মাকে হয়তো আবারও ফিরে পাবো।”
“আমিও।আমার বাবাকে আবার ফিরে পাবো। ওইদিনটা আসলে আমি ওইদিন বাবাকে আর বের হতে দিবো না।বাবা বের না হলে এক্সিডেন্ট হতো না।”
কথার মধ্যে কষ্টের ছাপ।মিসেস জুঁই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”যার যাওয়ার সময় হয় তাকে আটকে রাখলেও সে থাকবে না।”
রিমলির চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে।মিসেস জুঁই দেখছেন।গাড়ির শব্দে পিছনে তাকালো দুজনে।শ্রেয়া আর ফারাজ এসেছে। রিমলি দৌড়ে জড়িয়ে ধরলো বোনকে।সালাম দিলো ফারাজকে,”আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
ভিতরে গিয়ে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে শ্রেয়া দোকানে গেলো।মিসেস জুঁই ফারাজের পাশে এসে বলেন,”তোর সাথে একটু কথা ছিলো।”
“হ্যাঁ,বলো।”
“শিহাবকে নিয়ে।আমার মনে হয় শিহাব কাউকে ভালোবাসে।”
“কাকে?”
“তোর শালীকে।”
ফারাজ তাকালো মিসেস জুঁইয়ের দিকে।বলে,”তোমার কি মেয়েটাকে পছন্দ?”
“হ্যাঁ,তবে বয়স তুলনামূলক বেশ কম।”
“তোমাদের জেনারেশন তো এগুলো দেখতো না।স্টাডি করতে গেলে গ্র্যাজুয়েশন ছেলের বয়স বাড়বে আর মেয়েরা তো আঠারো এর পর যেকোনো সময় বিয়ে করতে পারবে।যদি তাদের সম্মতি থাকে।”
“এটাও ঠিক।”
“শিহাব রাজি থাকলে তোমার আপত্তি করার কিছু দেখছি না।তবে মা হিসেবে তোমার মতামত অবশ্যই আছে।”
“তুই শ্রেয়ার সাথে কথা বলে দেখ।”
“হুম।”
দোকানের কাজ সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়া।কেক বানানো মাত্র শেষ হলো।আজ এখানে যারা আসবে তারা দুজন হলো নাবিহা আর মীর।এই দুই মাস হলো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়েছে।রোজ সকালে মর্নিং ওয়াকের সময় এখান দিয়ে যায়।নাবিহা কেক খেতে খুব ভালোবাসে।মীরের জন্য খায় না।নাবিহার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর থেকে স্ট্রেসমার্ক আর মেদ বেড়েছে।যেটা মীরের চিন্তার কারণ।নাবিহাকে মেদ কমাতে এই একমাস ধরে অনেক দৌড়ের উপর রেখেছে। কাল হঠাৎ নাবিহা কেক খাওয়ার আবদার করেছিলো।মীর প্রমিস করেছে আজ তাকে ইচ্ছামত কেক খাওয়াবে।শ্রেয়া সব ঠিক করে বসতেই দোকানে উপস্থিত হলো মীর ও নাবিহা।মীর এসেই শুরু করে দিলো ফ্লাটিং করা।শ্রেয়ার সামনে এসে একটু ঝুঁকে বলে,”হেলো মিস বিউটিফুল লেডি।আপনার মতো দেখতে মিষ্টি এবং ভালো কেক দিবেন আমার হানিকে।”
শ্রেয়া হা হয়ে আছে।বউকে পাশে রেখে আরেকজনের বউকে এভাবে বলছে।নাবিহা মীরের মাথায় আলতো চাপড় মেরে বলে,”যেখানে সেখানে ফ্লাটিং!”
“মিস বিউটিফুল লেডি।মাই হানি ফিল জেলাস।প্লীজ ডু ইট ফার্স্ট।”
“ওটা মিস না মিসেস হবে মিস্টার মীর।”
পরিচিত কণ্ঠ পেয়ে পিছনে তাকালো মীর। ফারাজকে দেখে বলে,”হেয় ব্রো।”
বলেই হ্যান্ডশেক করে।মীর শ্রেয়ার দিক তাকিয়ে বলে,”তোমার মিস উফস মিসেস?”
“ইয়াহ।”
“ওহহো!এই জন্য তুমি আমার বিয়েতে আসতে পারোনি।”
“নো।তখন আমি দেশে ছিলাম না।তো মিসেস নাবিহা আমার ভাইটার সাথে এডজাস্ট হতে সমস্যা হচ্ছে না?”
নাবিহা মীরের পাশে এসে দাড়িয়ে বলে,”ও আছে বলেই আমি মুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়তে পারি।ডানা মেলে সুখপাখিদের দেখতে পাই।ভালোবাসার নতুন আবির্ভাব উপলব্ধি করি।”
“বিয়ের আগে তো এমন ছিলি না ভাই।”
“হানি আমার ব্যাপারে সব জেনেই আমার সাথে লীলাউদ্যানে পারি জমিয়েছে।”
বলেই নাবিহার হাত ধরে নেয় পরম আবেশে।ফারাজ আলতো হাসে।শ্রেয়া খুব সুন্দর ডিজাইন করা কেক এনে বলে,”হ্যাপি সেকেন্ড মান্থ এনিভারসারি।”
নাবিহা মীরের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই জন্য তুমি আমাকে কাল কেক খেতে দেওনি?”
“ইয়েস।আমার হানির একটি দিন ছুটিতে দিবো।তো সেটা পারফেক্টলি কাটাতে হবে না!কেক কেনো আজ তুমি তোমার আনহেলদি খাবার যা খুশি খাও।কাল থেকে আবারও ফুল ডায়েট।আমাদের বেবী প্ল্যান করতে হবে তো।”
শ্রেয়া নাবিহার দিকে তাকাচ্ছে।কত যত্নে আছে মেয়েটি।জীবনের দুইটা বছর হেলায় পার করে আজ সুখের সাগরে পারি জমিয়েছে।ফারাজ এসে শ্রেয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,”হানি শব্দটা এভেইলেবল হলেও আমি এটার সাথে সম্পর্কিত নই।তাই আমি ওসব হানি জানু বলে ডাকতে পারব না।একটু বাঙালি নামে ডাকতে পারি কি?”
“যেমন?”
“শ্রেয়াময়ী।বাঙালি বাঙালি ভাব প্রকাশ পায়। চলবে?”
মীর শিস বাজিয়ে বলে,”চলবে না ব্রো দৌড়াবে।আসো আমাদের কেক কাটতে হবে।”
মীর আর নাবিহা বিয়ের দুই মাস পূর্ণ হওয়ার কেক কেটে একে অপরকে খাইয়ে দিলো। মীর শ্রেয়াকে বলে,”সাউন্ড বক্স আছে?”
“হ্যাঁ,আপনারা ড্যান্স করবেন নাকি এমনি শুনবেন?”
“আমি এখন আমার হানির সাথে কাপল ড্যান্স করবো আর আপনারাও করবেন।”
শ্রেয়া তাকালো ফারাজের দিকে।ফারাজ বলে,”বউয়ের সাথে ড্যান্স করতে আমার আপত্তি নেই।”
চোখ বড় বড় হয়ে এলো শ্রেয়ার।তারপরও খুশি হলো মনে মনে।সাউন্ড বক্সে সফট গান বাজানো হলো।মীর আর নাবিহা নাচতে থাকে অন্যদিকে ফারাজ আর শ্রেয়া।দোকানের মধ্যে ঢুকলো রিমলি।কোচিং শেষ করে মাত্র আসলো।টেস্ট পরীক্ষা সামনে।এখন কলেজে যায় না।দোকানে বসে বই নিয়ে পড়ে আর গল্প লিখে।সৃষ্টি বেগম এদিক ওদিক দেখে আর রিমলি টুকটাক সাহায্য করে।দুইজোড়া কাপলের ড্যান্স দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে ছবি তুলতে থাকে রিমলি।শিহাব এসে দাড়ালো রিমলির পাশে।রিমলি প্রশ্ন করে,”আজ কাজ নেই আপনার?”
“টানা একমাস একটা সিরিয়াস কেস দেখেছি।এখন কিছুদিন ছুটি।কিছুদিন বললে ভুল পরশু থেকেই জয়েন হবো।”
সামনে কাপলদের দেখে মনের আবেগেই শিহাব বলে,”তোমার কি কাউকে ভালো লাগে রিমলি?”
ভ্রুকুটি করে রিমলি উত্তর দেয়,”যেমন?”
“বিএফ।”
“এখনও তো ইন্টার কমপ্লিট করলাম না।এত অল্প বয়সে বিএফ রাখলে মানায়?”
“এর মানে কি অনার্সে উঠলে তুমি প্রেম করবে?”
“সবাই করে।আমি করলে সমস্যা কোথায়?”(শিহাবকে খেপাতে)
“কার সাথে প্রেম করবে শুনি?”
“যার সাথেই করি না কেনো।আপনাকে কেনো বলবো?”(মুচকি হেসে)
“তোমার প্রেম আমি করাচ্ছি।এতটুকু মেয়ে সে কি না প্রেম করতে চায়!”
“এই একদম বয়স নিয়ে খোচা দিবেন না।এই এতটুকু মেয়ে কত বুইড়া থেকে জোয়ান মানুষের বিয়ে দিয়ে বাচ্চা পয়দা করেছে জানেন?”
“কয়জনের?”
হাতের কর গুনলো রিমলি।বলে,”একেকটা গল্প অনুসারে প্রায় বিশটা লোকের বিয়ে দিয়েছি।”
কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না শিহাব।বলে,”মানে?”
“কিছুনা।”(কথা এড়াতে)
“ভুলে কি ভুলভাল বকি আমি।এরা তো জানে না আমি লেখিকা।ধুর!”(মনে মনে)
কাপল ড্যান্স শেষ হতেই মীর বলে,”এখন আমাদের যেতে হবে।আমার কাজ আছে।অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।আজ আসি ব্রো।”
ফারাজ জড়িয়ে ধরে মীরকে।শ্রেয়া এসে জড়িয়ে ধরে নাবিহাকে। একে অপরকে বিদায় দিলো তারা।নাবিহার হাত ধরে বাইরে এলো মীর।গাড়িতে উঠে ড্রাইভ করে কিছুটা দূরে যেতেই শ্রেয়া দেখলো দোকানের সামনে একটা রিক্সা এসেছে।রিক্সা থেকে নামছে জিন্নাত আর পূর্ব।জিন্নাত হাত ধরে টানতে টানতে আনছে পূর্বকে।নাবিহা আর পূর্বের সম্পর্কে অবগত শ্রেয়া।ওদের বিচ্ছেদের নিউজ দেখেছে সে।মনে মনে ভাবছে,”ভাগ্য তাদের আলাদা করলেও রেখেছে পাশাপাশি।দুই দেহ আলাদা হলেও আলাদা হতে পারেনি দুই মন।যেভাবেই হোক তাদের একসাথে দেখা না গেলেও দেখা যাবে তাদের সম্পর্কের গভীরতা।”
একদিকে নাবিহা তার স্বামীর সাথে চলে যাচ্ছে গাড়ি করে আরেকদিকে পূর্ব এলো আরেক মেয়ের জোরাজুরিতে।জিন্নাত এসেই শ্রেয়ার সামনে দাড়িয়ে বলে,”আমাকে স্ট্রবেরি কেক দিন।আর এই লোকটিকে তেতো চকলেট কেক।উমমম না।ওনাকে ভেনিলা একটু মিষ্টি বেশি সেই কেক দিন।”
রিমলি ওদের কাছে এসে বলে,”জিন্নাত আপু তুমি?”
শ্রেয়া বলে ওঠে,”তুই চিনিস?”
“হ্যাঁ,আমার কলেজেই পড়ে।আমার সিনিয়র কিন্তু খুব ফ্রেন্ডলি।আমিও স্ট্রবেরি কেক খাই।দাড়াও নিয়ে আসছি আমি।”
পূর্ব পাশের টেবিলে বসতে যাবে দেখলো একটি কেকের অর্ধেক অংশ কাটা কিন্তু কেকের উপরের নাম দেখা যাচ্ছে।সেকেন্ড মান্থ এনিভার্সারি মীর এন্ড নাবিহা।চোখ চিকচিক করে উঠলো পূর্বের।গলা শুকিয়ে এলো তার।আজ সে সম্পর্কের মূল্য বুঝলে সুখটা সেই পেতো।শ্রেয়া ভ্যানিলা কেক এনে পূর্বের টেবিলের উপর রেখে বলে,”সম্পর্ক ধরে রাখতে অধিক অর্থ নয় অধিক সময়ের প্রয়োজন।”
অতঃপর ফারাজের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভালোবাসার জন্য মন থাকা লাগে এটা যেমন ঠিক ভালোবাসা ধরে রাখার জন্য ভালোবাসার ব্যক্তিকে মন ভরে সময় দিতে হয়।সারাটা দিন না হোক একটু সুখ দুঃখ আদান প্রদানের জন্য স্বল্প সময়ই হোক।হারিয়ে গেলে আফসোস করলেও কেউ ফিরে আসবে না হারিয়ে যাওয়ার আগে ধরে রাখতে হবে।”
ফারাজ শ্রেয়ার কথাগুলো শুনে হেসে দিলো।মনে মনে বলে,”সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আমি আপনার মুখ থেকেই আগে শুনতে চাই শ্রেয়াময়ী।বেদনার বানী দিয়ে নয় মধুর মিশ্রণে যেদিন আপনি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করবেন সেদিন আমিও আপনাকে আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখাবো।”
রিমলি কেক এনে জিন্নাতের হাতে দিলো।সে নিজেও এক পিচ খেতে শুরু করলো।শিহাব দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।মনে মনে বলে,”স্ট্রবেরি।তোমার এই স্ট্রবেরির প্রতি পাগলামির জন্যই নামটা তোমাকে দেওয়া হলো।”
চলবে…?
#আশার_হাত_বাড়ায়
(সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করেন, ধন্যবাদ)