#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব-৪৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
প্রাক্তন স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে এক ফোটা জল ফেলে অভ্র। ঘুমন্ত অবস্হায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেহেভীনের শুকনো মুখটা। এখন রাত প্রায় দুটো বাজে। অপরাশনেই ডক্টর জেসমিন মেহেভীনকে ঘুমের গভীর ডোজ দিয়ে দিয়েছিলো,যার ফলে
মেহেভীন এখনো জানেনা যাকে নিয়ে তার এতো লড়াই সে বেঁচে নেই পৃথিবীর বুকে।ছোট্ট নবাজাত শিশুটিকে আরিয়ান আরহাম, অভ্র ও আরহামের বাবাসহ অনেক মিলে দাফন করতে নিয়ে গিয়েছিলো। দাফন শেষে আরহাম কিংবা আরিয়ানকে অভ্র আর দেখিনি। তাই সে দাফন শেষে সোজা মেহেভীনকে চোখের দেখাটুকু দেখতে চলে এসেছে। অভ্রের গলা ধরে আসছে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার সন্তান পৃথিবীর বুকে আর বেঁচে নেই।
ছোট্ট প্রানটার পৃথিবীতে আগমনের আগেই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। মেয়ে সন্তান হয়েছিলো তার।অভ্রকে এখন নিজেকে সবথেকে বেশি বড় দুর্ভাগা মনে হচ্ছে, তার একটা ভূলের জন্যে আজ সে তার সন্তানকে হারিয়ে ফেললো। প্রথমত সে জানতোই না মেহেভীনের গর্ভে তার সন্তান বেড়ে উঠছে, তখনি তার সন্তান তাকে ছেড়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ফেললো। অভ্র তার সদ্য মৃত সন্তানকে স্পর্শ করার সাহসটুকুও পাইনি নিজেকে কেমন একটা অপরাধী মনে হচ্ছিলো তার।
আরহাম নিজের হাতেই কাঁদতে কাঁদতে বুকে পাথর দিয়ে সেই ছোট্ট শিশুটিকে নিজ হাতে মাটিতে শুয়িয়ে দেয়।অভ্র আরেকদফা কেঁদে উঠে। তখনি তার চোখ যায় সামনে থাকা রমনীর দিকে। মায়রা
ছল ছল চোখে তার দিকেই তাকিয়েই আছে। মায়রাকে দেখেই পুনরায় মাথায় রক্তচড়ে বসে তার।
___________
হসপিটালের করিডোরে মাথা নিচু করে বসে আছে আরহাম। আরিয়ানও তার ভাইয়ের দিকে অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান জানে তার ভাইয়ের মনের উপর দিয়ে কতটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
একপ্রকার পাথর হয়ে বসে আছে আরহাম। আরিয়ান আরহামকে ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,
‘ ভাই তুমি একটু মাথা তুলে বসো। আমি জানি ভাই তুমি কতটা কষ্ট পাচ্ছো। তাই বলে এইভাবে পাথর হয়ে বসো থেকো না। কাঁদো ভাই একটু কাঁদো তুমি। হাল্কা করো নিজেকে। ‘
আরহাম আরিয়ানের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই আরিয়ানের বুকটা ধক করে উঠলো। আরহামের সমস্ত কষ্ট যেন তার চোখ এসে ধরা দিচ্ছে এখন শুধু অজোড়ে অশ্রুপাত করলেই, সেই কষ্টগুলো একটু হলেও বুকটাকে হাল্কা করবে,কিন্তু আরহাম কাঁদলো না বরং তার হাতের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
‘ যেই হাতে বেবীকে বড় করবো ভেবেছিলাম আজ সেই হাতেই তাকে দাফন করে দিয়ে আসলাম।ভাবতে পারছিস আরিয়ান কতটা বেদনাদায়ক অনুভুতি। আমার এবং মেহেভীনের কত স্বপ্ন, তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। জানিস আমি ওকে আমার নিজের মেয়ের মতো মানুষ করতাম। ওকে সবকিছু কিনে দিতাম। আমার কাছে যা যা চাইতো সব দিতাম। তাহলে কেন চলে গেলো রে বলতে পারিস আমাকে?আরিয়ান? নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর কেন হলো?’
আরহাম কথাটি শান্ত সুরে বললেও সেই কথাতে ছিলো বেদনাদায়ক তার আর্তনাদ। তার ভিতরের কষ্টগুলো যে জমাট বেধে রয়েছে, সেইটাই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু হয়েছে। আরিয়ান তা ভালো করেই বুঝতে পারছে। আরিয়ান কিছু বলতে নিলে,তখনি সে শুনতে পায় অভ্রের চিৎকার চেচামেচি। আরহামকে রেখে আরিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় অভ্র মায়রার সাথে চেচিয়ে কথা বলছে।
‘ এইখানে কেন এসেছো তুমি?এইটাই দেখতে এসেছো তাইনা যে তুমি আজ জিতে গিয়েছো। এতোটাই প্রতিহিংসার আগুন তোমার মধ্যে যে আমার এবং মেহেভীনের বাচ্চাটাকেই তুমি মেরে ফেললে। ‘
অভ্রের কথার প্রেক্ষিতে মায়রা নিচু গলায় বললো,
‘ তুমি আমাকে ভূল ভাবছো অভ্র। দেখো আমি যতই মেহেভীনকে সহ্য না করতে পারি,কিন্তু বাচ্চাটাকে আমি মারিনি। দেখো বাচ্চাটার তো কোন দোষ নেই সে তো নিষ্পাপ তাকে আমি কেন মারতে যাবো? ‘
সঙ্গে সঙ্গে অভ্র দ্বিগুন চিৎকার করে বলে,
‘ তোমার নাটক বন্ধ করো মায়রা। তুমি যে কতটা খারাপ হতে পারো তা আমি ভালো করেই জেনে গিয়েছি। তোমার বাবাকে তো তুমি এই কাজটা করতে বলেছিলে তাইনা? ছিহ মায়রা। ‘
মায়রা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ দেখো অভ্র। আমি জানি আমার বাবা যা করেছি তা কতটা ভূল কতটা ঘৃণিত কাজ। বিশ্বাস করো আমি এইসব কিচ্ছু জানতাম না। জানলে আমি কখনোই বাবাকে এমন কাজ করতে দিতাম না। আমিও তো মা হতে চলেছি আমি বুঝি একটা মায়ের কতটা কষ্ট। আমি নিজের বাবার কাজের জন্যেও অনেকটা অনুতপ্ত তাই আমি ছুটে চলে এসেছি যখন খরবটা শুনলাম যে মেহেভীনের বাচ্চাটা মারা গিয়েছে। ‘
মেহেভীনের চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম টা হাল্কা হয়ে গিয়েছিলো। মায়রার কথা কানে আসতেই সে ধরফরিয়ে উঠে বসে। সে একপ্রকার জন্যে স্থগিত হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষন। বুকে ব্যাথা করছে। মেহেভীন কিছুক্ষন এর জন্যে ভাবলো সে ভূল শুনেছে। এইসব কিছুতেই সত্যি হতে পারেনা। তার সন্তান তার কাছেই আছে। মেহেভীনের পুরো কেবিনে জুড়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার সন্তানের তো তার পাশেই থাকার কথা। সাধারণত সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার মায়ের পাশেই তাকে শুয়িয়ে রাখা হয়।
তার কলিজার টুকরো কোথায়? সে তো পৃথিবীতে চলে এসেছে তাহলে সে মেহেভীনের পাশে নেই কেন?
মেহেভীন পেটের ব্যাথ নিয়েই কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো। মেহেভীনকে এই অবস্হায় বেড়িয়ে আসতে দেখে সবাই চমকালো বটে।
অভ্র বললো,
‘ মেহু তুই এই অবস্হায় বেড়িয়েছিস কেন? ‘
অভ্রের কথায় পাত্তা না দিয়ে মেহেভীন আরিয়ানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা আরিয়ান আমার বেবী কোথায় বল তো? নিশ্চয় আরহাম সাহেব তাকে নিজের কাছে এখনো রেখে দিয়েছে। কোথায় নিয়ে আসতে বল। আমার বেবীকে সবার আগে ভেবেছিলাম আমি কোলে নিবো। দূর কিছুই হলো না। আরহাম সাহেব ঠিক আমার বেবীকে আগে কোলে নিয়ে নিয়েছেন।’
মেহেভীনের কথায় আরিয়ান ঠোট কামড়ে কেঁদে উঠে। আরিয়ানকে কাঁদতে দেখে মেহেভীন অবাক হয়ে বলে,
‘ কিরে এইভাবে কাঁদছিস কেন তুই? আমার বেবী কোথায় আরে বল না? ‘
আরিয়ান বলতে পারলো না তার আগেই অভ্র কান্নামিশ্রিত গলায় বললো,
‘ আমার সন্তান বেঁচে নেই রে মেহু। সে আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। ‘
সঙ্গে সঙ্গে মেহেভীন অভ্রের মুখ চেপে ধরে বলে ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
‘ কি বলছো অভ্র? তুমি এতোটা নিকৃষ্ট যে আমার সন্তানকে মৃত্যু বলছো? একদম মিথ্যে বলবে না তুমি। আমার কলিজা টুকরোর কিচ্ছু হয়নি।’
মেহেভীন এইবার ডক্টরদের কাছেও জানতে চাইলো তার সন্তানের কথা,কিন্তু বরাবরের মতো তারাও নিরবতা পালন করলেন। মেহেভীন এইবার আরহামের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বলে,
‘ কেউ আমার বেবীর কথা বলছো না কেন? তার মানে সবাই ওই প্রতারক অভ্রের মিথ্যে কথার সাথে সায় দিচ্ছো তাইনা? কিন্তু আরহাম সাহেব ঠিক সত্যি কথা বলবে। আরহাম সাহেব? কোথায় আপনি? ‘
আরহাম মাথা নিচু করে বসে ছিলো, মেহেভীনের ডাকে সে মাথা তুলে তাকিয়ে বুঝতে পেরে যায় মেহেভীন জেগে গিয়েছি এবং এইটাও জানতে পেরে গিয়েছে তার সন্তান আর বেঁচে নেই। আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে মেহেভীনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আরহামের চোখ-মুখ ফুলো দেখেই মেহেভীন বুঝতে পারছে আরহাম কেঁদেছে। মেহেভীন আরহামের কাছে অনেকটা আশা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
‘ আমার বেবী কোথায় আরহাম সাহেব? দেখুন না ওরা কি বলছি আমার বেবী নাকি পৃথিবীতে বেঁচে নেই। এইটা কী করে হতে পারে বলুন? আমার বেবীকে নিয়ে আমার এতো লড়াই এতো ফাইট সবকিছু কি নিমিষেই শেষ হয়ে যেতে পারে বলুন? আচ্ছা আমরা না কত স্বপ্ন দেখেছিলাম বেবীকে নিয়ে। সেগুলো পূরণ করবো না? ও আরহাম সাহেব বলুন না আমার বেবী কোথায়।’
আরহাম অপরদিকে ঘুড়ে যায়। মেহেভীনের কথার জবাব দেওয়ার সাধ্যি তাই নেই। সে পারবে না তা করতে।
কথাটি বলতে বলতে মেহেভীন মাটিতে ধপ করে চিৎকার করে কেঁদে দিয়ে বলে,
‘ আমার বাচ্ছা! আমার কলিজা মাকে ছেড়ে কোথায় গেলি তুই? ‘
মেহেভীনের কান্নার আর্তনাদ পুরো হসপিটালের দেয়াল জুড়ে বিরাজমান হয়ে রয়েছে। মেহেভীনের কান্নাতে আরহামের বুকটাও ফেটে আসছে। মেহেভীনের এই করুন আর্তনাদ দেখে ডক্টরদের চোখেও জল চলে আসে। অভ্র মেহেভীনকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসতে নিলে,মেহেভীন দ্রুত পায়ে অভ্রের কাছে এসে, অভ্রের কলার চেপে চিৎকার করে বলে,
‘ কেন করেছিলে প্রতারণা তুমি? কেন করেছিলে? তোমার টাইম পাসের মূল্য শুধুমাত্র আমি নই আমার সন্তানকেও দিতে হলো। আজ যদি তুমি আমার সাথে প্রতারণা না করতে তাহলে এইরকম পরিনতি কখনোই হতো না। আমার বাচ্চা আমার কলিজা আজকে আমার সাথে থাকতো অভ্র। তুমি আমার বাচ্চার খুনি। তুমি আমার বাচ্চার খুনি। ‘
মেহেভীন কথাটি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
মেহেভীনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। চোখ দিয়ে অজান্তেই তার নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সে তার সন্তানের খুনি? তার জন্যে আজ তার সন্তান তাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলো। মেহেভীন অভ্রকে ছেড়ে কিছু একটা ভেবে দৌড় দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মেহেভীনকে এইভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখে সবাই হতবাক! মেহেভীন যেন এখন নিজের মধ্যে নেই।
ডক্টর বললেন,
‘ উনাকে আটকান আপনারা। সবে মাত্র উনার সিজারি হয়েছে। এই অবস্হায় দৌড়া দৌড়ি করা উনার জন্যে বিপদজনক। ‘
আরহাম ও অপেক্ষা না করে মেহেভীনের পিছনে দৌড়াচ্ছে। মেহেভীন কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়।
__________চলবে কী?
[ মেহেভীনের সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে, যার ফলে মেহেভীন এবং অভ্রের ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে। আশা করি এই বিষয় নিয়ে কনফিউশন থাকবে না। তাছাড়া আমার এক্সাম তাই আমি একদিন পর পর গল্প দিচ্ছি। তাও সবাই প্রতিদিন গল্পের জন্যে অপেক্ষা করেন কেন?]