#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা
বাইশ
আরো ফুসে উঠলো ময়ূরাক্ষী৷ এ লোক আবার এসেছে এবার জান নিবে ময়ূরাক্ষী এ ছেলের৷ভেবেই সামনে পায়ের কাছে থাকা লাঠিটা নিয়ে পিছন ঘুরে হুট করে বাহুতে লাঠিটা দিয়ে বা’রি দিলো৷
কিন্তু বা রি দেওয়ার পর সামনে থাকা মানুষ টি কে দেখে হতভম্ব হয়ে রইলো ময়ূরাক্ষী৷
কয়েক মিনিট থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো বিস্মিত আর অপরাধী নয়নে৷ নিমেষেই মুখশ্রীতে ক্ষোভ কেঁ’টে গিয়ে আঁধার আর ভীতি নামলো৷
এত জোরে বাড়িটা লেগেছে তার উপর কাঠের লাঠি খানায় লোহা লাগানো ছিলো যার ফলে অনেকাংশ কেঁ’টে গেছে৷
সাদা শার্টটা বাহুর দিক দিয়ে নিমেষে লাল হয়ে গেছে র’ক্তে৷
বাহুতে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সামনে শাহওয়াজ৷ লোকটার মুখচোখ শান্ত দেখাচ্ছে৷ যেন কিছু হয়নি বৃষ্টির পানি পরায় হাতটা সহ শার্টের একাংশ লাল হয়ে গেছে র’ক্তে৷
শাহওয়াজ নিজের ক্ষ’ত হাতের দিকে ধ্যান দিচ্ছে না৷ গাড়ি নিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকছিলো ময়ূরাক্ষীকে এই বৃষ্টির মাঝে দৌড়ে এদিকে আসতে দেখে গাড়ি রেখে সে ও এখানে আসলো৷
হুট করেই মেয়েটা এমন কেন করলো বোধগম্য হচ্ছে না শাহওয়াজ এর৷ মেয়েটি যে তাকে উদ্দেশ্য করে মারতে চায়নি এটাতো স্পষ্ট৷ কিন্তু কাকে ভেবে মে’রেছিলো? আর কেন?
“হায় আল্লাহ ভাইজান আপনার হাতে কি হইলো?”
মৃদুলার কন্ঠে হুস ফিরে ময়ূরাক্ষীর৷শাহওয়াজ এখনো নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ মৃদুলা অদুরেই ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ ময়ূরাক্ষীকে আসতে দেখে সে ও ছাতা নিয়ে বের হয়েছে৷
মৃদুলা এগিয়ে এলো বাচ্চা মেয়েটির চোখেও আকাশ সমান কৌতুহল৷ তার মাথার ও হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে!
শাহওয়াজ এর হাতের এ অবস্থা দেখে তটস্থ হয়ে পরলো মৃদুলা৷ এগিয়ে এসে ছাতা ফেলে বাহু চেপে ধরে বললো,
“ভাইজান হাত কাঁ’টলো কি করে?”
শাহওয়াজ তপ্ত শ্বাস টানলো ময়ূরাক্ষীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার ময়ূরবু কে জিগ্যেস করো৷”
মৃদুলা অবুঝ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ময়ূরাক্ষীর পানে৷ তার বুবু কি করে জানবে?
হুট করেই ময়ূরাক্ষীর হাতে মোটা একটা কাঠের মত লাঠি দেখে আঁতকে উঠলো৷ বললো,
“হায় আল্লাহ বুবু তুমি ভাইজানরে মা’রছো?”
মৃদুলার কথা শুনে ময়ূরাক্ষী সাথে সাথেই মাথাটা নিচু করে ফেললো৷
সে কি ইচ্ছে করে করেছে নাকি? সে তো ভেবেছিলো ওই লোকটা এসেছে৷
শাহওয়াজ এগিয়ে এলো ক্ষানিটা যার ফলে কিঞ্চিৎ দূরত্ব ঘুচলো৷ শুধালো ময়ূরাক্ষীকে,
“কি হয়েছে ময়ূর? কিছু কি হয়েছে? বলুন তো?”
ময়ূরাক্ষী উত্তর দিলো না৷ সামনে দাঁড়ানো শাহওয়াজ এর অবস্থা দেখে হীম হয়ে আশে শরীর৷ কি করলো সে এটা? মাথা আর কাজ করছে না তার৷ সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে এটা কি করে করলো সে? মা’রার আগে একবার দেখা উচিত ছিলো৷
রুপা জানলে তো আরো অভিমান করবে তার উপর৷ না দেখে তার প্রাণ প্রিয় ভাই কে আহত করে দিলো সে?
মস্তিষ্ক যেমন ভাবনা থকে বিরতি নিলো৷ স্নায়ু, ইন্দ্রিয় যেন তার কার্যকারীতা বন্ধ করলো৷
শরীর ও বিনা অনুমতিতে খেই হারালো আধার হলো চারোপাশ নিমেষে লুটিয়ে পরলো কিঞ্চিৎ দূরে থাকা শাহওয়াজ এর বক্ষে৷ বিস্মিত হলো শাহওয়াজ৷ কি হলো এটা? ঠিক তখনি শোনা গেলো মৃদুলার কন্ঠ,
“হায় আল্লাহ ময়ুরবু আবার জ্ঞান হারাইছে? কিন্তু ভাইজান হাত কাঁ’টছে আপনার ময়ুরবু জ্ঞান হারাইলো কেন?”
হলোটা কি?এই মেয়ে নিজেই মে’রে নিজেই জ্ঞান হারালো?
..
চোখ পিট পিট করে তাকালো ময়ূরাক্ষী৷ নিজেকে বিছানায় দেখে তটস্থ হয়ে বসলো৷ হুট করেই মস্তিষ্ক খুললো কিছুক্ষণ আগেতো সে পুকুরপাড় ছিলো এখানে কি করে?
গায়ের জামা কাপড় ও ভিন্ন৷
“ছেলে দেখলেই বুঝি তোর গায়ে পরতে ইচ্ছে করে ময়ূর?”
হাসির কন্ঠে তাকালো দরজার দিকে৷ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাসি৷
ময়ূরাক্ষী কিছু বলবে তার আগেই হাসি আবার বলে,
“শাহওয়াজ ভাইজান কে দেখলেই কি তোর জ্ঞান হারাতে ইচ্ছে করে? সব তোর সয়তানি বুঝিনা ভেবেছিস৷”
ময়ুরাক্ষী চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো হাসির পানে৷ এই মেয়েটার পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া না করলে ভালো লাগে না৷
ইচ্ছে করে মানুষ জ্ঞান হারায় কি করে? ময়ূরাক্ষী রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
“কি বলছিস কি এসব?”
হাসি এগিয়ে এসে বললো,
“নাটক করবি-না একদম৷ দাদি আসুক সব বলবো দেখিস৷”
ময়ূরাক্ষীর রাগ বাড়লো৷ কাটকাট কন্ঠে বললো,
“বেশ করেছি৷ দাদিকে বলবি? বল গিয়ে এক্ষুনি বল৷ আর কি যেন বললি? তোদের ভাইজান কে দেখলে ইচ্ছে করে জ্ঞান হারাই? হ্যাঁ ভালো হয়েছে যা ইচ্ছে ভাব যদি তাই মনে হয় তাই করি কি করার কর গিয়ে৷”
হাসি আশ্চর্য বনে গেলো৷ এ মেয়ের মুখ থেকে আজকাল বেশ খই ফুটছে৷ রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো৷ ময়ুরাক্ষী নিরাশ হয়ে বসে রইলো সেখানেই৷
“ইচ্ছে ইচ্ছে করে জ্ঞান হারানোর কি আছে মেয়ে? আপনি চাইলেই তো নিজ থেকে আমি জড়িয়ে ধরি৷ এভাবে কথায় কথায় জ্ঞান হারিয়ে আমার বুকে পরে আমার ইজ্জত লুটে নিচ্ছেন আপনি৷ পরে লোক সমাজে মুখ দেখাবো কি করে আমি? আমায় বিয়ে করবে কে বলুন তো?”
ময়ূরাক্ষী বড় বড় চোখ করে তাকালো শাহওয়াজ এর পানে৷ এই লোকটা ভয়ংকর৷ এ লোক কথা বললেই মনে হয় ভয়ংকর কিছু বের হবে৷ কি ঠোঁট কাঁ’টা লোক৷ কান ঝা ঝা করে উঠলো৷
এখন মনে হচ্ছে না দেখে মে’রেছে বেশ করেছে বারি টা মুখে পরলে আরো বেশি ভালো হতো৷
শাহওয়াজ বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে শুভ্র ব্যান্ডেজ খানা দেখা যাচ্ছে৷
লোকটা বেজায় অভদ্র! নিজেই বলছে আপনি চাইলেই জড়িয়ে ধরবো আবার বলছে সে বুকে জ্ঞান হারানোতে তার ইজ্জত লুট করে নিয়েছে৷
“চুপ করে আছেন কেন মেয়ে?বলুন বিয়ে করবে কে আমায় এখন?”
ময়ূরাক্ষী যেন এখন লজ্জা পেলো৷ লজ্জায় আষ্টেপৃষ্টে ধরলো কেমন! হাসির সাথে সব কথোপকথন শুনে ফেলেছে এই লোক? ইশ এখন তো শুধু লজ্জা দিবে৷
ময়ূরাক্ষী জড়োসড়ো হয়ে বসলো কথা পাল্টানোর জন্য বললো,
“আপনি কি হসপিটালে গিয়েছিলেন? রুপাবু কেমন আছে?”
মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে বেশ বুঝলো শাহওয়াজ৷ এ মেয়েকে লজ্জা দিতে বেশ লাগে তার৷ লজ্জা পাওয়ায় মুখের আদল যেন আরো সুন্দর, স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে৷
একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে? সৃষ্টি কর্তা যেন নিখুঁত ভাবে তৈরি করে দিয়েছে৷ কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকালে কেমন যেন চেনা চেনা লাগে৷ অদ্ভুত না এ বিষয়টা? এমন কেন মনে হয় সে জানে না
মেয়েটার রুপ যেন বুকে যেন জ্ব’লন ধরিয়ে দেয়৷
মাঝে মাঝে নিজের উপর হাসি পায় শাহিওয়াজ এর৷ আটাশ বছরের একটা ডাক্তার কিনা তার থেকে দশ বছরের ছোটো মেয়ের প্রেমে পরলো? মানুষ হাসবে না শুনলে?
হুট করেই কিছুক্ষণ আগের কথা স্মরণ হলো৷ মেয়েটার হয়েছিলো কি? কি এমন ঘটেছিলো?শাহওয়াজ কাছে এলো, বেশ দুরত্ব নিয়ে বসলো পায়ের কাছে৷ কৌতুহল নিয়ে বললো,
“একটা কথার উত্তর দিন তো? কাকে ভেবে আমায় মেরেছিলেন ময়ূর কি হয়েছে বলুন আমায়?”
ময়ূরাক্ষী ফোলা ফোলা চোখে তাকালো শাহওয়াজ এর দিকে৷ লোকটার মুখঅভয়ভ স্বাভাবিক৷ ময়ূরাক্ষী এবার পরলো বিপাকে, এখন উত্তর দিবে কি?
বলবে কি করে সকালের কথা? এসব কি মানুষ কে বলা যায়? মন্দ বলবে না তাকে?
দৃষ্টি এলোমেলো হলো তার৷ ময়ূরাক্ষী ফের কথা পাল্টাবে তার আগেই শাহওয়াজ গম্ভীরমুখে বললো,
“এড়িয়ে যাচ্ছেন?কথা পাল্টাবেন না ময়ূর৷ উত্তর দিন? বলুন আমায়?”
মেয়েরা হয় তুলার ন্যায় নরম, একটু আহ্লাদ পেলেই পানির ন্যায় হয়ে যায়৷ এবার ময়ূরাক্ষী ফুঁপিয়ে উঠলো৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েই অনর্গল বললো শাহওয়াজ কে সবটা৷ মেয়েটা বেশ বাচ্চা সুলভ৷ অথচ নিজেকে কত বড় দেখায় সবার কাছে৷ ময়ূরাক্ষী বার বার হাত কোমর ঘঁষছে আর বলছে “আমি অপবিত্র হয়ে গেলাম৷ নোংরা হাতে ছুঁয়েছে আমায়”
শাহওয়াজ শুনলো সব৷ মেয়েটা বাইরের জগৎ দেখেনি এখনো কথাতেই বোঝা যায়৷ এ দুনিয়া যে বড়ই কঠিন এইটুকুতেই মেয়ে ভে’ঙে পরেছে৷ আর মেয়েদের বাবা মা হীন জীবন তো আরো কঠিন এইটুকুতে ভে’ঙে পরলে হবে?
শাহওয়াজ স্বাভাবিক রইলো৷ তার ভাবভঙ্গি বোঝা গেলো না কিছু৷
নিরব রইলো ক্ষানিক্ষণ মেয়েটার ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে এখনো৷ পিনপতন নিরবতা কাঁ’টিয়ে শাহওয়াজ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,
“রুপার কাছে যাবে?”
শাহওয়াজ এর কন্ঠস্বর শীতল৷ শাহওয়াজ এর এহেন কন্ঠে ময়ূরাক্ষীর কান্না হুট করেই থেমে গেলো৷ লোকটা আবার তাকে তুমি বললো? চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো ময়ূরাক্ষী৷ বুকে কেমন কম্পন ধরলো!
শাহওয়াজ লক্ষ করলো মেয়েটা আর কাঁদছে না৷ নিঃশব্দে হাসলো শাহওয়াজ৷
ফের বললো,
“আমি চলে যাবো?”
ময়ূরাক্ষী এবার নিজ থেকেই খপ করে ধরে ফেললো শাহওয়াজ এর হাত৷ মিনমিনিয়ে বললো,
“আমায় নিয়ে যাবেন?”
শাহওয়াজ ফের হাসলো৷ হাতের দিকে তাকালো, এ মেয়েতো সাংঘাতিক কাজ করে বসেছে৷ খানিকটা কাছে গেলো শাহওয়াজ সামনে এখন কিঞ্চিৎ ফারাক৷ এইটুকু ফারাক না থাকলে সীমা লঙ্ঘন হয়ে যাবে না? এই সীমাটা আপাতত অতিক্রম করতে চায় না শাহওয়াজ৷ প্রেয়সী এখনো ছোটো এইটুকু দুরত্ব হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকুক৷ অতঃপর ফিসফিসিয়ে বললো,
“নিজেই লজ্জা পাও আবার নিজেই কাছে আসো৷ এইযে নিজ থেকে হাত টা ধরলে এ হাত কিন্তু আমি না চাইলে আর ছাড়া হবে না মেয়ে৷ ”
চলবে