#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া মেঘলা
পঁচিশ
রৌদ্রজ্বল দ্বিপ্রহর চলছে৷ কাটফাটা রোদে চকচক করছে ধরণী৷ বিভাবসুও প্রখর উত্তাপ ছড়াচ্ছে চারোদিকে৷ রোদ আর গরমের তীব্রতা এতই যে রাস্তায় থাকা কুকুর গুলো ও ছায়ায় ঠায় খুঁজছে৷
মাস পেরিয়েছে সে দিনের পর৷রুপাকে হসপিটাল থেকে আনা হয়েছে বিশ দিন আগে৷ দশ দিন হসপিটালে ছিলো সে৷
ভাবা যায় কি হুলস্থুল কান্ড? সবাই ঠাহর ও করেছে রুপা যে ছাদ থেকে লাফ দেয়নি শোকে৷ এতটাও প্রভাব পরেনি তার জীবনে সে ঘটনা৷ বলতে গেলে কিঞ্চিৎ মন ক্ষুন্ন ও হয়নি বরং ভালো হয়েছে আরো৷ পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে আরো৷ সবে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করলো এখন তো তার বিশাল স্বপ্ন ভাইয়ের ন্যায় হতে চায় সে৷
মানুষ বেশ বোধ বুদ্ধিহীন৷ আর বাঙালি তো হুজুগে পাগল ঘটনার যাচাই বাছাই না করে ধুম করে একটা বানিয়ে ফেলতে পছন্দ করে তারা৷
আসল ঘটনা, আসল কথাটা কি তারা আলোচনা সমালোচনার পর জানতে পারে তারা যা ভেবেছে কোনোটাই সঠিক না৷ অথচ আমাদের উচিত রয়ে সয়ে জেনে শুনে বিচার করা৷
তাদের আচরণে এমন বোঝায় যেন তার বিয়ের আসর থেকে বিয়ে ভেঙেছে৷ বড় অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? অথচ পাঁকা দেখা চলছিলো সবে৷
বাকি সবারটা বাদ তার বাবা মা কি করে ভেবে নিলো সে আত্মহ’ত্যা করেছে? আত্ম’হ’ত্যা করবে কেন ভাই? এটা একটু ভাবলেই তো বাচ্চাদেরো মাথায় আসার কথা৷ আর সব থেকে বড় ব্যাপার যে দিক থেকে পরেছে বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে সবাই জানে সে দিকটা পিচ্ছিল রেলিং নেই৷
মোদ্দা কথা বাঙালি জাতী যত শিক্ষিতই হোক মূর্খতার প্রমাণ দিবেই৷ রুপা পুরোপুরি সুস্থ এখন, সবাই আসল ঘটনা জানঅলেও এর মাঝে কেউ কেউ এ কথা বিশ্বাসী করছে না, সান্নিধ্যে হ্যা হ্যাঁ করলেও নিজেরা ভাবছেই মিথ্যা বলছে তারা৷ কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের কথাই সঠিক মনে করে৷ এ নিয়ে অবশ্য রুপার বা কারো মাথা ব্যাথা নেই৷ মানুষের কাজই নিজের কথাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, নিজেকে বড় ভাবা৷ আসলে আমরা সবাই স্বার্থপর৷
শাহওয়াজ ঢাকা থেকেও থেকে এসেছে দিন পনেরো৷ সে এখানের একটা হসপিটালে জয়েন করেছে৷ রুপার চিকিৎসার পর হসপিটাল কতৃপক্ষ নিজেরা এ অফার দিয়েছে শাহওয়াজ কে৷
শাহওয়াজ এর সব মিলিয়ে বাকি কাজের জন্য সময় যেন পাচ্ছেই না৷ হিমশিম খাচ্ছে ব্যাপক৷
সব কিছু মিলিয়ে না চাইতেও এখানে থাকতে হচ্ছে৷ এখানে হসপিটাল বাদেও যে কাজে এসেছেলো সে কাজ ও এগোতে পারছে না৷ অনেক প্রশ্ন যে অজানা তার অনেক রহস্য চৌধুরী বাড়ির কোণায় কোণায় রহস্য তার সব জানতে হবে৷
কিন্তু এখানে থাকলে ডাক্তারি কাজ কর্ম সব বন্ধ হয়ে যাবে এ জন্য আরো আগ্রহ করে সে হসপিটাল টিতে জয়েন করেছে৷
আপাতত দুদিক সামলাচ্ছে সে এখানে বিশদিন থাকলে ওখানে সে দশদিন চেম্বার রাখবেই কতৃপক্ষর সাথে কথা বলেছে শাহওয়াজ৷
এখানে হসপিটালের জন্য যে জমিটা নিয়েছে সে জমিতে হসপিটাল নির্মানের কাজ শুরু হবে শীঘ্রই৷ তার যে স্বপ্ন অনেক বড়, হসপিটালের পাশেই সে আশ্রম বানাতে চায় এর জন্য ও পাশের জমিটা কিনতে চায়৷ এসবের জন্য বেশ টাকার প্রয়োজন৷ সে এ কাজে নানার সাহায্য চায় না৷ নিজের টাকায় মায়ের স্বপ্ন এবং তার স্বপ্ন পূর্ণ করবে সে৷ এ স্বপ্ন টা বাবা পূর্ণ করতে না পারলেও সে করবেই৷
হসপিটাল তৈরির জন্য বরাদ্দকৃত টাকা থাকলেও এখন অনেক টাকার প্রয়োজন তাই সব ফেলে বসে থাকা যাবে না৷
এখানে সে হসপিটাল ছাড়াও অন্য একটা হসপিটালে চেম্বার পেয়েছে সেখানে সপ্তাহে দু দিন চার ঘন্টা করে রোগী দেখবে৷ সব মিলিয়ে ব্যাস্ত সময় কাটালেও সব কাজে পরিপূর্ণ সময় দিতে পারছে৷
শাহওয়াজ এর নানার হসপিটালে প্রতি মাসে চার বার একটা ক্যাম্পেইন হয় গরীব মানুষদের পাঁচ টাকায় সনামধন্য ডাক্তার দ্বারা সেবা দেওয়া হয় সেখানেও শাহওয়াজ কে যেতে হয়েছে৷
শাহওয়াজ এর এ বাড়িতে থাকার ইচ্ছা নেই তবে স্বার্থসিদ্ধির জন্য রয়ে যেতে হয়েছে৷ যদিও ভেবে ছিলো নানার বাংলোতে উঠবে একা থাকবে সেখানে৷ যদিও এসব মায়ের ইচ্ছে মা-ই বলেছিলো৷
কিন্তু এ কথা আকবর চৌধুরীর কর্ণে পৌছানোর পরই ছুটে যায় আকবর চৌধুরী খোদ ঢাকা৷
সে ভেবেছিলো কল দিবে কিন্তু রাবেয়া বললো নিজে গিয়ে কথা বলতে৷
এমনিতে আকবর চৌধুরী কোনো কারো কথা শোনার মানুষ না কিন্তু রাবেয়ার কথা যুক্তিযুক্ত৷
মধুলতা শান্ত আর বেশ বুদ্ধিমতী হলেও সে বেশ রাগী একজন মানুষ ও বটে৷ এসব গুরুত্বপূর্ণ কথা ফোনে বললে হয়? সামনা সামনি বুঝিয়ে এবং বুঝে বলতে হবে৷
শাহওয়াজ যে দিন বললো সে চলে যাবে তার বাড়ি রেখে নানার বাংলোতে উঠবে আকবর আকবর চৌধুরী অবাক হয়েছিলো ব্যাপক৷ তার সাথে বেশ আহত ও হয়েছিলো৷ ছেলে নিজের বাড়ি থাকতে অন্য কোথও কেন যাবে?এতই অপছন্দ করেন তাকে? ছেলের মুখ থেকে অন্যত্র যাওয়ার কথা শুনে ছেলেকে বলেছিলো,
“নিজের এত বড় প্রাসাদের মত বাড়ি থাকতেও তুমি একা নানার বাংলোতে থাকার বলছো শাহওয়াজ? আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য তবুও তোমার বাবা আমি এ বাড়িতে না থেকে অন্য কোথাও থাকলে বলবে কি লোকে?”
শাহওয়াজ সে দিন গম্ভীরমুখে বলেছিলো সে দিন,
“ডিসিশন টা মায়ের৷ আমার না! আর অন্য কোথাও না যার কাছে থেকে বড় হয়েছি তার বাড়িতেই উঠবো৷”
সল্প ভাষায় উত্তর দিয়ে স্থান ত্যাগ করেছিলো ছেলে৷ বাংলোটা সদরের দিকে, শাহওয়াজ এর নানার এখানে ব্যাবসা ছিলো সেই সুবাদেই আকবর চৌধুরীর বাবার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে৷ বাংলোতে মধুলতার আসা যাওয়া থাকতোই৷ মধুলতারা ছোটো থেকেই ঢাকা বড় হয়েছে৷ আকবর চৌধুরীর সাথে ঝামেলা হওয়ার পর এ বাংলোতে এখন অব্দি আসেনি ও বাড়ির কেউ৷
ছেলের কথা শুনে হতবাক ছিলেন৷ হুট করেই ভাবলো ছেলে যে অল্পতেই তাকে ছাড় দিয়েছে এইতো অনেক৷
আজ সে রাজ প্রাসাদের ন্যায় বাড়ির কথা বলছে কই এত বছর তো সে জোর করে আনতে পারেনি? মধুলতার রাগ স্বাভাবিক ছিলো তাই যা ভেবেছে তাই বলেছে৷ সে তো পারতো জোর দিয়ে বলতে আমার ছেলে আমার কাছেও থাকবে৷ নিজের স্বার্থর জন্যইতো হাতে পায়ে ধরে ছেলেকে এ বাড়িতে আনতে পেরেছে৷ এ কাজটা আগে কেন করলো না সে?
এখন যেই শুনেছে ছেলে বড় ডাক্তার সেই ছেলেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে৷ অথচ সব কৃতিত্ব তার মায়ের একার৷
আকবর চৌধুরী সে দিন সাথে সাথেই বেড়িয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে৷ সে দিন অনেকদিন বাদ ফের মুখোমুখি হয়েছিলো দু-জন৷
আগেও একদিন দেখা হয়েছিলো তাদের রুপার বিয়ের কথা যখন বলতে গিয়েছিলো কিন্তু তখন মধুলতা তার সাথে তেমন কথা বলেনি৷
যে আকবর চৌধুরী কখনো কারো কাছে নতজানু হয়নি সে আজ মাথা নিচু করে বসে ছিলো৷ দাম্ভীকতাহীন মুখশ্রীতে মলিনতার ছাপ৷ কখনো কারো কাছে শীর নিচু কারো কাছে নিজ থেকেই দমেছিলো সে দিন৷
তবে থমথমে কন্ঠেই বলেছিলো,
“আমার ছেলে আমার গ্রামেই থাকবে তবুও কেন আমার বাড়িতে থাকবে না বলছে?”
মধুলতা বেশ শক্তপোক্ত চিত্তের৷ কষ্ট তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না৷ এ লোককে দেখলে কখনোই সে নরম হয় না৷ সে দিন সে ও গম্ভীর চিত্তেই বলেছিলেন,
“তা আপনার ছেলেকে গিয়ে শুধান৷ এসবের জন্য আমার কাছে আসার কি দরকার ছিলো? শুনুন? কথায় কথায় আপনার এখানে আসা যাওয়া আমার পছন্দ হচ্ছে না৷”
আকবর চৌধুরীর মুখশ্রী খানা দাম্ভীকতায় ফের ছেয়ে গেলো৷ ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে মাথা তুলে চাইলো সে ও বললো,
“মধু আমি ভালো করে জানি তুমি বলেছো শাহওয়াজ কে৷ আমার ছেলে নিজের ডিসিশন এ চলে না তোমার কথায় চলে৷ কেন এমন করছো? ছেলে ছোটো ছিলো এত বছর কিছু বলিনি আমি কিন্তু আজ চুপ থাকতে পারছি না৷ আমার ছেলের প্রতিকি আমার অধিকার নেই? আমি যাই করে থাকি ছেলের প্রতি আমার অধিকার কমবে না৷”
মধুলতা স্তব্ধ, বিমুঢ়৷ এ লোকের ঝাঁঝ এখনো কমেনি? তার সাথে এভাবে বলছে?
মধুলতা রূঢ় কন্ঠে বলে,
“খবরদার মধু বলবেন না আমায়, আর আপনার ছেলে আপনার ছেলে করছেন কেন? কে আপুনার ছেলে? ও আমার ছেলে আমার শাহওয়াজ৷ থাকবে না ওখানে আপনার কাছে৷ ওখানেই থাকবে না ও কিছু দরকার নেই আমার আজই ওকে আমি চলে আসতে বলবো৷”
তখন আকবর চৌধুরী দমে৷ সে এসেছিলো ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে কেন যে মাথা গরম করলো৷ সে দিন বেশ কষ্ট করে বুঝিয়ে শুনিয়ে শাহওয়াজ কে তার বাড়িতে থাকার অনুমতি পেয়েছিলো৷
।।
আজ সপ্তাহখানেক পর স্বস্তির সময় কাটাচ্ছে শাহওয়াজ৷ আজ কোনো হসপিটালেই চেম্বার নেই তার সাথে রোগীর চাপ নেই আজ৷ সকালের শিফট ছিলো বারোটা অব্দি ডিউটি করে এসেছে৷ এত ব্যাস্ততায় যেন নিজেকে সময় দেওয়া হচ্ছে না৷
তার সাথে হৃদয়টা বড়ই অশান্ত তার চক্ষু জোড়াও বেশ পিপাসু প্রেয়সী যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ মেয়েটা নিজ থেকে ইচ্ছে নিজেকে লুকিয়ে রাখে৷ আজ মেয়েটাকে একবার পাক একা শাস্তি দিবে৷ তার হৃদয় কে ব্যাকুল করে তুলছে ওইটুকুনি একটা মেয়ে৷ ভাবা যায় কি সাংঘাতিক?
এ এক মাসে মাত্র দুই বার মুখোমুখি হয়েছে তবুও মানুষের সামনে৷ তারপর মেয়েটা যে কোথায় লুকায় সে খুঁজেও পায় না৷
এ এক মাসে বাড়ির সবার সাথে তেমন না কথা হলেও মেঝো চাচার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে৷ এর পিছনেও হেতু আছে৷ নিমিত্তহীন কিছুই করেন না শাহওয়াজ৷
রুম্মন চৌধুরী চমৎকার মানসিকতার মানুষ৷ মায়ের কাছেও তার অনেক সুনাম শুনেছে মায়ের বন্ধুর মত ছিলো তার মেঝো চাচা৷
আজ কৌশলে ভাইপোর কাছে এসে বসেছে রুম্মন চৌধুরী সাথে নিয়ে এসেছে দাবা৷ আগেতো মধুলতা ভাবির সাথে জমতো আজ ডাক্তার ভাইপোর সাথে খেলবে৷
বেশ জমজমাটি খেলা চলছে ভাইপো বেশ বুদ্ধিমান মায়ের মত৷ একদম পাক্কা দাবাড়ু, রুম্মন চৌধুরীও কম যায় না চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে কোনদিকে তার দৃষ্টি এবার ধরে ফেলেছিলো প্রায় চালটা তার আগেই ব্যা”ঘাত ঘটালো ময়ূরাক্ষী রিনরিনিয়ে বললো,
“মেঝোবাবা, আপনাকে মেঝোমা ডাকছে৷”
থমকালো শাহওয়াজ, কন্ঠ কর্নপাত হতে এক মূহুর্ত সময় ব্যয় না করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তৎক্ষনাৎ তাকালো দরজার পানে৷ আরে এ তো মেঘ না চাইতেই জল, পাখি নিজ থেকে খাঁচায় এসেছে৷
রুম্মন চৌধুরী খেলা মাঝপথে রেখেই প্রস্থান করলো আসছি বলে৷ ময়ূরাক্ষীও সাথে সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে যেন সে৷ কিন্তু এ অভদ্র লোক তা আর হতে দিলো না বাঁধ সেধে বললো,
“দাঁড়ান মেয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”
ময়ূরাক্ষী থামলো এলোমেলো তার দৃষ্টি নত তার শির৷ বললো নমনীয় কন্ঠে,
“ক কি?”
শাহওয়াজ হাসলো৷ একপা দু-পা করে এগোচ্ছে ময়ূরাক্ষী লক্ষ করলো৷ বেশ কষ্টে এত দিন নিজেকে সংযত করেছে বিক্ষিপ্ত মন কে৷ এখন চায় না ফের ছন্নছাড়া হতে৷ এবার চোখে মুখে কঠিনত্ব আনলো অষ্টাদশী মেয়েটি গম্ভীর হয়ে বললো,
“ডাকলেন কেন? কি চাই?”
শাহওয়াজ বিস্তর হাসলো ফট করে বললো,
“তোমাকে, তোমাকে চাই৷”
চলবে,
নোট: ১৪৮০