#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
চৌদ্দ
“হায় আল্লাহ তোর পায়ে কি হয়েছে ময়ূর?”
রুপার কথায় পায়ের পানে তাকায় ময়ূরাক্ষী৷ ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে পা টা জ্বলছে কিন্তু এক বার ও চোখ ঘুরিয়ে তাকায়নি৷
তখন যে ধাক্কা খেলো প্রায় ভুলেই বসেছিলো ভয়ে৷ পায়ের দিকে তাকাতেই চকিত চমকালো৷ বিস্ময় আভা ফুটলো মুখে৷ অষ্টাদশী মন ক্লেশে ছেঁয়ে গেলো নিমেষে৷ পা টা যে এতখানিই কেঁ’টেছে খেয়ালই করেনি ময়ূরাক্ষী৷
র’ক্ত মাখো মাখো অবস্থা পা টার৷
মাত্রই খেয়ে উঠে হাত ধুতে এসেছিলো রান্না ঘরে৷
রুপা এগিয়ে এসে বললো,
“এতটা ক্ষত কি করে হলো ময়ূর?”
ময়ূরাক্ষীর মন অভিমানে জর্জরিত হলো৷ বদন খানা রক্তিমাভা ছেয়ে গেলো৷ এক আকাশ অভিমান জন্মালো সেই অভাদ্র লোকটা কে নিয়ে৷ ময়ূরাক্ষী মুখ ফসকে বলতে নিয়েও থেমে গেলো৷
বেশ ইচ্ছা জাগছে বলার,
“তোমার অভদ্র ভাইজানের জন্যই এ দশা৷”
রেহান ও এগিয়ে এলো শুনে বিচলিত হয়ে পরলো ছেলেটা৷ হাত ধুয়ে কোনো রকম এগিয়ে এসে পায়ের কাছে বসলো বললো,
“হায় আল্লাহ কি করেছিস ময়ূর? দেখে চলবি না? হলো কি করে?”
রেহানের অধিকারী কন্ঠ৷ রেহানের কন্ঠে ইতমধ্যে সবাই এসেছে৷ শাহওয়াজ উপরেই যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো রেহানের কন্ঠে এগিয়ে এলো৷ রেহানের কথায় আরেকটু আবেগী হলো ময়ূরাক্ষী টইটম্বুর হলো আঁখিদ্বয়৷
সংযত করলো নিজেকে শাহওয়াজ কে দেখে মিনমিনিয়ে ধাতস্থ গলায় বললো,
“ছাদের দরজা খানা নিচে দিয়ে ভাঙা ভাইয়া৷ কে যেন দরজা আটকে এসেছিলো অন্ধকারে দেখতে পাইনি ধাক্কা খেয়ে পা কে’টে গেছে৷”
রেহান তটস্থ হলো, বিচলিত দেখালো৷ বেতের মোড়া খানা এগিয়ে দিলো বসার জন্য ময়ূরাক্ষীকে বললো,
“এখানে বোস ময়ূর আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি৷”
শাহওয়াজ কে দেখেই মোচড়া মুচড়ি শুরু করে দিয়েছে মেয়ে টা, খেয়াল করলো শাহওয়াজ৷ ময়ূরাক্ষী বসলো না এর মাঝেই রেহান হাত ধরে বসিয়ে দিলো ময়ূরাক্ষীকে৷
ময়ূরাক্ষী মিনমিনিয়ে বললো,
“ভাইয়া আমি করে নিবো উপরে গিয়ে৷ ছাড়ুন!”
রেহান ছাড়লো না৷ রুপাকে বললো ফার্স্ট এইড বক্স টা যেন এনে দেয়৷
শাহওয়াজ লক্ষ করলো মেয়েটাকে অন্য কেউ স্পর্শ করায় রাগ বাড়লো৷ তার মুখ খানা গম্ভীর হয়ে এল, সহ্য হলো না এ দৃশ্য আর৷ প্রস্থান করার জন্য পা বাড়ালো৷ এখানে আর দু-দন্ড থাকলে নির্ঘাত কিছু বলে বসবে৷ সে ক্ষানিকটা দুর যেতেই কানে এলো খোদেজার কন্ঠ৷ সে বললো,
“আহ নানু ছাইড়া দাও৷ আর মরদ হইয়া মাইয়া মানুষের পাও ধরছো কেন? ওর কাম ওয় করবোনে৷ ছাড়ো কইতাছি৷”
রেহানের ও রাগ হলো মহিলার কথায়৷ এ কেমন আজগুবি কথা? কিন্তু কথার খেলাপ করতে পারলো না৷ ময়ূরাক্ষী দীর্ঘ শ্বাস টেনে হাটা ধরলো রুপা কয়েকবার ডেকে বললো সে যেন ওর রুমে যায় ও মলম লাগিয়ে দিবে৷ কিন্তু মেয়ে টা যেন পাত্তাই দিলো না৷
পায়ের জ্বলন থেকে অভিমান বেশি অষ্টাদশী ময়ূরাক্ষীর৷ এ অভিমান যেন তেন না৷ নিজের ভাগ্যের প্রতি অভিমান ওই অভদ্র লোকের প্রতি অভিমান৷
নিজেকে নিয়ে আকাশ কুসুম ভাবনা তার৷ রেহান যখন তার পা স্পর্শ করলো রাহেলার মুখ খানা দেখেছে৷ সে তো সব সময়ই বলে ময়ূরাক্ষী নাকি রুপ দিয়ে রেহান কে ফাসাতে চায়৷ কিন্তু আদৌ যদি রেহান ভাই এসব শোনে কি ভাববে?
হুট করেই হাতে টান পরায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো ময়ূরাক্ষী আকস্মিক কেউ হাতে টান দিয়ে কক্ষে ঢুকিয়ে নিলো৷ ভয়ে প্রাণ পাখি উড়ার পথে যেন৷
সামনে তাকাতেই কারো প্রসস্থ বুক দেখতে পেলো৷ ক্ষানিকটা মাথা উচু করতেই এক অভদ্র লোকের দেখা৷ হ্যাঁ অভদ্রই তো৷ ময়ূরাক্ষীর কাছে অভদ্র৷
লোকটা এত্ত লম্বা চেহারার দিকে তাকাতে বেগ পেতে হয়৷ মেয়েটা এমনি সাংঘাতিক রেগে ছিলো এখন যেন আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থা৷ রাগ শিড়ে উঠলো ময়ূরাক্ষীর! লোকটা পেয়েছে কি? যখন তখন কাছে আসে৷ ময়ূরাক্ষী আকাশ চুম্বি ক্রোধ নিয়ে কিছু বলতে উদ্ধত হবে তার আগেই মুখ খানা চেপে ধরলো শাহওয়াজ৷
এক ঝটকায় ঘুরিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো সান্নিধ্যে গেলো, মেয়েটা ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলো৷
মুখশ্রী খানা লাল হয়ে গেছে৷ কি সুন্দর সেই আদল৷ সৃষ্টি কর্তা যেন স্বযত্নে বানিয়েছে৷ কিন্তু ওই আঁখিতে কি যেন আছে৷
মেয়েটা তাকায় না কেন? চোখ নামায় কেন? তাতে শাহওয়াজ এর রাগ হলো৷ হুট করেই মস্তিষ্কে চারণ হলো একটু আগের ঘটনা৷ যে হাত ধরে রেহান ময়ূরাক্ষীকে বসিয়ে দিয়েছিলো সে হাতটা চেঁপে ধরলো৷ তার এমন রাগ কেন হচ্ছে জানে না শাহওয়াজ! এই অষ্টাদশী মেয়েতে কেন হুট করে মন লাগলো জানে না শাহয়াজ শুধু জানে এ মেয়েটি তার শান্তি৷ এই অশান্তিময় বাড়িতে এক টুকরো সুখ, আত্মার শান্তি, চোখের শান্তি এবং মনের শান্তি৷ শাহওয়াজ ক্ষানিকটা মৃধু রাগ নিয়ে বললো,
“চোখ তুলে তাকান ময়ূরাক্ষী৷তাকান আমার দিকে৷ ”
কিন্তু মেয়েটা তাকালো না৷ চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো৷ যে মুখশ্রীতে একটু আগে রাগ ছিলো সে মুখশ্রীতে ভীতি পেলো৷
পছন্দ হলো শাহওয়াজ এর৷ মনে ধরলো৷ শাহওয়াজ ফের বললো,
“তাকাবেন না ময়ূর?”
ময়ূরাক্ষী তাকালো৷ তবে তার পানে না, টইটুম্বুর আঁখি থেকে দু এক ফোটা পানি পরলো অভিমান নিয়ে বললো,
“আপনার জন্য আমি আঘাত পেয়েছি৷”
শাহওয়াজ থমকালো কি যেন ছিলো ওই অভিমানী কন্ঠে৷ বউকে গিয়ে লাগলো৷ ক্ষানিকটা চেয়ে রইলো, তবে দৃষ্টি বিনিময় হলো না৷
কম্পিত বক্ষে হাত দিয়ে মেয়েটার পায়ের কাছে বসে পরলো৷ তাতে তাকালো ময়ূরাক্ষী হাসফাস শুরু করলো, তটস্থ হলো৷ তার মাঝেই শাহওয়াজ এর কন্ঠ কর্ণপাত হলো,
“আপনি যে আমায় এখন এখানে আঘাত করলেন ময়ূর৷ হার্টের ডাক্তার কে রোগী তে পরিনত করলেন?”
ময়ূরাক্ষী এবার বোকা বোকা চাওনিতে তাকালো৷ লজ্জায় আড়ষ্ট হলো৷ কি বলছে? সে নাকি ডাক্তার আবার৷ অভদ্র ডাক্তার৷
শাহওয়াজ এবার উঠলো লাগেজ থেকে ছোট্ট ফাস্ট এইড বক্স টা বের করলো৷ এর মাঝেই নুপুর জোড়া রুনঝুন শব্দ তুললো নাড়াচাড়ার ফলে৷ ময়ূরাক্ষী মিনমিনিয়ে বললো,
“আমার নুপুর আছে ওখানে? দিচ্ছেন না কেন?”
শাহওয়াজ ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললো,
“কোথায় নুপুর? এখানে কোনো নুপুর নেই৷ ”
ময়ূরাক্ষী ঢেড় টের পেলো৷ অভিমান নিয়ে ফের উঠে যেতে নিলেই ধরে ফেললো শাহওয়াজ৷ ময়ূরাক্ষী নিভু কন্ঠে বললো,
“ছাড়ুন আমায় উপরে যাবো৷”
শাহওয়াজ জোর করে বসিয়ে স্বযত্নে পা টা মুছে দিলো৷ মেডিসিন লাগাতে লাগাতে বলল,
“ধরিনিতো আমি৷ আমি যখন ধরবো তখন ছাড়া পাবে না মেয়ে৷ আপাতত ব্যান্ডেজ অব্দি থেকে যাও পরে না হয়….!!”
..
আজকের ভোরটা একটু বেশি স্নিগ্ধ আজ রেহানের ঘুম ভেঙেছে চাঁদের মুখদর্শন করে৷ চাঁদ নয়কি?
বাড়িতে কাজ করার শ-খানেক লোক থাকলেও তাকেও উঠতে হলো৷ আজ রুপার আংটি বদল আর পাঁকা কথা৷ তার বেশ সকালে উঠতে হলো৷
বাইরে একটু হাটতে হিয়েছিলো ভেতরে আসতেই হুট করেই ময়ূরাক্ষীর দেখা পেলো৷ মেয়েটার পায়ে শুভ্র ব্যান্ডেজ৷ ব্যান্ডেজ টা বোধহয় রুপা করে দিয়েছে৷
মেয়েটা সাংঘাতিক সুন্দর, ঝলসানো রুপ প্রতিবার রেহান কে ঝলসায়৷ এ উপ দেখে বুকের বা পাশটা জ্বলন ধরে৷
ময়ূরাক্ষী ঘোমটা টেনে বের হলো অন্দর থেকে এর মাঝেই মুখোমুখি হলো রেহান৷ মিষ্টি কন্ঠে শুধালো,
“কোথায় যাচ্ছিস ময়ূর?”
ময়ূর ভারী নেত্রপল্লব ঝাপটালো! প্রভাত বেলায় হৃদয় নিঙড়ানো মিষ্টি হাসির দেখা পেলো৷ ঝলমলে আলো যেন আলো ঝলমলে হলো৷ নাকি রেহানের কাছেই লাগলো? মেয়েটার সদ্য নিদ্রা থেকে উঠে আসা ফোলা ফোলা মুখ খানায় কি স্নিগ্ধতা আর কোমলতা৷ মেয়েটার শুধু চামড়াই সাদা না মুখের আদল ও অত্যন্ত সুন্দর৷ যেন ছোট্ট এক পুতুল৷
ময়ূরাক্ষী ছোট্ট ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“বাগানে যাই ভাইয়া৷”
কিন্তু কথা কি কর্ণদ্বয়ে পৌছায় আর? এত্ত মিষ্টি হাসি দেখলে কি কিথা কর্ণকুহরে পৌছায়? সে হাসির পানি নির্লিপ্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো নিভৃতে৷
বাগানটি একাংশ জুড়ে জবা ফুলের গাছ৷ এ জবা গুলো রুপা আর তার পছন্দের৷ পরিচর্যা করেন ময়ূরাক্ষী নিজে৷ ফুল গাছে পানি দিচ্ছে ময়ূরাক্ষী নিতুন বউয়ের ন্যায় এক হাত ঘোমটা টানা৷
আজ বাড়িতে লোক আসবে আজ তো মাথা থেকে ঘোমটা ফেলা যাবেই না৷ দাদিজানের নির্দেশ৷ ময়ূরাক্ষীর মনে হয় মাঝে মাঝে এ রুপ তার বোঝা৷
তাদের ভাষ্যমতে ময়ূরাক্ষী রুপ দিয়ে মানুষ কে ফাসাতে চায়৷
ওসব কথায় ময়ূরাক্ষীর মন খারাপ হয় না৷ মন খারাপ হয় এই ভেবে সে খোলামেলা চলতে পারে না৷
আশেপাশে দৃষ্টি ফেলছে আর গাছে পানি দিচ্ছে ময়ূরাক্ষী৷ মুখশ্রী জুড়ে লজ্জার আভা৷ কাল রাতের কথা স্মরণ হতেই লজ্জায় মিহিয়ে যাচ্ছে৷
লোকটা সকালে এখানে আসে ব্যায়াম করতে আজ আর না দেখা হোক৷
ভাবতে ভাবতেই পানি দেওয়া রেখে এগোলো পুকুরের দিকে এর মাঝেই ঘটলো এক কান্ড৷ ফের ধাক্কা খেলো কারো সাথে৷
মাঝে মাঝে নিজের উপর নিজেরই রাগ হয় ময়ূরাক্ষীর৷ সে যে দিনে কয়বার ধাক্কা খায়, হোচট খায় ঠিক থাকে না৷ কিন্তু এখন কিসের সাথে ধাক্কা খেলো তা দেখতে যাবে ঠিক তখনি চেনা কন্ঠ কানে এলো,
“সামনে পরতে চান না তাই ইচ্ছে করে সারাদিন লুকিয়ে থাকেন মেয়ে, কিন্তু পরিশেষে আমার বক্ষে এসেই পরতে হয় আপনার৷ এভাবে হোচট খেতে খেতে আমার বক্ষই না আপনার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায়৷”
চলবে,
নোট: ১২৩৫ শব্দ