#হিয়ার_মাঝে ৬৩.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
দুপুরের ক্লান্তিতে দু’চোখ মুদে আসছিল বার বার। কিন্তু মনটা বড্ড বিষন্ন আজ। জামাই ছাড়া দিনগুলো কেমন পাংশুটে, যেন বিরহের রঙে রঙ্গিন বির্বণময়। উহু বলে মুখে শব্দ তুলল মুহুর্তে। হঠাৎ নুবাহর মনের মাঝে খেলা করল দুষ্টুবুদ্ধি। তড়িঘড়ি ছোট্ট এক বার্তা পাঠালো নিজের প্রিয় জামাইকে।
“নাম তার জিতু
কাজে সে ভীতু,
বলে নাকি সাহসী
আসলে সে বনবাসী।”
মেসেজ পাঠানোর পর অপেক্ষা করল উত্তরের। কিন্তু সময় গড়ালো, বেলা ফুরালো। কিন্তু নিষ্ঠুর জামাইয়ের রিপ্লাই এল না তার। কষ্টটা এবার অভিমানে পরিণত হল। তার জামাই তাকে আর ভালোবাসে না। ভুলে গেছে সে। নিশ্চয় নতুন কাউকে পেয়েছে এখন। সে পুরাতন হয়ে গেছে না, তাই তো তাকে আর চেনেই না।
___
রাত নেমেছে ধরণী তলে। অথচ এই শহর রাত হলে নিজের চেনা রূপ ছেড়ে ফিরে আসে অন্য রূপে। বাতি ঝলমলে আলোয় নিজের জৌলুশ খুঁজে পায় সে। হয়ে যায় আলোর নগরী। এই বাতির আলোময় রাতে চিন্ময় বাসায় ফিরেছে মাত্র। শরীরের জামা এখনো খোলা হয়নি। তার আগেই রুমের ভেতর কারো অস্তিত্ব টের পায়। অবাক হয়নি সে। হাঁটার গতি শুনেই বুঝতে পারে আগুন্তকঃ কে হতে পারে? তাই মাথা তুলে তাকালোর প্রয়োজন হয়নি তার দিকে। নিজের কাজে মগ্ন পুরো। গায়ের টিশার্ট খুলে রাখল হ্যাঙ্গারের মাঝে। পেছনে শব্দের গতিদানব তার চেনা-চরিত ভাষা ছেড়ে কন্ঠ নরম করল। বলে উঠল,
‘চিন্ময় তোমার পানি।’
মুহূর্তে মাথায় যেন বজ্রপাত হল চিন্ময়ের। তড়িৎ মাথা তুলে তাকাল কুমুদের দিকে। মেয়েটার বেশভূষা দেখে দু’চোয়াল শক্ত হল তৎক্ষণাৎ। গায়ে কোমর সমান টপস পরিহিত। তার উপর পাতলা ফিনফিনে শিফনের ওড়নাটা নেহাৎই তাচ্ছিল্যের স্বরুপ পরা। শরীরের ভাঁজ স্পষ্টত দৃশ্যমান। টাকনুর দু’ইঞ্চি উপরে উঠানো লম্বা প্লাজুটা। মুহুর্তে সে ভ্রুজোড়াও কুঁচকালো। গর্জে উঠল, ‘কি বললি কুমুদ?’
‘পানি খেতে বললাম।’
‘তার আগে কি বলিছিস?’
‘কি বলেছি আবার?’
‘কথা না পেঁচিয়ে যা জিজ্ঞেস করেছি তাই জবাব দেয়।’
‘কি আর বললাম, তোমাকে নাম ধরে ডেকেছি।’
‘সেটাই তো! আমি তোর সমবয়সী, না বন্ধু হই, নাম ধরে ডাকিস কোন সূত্রে। গাল লাল করে দেব বেয়াদব, আরেক দিন নাম ধরে ডাকলে।’
কুমুদ তার চিরচেনা রূপে ফিরে গেল। হঠাৎই গলার স্বর পরিবর্তন হল তার।
‘কেন ডাকব না? দুদিন বাদেই তো স্বামী হবে।’
‘এখনও স্বামী হইনি।’
‘হতে কতক্ষণ আর।’
‘সেটা সময়ই দেখা যাবে। কিন্তু তুই এসব পোশাক পরে নিজেকে কি প্রমাণ করতে চাস? তুই একটা মেয়ে? শোন, তুই যদি গায়ের পোশাক খুলেও থাকিস না, তাও এই চিন্ময়ের পুরুষত্ব তোকে দেখে জাগবে না। তাই দ্বিতীয়বার এমন পোশাক পরে আসবি তো, পোশাক পরার মত অবস্থাও তোর থাকবে না কিন্তু। রুম থেকে বাহির হ, যা এখন।’
অপমানে থমথমে হয়ে আছে কুমুদ। রাগে হিসহিস করছে তার ভেতরের সত্তা। চিন্ময়ের এত দেমাগ কিসের সে এটাই বুঝে না। তার মধ্যে কমতি’টা কিসের আজও জানা হয়নি। ছোট থেকেই সে এই ছেলের আশেপাশে কত ঘুরঘুর করত। অথচ এই ছেলে তাকে সামান্যতম সম্মানও দেইনি। কথা তো প্রয়োজন ছাড়া বলেই না। তাকে দেখলে কেমন পালাই পালাই ভাব। তবে সেটা আর কতদিন? দু’দিন বাদেই সব উশুল করবে। কুমুদ গজগজ করতে করতে বের হল চিন্ময়ের রুম থেকে।
__
রাতের আঁধারের সাথে সাথে অভিমানের পারদ বাড়ছে হু হু করে। ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা। কিন্তু আজ জিতু এখনও বাসায় ফেরেনি। মনটা বড্ড ব্যাকুল হল নুবাহর। সেই সকালে মুখটা দেখেছে। কিন্তু আর দেখা হয়নি তার। আজকাল এত ব্যস্ততা জিতুর, তাকে সময়ই দেয় না। সত্যি অভিমানে আকাশ ছুঁলো তার। বিয়ের আগে সব পুরুষই ভালোবাসা দেখায়। বিয়ে হলে তখন আর বউ নামক প্রানীটাকে চেনেই না আর। ল্যাব পরীক্ষা দু’দিন বাদেই অথচ বক্ষপটে কারও জন্য দগ্ধ হচ্ছে অজান্তে। কি বেহায়া মন তার। যে লোক তাকে আজ সারাদিনে একটা কল দেয়নি, মেসেজের উত্তর দেয়নি তবু সে তার জন্য ভেবে যাচ্ছে। আসলেই অসভ্য বেহায়া মন তার। টেবিলে মাথা ঠেকালো, দু’চোখে তার প্রিয় মানুষটার ছবি ভাসছে। আনমনে খাতায় আঁকিবুঁকি করছে কারও মুখাবয়ব। দৈবাৎ কারও পায়ে হেঁটে আসার শব্দ তার কানে ভেসে এল। সে নিশ্চুপ আগের মতই মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে টেবিলে।
নিজের রুমে প্রবেশ করে পুরো স্তব্ধ জিতু। অন্ধকারাচ্ছন্ন রুম জুড়ে, আলোর ছিঁটেফোঁটাও নেই কোথাও। তার মানে কি, আজ আলো জ্বালায়নি নুবাহ। রুম এত শান্ত, তাহলে তার বউটা কোথায়? পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজল। নিজমনে বিড়বিড় করল, তার বোকাপাখি গেল কোথায়? আবার তাকে ফাঁকি দিল নাতো! আনমনে কতই কিছুই ভাবল। সহসাই চোখ পড়ল পাশের রুমের টিমটিমে আলো দেখে। পাশের রুমে আলো জ্বলছে, তার মানে বোকাপাখি আবারও নিজের ফেরত গিয়েছে। কিন্তু কেন? অবুঝ মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিল তার। নিজের রুম ছেড়ে নুবাহর রুমের দরজায় বার’কয়েক টোকা দিল। কিন্তু ভেতর থেকে বন্ধ হওয়া দরজা খুলল না নুবাহ।
হতাশ হল জিতু। রাতটা নেহাৎ কম হয়নি। আজ বেশ দেরিও করেছে। ভীষণ ব্যস্ত ছিল সারাদিন। বউয়ের সাথে একটু কথাও বলা হয়নি তার। দরজা বন্ধ দেখে নিজের রুমে ফেরত গেল আবার। নিজের ড্রয়ার খুলে দেখে ডুব্লিকেট চাবিও নেই। কি অবাক কান্ড! বউ সব চাবি সমেত রুমে ঢুকেছে নাকি? নিজের গ্লাসের বারান্দার দরজা খুলল সে। নুবাহর রুমও গ্লাসের বারান্দা দিয়ে ঘেরানো। সে গ্লাসের দরজা খুলে নুবাহর রুমে প্রবেশ করল। প্রবেশ করতেই চক্ষু চড়কগাছ। বউ তার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। এভাবে ঘুমালে তো মাথা, ঘাড় ব্যথা করবে তার। সে দ্রুত এগিয়ে গেল বউয়ের দিকে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল নুবাহকে। মাথা টেবিল থেকে উঠিয়ে নিজের হাতে নিল। নুবাহর পুরো শরীর নিজের কোলে টেনে নিল সে। মেয়েটা ঘুমে অচেতন হুঁশহীন। বুকের মাঝে ধরে মুখের সাথে মুখ ঠেকালো। চোখমুখে ছোট ছোট চুমু খেল সে। মুখের উপর মুখ রেখে বলে উঠল,
‘বোকাপাখি এত জলদি ঘুমাচ্ছো। আজ আমাকে রেখে খেয়ে ফেলছো রাতের খাবার। আমি তো এখনো খাইনি। আজকে খাবার দেবে না। খিদা পাইছে তো। উঠবে না।’
চোখদুটো খুলল না নুবাহ, না জিতুর কথার জবাব দিল। ঘুমে অচেতন হয়ে আছে উল্টো। বউয়ের উপর জোর-জবরদস্তি তো আর চলবে না। সে বউকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার ওষ্ঠদ্বয় নিজের দখলে নিল দ্রুত। সময় অতিবাহিত হল এভাবে। অথচ দু’চোখ মুদিত নুবাহর কর্ণদ্বয়ে জিতুর সব আদুরে বাক্যেই পৌঁছালো। অথচ সে বুঝেও ঘুমের ভান ধরে আছে সেই কখন থেকে। এই জামাইয়ের সাথে তার একদমই কথা নাই। আজ তো কথা সে বলবেই না। অভিমান জমেছে বেশ।
জিতু যেন গো-বেচারার মত হয়ে আছে। বউয়ের এত পরম শান্তির ঘুমে যেন তার দমবন্ধ অবস্থা। আরও একবার চেষ্টা চালালো বউয়ের ঘুম ভাঙাতে। কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করল,
‘ও বউ উঠো না, খিদে পেয়েছো। তুমি খাবার না দিলে আমি খাব না কিন্তু। উপোস গিয়ে বিছানায় ঘুম দেব। উঠো না বউ। ও বোকাপাখি কথা শুনবে না।’
নুবাহর আগের মতই নিরুত্তোর। কিন্তু দুচোখের পাতা নড়ছে ভীষণ। জিতু হুট করে বলে উঠল,
‘বোকাপাখি, তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো? আজকে আমি একটুও সময় পাইনি। তোমার মেসেজও অনেক দেরিতে পেয়েছি। তখন উত্তর দেয়ার মত সময় ছিল না। সর্যিই বোকাপাখি।’
তন্দ্রাঘোরে নুবাহ দু’ঠোঁট উল্টিয়ে বলে উঠল,
‘কে আপনি?
জিতু ঠোঁট চেপে মুচকি হাসল। অবশেষে তার বউ মুখ খুলেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। সেও আর দেরি করল না। জবাব দিল দ্রুতই,
‘তোমার বনবাসী, ভীতু জামাই।’
চলবে,,,