#আশার_হাত_বাড়ায়|৩৬|
#ইশরাত_জাহান
🦋
শ্রেয়ার দোকানে আজ অনেক কাজ। রিমলিও আজ কলেজে যায়নি।সৃষ্টি বেগম বাসার রান্না করে চলে আসেন দোকানে।আজ এক ছোট মেয়ে প্রায় মিমির বয়সী তার জন্মদিন।মিমির ক্লাসফ্রেন্ড হয়।জন্মদিন পালন করতে চায় এই দোকানে।চারপাশ সাজাতে ব্যস্ত অর্পা ও রিমলি মিলে।শ্রেয়া কেক বানাচ্ছে।সবকিছু রেডি করে একটু বসতেই ওখানে সৃষ্টি বেগম আসলেন।শ্রেয়ার উদ্দেশে বলেন,”বাসায় যা।তোর বিছানার উপর একটি জামা রেখেছি ওটা পরে মাথায় হিজাব সুন্দর করে বাঁধবি।”
“আমি কেনো আবার নতুন জামা পড়তে যাবো আম্মু?”
“ছেলে পক্ষ বিয়ের ডেট দিয়েছে।তোর যখন এতই তাড়াহুড়া তাই তারা দুইদিন পর বিয়ের ডেট দিয়েছে।আজ ছেলের দুঃসম্পর্কের ফুফু আসবে।সবাই তোকে দেখলেও ফুফু এখনও তোকে দেখেনি।তোর শ্বশুরের চাচাতো বোন।অনাথ ছিলেন তাই তোর শ্বশুরের বাড়িতেই থাকতো।বড় শখ করে তোকে দেখতে চায়।এটাতে অন্তত না করিস না।ছেলে তো তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে ছেলের পরিবারও রাজি।শুধু ফুফু বাইরে থাকে বলে আজ দেখা করতে চায়।”
“আচ্ছা,আমি যাচ্ছি।”
শ্রেয়া রেডি হতে গেলে রিমলি ও অর্পা পিছন পিছন চলে যায়।ওদেরকে দেখে শ্রেয়া বলে,”তোরা এখানে কেনো?”
“তোকে সাজাতে।”(অর্পা)
“আজ আমার বিয়ে না।যতটুকু সাজার দরকার আমি নিজেই সাজতে পারি।”
“তোকে এত কথা কে বলতে বলেছে। শোন শ্রেয়া তোর আগের বিয়েতে আমরা কেউই তেমন আনন্দ করতে পারিনি।এবার আনন্দ করতে চাই।”
শ্রেয়ার মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে।কোথায় একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করতে হচ্ছে আর এরা তাকে সাজাতে চায়। নাক ফুলিয়ে উঠছে।কিন্তু কান্না করা যাবে না তাই চুপ আছে।রিমলি আর অর্পা মিলে সাজিয়ে দিচ্ছে শ্রেয়াকে।চোখের পাতায় মোটা করে কাজল ঠোঁটে হালকা গোলাপি রংয়ের লিপস্টিক আর মুখে একটু পাউডার দিয়ে সাজানো শেষ করলো।এর উপর দিয়ে রিমলি হিজাব বেধে দেয়।রিমলি ইউটিউবে দেখে বিভিন্ন ভাবে হিজাব বাধা শিখেছে।শ্রেয়াকে এখন অনেক সুন্দর করে বেঁধে দিল।ওড়না এক কোনায় দিয়ে হাতে কিছু চুরি পরিয়ে দিল সাথে আঙুলে একটি আংটি।শ্রেয়া চোখ ছোটছোট করে দেখছে।কিছু বলছে না।সাজ শেষ করে ওরা চলে গেলো দোকানের দিকে।দোকানে আসতেই অবাক হয় শ্রেয়া।ফারাজ এখানে আছে।মুখটা ঘুরিয়ে সবার আড়ালে একটা ভেংচি কাটলো।আজ সকালেই রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়েছে।চাকরি হয়তো এতক্ষণে বাই বাই টাটা।সৃষ্টি বেগমের কাছে আসতেই সৃষ্টি বেগম শ্রেয়াকে কাছে টেনে একটি মহিলার সামনে দাড় করায়।বলেন,”আমার মেয়ে শ্রেয়া।যার সাথে আপনাদের পরিবারের মধ্যে কথা চলছে।”
ছেলের ফুফু মানে ফারাজের ফুফু শ্রেয়াকে দেখে শ্রেয়ার হাত ধরে নিজের কাছে আনেন।বয়স্ক মহিলা চোখে কম দেখেন।ফারহান চৌধুরীর থেকেও বয়সে বড় তিনি।শ্রেয়ার মাথায় হিজাব মুখে বেশি মেকআপ করেনি দেখে ভালো লাগলো তার কাছে।শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,”মাশাআল্লাহ।মেয়ে অনেক সুন্দর।আমাদের ছেলের সাথে খুব ভালোভাবেই মানাবে।”
সৃষ্টি বেগম খুশি হলেন।বাসার সবাই রাজি এতেই অনেক।তবে জিনিয়া অমত আছে এখনও। ফারহান চৌধুরী ও ফারাজের আশ্বস্ত পেয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন সৃষ্টি বেগম।বার্থডে গার্ল চলে এসেছে।মেয়েটির পাশে মিমি এসে দাড়ালো।আরও কিছু বাচ্চা আছে সেখানে।মিমি সহ বাকি বাচ্চাদের নিয়ে কেক কেটে একসাথে খেতে থাকে।মিমির স্কুলের প্রিন্সিপাল এসেছিলেন।কেক খেয়ে প্রশংসা করতে থাকেন শ্রেয়ার।হাসি মুখে বলেই দেন,”সত্যি বলতে নতুন পেস্ট্রি হাউজ তাও আবার টিনের ঘরে দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিলো।ভেবেছিলাম কেমন না কেমন হবে।তবে নতুন হিসেবে ভালোই আছে।শুধু ভালো না অনেক ভালো খেতে।আপনি উন্নতি করতে পারবেন এই পেস্ট্রি হাউজ দিয়ে।”
“ধন্যবাদ আপনাকে।”
“আপনি চাইলে আপনার কেক আমাদের স্কুলে রেগুলার ডেলিভারি দিতে পারেন।আমাদের ক্যান্টিনে ভিন্ন খাবারের অর্ডার জন্য আমরা আগে থেকে বুকিং করি।কাছের মানুষ থাকতে দূরে যেতে ভালো লাগছে না।”
নতুন অর্ডার পেয়ে খুশি হলো শ্রেয়া।ক্যান্টিনের বাচ্চাদের জন্য কেক দেওয়া মানেও একটা ভালো ইনকামের রাস্তা।খুশি হয়ে বলে,”জি অবশ্যই।কয় পিচ আর কি কি ফ্লেবার লাগবে আমাদের বলবেন।আমরা ডেলিভারি দিবো।”
সবশেষে শ্রেয়া এক কোনায় এসে হাত মুছতে থাকে।শ্রেয়ার পাশে এসে দাঁড়ায় ফারাজ।বলে,”হঠাৎ রিজাইন নিলেন কেনো জানতে পারি?”
ফারাজের উল্টোদিকে ফেরা ছিলো শ্রেয়া।রাগ হচ্ছে মনে মনে।এক বছর আগে অপমান করেছে এখন বুঝতে পারছে না কেনো চাকরি ছাড়তে চায়।শ্রেয়া নিজেও বা কম কিসে?অপমান করবে সে ফারাজকে।ফারাজের দিকে ফিরে বলে,”আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।হাসব্যান্ড চাচ্ছেন না আমি জব করি।আর এখন তো আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।চাকরি করার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
ফারাজ শ্রেয়ার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি নিজের পায়ে দাঁড়াবেন না তো কি অন্য কারো পায়ে দাঁড়াবেন মিস শ্রেয়া?”
চোখ বড়বড় করে ফারাজের কথা শুনলো।বুঝতে পারল না কিছুই।এটা কি মজা করে বলা নাকি পাল্টা অপমান।শ্রেয়া বলে,”আসল কথা হলো আমার যে স্বামী হবে সে কাজ করতে দিবে না।”
“আপনি কি তার সাথে কথা বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ,বলেছি কথা।”
“কি মিথ্যুক(বিড়বিড় করে),ওহ আপনার হাসব্যান্ড যদি কাজ নাই করতে দেয় তাহলে আর কি?করলেন না চাকরি।আমি তাহলে নতুন অ্যাসিসট্যান্ট খুজবো।অবশ্য আমার যে ওয়াইফ হবে ভাবছি তাকেই আমার অ্যাসিসট্যান্ট করে রাখবো।”
মনের মধ্যে জ্বলতে থাকলেও বাইরে ঠান্ডা পানির মতো নিজেকে প্রকাশ করছে শ্রেয়া। ফারাজকে অপমান করতে পারল না বরং নিজেই অপমান হয়ে গেলো।শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো ফারাজ।দুদিন পর তাদের বিয়ে আর এখন হবু বউকে তার কথা বলেই জেলাস ফিল করাচ্ছে।শ্রেয়া মুখে লোক দেখানো হাসি ফুটিয়ে বলে,”বেশ ভালো তো।আপনিও আপনার ওয়াইফকে নিজের মতো করে ট্রিট করবেন আমাকে আমার হাসব্যান্ড নিজের মতো করে ট্রিট করবে।”
“জি অবশ্যই।আমি আমার ওয়াইফকে যথেষ্ঠ ফ্রিডম দিবো।তাকে কোনো কিছু নিয়ে সাফার করতে দিবো না।ট্রিট কেনো করতে যাবো আমি আমার ওয়াইফকে?হাসব্যান্ড ওয়াইফ কেউ কাউকে ট্রিট করে না।এক অপরের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ধরে রাখে।”
“কংগ্রাচুলেশন।”
“আপনাকেও মিস শ্রেয়া।”
চলে গেলো ফারাজ।মিমির হাত ধরে এগোতে থাকে।শ্রেয়া পিছন থেকে দেখছে ওদের।কষ্ট হচ্ছে শ্রেয়ার মনে।কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছে না।
দেখতে দেখতে গেলো এই দুইটি দিন। ফারাজের ফুফু আর তার মেয়ে এসে দেখা দিয়ে যায় শ্রেয়ার সাথে।কেকের ডেলিভারির জন্য দুইটি ডেলিভারি ম্যান অনেক আগেই রেখেছিলো শ্রেয়া।একজন এখন স্কুলে ডেলিভারি দেয় আরেকজন বাড়িতে বাড়িতে।বেশ ভালই চলছে শ্রেয়ার দিন।তবে মনের মধ্যে শূন্যতা কাজ করছে।আজ তার বিয়ে।গায়ে হলুদ বা মেহেন্দির অনুষ্ঠান করেনি।শ্রেয়া করতে চায়না আবার ফারাজ নিজেও এসবে ইন্টারেস্টেড না।শুধু বিয়েটা আশ্রমে হবে।আয়নার সামনে বসিয়ে সাজানো হচ্ছে শ্রেয়াকে।আজ দ্বিতীয়বার নিজেকে লাল বেনারসিতে ফুটিয়ে তুলছে শ্রেয়া।আগের মতো এবারও শ্রেয়ার মুখে নেই হাসি।তবে আগেরবার রিমলি ও অর্পা খুশি না থাকলেও এবার ওরা বেশ হাসিখুশি আছে।শ্রেয়া ফারাজদের আশ্রম সম্পর্কে অবগত না।তাই আশ্রমের মধ্যে বিয়ে শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বরং রাজি হয়েছে।কিছু অনাথ বাচ্চাদের আনন্দ হবে আজ।বিয়ের সাজ শেষ করে গাড়িতে উঠে বসে।গাড়ি আশ্রমে এসে থামতেই জানালা খুলে শ্রেয়ার দিকে একটি ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দেওয়া হলো।শ্রেয়া কাঙ্ক্ষিত হাতের দিকে তাকাতেই অবাক।হুবহু নিজের বেনারসির সাথে মিলিয়ে একটি শাড়ি পরে ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে আছে মিমি।মিমি নিজেই হাত বাড়িয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে।মিমিকে দেখে অবাক হলেও পাশে থাকা রিমলির দিকে তাকাতেই রিমলি ইশারা করে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।শ্রেয়া হাত বাড়িয়ে দিলো।মিমি ভিতরে নিয়ে গেলো শ্রেয়াকে।শ্রেয়া যাওয়ার পর রিমলি নামবে গাড়ি থেকে ওমনি রিমলির দিকেও একটি হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়।মানুষটির দিকে তাকাতেই রিমলি দেখলো শিহাব।অবাক হয়ে বলে,”আমার দিকে হাত বাড়িয়েছেন কেনো?”
“বেয়াইনকে নামতে সাহায্য করছি।”
হাত বাড়ালো না রিমলি।নিজে থেকে নেমেই বলে,”এতদিন কোথায় ছিলেন?”
“নতুন কেস এসেছিলো।খুলনায় গিয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য।মিস করছিলে বুঝি?”
পা থেমে গেলো রিমলির।শিহাবের দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ দেখলো শিহাবকে।সত্যি বলতে সে মিস করেছে শিহাবকে কিন্তু তারপরও বলে,”একদমই না।আমি কেনো মিস করবো আপনাকে?”
“তাহলে খোঁজ নিলে যে?”
“ওটা তো এমনিতেই।কিছুদিন দেখিনি আপনাকে আজ হঠাৎ দেখলাম তাই মনে পড়ল আপনি ছিলেন না এতদিন।এছাড়া কিছুই না।”
“সত্যিই কিছু না?”
“উহু।”
“আচ্ছা ভিতরে চলো।বিয়ের আয়োজন শুরু করতে হবে।”
এই কয়দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো অহনা।ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে তার।মাথা ঘুরছে আর বমি আসছে বেশি।মাথার চুলগুলো এখন আর নেই।আজ রিলিজ পেয়েছে সে।বাসায় আসতেই মিসেস নাজমা বলেন,”জীবনের সবকিছু ভুলে তোমার উচিত অন্তত তোমার মা ও মেয়েকে একটু আগলে নেওয়া।মেয়ের ভালোবাসা পেতে চাও না তুমি?”
অহনা তাকালো মিসেস নাজমার দিকে।বলে,”পেতে তো ঠিকই চাই আরও অনেক আগে থেকেই কিন্তু ও কি আমায় মা বলে জড়িয়ে ধরবে?অনেক অন্যায় করেছি আমি ওর সাথে।এই অন্যায় ছোট মানুষ কিভাবে মাফ করবে?ওর বাবা আমাকে মাফ করবে না।”
“পাপ যখন মানুষ করে তখন তাকে সবাই ঘৃণা করে কিন্তু সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে করে তাকে কিন্তু মানুষ দূরে ঠেলে দেয় না।একবার মেয়েকে নিজের বুকে জড়িয়ে দেখো।দেখবে তোমার মেয়ে তার অতীত ভুলে গেছে।মাতৃত্বের স্বাদ পাবে।”
“সত্যি বলছেন আপনি?আমার মিমি আমার কাছে আসবে?”
“কেনো আসবে না?মা হও তুমি ওর।মাতৃত্বের আশার হাত বাড়িয়ে দেখো ও তোমার কোলে ঠিক ফিরবে।”
“আচ্ছা আমি যদি ওকে কয়েকদিনের জন্য আমার কাছে এনে এখানে রাখি আপনি কি রাগ করবেন?”
“একদমই না।তুমি তোমার মেয়েকে এনে একটু ভালোবাসা দিবে।এতে আমি বাধা দিব কেনো?যাও তোমার মেয়ের কাছে।আমার ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।তোমাকে নিয়ে যাবে ওই বাসায়।”
“আচ্ছা।”
বলেই আলমারি খুলে বোরকা নিয়ে বোরকা পরে অহনা।উদ্দেশ্য তার মেয়েকে দেখা।
চলবে…?