#হিয়ার_মাঝে ৬২.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
সময় যেন ছুটে চলা মরীচিকার মত। দিগন্তের শেষে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া এক আবির মাখা ক্লান্ত লগ্ন। এই আসে তো, এই ছুটে যায়। সেই সময় পরিক্রমায় সপ্তাহ পেরিয়েছে জিমান তমার বিয়েরও। বেশ কিছুদিন ভার্সিটি যাওয়া হয়নি নুবাহর। দীর্ঘ ব্যস্ততা শেষে আজ ভার্সিটিতে পা রেখেছে। তমা আসবে বলেছে তাকে। তার সাথে দেখা করার জন্যই বিজ্ঞান ভবনের সামনে দাঁড়াল। কারও রগড় গলা পেয়ে চকিতে তাকাল তৎক্ষণাৎ। জাকী নীলচে বর্ণের হাফ হাতার গেঞ্জি পরিহিত। দু’হাত বগলদাবা করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখমুখে উচ্ছ্বাস কিন্তু চাউনি কেমন যেন অদ্ভুত। নুবাহ একপলক তাকাতেই তার শরীর কেমন রি রি করে উঠল। হুটহাট কোত্থেকে আসে এই জাকী। কেমন করে আজকাল তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সে কিছু না বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। জাকী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
‘কি ব্যাপার নিশাত, আজকাল ভার্সিটি আসো না, তোমায় খুঁজেও পাই না। কোনো সমস্যা নাকি?’
নুবাহর দৃষ্টি নিচের দিকে। জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। জাকী অপমানবোধ করল। কিন্তু হাল ছাড়ল না। ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘বিরক্ত হচ্ছো নাকি? ছোট্ট একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিচ্ছো না যে।’
‘তেমন কিছু না, আসলে আমার বান্ধুবীর জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘এটা কি সেই বান্ধুবী, যার জন্য আমাকে খোঁজ করেছিলে?’
‘নাহ।’
‘তাহলে তোমার সেই বান্ধুবী কোথায়?’
‘নেই।’
‘নেই মানে?’
‘মরে গেছে।’
জাকী ভ্যাবাচ্যাকা খেল। এটা কেমন কথা। সে কথা ঘুরাতে চাইল। ফের প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখল নুবাহ দ্রুত কদমে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে ডাকল, ‘নিশাত, উত্তর দিয়ে যাও।’
কিন্তু জবাব এল না তার। ফের একবার অপমানিত হতে হল তাকে। সে চুপচাপ হলেও মস্তিষ্ক চুপ নেই, রক্তক্ষরণ হতে লাগল সেখানে। এই বদলা সে নেবেই। এত বড় স্পর্ধা এই মেয়ের! দেখেই ছাড়বে।
ক্লাসে এসে হাঁপাতে লাগল নুবাহ। জান নিয়ে বেঁচে এল মাত্রই। জাকীকে দেখলে তার কেমন ভয় লাগে। সেই দিনের স্মৃতি সে আজও ভুলেনি, আর না ভুলতে পারবে। এককোণের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। তার কিছুসময় বাদেই তাসনিয়ার আগমন ঘটল ক্লাসে। নুবাহকে দেখে মুচকি হাসল। তার পাশে বসে বলল,
‘নিশাত তুই না আসলে আমারও ক্লাস করতে ভালো লাগে না। তাই আমিও কয়েকদিন গ্যাপ দিয়েছি।’
নুবাহ চিন্তিত হল। এখন এত পড়া কার থেকে নেবে। তার উপর ল্যাব পরীক্ষা আছে তাদের। হাপিত্যেশ করল নিজমনে। তখনি হুট করে তার মাথায় টোকা পড়ল। চোখ তুলে তাকাতে দেখল নিরব দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠল,
‘কি ব্যাপার! মাথায় টোকাস কি জন্য?’
কালো ফ্রেমের আদলে দু’চোখ আবৃত তার। ঠোঁটের কোণে বেশ চওড়া হাসি। সাদা শার্ট পরিহিত নিরব বেঞ্চিতে বসতে বসতে জবাব দিল নুবাহর, ‘এতদিন আসোনি কেন? তোমাকে অনেক মিস করেছি আমি। তোমার মোবাইল নাম্বারও নেই কল করব যে। বাড়িতে কোনো সমস্যা ছিল নিশাত?’
নুবাহ না বলে মাথা নাড়ালো। মুখে হাই তুলতে তুলতে নিজের জবাব দিল, ‘বিয়ে ছিল।
দৈবাৎ নিরব প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘কার?’
‘বান্ধুবীর।’
নিরব স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল দ্রুতই। যাক বাবা নিশাতের বিয়ে নয়, না হলে এতক্ষনে সে কোমায় চলে যেত।
___
দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর সোনিয়াকে বাসায় নিয়ে আসা হল। চিন্ময় মায়ের পাশে সার্বক্ষণিক বসে থাকে। আজকাল মায়ের মুখ দেখে আৎকে উঠে। ভয় আর অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরেছে। তার মায়ের সুগার লো, কিডনি সমস্যা ধরা পড়েছে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছে ডাক্তার। কিডনি ঝুঁকিতে আছে এখন। এতসব দুঃচিন্তার মাঝেও নতুন চিন্তা আবার কুমুদকে নিয়ে। পারিবারিকভাবে তাদের দু’জনের বিয়ে’টা করে রাখতে চাইছে তার মামা। সে যেন অকূল পাথারে পড়েছে। মামাকে না বলার মত হিম্মত নেই, আবার হ্যাঁ বলার মত মনের জোরও নেই। কি হবে সেটাও জানা নেই, তবে এই মেয়েকে সে স্ত্রী রূপে একদমই গ্রহণ করতে পারবে না। দেখলেই কেমন গা রি রি করে। একজন মেয়ে হতে হয় নরম স্বভাবের। তার কথা হবে শ্রুতিমধুর, চালচলন হবে ধীরগতি, হাসিতে থাকবে মাধুর্য। অথচ এই মেয়ে তার উল্টো স্বভাবের। কথা বললে মনে হয় বাজখাঁই, হাসলে বজ্রপাত, আর চলাফেরায় মনে হয় কোনো নারীরূপে পুরুষ। দেখতেই হাফ লেডিস লাগে। ভক্তিই আসে না, আবার বিয়ে! এর থেকে পিচ্চি মেয়েটা শতভাগ ঠিক আছে।
চিন্ময় মায়ের মুখে খাবার তুলে খাওয়াচ্ছে। বেশ শুকিয়ে গেছে তার মা। কালচে দাগ হয়ে দু’চোখ কোটরে ধেবে গেছে। হাসিমাখা মুখটা নেই আগের মত, চোখমুখ কেমন জীর্ণশীর্ণ। ফোৎ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। আচমকাই রুমের মাঝে কুমুদের আগমল হল। বাঁজখাই গলায় বলে উঠল,
‘আমাকে দেন, আমি ফুফুকে খাওয়াই দিই।’
চিন্ময় বোঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা তাকে আদেশ করছে নাকি অনুরোধ। কারণ মেয়েটা কথা বললেই বাঁজখাই আওয়াজ হয়। শুনলেই আৎকে উঠে সে। হুট করে তার রাগ থরথর করে বাড়ল। এত আদিখ্যেতা জানে মেয়েটা, একদম তার মামীর মত। উঁচুশব্দ করে বলল,
‘না লাগবে না। আমি খাওয়াচ্ছি।
‘আমি খাওয়ালে কি সমস্যা?’
‘বললাম তো লাগবে না, তুই যা তো এখান থেকে।’
‘চিন্ময় কুমুদকে খাওয়াতে দেয়। আজ নয় শুধু, এবার থেকে কুমুদই ওর ফুফুকে খাওয়াবে।’
দরজার চৌকাঠ থেকে সহসাই শাহাদাৎ কঠোর আদেশ ছুঁড়লেন চিন্ময়ের উদ্দেশ্য।
চিন্ময় নিজমনে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল। এই জন্যই এই মেয়ের এত তাড়া আজকে। নয়তো অন্যসময় খোঁজই নেয় না তার মায়ের। হাতের বাটিটা কুমুদের হাতে তুলে নিল। সেও দেখতে চাইল কুমুদ এবার কি করে। কিভাবে খাওয়ায়? কুমুদ বাটি হাতে বসেছে ফুফুর পাশে। এক চামচ স্যুপ ফুফুর মুখের সামনে ধরল। সোনিয়া হা করল না। কেমন মুখ কুঁচকে আছে উল্টো। কুমুদ বিরক্ত হল নিজমনে। এই মহিলা কত ডং করে। হা করে খেয়ে নিতে পারে সব, তা না। অসহ্য লাগছে তার। শুধু নিজের বাপের ভয়ে বসেছে খাওয়াতে। নয়তো এই মহিলাকে তার একদমই সহ্য হয় না।
চিন্ময় উঠে এল মায়ের পাশ থেকে। জানালার দ্বার ঘেঁষে দুই হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়েছে। তবে দৃষ্টি তার কুমুদের দিকে। শুভ্রবর্ণা গায়ে ধূসর রঙের জামা, ওড়না বুকের দুপাশে ঝুলানো। তাও শরীরের ভাঁজ স্পষ্টত। কিন্তু তার সেই দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাকে দেখলে তার পুরুষত্ব নাড়া দেয় না, উল্টো বমি আসে।
__
আজকাল অহেতুক কান্না পায় তার। সামান্য কিছুতে আবার রেগেও যায় নয়তো অল্পতেই মনটা বিষন্নতায় ভোগে। অদ্ভুত কি সব চিন্তারা ঘুরে বেড়ায় তার মাথার মধ্যে। যানবাহন দ্রুত চললে আচমকাই ভীষণ ভয় করে। কি সব ভাবে তখন নিজমনে। সত্যি কি সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে হৃদির। স্কুলের বিরতি পড়েছে এখন। কমনরুমে বসেছে অথচ মন তার কোন এক নাম না জানা শহরে। বড্ড আকুপাকু করছে মন। ইচ্ছে করছে সোনিয়া আন্টিকে দেখতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু চিন্ময়ের অবজ্ঞা তার মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছে। তার উপর সেইদিন হাসপাতালে গিয়ে এমন একটা খবর শুনেছে, তা না শুনলেই হয়তো ভালো হত তার জন্য। সোনিয়া আন্টি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলে চিন্ময়ের বিয়ে মামাতো বোনের সাথে। সেইদিন থেকে নিজেকে বড্ড উন্মাদ লাগছে হৃদির। এতটা কষ্ট লাগছে, কাউকে বুঝানোর ক্ষমতা তার নেই। চিন্ময় তাকে কখনো ভালোবাসেনি সে জানে। তাও কেনো ঐ লোকটাকে মনে পড়ে জানা নেই। নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু পারছে কই?
ক্লাস থেকে রিক্তবদনে বাসায় ফিরছে সে। আচমকাই কেউ একজন তাকে পেছন থেকে ডাকল।
‘এই পিচ্চি, দাঁড়াও।’
হৃদি চকিতে তাকাতেই চিন্ময়কে দেখে আৎকে উঠল। হুট করে মাঝ রাস্তায় কোত্থেকে আসল এই লোক। একপলক দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল। একদমই তাকাবে না সে। পায়ের জোর বাড়িয়ে সামনের দিকে আগালো। পেছন থেকে দ্রুতই এগিয়ে এল চিন্ময়। হুট করে নিজের দুহাত দু’দিকে প্রসারিত করে বলে উঠল,
‘দেখতে তো ক্ষুদ্র মশা একটা। আমার কাঁধ সমানও হবে না। ওজন কত হবে তোমার চল্লিশ বিয়াল্লিশ হয়তো। জানও এক হাত দিয়ে তোমাকে উঠিয়ে পিষিয়ে দিতে পারব। কিন্তু তোমার এত অহংকার কোত্থেকে আসে পিচ্চি মেয়ে? ডাকছি শুনতে পাওয়া না। জিমানের হলুদের রাত থেকেই তুমি আমাকে দেখলে এড়িয়ে যাচ্ছো। আগে তো লেজ নাড়িয়ে আমার পেছন পেছন ঘুরতে। এখন তোমার কি হলো হঠাৎ করে।’
হৃদি যেনো শুকনো মাটিতে আছাড় খেল। এগুলো কেমন ধরনের কথা। গলার স্বর কঠিন করে জবাব দিল,
‘আমার ইচ্ছে, আমার খুশি। তাই আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছি? আপনার কোনো সমস্যা?’
‘আমার সমস্যা হতে যাবে? তবে এড়িয়ে যাবে কেন আমাকে? দরকার হলে আমি তোমাকে এড়িয়ে যাবো, কিন্তু তুমি না, বুঝলে পিচ্চি।’
কথাগুলো বলেই চিন্ময় হনহনিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্য। হৃদি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি ছিল তার সাথে। কেমন খারাপ লোক। তাকে হেয় করে গেল। গজগজ করল নিজমনে।
চলবে,,,,,,,