ময়ূরাক্ষী #তাফসিয়া_মেঘলা ঊনত্রিশ

0
318

#ময়ূরাক্ষী
#তাফসিয়া_মেঘলা

ঊনত্রিশ

বাইরে গুরুম গুরুম শব্দ হচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর, গোধুলির আকাশে মেঘ জমেছে৷ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে কিয়ৎক্ষণ পর পরই ধুসর আকাশ দিনের আলোর ন্যায় আলোকিত হয়ে আঁধার আবার আচ্ছন্ন হচ্ছে৷
দীর্ঘ পনেরো দিন পর মেঘের আগমন৷ তীব্র গরমে পুরছিলো এতদিন শহর৷ সূর্যের রুষ্টতা আজ বিকেল অব্দিও তীব্র ছিলো৷
সূর্যের এত ক্রুদ্ধ আচরণ কখনোই দেখেনি কেউ৷ গুনে গুনে পনেরো দিন পর মেঘের দেখা পেলো সবাই৷ মেঘ যেন পণ করেছিলো দেখা দিবেই না৷
উত্তপ্ত রোদে পুরছিলো শহর৷ অতঃপর স্বস্তির দেখা মিললো৷ মেঘের দেখা পেয়েই মানুষ ইদের ন্যায় খুশি৷ তবে বৃষ্টি আসবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না৷
ঝড়ের তান্ডব চললেও বষ্টির দেখা মিলছে না এখন ও৷ তবুও ধরণী শীতল হয়েছে বিভাবসুর দাপট কমেছে৷ বিভাবসুর দাম্ভীকতায় উত্যক্ত মানুষ স্বস্তি পেলো বেশ৷

নিচ তলায় স্টোর রুমের পাশেই “পাঠাগার ” নামক কক্ষটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুপা আর শাহওয়াজ৷ রুপার হাতে বড়সড় একটা ঝাড়ু, যা শাহওয়াজ আনিয়েছে৷ একজনের চোখে ভীতি আর এক জনের চোখে কৌতুহলতা বিদ্যমান৷
এ দিকটার বাল্বটি কেমন নিভু নিভু তাই বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে আলোকিত হচ্ছে আবার আঁধার ছেয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পরই৷
স্টিলের উপর খোদাই করে “পাঠাগার”লেখা জায়গার “পা” টা কেমন কালসিটে হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছে কেমন মরিচা পরে গেছে যার জন্য “ঠাগার” এইটুকু স্পষ্ট শুধু৷ এ দরজাটা বহুকাল বন্ধ আছে৷ চাবিটাও রাবেয়ার কাছ থেকে রুপা কে দিয়ে আনিয়েছে শাহওয়াজ৷

ভাইজান বেশ জেদি কোনো কথাই শুনেনা৷
আকবর চৌধুরী বেশ যত্ন করে তার মধুলতার জন্য এ পাঠাগারটি সাজিয়েছিলো৷ এ পাঠাগার এর কথা শাহওয়াজ শুনেছে মায়ের কাছে৷ মায়ের মত বই ভিষণ প্রিয় শাহওয়াজ এর তাই ভাবলো এসে দেখবে একবার৷
রুপার ভয়ের কারণ তার বাবা তো এখানে কাউকে আসতে নিষেধ করেছে এখন যদি যানে বকবে না? যদিও তার আব্বা তার ভাইজানের কথা শুনলে কিছু বলবে না৷ তবুও আব্বার অনুমতি ছাড়া কিছু করতে ভালো লাগে না রুপার৷

রুপা এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনমিনিয়ে শুধালো,
“ভাইজান চলো আমরা চলে যাই এখন৷ আব্বা কে বলে কাজের লোক দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে না হয় আসবো পরে?”
শাহওয়াজ চাবির ছড়াটা উল্টে পালটে চাবি খুঁজতে খুঁজতে উত্তর দিলো,
“ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার আব্বা আমায় কিছু বলবে না, চুপচাপ দাঁড়াও৷ অন্য জনকে দিয়ে পরিষ্কার করবো কেন? জানো না নিজের কাজ নিজে করা ভালো? আর তোমার ইচ্ছে না করলে যেতে পারো৷”

ভাইজানের গম্ভীর কন্ঠে নড়েচড়ে দাঁড়ালো রুপা৷ ভাইজান এখনো আব্বা কে বাবা বলে না৷ রুপার এটা ভালো লাগে না৷ ভাইজানের এত্ত অভিমান কেন? সে জানে বাবা ভালো করেনি তাই বলে এত রেগে থাকবে?
পরক্ষণেই মায়ের কথা মনে পরলো, একদিন মা কে বলেছিলো শাহওয়াজ ভাইজান তার আব্বার উপর এত রেগে কেন? সে যতই খারাপ করুক আব্বা তো তার সাথে কি এমন ব্যাবহার সাজে? সে দিন তার মা তাকে বলেছিলো,
“শাহওয়াজ এর দিক টা, তোমার বড় মায়ের দিকটা নিজের দিকে নিয়ে দেখো তখন বুঝবে কেমন অনুভব হয়৷”
রুপা সে দিন সত্যি মধুলতার জায়গাটা নিজের মায়ের দিকে নিয়ে দেখেছে বাবার প্রতি প্রথম সে দিন খারাপ লাগা জন্মেছিলো৷ দাদিজান এর প্রতি ঘৃণা জন্মেছিলো৷ একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ে এর সর্বনাশ কি করে করতে পারে মানুষ?
আচ্ছা পৃথিবীতে সন্তানই কি সব? হুট করেই ভয় আষ্টেপৃষ্টে ধরে তার যদি তার সাথেও এমন হয়? না না এমন না হোক৷

তালা খুলে প্রবেশ করলো ঘরে শাহওয়াজ রুপা৷ ঢুকতেই বরাবর একটা বড় তৈলচিত্রের দেখা মিললো৷ বিয়ের সাজে শাহওয়াজ এর মা৷ মা বলেছিলো পাঠাগারটিতে তার একটা বড় ছবি আছে৷ ছবির সামনে গেলো আগে রুপা৷ নিচে ইংরেজীতে লেখা শাহনাজ মধুলতা, এর নিচেই তৈলচিত্রটি যে এঁকেছে তার স্বাক্ষর৷ এ চিত্রটি বড় একজন শিল্পী কে দিয়ে আগ্রা থেকে বানিয়ে এনেছিলো আকবর চৌধুরী৷
রুপা আরেক দফা অবাক হলো৷ এটা বড় মায়ের অনেক আগের ছবি তার বয়সী রমনী একদম তারই যেন প্রতিরুপ৷ কেউ যেন তাকেই এঁকেছে৷ নিজের উর্নাটা দিয়েই যতটা নাগাল পেলো মুছলো রুপা৷ বিস্ময়কর কন্ঠে বললো,
“এত সুন্দর ছবি এখানে?”

শাহওয়াজ হাসলো৷ যেখানে মানুষ টাই নেই সেখানে মানুষ টির ছবি তো অযত্নে থাকবেই৷ এ বাড়িতে যে ছবি আছে এটাই তো অবাক কর দৃশ্য৷ শাহওয়াজ ঘুরে ঘুরে দেখছে সব৷ এর মাঝেই ফের কানে এলো রুপার কন্ঠ,
“ভাইজান ছবিটি আমি আমার ঘরে নিয়ে যাই? ছবি খানা দেখে মনে হচ্ছে কেউ আমাকেই এঁকে রেখেছে৷”
বলেই খিলখিলিয়ে হাসলো রুপা৷
শাহওয়াজ বললো,
“নিয়ে যাওয়ার আগে তোমার বাবার থেকে পার্মিশন নিয়ে নিও৷”
রুপা সে কথায় পাত্তা দিলো না৷ অন্য দিকে গিয়ে ধুলো পরিষ্কার করায় মন দিলো৷ এ ঘরটিতে প্রায় পাঁচশর অধিক বই আছে৷ ঘর টা এখনো পরিপাটি শুধু অল্প সল্প ধুলো জমেছে৷ ঘর টি দেখলে মনে হয় কেউ আসে মাঝে মাঝে৷ হয়তো আকবর চৌধুরী নিজেই?

মাঝেই একটা টেবিল সে টেবিলে বসলো শাহওয়াজ৷ উপরেই একটা চাবি! চাবিটা নিয়ে কৌতুহল বসত ড্রয়ের টা খুললো৷ কিন্তু খুলেইই যা দেখলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে৷ পরিচিত একজন মানুষের ছবি, যার ছবি মায়ের কাছেও দেখেছে৷
খানিক্ষন ঘাটতেই একটা মেডিকেল রিপোর্ট দেখতে পেলো মেডিকেল রিপোর্ট টি ঘাটাঘাটি করে আরো অপ্রস্তুত হলো শাহওয়াজ৷ কি যেন কি ভেবে ড্রয়ের টি বন্ধ করে দিলো৷ সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“চলো এখান থেকে৷ আর এখানে যে আমরা এসেছিলাম কেউ যেন না জানে৷”
বলে গটগট পায়ে রিপোর্ট টি নিয়েই বেরিয়ে গেলো৷ রুপা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ যাক বাবা কি হলো? পরক্ষণে ভাবলো ভালোই হয়েছে বাবা জানবেও না বকবেও না৷ সে ও তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে ঝাড়ু নিয়ে বের হলো তালা দিয়ে৷ কিন্তু ছবিটি নিজের সাথে নিয়ে যেতে না পারায় আফসোস হলো ব্যাপক৷

..

অতঃপর সে মাহেন্দ্রক্ষণ মেঘকে সঙ্গ দিতে বৃষ্টির আগমন৷ টানা দুই ঘন্টা যাবত বৃষ্টি হচ্ছে৷ ময়ূরাক্ষী রুপার ঘরের অলিন্দে দাঁড়িয়ে দুই ঘন্টা যাবতই৷ যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে কারো পথ চেয়ে আছে৷ ময়ূরাক্ষী জানে না সে কি করছে কেন করছে৷ অথচ সে লোকটির উপর তার রেগে থাকার কথা ছিলো৷ শাহওয়াজ নামক লোকটা সেই সন্ধ্যা বেলা তুফানের মাঝেই নিজের কালো গাড়িখানা নিয়ে কোথাও বেড়িয়েছে দেখেছে ময়ূরাক্ষী তা৷ তখন সে বাগানে আম কূড়াচ্ছিলো৷ শাহওয়াজ ওকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়েছে তখনো৷
বৃষ্টি যখন বাড়লো তখন রুপাকে ইনিয়ে বিনিয়ে জিগ্যেস করেছিলো “বুবু তোমার ভাই কোথায় গেছে?”
রুপা বেশ অবাক হয়েছিলো অতঃপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো,
“হয়তো জরুরি তলবে হসপিটালে গছে, চিন্তা করিস না তুই৷”
রুপার এহেন কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছিলো ময়ূরাক্ষী৷ ইশ কি বলছে বুবু? আসলেই কি সে চিন্তা করছে? সে নিজেও জানে৷ সেই যে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আর ঘরে যায়নি৷

ময়ূরাক্ষীর ভাবনার ব্যাঘাত ঘটলো রুপার আগমনে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ অপ্রস্তুত হয়ে বসলো এখন দোলনায় তা দেখে হাসলো রুপা৷ বললো,
“ভাইজান তোকে পছন্দ করে তাই না ময়ূর?”

রুপার প্রশ্নে থমকালো ময়ূরাক্ষী৷ নির্নিমেষে চেয়ে রইলো৷ ভাবলো ক্ষানিক্ষণ৷ আচ্ছা শাহওয়াজ কি ওকে পছন্দ করে? জানে না ময়ূরাক্ষী কিছু জানেনা৷
রুপা ফের বললো,
“ভাইজান কি আজ সত্যি তোকে….”
রুপার কথা শেষ হতে না দিয়েই ময়ূরাক্ষী মাঝ পথে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বললো,
“না বুবু ওইরকম কথা ভেবোও না৷ সে তেমন না৷ সে আমায় অনেক সম্মান করে৷ কি বলছো ছি ছি৷”
রুপা জানতো তার ভাইজান কিছু করেনি৷ তবুও শুধালো কি মনে করে যেন৷ রুপা নমনিয় কন্ঠে বললো,
“আর ভালো ও বাসে৷”
বলে আকাশ পানে তাকালো৷ তার খুব আনন্দ হচ্ছে, কেন জানে না কিন্তু হচ্ছে৷
এদিকে দগ্ধ হচ্ছে ময়ূরাক্ষী বুকের ভেতর হাসফাস শুরু হলো৷ রুপাবু কি বললো সে কি জানে?সে বোঝে না ওই দৃষ্টি সে বোঝে না ওই লোকের কঠিন কঠিন কথার মানে৷ তবে রুপার দ্বিধা হীন এ কথায় অষ্টাদশী মন অবাদ্ধ করে তুললো৷ তটস্থ হলো! অদ্ভুত অনুভূতি ডানা ঝাপটালো৷ এমন যন্ত্রণার সাথে নতুন পরিচিত সে৷

ভাবনার মাঝেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ৷ রুপা শব্দ তুলে বললো,
“কে? দরজা খোলাই আছে ভেতরে এসো৷”
তারপরই ঢুকলো রেহান৷ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে, রেহান এসেছে তুফানের সময়৷
ঘরে ঢুকেই বললো,
“ময়ূর আমায় এক কাপ আদা চা করে দে তো৷ ”
ময়ূরাক্ষী বারান্দা থেকে এসে সায় দিলো৷ নিচে নেমে আসতেই শাহওয়াজ এর দেখা পেলো৷ ভেজা জুবুথুবু অবস্থায় ঢুকলো বাড়িতে৷ এলোমেলো চুল তার৷ বেশি সময় বৃষ্টিতে ভেজায় মুখটা লাল হয়ে গেছে৷ শাহওয়াজ কে দেখে এগিয়ে গেলো সে দিক৷ রুপাও গেলো রুপাকে দেখে শাহওয়াজ বললো,
“বেশ মাথা ধরেছে আমায় এক কাপ কফি দিয়ে আসতে পারবে উপরে?”
রুপা কিছু বলার আগেই ময়ূরাক্ষী ফটাফট বললো,
“আপনি ঘরে যান আমি নিয়ে আসছি৷ ”
শাহওয়াজ প্রায় সিড়িতে উঠে গিয়েছিলো৷রেহান দাঁড়িয়ে দেখছে রাগে মুষ্ঠিবদ্ধ করলো৷ মাঝপথেই শাহওয়াজ গম্ভীর মুখে বললো,
“রুপা? আমি তোমায় বলেছি অন্য কেউ যেন না আসে৷ তাহলে ওই কফি আমি মুখেও তুলবো না৷

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here