ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা পনেরো

0
157

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

পনেরো

দীর্ঘ আঠারো বছর পর পা রাখলো জোবেদা সৌহার্দ্য নিবাসে৷জোবেদা খোদেজার বোন৷ মহিলা খোদেজার থেকে দুই গুন বেশি রাগী৷ কথায় কোনো মায়া নেই, মানুষ কে তুচ্ছ করা তার যেন প্রিয় কাজ৷
জোবেদা প্রবেশ করলো বাড়িতে সাথে তার নাতী নাহিন৷ জোবেদা তার বুবুর থেকে সৌখিন মানুষ৷ গা ভর্তি স্বর্নালংকার৷ বাড়িতে পা রাখতেই শরীর খানা শিরশির করে উঠলো ক্রোধী হলো বদন৷ কিছু স্মৃতি ঝলমলিয়ে উঠলো নেত্র খানায়৷ সংযত করলো নিজেকে৷
বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখা হলো দারোয়ানের সাথে৷ দারোয়ান দেখেই খুশিতে গদগদ হলো৷
জোবেদা হাশি মুখে বললো,
“কিরে তুই এখনো আছিস এ বাড়িতে?”
দারোয়ান হেসে উত্তর দিলো,
“আপনাদের ছেড়ে কোথায় যাই বলুন তো মা জননী?”
জোবেদা হাসলো৷ হাসলেও যে মানুষ কে এত কুৎসিত লাগে তা হয়তো জোবেদা কে না দেখলে বোঝা যেতো না৷
খোদেজা আর জোবেদা দু-জন দু-গ্রহের মত৷ তাদের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ৷
খোদেজার যেমন রুপ সৃষ্টি কর্তা ঢেলে দিয়েছে তেমন জোবেদা যেন বিপরীত৷ গায়ের রঙ কৃষ্ণ কালো৷ খোদেজারা তিন বোন৷ আকবর চৌধুরীর স্ত্রী রাবেয়ার মা সবার বড় এবং দু-বোন থেকে একদম ভিন্ন ধাঁচের মানুষ৷ খোদেজা আর জোবেদা রুপের দিক দিয়ে আকাশ পাতাল হলেও বুদ্ধি, আচরণ একেবারে এক৷
মানুষ বলে কালো মানুষের মন ভালো হয় কিন্তু এ মহিলা যেন এ কথার বিপরীত৷ এ মহিলার সব কু-কীর্তি জানে এই দারোয়ান৷

নিহান বাড়ির বাইরে থেকেই পুরোটা চোখ বুলালো৷ উচ্চ শিক্ষিত হলেও বখাটে ধাঁচের ছেলে নাতীর দিকে বিচক্ষণী দৃষ্টিতে তাকালো জোবেদা৷ সামনে এগোতে এগোতে বললো,
“পছন্দ হয়েছে ভাই?”
নিহান চোখ ঘুরিয়ে ফের দেখলো বাড়িটি৷জোবেদা হেসে নাতির উদ্দেশ্যে বললো,
“এ বাড়িতে চাঁদ আছে ভাই৷ আসমানের চাঁদ!”
বলেই সামনে এগোলো৷ সৌহার্দ্য নিবাস আজ ঝলমলে আর হৈ-হুল্লোড় ভরপুর৷
খোদেজার আজ খুশির দিন৷ তার ছোটো বোন এসেছে তার বাড়িতে৷

..

গোলাপি রঙ এর সালওয়ার কামিজ জড়িয়ে রুপার পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে ময়ূরাক্ষী৷
বাড়িতে আজ মেহমান ভরপুর বাইরে তার বেশি যাওয়া মানা৷ রুপার কক্ষে তাই রুপাকে সঙ্গ দিচ্ছে ময়ূরাক্ষী৷ নয়তো সে বসে থাকার মেয়ে নাকি?
ময়ূরাক্ষী লাজুক হলেও বেশ চটপটে ধাঁচের৷ অষ্টাদশে পা দিলেও বাচ্চামো স্বভাব যায়নি এখনো৷
চাঞ্চল্যতা ছেয়ে আছে মুখে পাশেই মৃদুলা যে কি না কিছুক্ষণ পর পরই বলছে,
“বুবু তোমারে আজ সুন্দর লাগতেছে৷”
তখনি চাঞ্চল্যতা মিহিয়ে গিয়ে লজ্জার আভা জায়গা করে নিচ্ছে মুখশ্রীতে৷ মেয়েটা আচ্ছা পাজী৷
মৃদুলা ময়ূরাক্ষীর এহেন লজ্জায় ছেয়ে যাওয়া মুখ খানা দেখে বললো,
“বুবু তোমার গাল টমেটোর মত হইয়া যাইতেছে৷ আমার কথায় ও তুমি লজ্জা পাও৷”
বলেই মুখ চেঁপে হাসছে আবার৷ মৃদুলার আর ময়ূরাক্ষীর কান্ড দেখে হেসে উঠলো রুপা৷ মেয়ে দু’টো এত্ত মিষ্টি৷ এদের ছাড়া থাকবে কি করে? এর কিছুটা দূর হাসি বসে৷ রঙচঙ মেখে মনে হচ্ছে বাগদান টা তার৷ যদিও অনুষ্ঠান রাতে তবুও এ মেয়ের সাজগোছ কমতি নেই৷

রুপা এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার খুঁজছে তার ভাইজান কে৷ সেই যে কাল রাতে খাবার টেবিলে দেখলো ভাইজান কে আর দেখা পেলো না তার৷

শাহওয়াজ এর সাথে তার কিছুদিন আগে বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো৷ শাহওয়াজ বলেছিলো বাগদান টা আপাতত সেরে রাখো বিয়ে অনার্স শেষ করে করো৷ রুপার মন এতে সায় দিলেও আগ বাড়িয়ে বাবা কে বলতে পারেনি সে৷
তার বাবা বেশ রাগী মানুষ৷ আকাশের জোড়া জুড়িতে সব তাড়াতাড়ি হচ্ছে৷ লোকটা একটু পাগল ধাঁচের একদিন হুট করেই রাস্তায় দেখা হয় তার পর থেকেই তার পিছে ঘুরঘুর করে৷ এতে রুপা সায় না দিলেও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে বাড়িতে৷
আচ্ছা শাহওয়াজ ভাইজান এর নিজের বোন হলেকি বাবার কাছে বলতো না? ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রুপা৷ র ক্ত তো তাদের এক মা ভিন্ন তাতে কি?হুট করেই মনে পরলো শাহওয়াজ তাকে একটা উপহার দিয়েছিলো শাহওয়াজ বলেছিলো আংটি বদলের দিন পরতে৷ তা নেওয়ার জন্য উঠবে তার আগেই ঘরে প্রবেশ করলো খোদেজা, জোবেদা আর রাবেয়া৷

মা কে দেখে থেমে গেলো রুপা৷ উপহার টা মায়ের ঘরেই রেখেছে৷ ওতে কি আছে রুপা জানে না তবে যাই থাকুক এ চৌধুরী বাড়ির সবচেয়ে দামি জিনিসের থেকেও দামি উপহারটা রুপার কাছে৷

রাবেয়া ঘরে ঢুকেই বললো,
“খালা এইযে আমার মেয়ে রুপা৷”
জোবেদা হাসলো, কিছু বলবে তার আগেই চোখ গেলো ময়ূরাক্ষীর দিকে৷ রাবেয়া কে পাশ কাঁ’টিয়ে গিয়ে ময়ূরাক্ষীর কাছে গিয়ে থুতনিতে ধরে খোদেজার উদ্দেশ্যে বললো,
“বুবু এইটাই ময়ূরাক্ষী না?”
খোদেজা থমথমে হয়ে মাথা ঝাকালো৷ তার মানে ‘হ্যাঁ ‘ জোবেদা তা দেখে বললো,
“বুবু এ দেখি আসমানের চাঁদ৷ এক্কেবারে মায়ের লাহান৷”
বলেই হাসলো৷ ময়ূরাক্ষী কৌতুহলী হলো চোখ গোল গোল করে শুধালো,
“আপনি কে? আপনি আমার মা কে চেনেন?”
জোবেদা হাসলো শুধু উত্তর দিলো না৷ ময়ূরাক্ষী উত্তরের আশায় বসে রইলো৷
রুপা চেনেন এ মহিলাকে৷ ছোটো বেলা দাদির সাথে গিয়েছেন অনেক বার এনাদের বাড়িতে নানু বাড়িতেও দেখেছেন এ এনাকে৷ নানী আর দাদীর বোন হন এবং তার মায়ের ছোটো খালা৷
পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন৷ জোবেদা জড়িয়ে ধরে কুয়ালে চুমু খেলেন৷
বড় বোনের বড় মেয়ে হওয়ায় রাবেয়া তাদের অনেক আদরের নিজের মেয়ের মতই৷ এবং সেই রাবেয়ারি মেয়ে রুপা আদর তো করবেই৷

জোবেদা চকচকে একটা মোটা স্বর্নের চেইন পরিয়ে দিলেন রুপার গলায়৷ চেনটা দেখে ফের স্বরণ হলো উপহারের কথা৷ রুপা এবার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“মা তোমার ঘরে ভাইজানের উপহার টা না? এনে দাও না একটু?সাবধানে রেখেছোতো?”
রুপার কথায় ভ্রু কুঁচকালেন জোবেদা৷ ভাইজান কাকে সম্বোধন করছে বোধগম্য হচ্ছে না ঠিক তখনি পেছন থেকে রাহেলা বললো,
“সৎ ভাইয়ের দেওয়া উপহারের প্রতি এত টান কেন তোর রুপা?”

রাহেলার কথায় বোধগম্য হলো জোবেদার৷ বুবু বলেছিলো বাড়িতে মধুলতার ছেলে এসেছে৷ রুপার পছন্দ হলো না চাচির কথা তার সাথে রঙ পাল্টালো ময়ূরাক্ষীর মুখেরো৷ এমন কেন চাচি? রাহেলার কথায় তার কেন খারাপ লাগলো হুট করে বুঝলো না ময়ূরাক্ষী৷
রাবেয়া যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনি জোবেদা বললো,
“সতীনের বীজ বাড়িতে উঠাইছিস রাবু? কপাল পু’ড়তে চাইতাছিস? মধুলতা ষড়’যন্ত্র কইরাই পাঠাইছে ওই মেয়ে ছেলেরে চিনিস না তুই কি ধড়িবাজ৷”
খালার কথায় ভরকালো রাবেয়া৷ খারাপ লাগলো তার৷ মধুলতা এখানে না থাকলেও তার অগোচরে তাকে নিয়ে কথা ভালো লাগে না রাবেয়ার৷ ষড়যন্ত্র কি করবে সে? যে নির্দ্বিধায় নিজের ভালোবাসা আরেক জনের কাছে সপে যায় সে খারাপ হতে পারে না৷
যে দিন মধুলতা গেলো সে দিন তাকে আঁটকে ছিলো তার স্বামী তবুও সে থাকেনি৷ আর সে এখন পাঠাবে ছেলেকে ষড়যন্ত্র করে?
বাড়িতে তার স্বামী আছে শুনলে কেলেংকারী হবে৷ ছেলে আসতে চায়নি কিভাবে যে হাত পা ধরে এসেছেন আকবর চৌধুরী তা রাবেয়া ছাড়া কেউ জানে না৷
প্রথম বার মধুলতা যখন নাকোচ করলো তখন আকবর চৌধুরী হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু রাবেয়া আবার পাঠিয়েছেন তাকে৷ খালা একই রয়ে গেলো পরিবর্তন হলো না আর৷
রাবেয়া থামলো বললো,
“মধুলতা পাঠায়নি খালা আমরাই আনিয়েছি শাহওয়াজ কে৷ ও আসতে চায়নি৷”
বলে রাবেয়া আর দাঁড়ালো না৷ রুপার মন ও ক্ষুন্ন হলো৷ ক্ষুন্ন হলো আড়ালে আবডালে আরো একট মন৷

দরজার সামনে আসতেই আকস্মিক কারো মুখোমুখি হলো শাহওয়াজ৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারায় আছে৷ ঘামে জুবুথুবু হয়ে আছে শরীর৷ হুট করে রাবেয়াকে দেখে থেমে গেলো রাবেয়া ক্ষানিকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো শুনেছে কি না৷ পরক্ষণেই মুখ দেখে মনে হলো সবেই এসেছে৷

রাবেয়া সংকুচিত কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
“কিছু লাগবে আব্বা?”
শাহওয়াজ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো৷ কেন যেন এ মহিকার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না তার৷ জড়তা নিয়ে শুধালো,
“রুপা কোথায়?”
রাবেয়া বললো,
“ভেতরেই আছে যাও৷”
শাহওয়াজ ভেতরে ঢুকলো রাবেয়া গেলো নিজের কক্ষের দিকে৷ শাহওয়াজ এর সাথে খোদেজা জোবেদাকে পরিচয় করিয়ে দিলো৷ মহিলা এত বহুরূপী আচরণ দেখে মনে হলো কতইনা পছন্দ করে শাহওয়াজ কে৷

শাহওয়াজ তপ্ত শ্বাস টানলো রুপার দিকে তাকালো৷ মেয়েটা তাকে অনেক শ্রদ্ধা করে আর ভালোবাসে মেয়েটা হয়তো মন খারাপ করবে? শাহওয়াজ মিনমিনিয়ে বললো,
“আমার আজ রাতেই একটা অপারেশন আছে৷আমি একটু পর ঢাকা রওনা হবো৷ না গেলে হবেই না হুট করেই রোগী অসুস্থ হয়ে পরেছে যেতেই হবে৷ আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো৷ রেজওয়ান এখানেই আছে আমি আসা অব্দি৷ ”

শোনা মাত্র রুপার মন ক্ষুন্ন হলো৷ আঁখি ছলছল করে উঠলো৷ কিন্তু আটকাবে কি করে? তআর বিশেষ দিনে তার ভাইজান থাকবে না৷ ভাবলো রুপা ভাইজান কি রুপাকে বিশেষ ভাবে না? পরক্ষনেই নিজের মন কে ধমকালো৷ কি ভাবছে এসব? সে তো বললো জরুরি৷ ডাক্তার মানুষ তার ভাইজান৷
তবুও শুধালো,
“আপনি রাতে থাকবেন না ভাইজান?”
শাহওয়াজ এর মন গললো মেয়েটা এত্ত মিষ্টি৷ ঠিক মায়ের মত! মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কাল সকালে চলে আসবো আমি৷ তোমার বাগদানের জন্য আসা হলেও হসপিটালের কাজ শুরু করবো এ গ্রামে আছি কিছুদিন৷ বাগদানে না থাকি তোমার বিয়েতে থাকবো প্রমিজ৷ কাল এসে তোমায় ঘুরতে নিয়ে যাবো সাথে নাহয় আকাশ কে ও নিয়ে নিবো৷”
আকাশের কথা শুনে লজ্জা পেলো রুপা৷ ইশ কি যে বলে ভাইজান৷ জড়িয়ে ধরলো রুপা শাহওয়াজ কে৷ শাহওয়াজ প্রথম একটু অবাক হলেও নিজেও মাথায় হাত রাখে রুপার৷

“ময়ূর আমায় এক কাপ চা দে তো৷”
রেহানের কথায় ধ্যান ভ’ঙ্গ হলো শাহওয়াজ এর৷ ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়ালো৷ বাড়িতে এত্ত এত্ত কাজের লোক সমানে কাজ করছে কিন্তু এই ছেলে ময়ূরাক্ষীর কাছেই চা চায় ব্যাপারটা খেয়াল করেছে শাহওয়াজ৷ সে দিন বলতেও শুনেছে রুপাকে রেহানের নাকি ময়ূরাক্ষীর হাতের চা ছাড়া হয় না৷
রাগ হলো তার, নিজের এহেন কান্ডে অবাক লাগে শাহওয়াজ এর৷ এ স্বভাব তো লক্ষ করেনি আগে৷ শাহওয়াজ প্রস্থান করলো এখান থেকে৷

চলবে,

[নোট:১৩৫০ শব্দ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here