“আপনার কাছে আমি ঠিকানা জানতে চেয়েছি চুমুতো চাইনি তাহলে এমন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকানোর কি আছে মেয়ে?”
মাঝ রাস্তায় অচেনা ছেলের মুখে এমন অদ্ভুত কথা শুনে কানটি “ঝা ঝা” করে উঠলো অষ্টাদশী মেয়েটির৷ মুখের আদল কাপড়ে ঢাকা ডাগর ডাগর আঁখি যুগল দৃশ্যমান৷ একতো এ ছেলেটি মাঝ রাস্তায় পথ আটকে প্রশ্ন জিগ্যেস করছে তারপর এমন কথা৷ ছেলেটি কি জানে না এ গ্রামে মেয়েরা অন্য ছেলেদের সাথে কথা বললেও কেলেংকারী হয়? মেয়েটি ভীত হয়ে আশেপাশে দৃষ্টি বুলালো৷ ছেলেটি বুঝলো না তার মতিগতি৷
মেয়েটির দৃষ্টি এবার গ্রুদ্ধ হলো নিভু নিভু স্বরে কঠিন কন্ঠে বললো,
“পথ আটকে দাঁড়ালেন কেন? এ কেমন অভদ্রতা?”
শাহওয়াজ কিছু বলবে এর আগেই মেয়েটির সাথের বাচ্চা টা বলে বসলো৷
“জানো বুবু বিলেত ফেরত ছেলেরা মেয়ে দেখলেই জরায় ধইরা চুমু খায়৷”
হুট করেই পাশ থেকে বলা মৃদুলার এহেন কথায় সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো অষ্টাদশী মেয়েটি৷ আশেপাশে ফের দৃষ্টি বুলালো সে৷ আঁধার নেমে আসছে৷ তার সাথে আঁধার নামলো সে ডাগর ডাগর আঁখি দ্বয়ে৷ অগ্নীদৃষ্টি যেন নিমেষেয়েই ভীতি দৃষ্টিতে পরিনত হলো৷ ধরণীর আলো নিভু নিভু প্রায়, এখানে আর দু-দন্ড দাঁড়ালে কেউ দেখে ফেললে মন্দ কথা বলবে৷ আজ বাড়িতে কেউ নেই বলে মৃদুলা কে আনতে দাদিমা পাঠিয়েছিলো ওকে৷ মৃদুলা আর ও গুটি গুটি পায়ে যাচ্ছিলো আর তখনি আগমন এ ছেলেটির৷ পথ আগলে দাঁড়িয়ে শুধালো আমায় একটা ঠিকানা বলতে পারবেন? এ কেমন আদব? ছেলেটি যে নতুন গ্রামে দেখেই বোঝা যায়৷ বিলেতি দের মত জামা গায়ে৷ কোনো অচেনা মেয়ে কে কি এমন করে শুধায় কেউ?
উর্নাটা আরেকটু টেনে মুখশ্রীটা আরো আড়াল করলো৷ এবার আঁখি যুগল ও কিঞ্চিৎ দেখা যাচ্ছে৷ মৃদুলার কথায় ভরকালো শাহওয়াজ৷ এ কেমন কথা বার্তা? ইতোমধ্যে শাহওয়াজ এর মনে হলো ওই বাচ্চা মেয়েটা একটু বেশি পাঁকা৷ যাকে ইঁচড়েপাকা বলে৷ গ্রামের বাচ্চারা বুঝি এমনই হয়?
থমথমে কন্ঠে বললো,
“কি সব যা-তা বলছো মেয়ে?আমিতো ঠিকানা জানতে এসেছি শুধু৷ এ গ্রামে নতুন এসেছি পথঘাট আমার অচেনা৷”
শাহওয়াজ এর একটা কথায় ও যেন কান দিলো না অষ্টাদশী মেয়েটি৷ মুখশ্রী তার পুরোটাই ঢাকা প্রথম থেকে আঁখিদ্বয় দেখা যাচ্ছে কেবল৷ ডাগর ডাগর আঁখি টইটুম্বুর, যেন জল গড়িয়ে পরলো বলে৷ ভীত হয়ে তাকিয়ে এখন৷
শাহওয়াজ এর কথায় পাত্তা না দিয়ে মৃদুলার হাত ধরে তড়িৎ গতিতে বললো,
“চল মৃদু কেউ জানলে কেলেংকারী হবে৷”
বলেই তাড়াতাড়ি ছুটলো সামনের দিকে৷ শাহওয়াজ বোকাবনে গেলো৷ চোখমুখ কুঁচকে আশেপাশে তাকালো৷ কেউ নেই আশেপাশে এবার চেঁচিয়ে অষ্টাদশী সে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো,
“এরপর দেখা হলে আপনার বোনের কথাটা সত্যি করে ফেলবো মেয়ে দেখে নিয়েন৷”
..
পুরোনো একটা তিনতলা বাড়ি৷ জমিদার বাড়ির ন্যায় এখানেই একটা লোক এসে দিয়ে গেলো শাহওয়াজ কে৷ বাড়িটি দেখেই মুখ জুড়ে কঠিনতার ছাপ ছেঁয়ে গেলো৷ পর শ্বাস টেনে সংযত করলো নিজের ক্ষোভ৷ এ বাড়িটিকে জমিদার বাড়ি বলেই চেনেন এ অঞ্চলের মানুষ সহ দূরদূরান্তর মানুষ জন৷ জমিদারি এখনো বিরাজমান তাদের৷ এ বাড়ির বড় ছেলের এমপি মন্ত্রীদের সাথে উঠা বসা৷
বাড়ির মেইন কপাট টা এত্ত বড়৷ বাইরে থেকেই একবার চোখ বুলালো শাহওয়াজ৷ বাড়ি বললে ভুল হবে রাজপ্রাসাদ থেকে যেন কোনো অংশে কম না৷ এ বাড়ির প্রতিটা ইট ও শাহওয়াজ এর কাছে রহস্যের৷ বাড়িতে অনুষ্ঠান যে সামনে দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ শেওলা পরা ইটের বাউন্ডারি গুলো ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে৷ সামনে এগিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকবে ঠিক তখনি পথ আগলে দাঁড়ালো দারোয়ান বাজখাঁই কন্ঠে শুধালো,
“আহা, না বলে ঢুকছেন কোথায়?কার কাছে এসেছেন?”
শাহওয়াজ বেশ ক্লান্ত৷ আসার পর একের পর এক ঘটনার না ঘটেই যাচ্ছে৷ শাহওয়াজ এর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না কাটকাট কন্ঠে বললো,
“শাহওয়াজ প্রহর আমার নাম৷ শাহনাজ চৌধুরীর ছেলে৷”
বলে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো৷ লোকটার মুখের রঙ পালটে গেলো যেন৷ লোকটার সম্পর্কে জানে, শাহওয়াজ তাই সল্প কথায় কাজ সারলো৷ দারোয়ানটি তড়িৎ গতীতে বললো,
“মাফ করবেন মাফ করবেন৷ ভেতরে আসুন বাবা৷”
শাহওয়াজ ঢুকলো বাড়িতে প্রথম বাড়ের মত৷ বাড়িটি বিশাল অন্দরে ঢোকার আগেই মত বাগান তারপর অন্দরের গেইট৷ বাড়িটি পুরোনো ধাঁচের নকশার৷ বাড়ির বাইরে প্রতিটা দেওয়ালে কারু কাজ করা৷ রঙটাও পুরোনো সাদা রঙটা পুরোনো হয়ে কেমন কালার হয়ে গেছে সেই রঙই ঘষা হচ্ছে৷ বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় অনুষ্ঠানের তোরজোর চলছে৷ বাগান পেরিয়ে অন্দরের গেটের সামনে আসলো৷ এ দুয়ারটি কাঠের৷ কাঠটা যে সবে বার্নিশ করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে সুইচ চেপে বেল বাজাতেই দুয়ার খুললো মধ্য ঊনবিংশ বা বিংশ বয়সী একটা মেয়ে৷ যেন অপেক্ষায় ছিলো কপাট খোলার, সে যেন জানতো শাহওয়াজ এখনি ডোরবেল চাপবে৷ শাহওয়াজ কিছু বলবে তার আগেই মেয়েটি উৎসাহিত হয়ে বললো,
“শাহওয়াজ ভাইজান?”
শাহওয়াজ অবাক হলো খানিকটা হাত দিয়ে কপালে আসা চুল গুলো সরিয়ে চশমাখানা ঠিকঠাক পরে মাথা দুলালো মেয়েটি শাহওয়াজ কে কিছু না বলেই হাক ছেড়ে ডাকলো,
“আব্বা এসে গেছে, ভাইজান এসে গেছে৷”
শাহওয়াজ কে প্রবেশ করতে বললো৷ শাহওয়াজ অন্দরে প্রবেশ করবে এর আগে পায়ের নিচে বিঁধলো কিছু৷ ক্ষানিকটা পিছিয়ে গেলো কি যেন ভেবে তাচ্ছিল্য হাসলো৷ তার মন যেমন বাঁধা দিয়েছিলো এ বাড়িতে আসার৷ সব কিছু যেন নিষেধাজ্ঞা জারি করছে এ বাড়িতে পা রাখার জন্য৷
পায়ের নিচে কি তা দেখার জন্য নিচু হতেই চকচকে রুপালি এক নুপুর পেলো৷ ভ্রু কুঁচকে তুলে নিলো নুপুরখানা তার আগেই শোনা গেলো বৃদ্ধ এক মহিলার কন্ঠ,
“আইছে আইছে আমার রত্ন আইছে৷ আমার প্রদিপ আইছে৷ আয় ভাই আয় তোরে দেখে চোখ জুড়াই৷”
শাহওয়াজ এর চোখ মুখ কুঁচকে এলো অদ্ভুত ক্রুদ্ধ আভা ফুটলো চোখে মুখে৷ মুখশ্রীখানা শক্ত করে প্রথম বারের মত নিজের পৈতৃক ভিটায় পা রাখলো৷ কোনো ছেলে হয়তো প্রথম বারের মত জন্মের আটাশ বছর পর নিজের বাবার সাথে নিজের পরিবারের মানুষের সাথে দেখা করবে৷ কিছু কথা স্মৃতিচারণ হতেই নুপুরের কথা বেমালুম ভুললো বেখেয়ালিতে নুপুরখানা পকেটে ভরে নিলো৷ এইতো পা রাখলো শাহওয়াজ এবার এক এক করে সব হিসেব ষোলোকলা পূর্ণ করবে৷
চোখ ঘুরিয়ে পুরো বাড়ি নজর বুলালো বাড়িটি বাইরে থেকে যতটা পুরোনো ধাঁচের ভেতর থেকে এর বেশি যেন আধুনিকতার ছাপ৷
এ বাড়ির প্রতি কোণা কোণার সাথে নিজের পরিচিত ঘটাবে শাহওয়াজ৷ দৃঢ় পায়ে বৃদ্ধটির সামনে গেলো শাহওয়াজ, খোদেজা বেগম লাঠি হাতে এগিয়ে এলো নাতীর দিকে৷ চোখ জুড়ালো তার৷ এই তো তার রত্ন চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো৷
শাহওয়াজ এর উদ্দেশ্যে বললো,
“নিচু হ ভাই তোরে একটু মন ভইরা দেইক্ষা আদর করি৷ বাপের লাহান লম্বা হইছোস তোরে কি আমি নাগাল পাই নাকি?”
শাহওয়াজ নিচু হলো৷ পুরো মুখে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো নাতীর৷ ইতোমধ্যে বাড়ির বাকি সদর্সরা এসে পৌঁছেছে এখানে৷ মেয়ের কন্ঠ শুনে আকবর সাহেব ও নেমে এসেছে কেবল৷ তার বক্ষ শীতল কেমন, এই ছেলেটা তার? তার অস্তিত্ব? চোখ টইটুম্বুর কিন্তু চোখ কে যে বেহায়া হওয়া দেওয়া যাবে না৷ জমিদার পূত্র সে দূর্বলতা তাকে ছোঁয় না৷ ছেলের সান্নিধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো, কম্পিত হাতে ছুঁয়ে দিলো ছেলের গাল৷ শাহওয়াজ এর দৃষ্টি অনিমেষে গম্ভীর মুখী শাহওয়াজ এর অনুভূতি শাহওয়াজ এর নিজেরো বোধগম্য না৷ হুট করে বলিষ্ঠ এক দেহ তাকে বুকে চেপে ধরলো৷ আটাশ বছর বয়সে প্রথম কোনো বাবা তার ছেলেকে দেখলো এবং প্রথম বারের মত বুকে জড়ালো৷ নরম কন্ঠে বললো,
“আব্বু আসতে কোনো সমস্যা হয়নিতো? আব্বু আমায় চিনেছো? আমি তোবার বাবা৷ বাবা ডাকবে একবার আব্বু?”
শাহওয়াজ এর চোখ মুখ কুঁচকে এলো তাচ্ছিল্যতায় শাহওয়াজ এর৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আজ সে ব্যার্থ হচ্ছে৷ তবুও মায়ের কথা যে রাখতে হবে৷ মা কে যে কথা দিয়েছে৷
শাহওয়াজ মিনমিনিয়ে বললো শুধু,
“বাবা আমি ক্লান্ত, আর দূর থেকে এসেছি শরীরে ময়লা এভাবে না জড়িয়ে ধরাটাই ভালো৷ জার্মস আছে এখন শরীরে৷”
আকবর সাহেব যেন বুঝলো ছেলের অভিমান৷ তবুও হাসলো৷ ছেলেকে ছেড়ে হাক ছেড়ে বললো,
“রাবেয়া আমার ছেলেকে ঘরে নিয়ে যাও৷ আমার ছেলের যেন কিছু অভাব না পরে হাত বাড়াতেই যেন সব কিছু পায়৷”
স্বামীর কথায় আড়াল থেকে বের হলো রাবেয়া৷ পাঁচ ফুটের সিমসাম গড়নের একটা মহিলা৷ তার চোখে মুখেও কেমন খুশির ঝলক৷ শুধু যেন কাছে আসতে পারছিলো না৷ কারো সাথেই শাহওয়াজ এর পরিচয় হয়নি ৷ আকবর সাহেব জানিয়েছেন ছেলে বিশ্রামের পর সব হবে৷ একটা কাজের লোক সাথে সাথে ব্যাগ নিয়ে গেলো৷ শাহওয়াজ এর৷ শাহওয়াজ উপরে উঠার পর আকষ্মিক রাস্তার সেই পিচ্চি মেয়েটার সাথে দেখা হলো৷ কি যেন নাম তার মনে নেই৷ তার মানে মেয়ে দুটো এ বাড়িরই? কিন্তু কে? শাহওয়াজ এর ভাবনার মাঝেই মৃদুলে দৌড়ে যেতে যেতে বললো,
“বুবুগো জলদি পালাও সেই বিলেতি ছেলেটা আইছে তোমায় চুমু খাইতে৷”
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া মেঘলা
#সূচনা পর্ব