ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা দশ

0
152

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

দশ

ময়ূরাক্ষী যখন পরে গেলো মৃদুলা দিশা না পেয়ে নিজেই ঝাপ দিতে গেলো৷ তার ময়ূরবুকে বাঁচাতে হবে৷ ময়ূরাক্ষী বাঁচার জন্য তখনো হাসফাস করছিলো৷ পা যেন তার নিচের দিকে টানছে শুধু চেয়েও টাল সামলাতে পারছিলো না৷ হাসি ঝাপটে ধরে আঁটকায় তখন মৃদুলাকে৷ বলে,
“কি করছিস কি?পাগল হলি?”
মৃদুলা ছিঁটকে সরায় হাসির হার৷ মৃদুলা তখন দৌড় দেয় বাড়ির দিকে কাউকে ডাকার জন্য৷ শাহওয়াজ আর রেহান তখন জমি দেখে ফিরছিলো৷ মৃদুলাকে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসতে দেখে রেহান উৎকন্ঠা হয়ে জিগ্যেস করে,
“কাঁদছিস কেন মৃদু কি হয়েছে বল?”
শাহওয়াজ, রেহান কে দেখে মৃদুলার কান্নার বেগ যেন বেড়ে যায় আরো৷ হিঁচকি তুলে কান্না করতে করতে বলে,
“আমার বুবুরে বাঁচান ভাইজান৷”

শাহওয়াজ বুঝতে পারেনা কিছু৷ মেয়েটা কি বলছে বোঝাও যাচ্ছেনা৷ কান্নায় কথা গুলো জড়িয়ে আসছে৷ শাহওয়াজ ক্ষানিকটা নিচু হয়ে জিগ্যেস করে,
“কি হয়েছে মৃদুলা?এমন কেনো করছো? কেউ কিছু বলেছে?”
মৃদুলা অসম্ভব ভালোবাসে ময়ূরাক্ষীকে, কান্নার বেগ এতটাই ছিলো মুখ দিয়ে সে কিছু বলতে পারছিলো না শুধু পুকুরের দিকে ইশারা করে বলছিলো,
“ময়ূরবুকে বাঁচান ভাইজান, ওখানে….”

আর কিছু বলতে হলো না শাহওয়াজ এর কি যেন কি ভেবে ছুট লাগালো৷ পুকুরের কাছে এসে ধাপাধাপির শব্দে যা বোঝার বুঝে গেছে৷ সে ও ঝাপ দিলো পুকুরে, ময়ূরাক্ষী তখন খেই হারিয়ে ফেলেছে৷ মেয়েটার চোখ নিভু নিভু শরীরের শক্তি বোধহয় হারিয়েছে৷ শাহওয়াজ কোনো মত সাতরে গিয়ে হাত ধরলো৷ পানিতে এতটাই ভারী হয়ে গেছে হাত ফসকে গিয়েছে দু-বার৷
শাহওয়াজ কোনো রকম নিজের সাথে মিশিয়ে ধাতস্থ কন্ঠে বলে,
“চোখ বন্ধ করবেন না ময়ূরাক্ষী৷ চোখ বন্ধ করবেন না৷ ”
ময়ূরাক্ষী তখন ঝাপসা চোখে তাকিয়ে৷ সামনের মানুষ টির কথা কর্ণপাত হলেও যেন মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না৷ চোখের সামনে সব কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে৷ শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তিও নেই৷ শরীর যেন সব ভর ছেড়ে দিয়েছে শ্বাস প্রশ্বাস বুঝি এই এতি টানবে বলে৷
নিশ্বাস থেমে থেমে আসছে চেয়েও আঁখিদ্বয় খোলা রাখতে পারছে না৷ এত অবাদ্ধ কেন সব?

শাহওয়াজ এর হাত ফের ফসকায়, অতলে ডুবে যেতে থাকে যেন ময়ূরাক্ষী তখন ঝাপ দেয় রেহান৷ রেহান আসার আগেই শাহওয়াজ আগলে নেয় বক্ষে৷ মাথাটা তার বুকে চেপে ধরে গালে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে দিতে বলে,
“জোরে জোরে নিশ্বাস নিন ময়ূরাক্ষী৷ চোখ বন্ধ করবেন না৷ ”
কিন্তু মেয়েটি শুনলো না৷ এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে৷ বাড়ির লোক এসে পৌঁছেছে এতক্ষণে চেচামেচি শুনে৷আশেপাশের লোকজন ও এসেছে৷
শাহওয়াজ সকলের সামনেই সাংঘাতিক এক কান্ড ঘটালো পআনিতে থাকা অবস্থাতেই ঠোঁটে ঠোঁট বসালো৷
অক্সিজেন প্রয়োগ করার চেষ্টা চালালো কিন্তু ফলাফল শূন্য৷ শাহওয়াজ এর অন্য দিকে খেয়াল নেই৷ কে কি বললো দেখার বিষয় না, মানুষ টিকে বাঁচতে হবে তার৷ বাতাস ফুসফুস অব্দি পৌঁছাচ্ছে না৷ তারমানে শ্বাসনালী ও ফুসফুস সম্পূর্ণ পানিতে ভর্তি৷

শাহওয়াজ ময়ূরাক্ষীকে নিয়েই ঘাটের কাছে আসে৷ কোনো রকম উঠিয়ে ওপরে ওঠে৷ পানির কারণে ভারী হয়ে আছে ময়ূরাক্ষীর শরীর৷ এভাবে শ্বাস বন্ধ অবস্থায় পাঁচ মিনিট থাকলে জীবন ঝুঁকি রয়েছে৷
ঘাটটা এত্ত পিচ্ছিল দু-বার পা ফসকেছে শাহওয়াজ এর৷ নেহাৎ রেহান ছিলো পিছনে নয়তো ফের একটা দূর্ঘটনা ঘটতো৷

বার বার নিজের হাতঘড়ি পরখ করছে শাহওয়াজ৷ উপরে তুলে উপুড় করে শুইয়ে দিলো৷ তারপর পেট ধরে উচু করলো যেন মাথা এবং বুক নিচের দিকে থাকে৷ কাজ গুলো করার সময় খেয়াল করলো বক্ষখানা ধুকধুক করছে৷
রুপা এসে বার বার ডাকছে৷ সবার দৃষ্টিতে তখন বিস্ময় এর ছাপ৷ শাহওয়াজ এবার ময়ূরাক্ষীর পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিচ্ছে৷ যেন পাকস্থলী, শ্বাসনালী ও ফুসফুসের পানি বের হয়ে আসে৷ কাজ গুলো তাড়াতাড়ি করতে হবে নয়তো কেলেংকারী হবে৷ চাপড় দেওয়া অবস্থাতেই বললো শাহওয়াজ,
“আশেপাশে কোনো ফার্মেসি আছে যেখানে অক্সিজেন রয়েছে?বা বাড়িতে কোনো অক্সিজেনের ব্যাবস্থা আছে?”
রেহান না ভেবেই তৎক্ষনাৎ বললো,
“নানি জানের ঘরে আছে মনে হয়, নানিজানের অসুস্থর সময় আনা হইছিলো৷ ওরে বাড়ি নিয়ে আসেন আমি ব্যাবস্থা করছি৷”
ফুসফুস, পাকস্থলী থেকে পানি বের করে আনতে সক্ষম কিন্তু এখন কৃত্রিম অক্সিজেন দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস সচল না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না৷ জ্ঞান না ফেরা অব্দি স্বস্তি নেই৷

খোদেজা বেগমের জন্য অক্সিজেন আনা হয়েছিলো সে অক্সিজেনটাই বের করলো রেহান৷ বুক কাঁপছে তার৷ শাহওয়াজ এনে নিচেই একটা রুমে রাখলো ময়ূরাক্ষীকে৷ রুপা মেয়েটা কাঁদছে বার বার বলছে,
“ভাইজান তুমিতো ডাক্তার, তুমি ওকে ভালো করে দাও৷”
অভিভূত না হয়ে পারেনা শাহওয়াজ৷ কি এক হুলোস্থীর কান্ড সব কিছু এত তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে কি থেকে কি হলো কিছুই জিগ্যেস করার সময় পায়নি৷ রেহান অক্সিজেন এনে দিলো শাহওয়াজ ঠিকঠাক করলো সব এর মাঝেই রুপার কাছে এসে বললো,
“এক মিনিটের মাঝে ওর জামা টা পালটে দিতে পারবে? তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয় নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে৷ ”

রুপা যেতে নিয়েও থেমে যায় বলে,
“ভাইজান ও ভালো হয়ে যাবে তো৷”
শাহওয়াজ নিরাশ কন্ঠে বলে,
“জ্ঞান না ফেরা অব্দি কিছু বলতে পারছিনা৷”
রুপা অশ্রুসিক্ত চোখেই গেলো ময়ূরাক্ষীর জামা পাল্টাতে৷ সবাই তখনো শাহওয়াজ এর দিকে তাকানো৷ যদিও আকবর চৌধুরী ছিলো না এতক্ষণ এখন এসেছে৷ কিছুক্ষণ আগের করা ঘটনা ভাবতেই আকবর চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে৷ একবার সবার দিকে তাকিয়ে তারপর আকবর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমি যা করেছি একজন ডাক্তার হিসেবে করেছি৷ এ নিয়ে কেউ ওই মেয়েকে বা আমাকে কেউ কটুক্তি করলে আমি বরদাস্ত করবো না সবাইকে বলে দিবেন৷ আমি একজন ডাক্তার রোগীর ভালো হবে তাতে আমার যা করতে হয় আমি করবো৷”
সবাই সব টা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও৷ রাহেলা আর খোদেজা নেয়নি৷
আশেপাশের অনেকেও কানাঘুঁষা করছে৷ আকবর চৌধুরী স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“তুমি কি করেছো আমি জানি না৷ তবে খারাপ যে কিছু করোনি আমি জানি তুমি নিশ্চিন্তায় থাকো কারো সে সাহস নেই আকবর চৌধুরীর ছেলেকে কটু কথা বলবে৷”
আকবর চৌধুরীর এহেন কথায় যেন একটু কানাঘুঁষা কমলো৷

অনেক্ষণ অক্সিজেন চলায় শ্বাস প্রশ্বাস ক্ষানিকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে৷ অক্সিজেন মাক্স এখনো লাগানোই৷ রুপা হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিয়েছে৷ শাহওয়াজ নাড়ি পরিক্ষা করলো৷ পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়েছে৷ যেন হাফ ছাড়লো৷ বুক থেকে বোঝা নামলো সবার৷

,,

একটা মানুষের জীবনে মাতৃ ছায়া হচ্ছে সব চাইতে নিরাপদ স্থান৷ মায়ের বিকল্প যেন কেউ থাকে না, সব কষ্টের অবসান যেন মায়ের বক্ষে৷ কিন্তু যারা মায়ের আদল, ঘ্রাণ, মমত্ব কিছুই জানেন না তাদের?
মায়ের ঘ্রাণ কেমন হয় জানেন না ময়ূরাক্ষী৷ মা কেমন দেখতে ছিলো তাও জানেন না৷ মমত্ব ও জানেন না৷ তবে সৃষ্টি কর্তা কিছুনা কিছু দিয়ে টান অনুভব করায়৷ মাঝে মাঝে আকাশ তুল্য তৃপ্তি পায় ভাবে এমনই কি মায়ের মমতা?

রুপার বুকে গুটিশুটি মেরে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ময়ূরাক্ষী৷ দৃষ্টি তার স্থীর, যেন মরণ দেখলো কিছুক্ষণ আগে নিজের চোখে নিজের৷ নিজের প্রতি নিজের মায়াটা কত্ত প্রগাঢ় তাও দেখলো সে৷ আহারে জীবন এক মিনিটেরো ভরসা নেই৷ এ ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে আমাদের কত্ত মায়া৷
মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে তার, রাবেয়া গরম দুধ এনে দিয়েছে তাকে৷ ময়ূরাক্ষী নতুন জীবন পেলো৷ যেন নতুন করে জন্ম হলো তার৷ সৃষ্টি কর্তা যেন এ মায়ার ধরণীতে আরেকবার বাঁচার সুযোগ দিলো৷ এবং আপন মানুষ চেনালো৷
যার বুকে নির্ভয়ে লেপ্টে আছে সে মানুষ টা সব সময় মায়ের মতই যেন আগলে রেখেছে৷ তার কষ্টে কষ্ট পেয়েছে৷ মন খারাপ, কষ্টে মায়ায় জড়িয়ে রাখা মানুষ৷ এ মানুষ টি যখন পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে মনে হয় এর থেকে শান্তি কিছু নেই৷ মানুষ টি যখন বুকে আগলে নেয় মনে হয় এর থেকে নিরাপদ স্থান দুটি নেই৷
লোকে বলে কেউ স্বার্থহীন কারো জন্য কিছু করেন না৷ অথচ এ মানুষ টি নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে ভালোবাসে৷ ঢাল হয়ে পাশে থাকে৷
মায়ের ঘ্রাণ না জানলেও মা কেমন হয় কিঞ্চিৎ হলেও বুঝতে পারে এ মানুষটি কে দেখে৷

মৃদুলা বসে পায়ের কাছেই৷ মেয়েটা কিছুক্ষণ পর পর হিঁচকি তুলছে৷ এইটুকুনি পুঁচকি মেয়েও তাকে কত্ত ভালোবাসে৷ আশেপাশে তাকিয়ে আরেক জন কে খুঁজলো ময়ূরাক্ষী৷ পেলো না সেই কাঙ্ক্ষিত মুখ৷ লোকটা কোথায়?

হাসি বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দুরই৷ যেন হয়নি কিছুই৷ বরং রাগে তার শরীর রি রি করছে কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতেই৷ শাহওয়াজ কেমন বিচলিত ছিলো সে দেখেছে৷ এই মেয়েটা রুপে শাহওয়াজ কে ও গলিয়ে দিলো৷ ম’রলে যেন শান্তি পেতো ম’রলো না কেন এই অপয়া?
“হাসিবুর জন্য এমন হইছে৷ ”
মৃদুলার কন্ঠে ধ্যান ভা’ঙে হাসির৷ পিলে চমকে উঠে ভয়ার্ত চোখে তাকায় মৃদুলার দিকে৷ মৃদুলাকে চোখ রাঙায় হাসি৷
এ মেয়ে না জানি সব বলে দেয় তাহলেতো রক্ষে নেই৷
মৃদুলা ফের বলে,
“হাসিবু জানে ময়ূরবু সাতার জানে না তাও…. ”
এইটুকু বলতেই থামিয়ে দিলো রাহেলা৷ তটস্থ গলায় বললো,
“কি বলছিস কি এসব?”
মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই হাসি বললো,
“দিবো টেনে এক চড়৷ ও যে পেয়ারা ধুইতে গিয়ে এমন হইছে তা বলিস না কেন? আমি কি বলেছি নাকি এসব? আমি ওরে না করেছি আরো৷ ”
হাসির কথা শেষ হতে দেরি হলেও শাহওয়াজ এর ধমক দিতে দেরি হয়নি৷ সে গিয়েছিলো ভিজে জামা কাপড় পাল্টাতে এসে এসব দেখলো৷
কঠিন কন্ঠে বললো,
“এটা একটা রোগীর ঘর রঙ্গশালা না৷ এখান থেকে গিয়ে চেচামেচি করো৷ খালি করো ঘর রেস্ট নিতে দাও ওকে৷”

চলবে,

[নোট:১৩০১ শব্দ]

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/6YV8VUWdXK75b57Y/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here