ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা তেইশ

0
311

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

তেইশ

দ্বিপ্রহের শেষভাগ তখন৷ অপরাহ্ন শুরু হতে কিয়ৎক্ষণ বাকি৷ অম্বর টা বেজায় শান্ত এখন কয়েক প্রহর আগেও যে তান্ডব নিত্য করছে বলবে কে? বিভাবসু নিজের জায়গা দখল করেছে দ্বিপ্রহরের পূর্বেই৷ ক্রুদ্ধ, রুষ্ট প্রকৃতি অতীব শান্ত৷ রুপার জ্ঞান ফিরলো সবেই৷ আলো ঝলমলে দ্বিপ্রহরের শেষ অধ্যায় দিয়ে তার দিন শুরু হলো! আঠারো ঘন্টা জীবন থেকে চলে গেলো নিমেষে৷ সময় নিজেকে নিয়ে বেজায় ব্যাতি-ব্যাস্ত কে আছে, কে নেই, কে কি করছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর তার সময় কই? সে আপন গতীতে এগোচ্ছে তার মত করে৷

দ্বিপ্রহের শেষ ভাগ হলেও বিভাবসু বেশ আটশাট হয়ে জায়গায় বসেছে৷ সূর্যটা চিকচিক করছে স্বর্নের নেয় উত্তাপ হীন হলেও রশ্মি সোনার ন্যায় চিকচিক করছে৷ আলোক রশ্মী সাদা পর্দা ভেদ করে আঁখিদ্বয়ে বারি খাচ্ছে রুপার৷ চোখ মুখ কুঁচকে আসছে বারংবার৷ কড়া ওষুধের ডোজে চোখ খুলতে দায় হয়ে পরছে যেন৷ শরীর জুড়ে যন্ত্রণা!
সময় সীমা নিয়ে রুপার কোনো আপাতত ধারণা নেই৷ সে এ ও জানেনা কতটা সময় সে চোখ বন্ধ করেই পার করেছে৷ কতটা সময় চোখ বন্ধ অবস্থায় জীবন থেকে চলে গেছে৷ সে এ ও জানেনা কি ঘটেছে এ পর্যন্ত৷ সে এ ও জানেনা তার জন্য কে কতটা কষ্ট পেয়েছে৷
আঁধার কেটে ধরণীতে এখন বিভাবসু রাজত্ব চালাচ্ছে৷ যেন বৃষ্টি আসেইনি৷ চারোদিক চকচকে ঝকঝকে৷ রোদ থাকলেও বিভাবসু আজ একটু কোমল যেন শীতল হয়ে আছে চারোপাশ৷
অন্তরিক্ষের মত রুপার জীবনেও যেন আঁধার কে’টেছে সে দিকে কি ধ্যান আছে রুপার?
সৃষ্টি কর্তা যেন এ মায়ার ধরণীতে বাঁচার নতুন করে সুযোগ দিয়েছে তাকে৷
এ ধরনীর মায়া কতই যে তীব্র এখন যেন রুপা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷ নিজের জীবনের প্রতি কতই মায়া তা যেন প্রগাঢ় ভাবে বোধগম্য হয়েছে৷
জীবন হলো ইন্দ্রজ্বালের মত৷ মানুষ কষ্ট হলে অনায়েসে বলে ফেলতে পারে মৃ’ত্যু কেন আসে না? কিন্তু সে মৃ’ত্যুই যখন ধেঁয়ে আসে আমাদের দিকে তার থেকে বাঁচার জন্য সৃষ্টি কর্তার কাছে কতই না আকুতি মিনতি করি৷

কষ্ট হোক বা আনন্দ সব স্বাদ গ্রহণ করতে চায় রুপা তবুও বাঁচতে চায়৷ জীবনের ভালো মন্দের সাথে জীবন উপভোগ করতে চায়৷ এ পৃথিবীতে আপন জনদের সাথে বাঁচতে চায়৷

আইসিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে আরো এক ঘন্টা পূর্বে৷ তখন থেকে নার্ভ ঠিক মত কাজ করলেও জ্ঞান ফিরলো এখন৷
তিন তলার উপর থেকে পরলেও মেয়ের ভাগ্য আছে বলা যায়৷ মৃ’ত্যু কোল থেকে ফিরে এলো যেন একটু তো যন্ত্রণা হবেই৷
তবে মেয়েটার মনের জোর আছে বলতে হবে এ অবস্থায় সব থেকে বেশি প্রয়োজন হলো মনের জোর৷ রোগী মানসিক ভাবে দূর্বল হলে সব কিছুই কষ্ট সাধ্য হয়৷ নার্ভ দূর্বল হলে দৈহিক মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় কাজের সমন্বয় ঘটাতে অক্ষম হয়৷
মনের জোর না থাকলে নার্ভ ও এত সহজে স্বাভাবিক হয় না৷
এ কেসের রোগীরা সেনসিটিভ হয় তাদের জ্ঞান ফেরা নিয়েও আশংকা থাকে ব্যাপক৷ অনেক সময় আটচল্লিশ ঘন্ঠা কে’টে যায় জ্ঞান ফেরে না! এ দিক দিয়ে রুপার চব্বিশ ঘন্টাও হতে বেশ দেরি৷ এর আগেই সৃষ্টিকর্তার রহমতে জ্ঞান ফিরেছে তার৷
সব রোগ বা এ’ক্সি’ডেন্ট এর ক্ষেত্রেই রোগীর মানসিক অবস্থার উপর তার সুস্থতা নির্ভর করে ৪০% ৷
মানুষ যদি নিজ থেকেই হাল ছেড়ে দেয় তখন দেখা যায় ডাক্তার চাইলেও কিছু করতে পারে না৷

নিচে নরম ভেজা মাটি থাকায় শরীরে ক্ষতীটা তুলনামূলক কম৷ তবে ডান হাত ভে’ঙেছে পায়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো না৷ সব থেকে বড় ব্যাপার মাথায় যে কোনো ক্ষতি হয়নি৷ কান থেকে রক্ত আসায় ডাক্তাররা এক সময় ভেবেছিলো ব্রেইন হেমোরেজ হয়েছে কিন্তু সিটি স্ক্যান করে স্বস্তি পায় তেমন কিছুইনা৷

শাহওয়াজ পাশেই সকালে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই আশেপাশেই আছে৷ তার ভাবনা শুধু মেয়েটা জ্ঞান ফিরলেই যেন স্বস্তি পায় শাহওয়াজ৷ তখন তাড়াতাড়ি রেজওয়ান হসপিটাকে না নিয়ে এলে সত্যি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যেতো৷

প্রায় অনেকেই বাড়িতে চলে গেছে আকবর চৌধুরী আর রাবেয়া আছেন৷ ময়ূরাক্ষীকেও নিয়ে এসেছে শাহওয়াজ৷ মেয়েটা আসার জন্য কত্ত ছটফট করছিলো অথচ একটা মানুষ খবর ও নেয়নি৷
মেয়েটাকে একাই রেখে এসেছে ওই বাড়িতে যেখানে একটা পশু ঘোরাঘুরি করছে৷

রুপা সেই কখন থেকে পিটপিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করছে ডাক্তার বার বার দেখে যাচ্ছেন তার সাথে শাহওয়াজ তো আছেই৷ বাইরেই দাঁড়িয়ে রাবেয়া আকবর চৌধুরী আর ময়ূরাক্ষী৷
ময়ূরাক্ষী বেশ জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে৷ তার কেমন ভয় ভয় করছে আকবর চৌধুরীর সামনে৷

“খাইছিস কিছু ময়ূর?”
রাবেয়ার কথায় মাথা তুলে তাকায় ময়ূরাক্ষী৷ চোখ তার চিকচিক করছে৷ রাবেয়ার ভাবমূর্তি দেখে বোঝা দায় সে রেগে কি না৷ তবে প্রশ্ন শুনে অবাক হলো ময়ূরাক্ষী৷ মেয়ের এই দশা তবুও তার খেয়াল রাখছে৷
ময়ূরাক্ষী উত্তর দিলোনা কিছু রাবেয়া আবার বললো,
“তুই কাল থেকে না খেয়ে আছিস৷ মুখ চোখের অবস্থা দেখেছিস? এবার রুপা দেখে বকলে আমি কিন্তু বাঁচাবোনা বলে দিলাম৷”
ময়ূরাক্ষী এবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলো৷ সবাই এত ভালো কেন? এত বুঝে কেন তাকে৷
এর মাঝেই একটা নার্স এলো কেবিন থেকে কোথাও একটা যাওয়ার জন্য পা বারাবে আকবর চৌধুরী তটস্থ কন্থে শুধালো,
“জ্ঞান ফিরেছে আমার মেয়ের?”
নার্স টি ‘হ্যা’ বলে সামনে ছুট লাগালো৷ সাথে সাথেই আকবর চৌধুরী ঢুকলো কেবিনে রাবেয়াও ঢুকবে ঠিক তখনি ময়ূরাক্ষী নিচু স্বরে বলে,
“আমি আসি বড়মা?”
ময়ূরাক্ষীর জড়তায় জর্জরিত কন্ঠ৷ বলতেও দ্বিধা করছে, রাবেয়া বুঝলো বিয়ের ব্যাপার টা নিয়ে ভয় পাচ্ছে ময়ূরাক্ষী৷
রাবেয়া কিছু বললো না তবে ময়ূরাক্ষী সমেতই কেবিনে ঢুকলো৷ শাহওয়াজ তাদের বলেছিলো জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই যেন না ফিরে৷ শাহওয়াজ নিজে ডাকবে কিন্তু চলেই এলো৷ কিছু বলতে চেয়েও বললো না কিছু শুধু বললো,
“এক কোণে দাঁড়ান আমরা চেকাপ করার অর না হয় সামনে আসবেন?”
আকবর চৌধুরী বুঝলো৷ স্ত্রী কে নিয়ে এক কোণে দাঁড়ালো৷ মেয়েটা জ্ঞান ফিরেছে এই যেন শান্তি!
শাহওয়াজ এর দিকে তাকালো সে, তার কেন যেন গর্বে বুকটা ভরে যায়৷ এ ছেলেটা তার এবং তার পূত্র ডাক্তার৷ সে চাইলেই যে কাউকে গর্ব করে বলতে পারবে “আমার ছেলে বিলেত ফেরত ডাক্তার৷”
মধুলতা তার ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করেছে৷ দেখিয়ে দিয়েছে সে একা হয়ে যাওয়ার পরেও ভে’ঙে পরেনি খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেকে বড় করেছে৷
তার কাছে যদি মধুলতা থাকতো ছেলে হয়তো তাকে দেখে দেখে রাজনীতিতেই আসতো?
সে এ লক্ষ করেছে তার শাহওয়াজ এর রাজনীতির প্রতি অন্যরকম একটা টান আছে৷

..

গোধুলী লগ্নের সমাপ্তি, শুক্লপক্ষ চলছে ঝলমলে গোধুলী রাত্রিকে আগমন জানাতে ব্যাস্ত৷ নিরবচ্ছিন্ন চারোপাশ৷ দুটি মানব মানবীও মৌন আজ৷
শাহওয়াজ এর গাড়িতে জড়সড় হয়ে থাকা মানবীটি এই শুক্লপক্ষের মতরই ঝলমলে৷
চাঁদ মুখী আদল তার৷ ডাগর ডাগর আঁখি৷ সে আঁখিতে আকাশ সমান উচ্ছাসতা৷
ময়ূরাক্ষীর বাইরের জগতের সাথে খুব একটা পরিচিত না, চৌধুরী বাড়ির অন্দর আর কলেজ ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ৷ কলেজ টা ও পাশেই গাড়িতে করে যায় গাড়িতেই আসে রেহানের সাথে৷ কলেজে ভর্তি হয়েছে ছয় মাস হলো তিন মাস ভালো করে গিয়েছে কিনা তাও সন্দেহ আছে৷ পরিক্ষার সময় পরিক্ষা দেয় ক্লাস খুব একটা করা হয় না৷

“আপনি কি আপনার মায়ের মত হয়েছেন ময়ূর??”
হুট করেই শাহওয়াজ এর এমন প্রশ্নে উচ্ছাসিত আঁখিতে ক্লেশ নামলো৷ মুখটা নিমেষে এইটুকুনি হয়ে গেলো ময়ূরাক্ষীর৷ আকাশ সমান মন খারাপ ও বিনা নিমন্ত্রণে ভীর জমালো মন কুঠিরে৷ মিনমিনিয়ে উত্তর দিলো,
“আমিতো দেখিনি আমার মা কে৷”
শাহওয়াজ থমকালো, সে কি মেয়েটার মন খারাপ করে দিলো? মেয়েটা কষ্ট পেলো বুঝি? কন্ঠেতো বিষন্নতা বিরাজ করছে৷ খেয়াল করলো মেয়েটা বেখেয়ালি হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে৷
কিছু বললোনা শাহওয়াজ চার চাকার গাড়ি খানার স্প্রিড বাড়লো৷ রাস্তার পাশ ঘেষেই হুট করে ব্রেক কষলো তাতে ময়ূরাক্ষীর হুস ফিরলো ভাবলো বাড়ি এসে গেছে বোধহয় কিন্তু চারোপাশ টা দেখে অচেনা লাগলো৷ শাহওয়াজ নেমে গেলো এপাশে এসে ময়ূরাক্ষীর দিকের ডোর টা খুলে বের হওয়ার জন্য ইশারা করলো৷ ময়ূরাক্ষী আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে শুধালো,
“কোথায় এসেছি আমরা?”
শাহওয়াজ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
“সামনেই একটা নদী আছে আপনাকে মেরে ভাবছি এখানে ভাসিয়ে দিবো৷ ভালো হবে না ব্যাপার টা?”
ময়ূরাক্ষী চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো৷ অতঃপর নিজ থেকে শাহওয়াজ এর হাতে হাত রেখে খিল খিলিয়ে হেসে উঠলো৷
শাহওয়াজ থমকালো, কয়েক সেকেন্ড এর জন্য হার্ট বিট বন্ধ হয়ে গেলো৷ শাহওয়াজ চোখ জুড়ালো, প্রাণ জুরালো ধপ করে বসে পরলো ময়ূরাক্ষীর পায়ের কাছেই এক হাটু নিচু করে৷ ময়ূরাক্ষী এখনো গাড়িতেই শাহওয়াজ এর এহেন কান্ড দেখে নিমেষে ময়ূরাক্ষীর হাসি বন্ধ হয়ে গেছে৷ শাহওয়াজ নিষ্পলকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“হাসুন ময়ূরাক্ষী৷”
থতমত খেলো ময়ূরাক্ষী৷ লজ্জা পেলো কেমন৷ শাহওয়াজ ফের বললো,
” ষড়যন্ত্র এঁটেছেন না? হৃদয় তো দখল করেছেন এবার প্রাণ ও হরণ করবেন তাই না? বুকে ব্যাথা করছে কেন বলুন তো? ডাক্তার থেকে রোগী বানালেন কেন আমায়? ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here